সেই এক দেশ আছে…
সেই এক দেশ আছে, যে-দেশে নানান প্রথা, নানা কথা, রীতি
যে-দেশে বনেদি চাঁদ, প্রজাপতি আর জংলি ফুলের সম্প্রীতি
আর দুগ্ধনদীতে প্লাবন তোলা সুশীলা কপিলা, ননী আর ননীচোরা…
যে-দেশে বেকার বসে থাকে, প্রায়-প্রায়ই, ডাকহরকরা–
কেননা সে-দেশে বার্তা নেই কোনো প্রেমবার্তা ছাড়া, আর তা বয়ে নিয়ে যায়
কখনো ভ্রমরে, কখনো তা গন্ধবহতা পবনে, পায়রায়।
বস্তু ক্ষয়ে যায়, বাস্তু ধসে পড়ে, ধরে ঘুণ বটে অবশেষে
বংশে বংশে, বাঁশে, কিন্তু বাঁশি থেকে যায় নির্ঘুণ অক্ষয়, সেই দেশে।
যে-দেশে উজান বেয়ে চলে, প্রেমে, ভাটির ভাসান
স্রেফ ভালোবাসাবাসি দিয়ে যেইদেশে বহু মুশকিল-আসান।
যে-দেশে সুজন দেখে করলে প্রেম, মরলেও বাঁচাতে পারে
তারে! সত্যি-সত্যিই, এবং বারে বারে!
অরূপ রূপের সেই দেশে, রূপপুরে,
উড়ে চলো মন, ঘুরে ঘুরে
বেড়াই এ মনপবনের জাদু-উড়াননৌকায়
দূর-দূরান্তের নানা জেলায় জেলায়।
বাংলা প্রাণের দেশ, বাংলা গানের দেশ, জাদু ও প্রেমের দেশ, বাংলা এক মায়াবাস্তবতার দেশ…
অরূপ রূপের সেই দেশের ছোট্ট একটি মায়াবাস্তব শহর বগুড়া– যেখানে কেবলই মিলে-মিলে যায় রোদ ও কুয়াশা, মিলে-মিলে যেতে চায় স্বপ্ন ও বাস্তব। একাকার হতে চায় প্রাপ্তি আর বাসনা…সম্ভব-অসম্ভবের দোলাচলে টালমাটাল দাঁড়িয়ে থাকে বগুড়ার ল্যান্ডস্কেপ, এর পথঘাট, বাহন-বিপণী, আড়ত-ইমারত! এখানকার মানুষ ও কবিকুল হাঁটেন স্বপ্নসম্ভব পথে। ঘুরে বেড়ান কুয়াশানিবিড় মাঠে ও প্রান্তরে! অবাক-করা এক শহর। বেশ কিছুকাল আমিও ছিলাম সেই স্বপ্নশহরে। এক অর্থে বগুড়া আমারও শহর…আসলে প্রত্যেকেরই থাকে একটি করে শহর, মনের মতো, স্বপ্নময় শহর- যেখানে উপশহরের আধো-আলো-আঁধার-জড়ানো কোনো বিষাদমাখা বারান্দা থেকে দেখতে পাওয়া যায় শহরের নার্সিং হোমের শুশ্রুষাময় আলো..
