পর্ব-১।। পর্ব-২।। পর্ব-৩।। পর্ব-৪।। পর্ব-৫।। পর্ব-৬
পাপড়ি রহমান
ফচাদিদির মিহির ও খনা!
দাদাজানের আপন চাচাতো বোন ফচা। আমরা ডাকি ফচাদিদি। ফচাদিদির গায়ের রঙ মেমসাহেবদের মতন টুকটুকে লাল। তিনি নিঃসন্তান বিধবা। নিজের অঢেল সহায়-সম্পত্তি বিক্রি করে চলে এসেছেন আমাদের বাড়িতে। মানে উনার বাবার বাড়িতে। ফচাদিদির একবোনের বিয়ে হয়েছিল চাচাতো ভাইয়ের সাথে। সেই বোনের ছেলের হাতে টাকাকড়ি সব তুলে দিয়ে নির্ভার হয়েছেন।
দুর্দান্ত প্রতিভাধর ও কর্মঠ নারী এই ফচাদিদি। তার বয়সী আর অন্য কোনো নারীকে আমি এত প্রতিভাধর ও কর্মী হতে দেখিনি! ফচাদিদি কানে কিছুটা খাটো। ফলে তার সাথে কথা বলতে হয় তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে। খুব ধীরে-সুস্থে। আসলে উনি ঠোঁট নাড়ানো দেখে বুঝে নেন কে কী বলছে। ফচাদিদি বয়সে আমার দাদাজানের চাইতেও বড়। কিছুটা খর্বাকৃতি দেহ । সায়াহীন ছোটপাড় সাদা ধূতি পরেন। আমার দিদির মতোই এক প্যাঁচ দিয়ে। আর পায়ে পরেন পাম্পসু। পাম্পসু পায়ে চষে বেড়ান জলা-জংলা, খাল-পুকুর, ক্ষেত-খামার, জাংলা-মাচাসহ বাড়ির সর্বত্র।
বোশেখ বা জৈষ্ঠ্যে জোরে হাওয়া বইলে একটা পাকনা কি আধা পাকনা আম নিচে পড়লে আর কারো কুড়ানোর উপায় নাই। সেই আম দেখা যাবে ফচাদিদির হাতে! কানে ভালো শুনতে পাননা কিন্তু আম বা বেল পড়ার শব্দ পান কীভাবে? আমাদের কাছে ফচাদিদি জলজ্যান্ত বিস্ময়। মানুষের চাঁদে যাওয়ার ঘটনার মতোই আশ্চর্যজনক। এইভাবে গাছের আম, জাম, বেল, আতা, নোনা, বরই সবই ফচাদিদির হাতে। আমাদের বাড়ির সব চাইতে প্রাচীন মানুষ ফচাদিদি।
ফচাদিদির স্বামী নাই। কোনো সন্তানাদি নাই। কিন্তু ফচাদিদির কোনো বিশ্রামও নাই। ফযরের আযানের সংগে সংগে তিনি বিছানা ছাড়েন। অজু করে নামাজ সেরে কোরান পড়েন। তেলওয়াত শেষ করেই বেরিয়ে পড়েন ঘর থেকে। তখন হয়তো সবে পূব আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে।
এই সামান্য সামান্য আলোতেই ফচাদিদি আমতলা, জামতলা, বকুলতলা, বেলতলা, কড়ইতলা, বরইতলা, কলাতলা, সব ঘুরে ঘুরে দেখেন। রোদ্দুর সামান্য চড়তা হলে বাসীভাতের সাথে কুড়া মিশিয়ে হাঁস-মুরগীর আধার বানান। এবং খোঁয়াড়ের দরজা খুলে দেন। তারপর শলার ঝাঁটা হাতে নিয়ে শুরু করেন সাফসুতরো করা। গাছের সব ঝরা পাতা জড়ো করে বিশাল বিশাল ঠেকি করে রাখেন। এই পাতা শুকালে ভালো জ্বালানীর কাজ দেবে। কুয়াতলায় গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে এককাপ চা নিজেই বানান এবং মুড়ি সহযোগে খেয়ে শুরু করেন দিনের অভিষেক।
