ফারহানা মান্নান
শিল্পের সৌন্দর্য নারীর সৌন্দর্যের মতন হরণ করবার মতন বিষয় কী? শিল্পকে জোর পূর্বক হাতের মুঠোয় আটকে রেখে নিজেকে শিল্পী তো ভাবা যায় না। শিল্প তাই জোর পূর্বক অর্জন করবার বিষয় নয়। আমরা শিল্পকে হাত দিয়ে ধরে দেখতে পারি, ছুঁতে পারি, অনুভব করতে পারি কিন্তু শিল্পের অধিকার কি পাওয়া যায়? ভূমির মালিক যেমন তার একখণ্ড পরিমিত জায়গাটির একচ্ছত্র আধিপত্য পেয়ে থাকেন, ঠিক তেমনটি করে কি শিল্পের আধিপত্য পাওয়া সম্ভব? আধিপত্য পেতে হলে কোন বুস্তু বা সামগ্রীতে নিজের নামের মহর লাগিয়ে দিতে হয়। কিন্তু শিল্পেরতো কোন নির্দিষ্ট পরিসর নেই! কোন গজ, ফিতা দিয়েতো শিল্পের নাগাল পাওয়া যায় না। মহাকাশের মতন অসীম শিল্পের জগতে আমরা যারা বিচরণ করতে শিখি, করতে পারি তারা নিজেদের শিল্পী বলে পরিচয় দিতে পারি ঠিক কিন্তু একথা কখনই নিশ্চিত করে বলা যায় না শিল্পের আধিপত্য শিল্পীর নাগালের মধ্যে এল অথবা শিল্পের পরিসরে সকল শিল্প প্রেমীই ‘শিল্পী’ হয়ে উঠেছেন। শিল্পের বিস্তৃত পরিসরে একজন শিল্পীর ভ্রমন তাই আজীবনের। একচ্ছত্রভাবে আধিপত্য অর্জন তাই সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই সৌন্দর্যের হরন নয়, শিল্প তার সৌন্দর্যকে তাই উপভোগ করবার স্বাধীনতাই দেয়।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলীতে বলেছেন, “জীবের মনস্তত্ত্ব যেমন জটিল যেমন অপার, সুন্দরও তেমনি বিচিত্র তেমনি অপরিমেয়”। সুন্দরকে ও অসুন্দরকে বোঝাবার, ব্যক্ত করবার চেষ্টা মানুষের আজীবনের। ছবি এঁকে, কবিতা লিখে, গান গেয়ে নানানভাবে আমাদের শিল্পবোধ প্রকাশের প্রয়াস থাকে। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই আমরা শিল্পের একটি চরম মাত্রায় পৌঁছে যেতে পারি। ছবি আঁকবার ক্ষেত্রে আমাদের আঁকা প্রত্যেকটি ছবিই প্রত্যেকবারে একটি অপরটিকে ছাড়িয়ে যায়। এর মানে হল, ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে একটি ছবি অপরটি থেকে নিজস্বতা তৈরি করে। এইভাবে এক আর্টে আর এক আর্টে, এক সুন্দরে আর এক সুন্দরে পরিচয়ের খেলা চলতেই থাকে। শিল্পী এস এম সুলতান, তাঁর eternal bangla ছবিতে গ্রাম বাংলার বিভিন্ন পেশাজীবীদের জীবনযাত্রা ফুটে উঠেছে। স্রষ্টার এই সুন্দর পৃথিবীতে তাঁর সৃষ্টিকে এত অপরূপ দৃষ্টিতে দেখে ক্যানভাসে মেলে ধরবার এই যে বিরল যোগ্যতা তিনি অর্জন করেছিলেন এটা যে কতখানি বড় ক্ষমতা আর কত সাধনার ফল তা বলাই বাহুল্য। শিল্পি এস এম সুলতান আশপাশের সুন্দর আর অসুন্দর উভয়কেই দেখেছিলেন। এই দেখবার ক্ষমতাই তাঁর শূন্য ক্যানভাস এঁকে এঁকে ভরিয়ে তুলেছিল অন্যন্য সব সাধারন জীবনযাত্রার অসাধারন সব সৃষ্টিতে।
চোখ হল শিল্পকে লক্ষ্য করবার একটি অন্যতম ইন্দ্রিয়। স্রষ্টার সৃষ্টির চারপাশকে আমরা প্রান ভরে দেখি। কিন্তু একজন শিল্পীর ক্ষেত্রে এ দেখা কেমন দেখা? হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করা, সমস্ত মেধা দিয়ে বিশ্লেষণ, হস্ত দিয়ে অংকনের যোগ্যতা তৈরি করবার পরও শিল্প চর্চার ক্ষেত্রে একটা শূন্যতা রয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে এই শূন্যতা সৃষ্টি হয় দৃষ্টি মেলে অন্তরচক্ষু দিয়ে দেখবার দক্ষতা না থাকলে। একটি শিশু যখন প্রথম অ-আ লিখতে শেখে তখন সে কেবল অক্ষরটিই দেখে আর কিছু নয়। কারন এই অক্ষর সাজিয়ে শব্দ তৈরি করবার খেলা সে তখনও রপ্ত করে উঠতে পারেনি। চোখের সম্মুখে অক্ষরগুলো তাই