সেই স্বপ্নশহরে আমার, আমাদের যাপন ও উদযাপনের আলো-আঁধারি দিয়ে রচিত এই সন্ধ্যাভাষ্য।
* * *
জিন্সের প্যান্ট। নীল টি-শার্ট। শার্টের পিছনে সেলাই করে লেখা ‘অ্যান্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ… অ্যান্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ…।’ শার্টে কুয়াশা। নীলচে-নীলচে। প্যান্টে কুয়াশা। কাঁধ বেয়ে নেমে আসা লম্বা-লম্বা চুল। চুলেও কুয়াশা। এই হালকা-হালকা শীতের গোধূলিবেলায় ধীরপায়ে হেঁটে চলেছে ওই যে এক কিশোর কবি। নিরুদ্দেশ পথিকের মতো। নির্জন গোহাইল রোড ধরে হেঁটে যাচ্ছে দক্ষিণে। ঘুমিয়ে পড়বার আগ-পর্যন্ত কবিকে পেরুতে হবে মাইল-মাইল পথ। কবি বায়েজিদ মাহবুব। মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকি তার ওই মাথানিচু হেঁটে যাওয়া, অনেকদূর পর্যন্ত। একসময় আস্তে-আস্তে মিলিয়ে যান কবি আরো অধিক কুয়াশার ভেতর।
এক বিখ্যাত তরুণ, বজলুল করিম বাহার, কবি, চিরসবুজের চিরবসন্তের দেশ থেকে আসা অজর অক্ষর ঝলমলে বসন্তবাহার! রাগ মিয়া-কি-মল্লার, রাগ অনন্ত–ভাটিয়ার…পা-থেকে-মাথা-পর্যন্ত কবি, চুল-থেকে-নখ-পর্যন্ত কবি– বিস্ময়কর এক তরুণ…মানুষের চোখেমুখে যে এত আলো ও বিজলিচমকানি থাকে, থাকতে পারে… মানুষ যে কখনো কখনো এতটা শিশু আর এতটা কবি হয়ে ওঠে, উঠতে পারে– আমরা দেখিনি কখনো…আর তার সেই বিখ্যাত শৈশববোধ– শৈশবে, জ্যোৎস্নারাতে, দূর ভুটানের পাহাড় থেকে স্বপ্নের মতো নেমে আসত সব নীলগাই। নেমে আসত বাঘ, বাঘডাস (ডিম পাড়ে হাঁসে/ খায় বাঘডাসে) আর ভুটান মুলুকের ভুটিয়ারা। দলে দলে। এই ধানজুড়ি, এই কইগাড়ি, এই বৃন্দাবনপাড়া, এই দত্তবাড়ি, এই নামাজগড়, মালতিনগর… আর আমরা সত্যি-সত্যি একদিন দেখলাম, ম্যান্ডোলিন-এর দোতলায় দাঁড়িয়ে, লাফিয়ে ওঠার ভঙ্গিতে একদম ফ্রিজ করে দেওয়া সেই তীরবিদ্ধ পাথরিত ঘোড়ার পায়ের নিচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, বাহার, ফখরুল-পাগলা, শিবলী, আদিত্য, পাগলা-রাইসু আর আমি…(আমি আর আমার বউ তখন কবি ব্রাত্য রাইসুকে প্রীতিবশত কখনো পাগলা-রাইসু কখনো রাইসু-পাগলা বলতাম, সামনে নয় আড়ালে। আর ফখরুলকে তো পাড়াসুদ্ধ সবাই পাগলা কবিই বলত। তো সেই সময় কবি সাজ্জাদ শরিফ, রাজু আলাউদ্দিন, ব্রাত্য রাইসু, আদিত্য কবির এঁরা ক-দিনের জন্য বেড়াতে এসেছিল আমাদের সেই বৃন্দাবনের বাড়িতে, আদিত্য তো এসেছিল সারাপথ নাঙ্গা পায়ে, গিয়েও ছিল তা-ই) তো আমরা সত্যি-সত্যিই দেখলাম, রাত দশটা বাজতে না বাজতেই উডবার্ন লাইব্রেরির পার্ক থেকে বেরিয়ে গোহাইল রোড ধরে আসছে চকচকে সব ডোরাকাটা বাঘ, সাতমাথার দিকে। একটা, দুইটা, তারও পরে আরো একটা, হুঙ্কার ছাড়তে ছাড়তে। আর পেছনে পেছনে সত্যিই একটা বাঘডাস, একটা নয় ঠিক, দুইটা। সাতমাথার সেই ছোট্ট গোল আইল্যান্ডে দাঁড়িয়ে এক বেরসিক ট্রফিক পুলিশ তার নির্বিকার হাতের সংকেতে থামিয়ে দিচ্ছে তাদের। আর বাঘ ও বাঘডাসগুলাও সব কেমন লাইন ধরে দাঁড়িয়ে পড়ছে সুশীল বালকের মতো। অবাক কাণ্ড!