ফচাদিদি সামান্য ক্ষণের জন্যও বসে থাকেননা বা একদণ্ড বিশ্রাম নেননা। তিনি পাটের আঁশ দিয়ে নিজেই দড়ি বোনেন। ওই দড়ি ও সুঁইসুতা দিয়ে বানান ফুলদানী। বানান বাঁশ দিয়ে চমৎকার টাপা (হাঁসমুরগী ঢেকে রাখার ঝাঁকা)। বানান মাছ ধরার পলো। তালপাতা কেটে এনে বানান হাতপাথা। সেই হাতপাখা মুড়ে দেন কাপড়ের ঝালর দিয়ে। ফচাদিদি অবিশ্রাম কাজ করেন। কাজ করেন আর কাজ করেন। রাতে কুপির আলোয় মাছ ধরার জাল বোনেন।
আমের মরশুম এলে তার ব্যস্ততা আরো বাড়ে। কড়া আম থেকে শুরু করে পাকা আম সবই সংগ্রহ করেন। তারপর বানান মোরব্বা, আচার, আমচুর, আমসত্ত্ব। বানান ঠিকই কিন্তু আমাদের কাউকে খেতে দেননা। অতিথ-মেহমান এলে তাদের ভাগ্যে কিঞ্চিত জোটে। বরইয়ের মরশুম এলে গাছের তলা থেকে নড়েনই না তিনি। ফলে তার বৈয়াম কে বৈয়াম ভরে থাকে আচারে। বরইয়ের ফলিতে। শুকনা বরই ডুবে থাকে গুঁড়ের রসে।
শীতের প্রারম্ভে যখন মাছ মারার ধুম পড়ে তখনো ফচাদিদি নিরলস। এক খালুই মাছ পলকেই কেটেকুটে ধুয়ে উঠতে পারেন। তারপর তারে গেঁথে শুঁটকি দেয়াও চলে। ফচাদিদির আছে একাধিক ছাগল। অর্থাৎ ছাগল লালন-পালনেও তিনি পটু। তার ছাগল আবার বিশেষ ট্রেনিং প্রাপ্ত। ফচাদিদির ছাগলেরা যেখানে–সেখানে মলমূত্র ত্যাগ করে না। রাতে ঘুমুবার আগে ছাগলের গলার রশি ধরে তিনি বাইরে নিয়ে যান এবং জোরে শিষ বাজান। শিষ শুনে ছাগলেরা হিসু করে ঘরে ঘরে শুতে আসে!
ফচাদিদির এমত নানাকাণ্ডে আমরা চমকিত হই, চমকিত হই তার ধর্মীয় জ্ঞানের বহর দেখে। ধর্মীয় গ্রন্থসহ তার আছে এক ট্রাংক বই। সেসব বইয়ে তিনি কাউকে হাত দিতে দেননা। কিন্তু নিত্য বিকেলেই পাঠের আসর বসান। কানে কম শোনেন বলেই তার চোখের দ্যুতি তীক্ষ্ণ। চশমা ছাড়াই পড়ে যান নানান আখ্যান। লাইলী-মজনু ও শিরী-ফরহাদের নাম আমি দুই-একবার শুনেছি। ফচাদিদির পাঠের আসরে পোলাপানের যাওয়া নিষেধ। এ আসরের বেশিরভাগ শ্রোতা বয়স্ক ও কোমলমতি। ফচাদিদির এই বৈকালিক পাঠচক্রে আছেন আমার দিদি, আমার ছোটদিদি-ফেরদৌসের মা (দাদার ছোটভাইয়ের দ্বিতীয় স্ত্রী, প্রথম স্ত্রীর ইন্তিকালের পর এনাকে বিবাহ করেছেন, ইনি নিঃসন্তান), লালের মা (আমার দাদাজানের বড় ভাইয়ের স্ত্রী), বড়চাচীমা, আমার দুইফুপু, আম্মা, আকলিমা ফুপু ( আব্বার চাচাতো বোন)। অন্যান্য বাড়ি থেকেও দুই-একজন বয়স্ক মহিলা শাস্তর শুনতে এই আসরে যোগ দেন। তিনি বেশিরভাগ পড়েন নানান হাদিসের বই। আর মুখে মুখেই রাজা-বাদশাদের কাহিনী বলে যান। ফচাদিদি যেদিন এক ঢাউস বই থেকে মিহির ও খনার কাহিনী পড়তে শুরু করলেন, পোলাপানদের মাঝ থেকে কেবল আমিই অনুমতি পেলাম এই পাঠচক্রে যোগ দেওয়ার!