তাঁর তেল জলের মিশ্রণের মতই খেলা করে যায়। কিন্তু যে মুহূর্তে সে শব্দ তৈরি করতে শেখে সে মুহূর্তেই শব্দগুলো দিয়ে বাক্য গঠন করবার লীলাখেলায় তাঁর দৃষ্টি উন্মোচিত হয়ে যায়। এই দৃষ্টি সকলের ক্ষেত্রে একই ভাবে উন্মোচিত হয় না। শব্দ নিয়ে খেলবার এই নেশা যাকে যত বেশি পেয়ে বসে তাঁর শব্দের মেলবন্ধন তলিয়ে দেখবার দৃষ্টি তত বেশি উন্মোচিত হয়। সে তখন লিখে যাবার শিল্প রপ্ত করতে শেখে। ঠিক একই ভাবে আমাদের চারপাশকে আমরা যত বেশি দৃষ্টি মেলে দেখব দেখবার দৃষ্টিভঙ্গিও প্রতিবারে পালটে যাবে। অন্তরচক্ষু দিয়ে দেখবার ভঙ্গি যার যত চেকনাই হবে; ক্যানভাসে আঁকবার ক্ষেত্রে তাঁর শিল্পবোধ ঠিক ততখানি ফুটে উঠবে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনStruggle, জয়নুল আবেদিন তাঁর struggle নামক চিত্রকর্মে খুব সাধারণ একটি গ্রাম বাংলার চিত্র তুলে ধরেছেন।
গরুর গাড়িতে করে মাল বহনের একটি অনন্য শিল্পকর্ম। এই দৃশ্য গ্রামে গঞ্জে আমরা দেখি কিন্তু এটিকে আমাদের সম্মুখে এগিয়ে যাবার সংগ্রামের প্রতিক হিসেবে ভেবেছি কজন? এই যে দেখবার চোখ, ভাববার এই যে দৃষ্টিভঙ্গি, আঁকবার ক্ষেত্রে বিষয়বস্তু চয়নের এই যে সরলতা এমনটি আমরা রপ্ত করতে পারি কতজন? এই রপ্ত করবার যোগ্যতাই একজন সাধারণ মানুষকে বদলে গড়ে তোলে শিল্পী মানুষ হিসেবে।
জানি আমি জানি সখী
যদি আমাদের দোঁহে হয় চোখাচোখি
সেই পরজন্ম পথে দাঁড়াব থমকি
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘মানসসুন্দরী’, সোনার তরী।
কল্পনার শক্তিমান বাহন ‘চোখ’ আমাদের দেখতে শেখায়, বুঝতে শেখায়, শেখায় উপলব্ধি করতে। চোখ ছাড়া শিল্পী, বিশেষত চিত্রশিল্পীর, অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না । প্রকৃতির বহুবিচিত্র রং-রূপ, দিবা- রাত্রির আলো-আঁধারের খেলা, রঙ্গিন দৃশ্যমান জগত, কল্পলোকের অজানা ভুবন এর সবই চোখ দিয়ে দেখে আবিষ্কার করবার বিষয়। শিল্প গুরু শফিউদ্দিন আহমেদ তাঁর ‘কান্না’ শীর্ষক চিত্রশিল্পে চোখ ব্যবহৃত করেছেন। তাঁর এই চোখের ভাষা কখনও নীরব প্রতিবাদের বিষয়, কখন বিদ্রোহের, বিপ্লবের, ক্রোধের, আক্রোশের সোচ্চার প্রতীকরূপে; আবার কখনো বা আলোর উৎস কিংবা আনন্দ-বেদনা ও বিজয়-উল্লাসের মূর্তিমান প্রতীক হিসেবে। এই চোখের ভাষা আছে। এটি চিন্তার গভীরতাকে অনুসরণ করে। আমাদের দেখবার ক্ষেত্র তাই ভিন্ন, আঁকবার ভাব ভিন্ন। চোখ মেলে তাকিয়ে ভূত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ দেখতে না পেলে; শিল্প রচনা হবে কেমন করে আর প্রকৃত অর্থে শিল্পী হয়েই বা উঠবে কেমন করে?
শিল্প চর্চার ক্ষেত্রে মানুষের চেষ্টা নতুন বর্ণে, নতুন নতুন ছন্দে বয়ে চলে। অদ্ভুত দৈব শক্তির ভরে এক এক জন সাধারণ মানুষ শিল্পের রস আস্বাদন করে হয়ে ওঠে শিল্পী মানুষ। এই রস আস্বাদনের নানা চেষ্টা তারা করে যায়, করছে। কত রকমের টেকনিকের প্রয়োগ যে সে ব্যবহার করেছে তাঁর ইয়ত্তা নেই। কিন্তু নয়ন মেলে দেখে সৃষ্টিকর্তার রচনাকে পুরো রকম বুঝে-সুঝে উপভোগ করার ক্ষমতা অনেকখানি যে সাধনার তা বুঝতে পারেন একমাত্র পটুয়াই। তারা দেখে অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে, অরূপকে রূপ দেয়, অসুন্দরকে সুন্দর করে, ছবিকে প্রাণ, রংহীনকে রঙ আর জগত সংসারের দর্শনকে উপলব্ধি করে তাঁর ভাবনাকে ক্রমশ লালন করে চলে শূন্য ক্যানভাসে।
“প্রেমের করুন কোমলতা
ফুটিল তা
সৌন্দর্যের পুষ্পপুঞ্জে প্রশান্ত পাষাণে”।