সপ্তপদী। কেউ বলে, সাতমাথা। সাতটা পথ এসে মিশেছে এখানে। ছোট্ট গোল ট্রফিক আইল্যান্ড। ফুলছড়ি ঘাট থেকে ট্রেন এসে থেমেছে বগুড়া স্টেশনে। যাত্রীরা আসছে খরগোশের মতো ব্যস্তসমস্ত হয়ে রিকশায়, পায়ে হেঁটে…। শহরের বাসগুলো ট্রাকগুলো সারাদিন কোথায়-কোথায় দৌড়ে বেড়িয়েছে ঊর্ধ্বশ্বাসে। এখন সব বাড়ি ফিরছে নিরীহ কিশোরের মতো নানা দিক থেকে, নানা দেশ থেকে। সাতমাথা আর রেলস্টেশনের মাঝামাঝি জায়গাটায় তাদের আস্তানা। বাহার ভাই বলছেন, অনেকটা প্রফেটিক ভঙ্গিতে, দেখবেন, বাঘগুলা যেই সাতমাথা পার হয়ে এদিকটায় আসবে, অমনি বদলে গিয়ে হয়ে যাবে একেকটা নতুন-নতুন ট্রাক। দেখবেন তা-ই হবে। আর কী অবাক ব্যাপার! সত্যি-সত্যি শহরের এই নতুন অংশের দিকে আসতে আসতে রূপান্তর হচ্ছে বাঘদের! বাঘের চোখ দুটি বদলে যাচ্ছে একজোড়া জ্বলজ্বলে হেডলাইটে। ধেয়ে চলা পা-চারটি ওই যে আস্তে-আস্তে গোলাকার হয়ে বদলে যাচ্ছে চাকায়! হুঙ্কার রূপান্তরিত হচ্ছে হর্নের আওয়াজে। আর বাঘের ডোরাকাটা তেলচকচকে শরীর হয়ে যাচ্ছে ট্রাকের পেইন্ট-করা স্ট্রাইপ-অলা চকচকে বডি। শহরের এই নতুন অংশের চোখধাঁধানো আলো পিছলে পড়ছে বডি থেকে।
আজ রাতে বাহার ভাই যা-যা বলছেন, ঠিক তা-ই তা-ই হচ্ছে। নেকড়েমতো একটা প্রাণী, লম্বামুখো, হুসহুস করে ছুটে আসছে অন্ধকারের ভেতর দিয়ে, শেরপুর রোড ধরে। সাতমাথার ওই গোলচত্বর পার হয়ে এসেই হয়ে যাচ্ছে টেম্পো। হুড়ুৎ করে দ্রুত বাঁক নিয়ে চলে যাচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের দিকে, নিজস্ব ডেরায়।
আপনি যদি কখনো বগুড়ায় আসেন, দেখবেন, এখানে এরকমই হয়।
চম্পক। গার্ডেন রেস্তোরাঁ। আলোজ্বলা গোল-গোল ছাতার নিচে গোল-গোল টেবিল। নানান বাহারি গাছ। ফুলগাছ। শহরের সব আলো নিভে যাবার পর সেখানে আপন তেজেই আলোকিত হয়ে থাকে উদ্ভিদগুলো। আজ তারা সেজেছে খুব করে। খোঁপা করেছে, নানা রকমের বাহারি খোঁপা- টপনট, পনি টেইল…কানে পরেছে দুল- ঝুমকা, রূপলঙ্কা…
সপ্তপদী থেকে আকবরিয়া মার্কেট, সারাক্ষণ উৎসব-উৎসব আমেজ। রাস্তার দুধারে ভিখারি বণিতা কবি প্রেমিক উন্মাদ ফলবিক্রেতা ওষুধবিক্রেতা গন্ধবণিক রেস্তোরাঁ প্রেক্ষাগৃহ, হরেক রঙের প্রথা, রিচুয়াল…। নানান যজ্ঞ লেগেই আছে। মহাধুমধাম।
(চলবে…)
Opurbo!