আমাদের বাড়ির বেশির-ভাগ বউ-ঝিরা অর্ধশিক্ষিত, কারো কারো শুধু স্বাক্ষর জ্ঞান সম্বল-কিন্তু পাঠ শুনতে কারো বিন্দুমাত্র অনিহা নাই। বরং তারা দুপুরের বিশ্রাম বাদ দিয়ে জড়ো হতেন এই পাঠচক্রে! হাতের কাজ-বাজ ও ছেলেপুলে সামলে-সুমলে তারা কীভাবে নির্দিষ্ট টাইমে আসতেন ভাবলে আমি বিস্মিত বো্ধ করি। ভাবা যায় কী তীব্র তাদের এই বিদ্যানুরাগ?
ফচাদিদির হাতে একটা ঢাউস বই। আমি বইটার নাম পড়তে পারিনা কিন্তু মলাট দেখে আনন্দিত বোধ করি। বইটার মলাট কড়ই কাঠের বার্ণিশের মতো লালচে ও মসৃণ। এবং সময়ের ধূলিতে কিছুটা ম্লান। অনুজ্জ্বল।
তবে ফচাদিদির গল্প বলার ঢংটি অতি মনোরম। তিনি প্রথম প্রথম বইয়ের কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে যান ফের সেটা কথ্য ভাষায় সকলকে বুঝিয়ে দেন। যখন এই বুঝানোর কাজটি করেন তখন দুই হাত মাথার উপর নেড়েচেড়ে, সাদাধূতির ঘোমটায় দুইকান ঢেকে যেমনটি করেন তাতে তার বয়ান মারাত্মক হৃদয়গ্রাহী হয়ে ওঠে। ফলে কারো ইচ্ছা হয়না টুঁ শব্দটি করতে বা এই আসর ভেঙে উঠে যেতে।
ফচাদিদি যে অত্যধিক পরিমাণ অভিজাত পরিবারের কন্যা ও বধূ, তা তার গায়ের টকটকে আপেল বর্ণ, কথা বলার মৃদু-সুমিষ্ট-মিহি গলার আওয়াজে প্রমাণিত হয়। মাথার উপর হাত ঘুরিয়ে ফচাদিদি উত্তেজনায় আরো খানিকটা লাল হয়ে বলে চলেন–‘বুঝলা মাইয়ানুকের এত জ্ঞান-গম্যি! খনার শ্বশুর বরাহ তো রেগে আগুন। সে বলে আমার পুত্র বউয়ের এত স্পর্ধা! আমার ভুল বের করে! রাজদরবারে এতদিন ধরে নির্ভুল গননায় কত নামডাক হৈছে আমার! আর এক পুচকে ছুকরি সে কিনা আমার গননায় ভুল ধরে! বরাহ তখন পুত্র মিহিরকে আদেশ দিলেন–খনার জিব কাটিয়া দাও-।
মিহিরের প্রাণাধিক স্ত্রী খনা, কিন্তু কি করবে সে? পিতৃ আজ্ঞার হেরফের হবেনা কোনোভাবেই। শুনে খনা কিছুই বলে না। যত পারলো লিখতে লাগলো নিজের বচন–
কলা রুয়ে না কেটো পাত
তাতেই কাপড় তাতেই ভাত!
যদি বর্ষে মাঘের শেষ
ধন্যি রাজার পুন্যি দেশ।
যদি বর্ষে আগনে
রাজা যাবে মাগনে।
গোড়ায় না নোয়ালে বাঁশ
পাকলে করে ঠাস ঠাস।
বাঁশের ধারে হলুদ দিলে
কথায় বলে দ্বিগুণ ফলে।
কাতি মাইয়া ভাওরে
না যাইও পুত হাওরে।
যদি বর্ষে ফাগুন
সোনা ফলে চৌগুন।
মেয়েমানুষের এত বাড়! বরাহ তখন খনার জিব কেটে দিলেন। সেই থেকে খনা বোবা। অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণে খনা একসময় মারা যায়। জ্ঞানের জন্য, মনীষার জন্য প্রাণ দিতে হলো খনাকে।
ফচাদিদির পাঠ শেষ হয়ে যায় কিন্তু কেউ-ই আসর ভেঙে উঠে যায়না! সবাই কেমন বিমূঢ়, ক্লান্ত। ফলে ফচাদিদি নিজেই আসর ভেঙে দেন। বলেন-
যাও, কালকে সবাই আবার আইসো। বীর হানিফার গল্প শোনাবো তোমাগো। শোনাবো তার দুলদুল ঘোড়ার গল্প।
শুনে আমার আত্মা ছ্যাৎ করে ওঠে!
হানিফার গল্প শোনার অনুমতি ফচাদিদি আমাকে দেবেন তো?