না-দেখা কিছুতেই
কোন দেওয়ালে টাঙানো রয়েছে ছবি
কোন দেওয়ালে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিচ্ছে ধর্মচক্ষু
কোন দেওয়ালে হা-হা করে কাঠি হাতে
তাড়িয়ে বেড়াচ্ছো কাক
কোন দেওয়ালে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে
একশো বছর ধরে একটি পিঁপড়ে পিছলে পড়ছে
বারে বারে
কোন দেওয়ালে দোলদোলানো মুখোশচক্ষু ভয় দেখাচ্ছো
কোন দেওয়ালে নাপিতের সামনে ঘাড় হেঁট করে
রোয়া রোয়া ছাঁটা হচ্ছে চুল
কোন দেওয়ালে যুগলমূর্তির বিপুল হস্তীশৃঙ্গার
হাঁ করে নিচে দাঁড়িয়ে দেখছি, ছোট হয়ে যাচ্ছি
না-দেখা কিছুতেই শেষ হচ্ছে না!
তাঁতিপাড়া গ্রাম
উঠোনে ডুবোনো এই মখমলি ঘাস
দুধেল গাইয়ের বাটে দুধরাজ সাপের চুমুক
এরকম দিনে তুমি সওদাগরের সাথে
হেঁটে হেঁটে চলে গেলে বণিকপাড়ায়
ভরন্ত কলস ভাঙে, উথলিয়া ছলকায় নদী
ঘাটে ঘাটে মাছরাঙা, বউ-ঝিরা কানাকানি করে
হংসমিথুন নামে রোজ, যেরকম নামে তারা দ্রুতলয়
হ্রদের কিনার ধরে চুপচাপ কিছুক্ষণ হাঁটে
হররোজ হাট বসে
কাঁকড়ার পিঠে-বসা মাছির মতন
জেলেদের মেছুয়া বালিকা তার নীল ফ্রক
রঙিন জলের ফোঁটা খসে পড়ে ঘাসের ভেতর
মাকুর জানালা দিয়ে লাল নীল বিষম হলুদ
চেয়ে থাকে তাঁতিদের জুলজুলে চোখ।
নাগ
তুমি এলে,
একটুখানি কেঁপে উঠেছিলো নীল জল
রোদ্দুর দেখলো তোমার ত্বকের ম্যাজিক
হাওয়ার ভেতরে তুমি দু’দুবার ছুঁড়ে দিলে
রুপোলি বিদ্যুৎ
ঘ্রাণেন্দ্রিয় খুলে একবার গন্ধ নিলে জলে
তোমার পাশাপাশি এসেছিলো ছায়া
পাথরের ওপর, চিহ্ন ছিল না
দর্জিঘরে আলো
ছিটকে পড়েছি এই রাতে, দর্জিঘর ছুঁয়ে
দর্জিবুড়োর দুলে-পড়া কালো চশমা ছুঁয়ে
মোটা কাচ, ঝুঁকে-পড়া হাত ও কব্জি
রোম, সুচ ও সেলাই
স্তূপীকৃত কাটা কাপড়, টুকরোতে
লাল-নীল-হলুদ হয়ে, মলিন, রাবারকাটা
স্যাণ্ডেলে বসে জিরিয়ে নিয়েছি
যমুনার ধারে ধারে বোল্ডারের ঘনক
শেয়ালকাঁটা হরিৎপুষ্প ঘুম পাড়িয়ে
ঝুলে থাকা চাঁদে পিঠেরঙ লাগিয়ে লাগিয়ে
দর্জিঘরের চতুরঙ্গে আলো হয়ে আছি
ছিটকে পড়েছি ছাদ থেকে ঝুল
হয়ে, মৃত্যু হয়ে একটুকরো উড়ে উড়ে
দর্জিবুড়োর টেবিলে পড়েছি।
মৌমাছি
উড়ে আসে উত্তুরে হাওয়া
কনকন
দাঁড়িয়ে আছি, মৌমাছি।
দুপুরচণ্ডী
মাঠে মাঠে আমি দৌড়ে বেড়িয়েছি
তোমার হাত ধরে।
তখন কি জানতাম কী এই খেলার মানে!
দ্রিম দ্রিম ঘন্টার ভেতর মুখ লুকোলাম,
জলছেউড়ি খেললাম রান্নাঘরের আড়ালে।
একডুবে মধ্যদুপুরে সাপঘুম ভাঙিয়েছি
শ্যাওলাজড়ানো কালাপুকুরে,
শাদাপর্দার মতো মেঘ উড়ছে আকাশে,
দিনদুপুরে জ্বলজ্বল করছে তারা।
ঈশ্বরের জন্য বাছাই-করা অন্ধকারে
হলুদঝাড় কলাবতী, জলবিছুটি, গন্ধভাদাল।
সন্ধ্যামুকুট জ্বেলে ফুটলো দুপুরচণ্ডী।
বহুদিন পরে এই দুপুরচণ্ডী গায়ে
পার হয়ে যাচ্ছে কেউ জনবিরল অরণ্য…
তাই দেখে কেঁদে উঠেছি আমি,
তখনো কি জানতাম কী এসবের মানে!
সংক্রান্তি
তারপর তারা আমার মৃতদেহের দিকে তাকিয়েছে
আর একজন জানতে চেয়েছে, ‘এই লোকটি কে?’
কফিনের ওপর ঢাকা শাদা চাদর সরিয়ে তারা
অপরিচিতের উষ্মায় আবার নিজেদের কথায় ফিরে গেছে।
তারা কেউই যেন কাউকে তখন চিনতে পারছিল না।
আপেলসমুদ্রে আপেল
কমলাসমুদ্রে কমলা…
তখনো বয়ে যাচ্ছে নিরবধি
নদীর অনেক নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে রক্তের বিদ্যুৎ।
তারপর তারা পুনরায় আমার কফিনের চাদর সরিয়ে বলেছে,
‘এই লোকটি কে?’
অশ্বমেধযজ্ঞ বসেছে মেঘলা আকাশের নিচে।
ঘূর্ণির মতো গ্রীবা দুলিয়ে রাজহংসী চলেছে
নিজস্ব সরোবরের দিকে।
পুনরুত্থিত শহর
সবক’টি শহরের নিজস্ব গন্ধ রয়েছে। রূপকথার
মতো শোনালেও সেটা খুব সত্যি। পাতা-পচা, প্রেম
আর প্রাচীনত্ব মিলে সে গন্ধসৌরভ তৈরি হয়।
কুকুরের মতো গন্ধ শুঁকে শুঁকে কেউ কেউ সে
শহরে ফিরে আসে। মাছ যেমন গন্ধতরঙ্গে ঘুমিয়ে
আর জেগে ফিরে আসে পরিচিত মাতৃনদীতে।
আমি এখন এমন একটি শহরের গল্প বলবো
যে মধ্যরাত্রিতে অবিকল দৈত্যের মতো চাপা দীর্ঘশ্বাস
ফেলতো। জ্যোৎস্নালোকিত চেরিবনের পাশ দিয়ে
যাওয়া শেষরাতের কিশোরীদের সে চুম্বন করতো।
দানবের মতো সে রোমান্টিক ছিল।
আমরা পুনরুত্থানের গল্প শুনবার জন্য কয়েকজন
এই শহরে এলাম। এই শহরের মার্বেল পাথরের
অপূর্ব মসৃণ সমাধিগুলো আমাদের খুব প্রিয়
বসবার জায়গা ছিল।
…….