চাঁদ, প্রজাপতি ও জংলি ফুলের সম্প্রীতি-৪

মাসুদ খান

(পূর্বপ্রকাশিত-র পর)

অতিগাগনিক উৎপাত…

মাহী-সওয়ার কলেজ। জনশ্রুতি আছে, হজরত শাহ সুলতান নামের এক দরবেশ এক বিশাল মাছের পিঠে চড়ে করতোয়া নদী দিয়ে ভেসে এসে নেমেছিলেন এইখানে, এই ঘাটে। সেই থেকে দরবেশের নাম হজরত শাহ সুলতান মাহী-সওয়ার আর তাঁর নামে নাম এই বিদ্যায়তনের।

কলেজের পাশ দিয়ে লালচে ধূলি-ওড়া পথ। সেই পথ দিয়ে তুফান-গতিতে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে চল্লিশ-পেরুনো এক লোক। চোখে স্ফূর্তি, মুখে গান- “চলো যাই ভেসে যাই প্রেমসাগরে নাও ভাসিয়ে দুজনে-এ-এ-এ-এ/ নাও ভাসিয়ে দুজনে/ রেখো মোরে তোমার নয়নে।” চেন পড়ে গেছে, সাইকেল চলছে তবু ঊর্ধ্বশ্বাসে। লুঙ্গি খুলে পড়ে যাচ্ছে চেনের সঙ্গে জড়িয়ে-মড়িয়ে, স্ফূর্তির চোটে টের পাচ্ছে না মানুষটা। ওদিকে বগলে একগাদা বই আর হাতে প্রচুর কাগজপত্র নিয়ে কী যেন ভাবতে ভাবতে ক্লাশের দিকে যাচ্ছেন এক অধ্যাপক, ভুলোমন স্বভাবের…হাতের কাগজ পড়ে যাচ্ছে, খেয়াল হচ্ছে না। পাকুড় গাছের নিচে আড্ডা জমিয়েছে কিছু হুল্লোড়বাজ ছাত্রছাত্রী। একজন দৌড়ে গিয়ে কী যেন কী একটা দেখাচ্ছে প্রফেসর সাহেবকে। ছোট্ট একটি স্ক্রু। বলছে, “স্যার, এটা বোধহয় আপনার, পড়ে গেছে।” আলাভোলা, পাগলা-পাগলা প্রফেসর পেছন ফিরে স্ক্রু-টা হাতে নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন, আর বলছেন, “না তো, আমার না তো।” হাসির হিল্লোল পাকুড় গাছের নিচে। খড়ের মালা গলায় দিয়ে একটা বেড়াল হেলেদুলে হেঁটে যাচ্ছে পাশের আলপথ ধরে। একশো একটা ইঁদুর মারার পর নিয়ত করেছে পুরাপুরি অহিংস হয়ে যাবে সে। ‘অহিংসা পরম ধম্ম’ মন্ত্র জপতে জপতে যাত্রা করেছে বুদ্ধগয়ার দিকে। ওই বেড়ালটিও কিনা ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে এই দৃশ্য আর মুচকি মুচকি হাসছে।

পাশেই করতোয়ার খাড়া পাড়। নিচে সেই বিশ্ববিশ্রুত অথইদহ। কত জরিপ হয়েছে যুগে যুগে, কিন্তু থই পাওয়া যায়নি সেই রহস্যদহের। লোকশ্রুতি বলে, কয়েকশো বছর আগে এক তারাভরা রাতে আকাশ থেকে বিকট শব্দে বিশাল এক আলোর গোলা এসে পড়েছিল করতোয়ায়। বিশাল সেই গোলার পেছনে পেছনে ছোট-ছোট আরো অসংখ্য গোলাণু, থেমে-থেমে, থেকে-থেকে। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, সেই আওয়াজে বধির হয়ে গিয়েছিল ১৩১ জন মানুষ, ২৮১টি গরুছাগল, ২২টি শিয়াল। এ বধিরতা যেমন-তেমন বধিরতা নয়। প্রজন্ম-প্রজন্ম বধিরতা। এই যে ঠসাবাড়ির গফফার ঠসা— ও নিজে ঠসা, ওর ব্যাটা ঠসা, বেটি ঠসা, বাপদাদা বারোগোষ্ঠি ঠসা। তাহলে বোঝেন! যাই হোক, সেই বিকট আওয়াজে গর্ভপাতের ঘটনা ঘটেছিল ২৯টি, আর কাঁপুনির চোটে সাঁকো ভেঙেছিল ১৫টি, টঙঘর ১২২, আর ভেঙে পড়েছিল এলাকার সবগুলি খাটা পায়খানা। সবাই ভেবেছিল কেয়ামত শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু আলামত ছাড়াই কেয়ামত! এরকম তো হওয়ার কথা না। খরে দজ্জাল আর ইমাম মেহেদির জমানা আসার কথা, সেগুলা কই! তাহলে কি ওই শয়তান জমিদারের রূপ ধরেই দজ্জালের আবির্ভাব! এখন না-হয় বুঝলাম দজ্জালের জমানা, কিন্তু এরপর তো ইমাম মেহেদির পালা… তিনি কই, তার তো আবির্ভাব ঘটেইনি এখনো! নাকি মেহেদিপর্ব বাদ দিয়েই শর্টকাট টু কেয়ামত! এইসব নানান ভাবনা ভেবেছিল এই মহাস্থানগড়ের মানুষ, ওই প্রলয়কাণ্ডের রাতে। ভোরের দিকে নারীপুরুষশিশুরা সব ভয়ে ভয়ে জড়ো হতে থাকল করতোয়ার পাড়ে। দ্যাখে-কি, আসমানি গোলার আঘাতে আউলাকান্দি মৌজার তিনগুণ-সমান বিশাল এক জায়গা একদম আউলে গিয়ে এক গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে করতোয়ার বুকে। প্রচুর কাদামাটি ছলকে ছলকে উঠে সয়লাব করে দিয়েছে অববাহিকার জায়গাজমিন।

নতুন পলিমাটি পেয়ে বছর কয়েক ফসল ফলেছে প্রচুর। কিন্তু আনকা এক উপদ্রব। চেনা সবজি ও শস্যের ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ অচেনা, অদ্ভুতকিম্ভুত সব সবজি ও শস্যের গাছ। এরকম কিম্ভূত-কিমাকার ফসলের গাছ দেখলেই তো ভয় লাগে! আসলো কোত্থেকে, এগুলির বীজ? এ রহস্যের কোনো কিনারা হয়নি এই সেদিন পর্যন্ত, যেদিন বিদেশী বিশেষজ্ঞরা এসে আশপাশের মাটি, কাঁকর, বীজ, শস্য, অথইদহের পানি…সবকিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করে আবিষ্কার করল, বহু বছর আগে যে আলোর গোলাটি এসে পড়েছিল তা আসলে আর কিছু নয়, সৌরজগতের বাইরের কোনো প্রাণময় গ্রহ থেকে ছুটে আসা এক বিপুলাকার উল্কাপিণ্ড। আর ওই সজীব-সপ্রাণ উল্কার সাথেই এসেছিল ওইসব অচেনা শস্যবীজ। বিশেষজ্ঞরা আরো যা আবিষ্কার করল তা হলো, অবাক-করা কিছু কাঁকর, পাথর। রত্নপাথর। নীলা আকিক গোমেদ পোখরাজ কোনো কিছুরই মতো নয়…না সূর্যের আলো, না চাঁদের আলো কোনো কিছুতেই জ্বলে না সেই রত্ন, চুপচাপ অন্ধকার হয়ে পড়ে থাকে। কেবল বিশেষ কিছু তরঙ্গদৈর্ঘ্যরে আলো ফেললে জ্বলজ্বল করে ওঠে, যেসব আলো হয়তো বিচ্ছুরিত হয় ভিন্ন কোনো নক্ষত্রলোকে।

কত খরা গেল, কত জলসেচ প্রকল্প গেল, কিন্তু কখনোই পুরাপুরি শুকাল না অথইদহের পানি। এই তো বছর কয়েক আগের কথা। নিদারুণ চৈত্রমাস। মাঠঘাট খালবিল সব চৌচির… খরার তীব্রতা ছাড়িয়ে গেছে আগের সব রেকর্ড। ডিপ টিউকলেও পানি উঠছে না। বাধ্য হয়ে কৃষকেরা বিশাল বিশাল নলকূপ ফিট করেছে ওই অথইদহে, শয়ে শয়ে। এরপর ঘটল সেই অস্বাভাবিক ঘটনা… হাজার হাজার কৌতূহলী মানুষের উপচানো ভিড়। দহের পানি উথালপাথাল। আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে উঠল এক অদ্ভুত অতিকায় প্রাণীর আতঙ্কিত নড়াচড়া… প্রাণীটা খুবসম্ভব উভচর- দুই হাত, দুই পা, আর আমাদের মানিক ময়রার দোকানে বসে যে নাদুসনুদুস ছেলেটা- লুকিয়ে লুকিয়ে মিস্টি খায় খালি, সবাই ডাকে ভোটুস— তার মতো ভুঁড়িভাসানো পৃথুল দেহ। অনর্গল কথা বলছে বহির্জাগতিক অবোধ্য ভাষায়, মাঝে মাঝে স্নিগ্ধ হাসি হাসছে, দেখা যাচ্ছে ঝকঝকে দাঁত… আবার হঠাৎ হঠাৎ বিমর্ষও হয়ে পড়ছে খুব। উৎসাহী পাবলিক গুলতি, লাঠি, সড়কি, এয়ার গান, ছররা বন্দুক সব নিয়ে এসেছে… বাইনোকুলারও নিয়ে এসেছে চুয়েটে-পড়া লিটন। মনোযোগ দিয়ে পড়তে চেষ্টা করছে, প্রাণীটির সারা গায়ে কোঁকড়া-কোঁকড়া ওগুলি কি লোম নাকি আঁশ। এর মধ্যে হঠাৎ করে দু-একজন গুলিও ছুড়েছে। কোনোটা লেগেছে, কোনোটা অতদূর পর্যন্ত পৌঁছতেই পারেনি। আক্কাস মণ্ডলের মেজ যে ছেলেটি, মলনালীতে ক্যানসার ধরা পড়েছে, সেও গুলি করেছে দুই রাউন্ড। অথইদহের তলদেশে দাঁড়িয়ে টলোমলো পায়ে ভর দিয়ে অসহায় সেই প্রাণী হাত তুলে তালু খুলে দেখাচ্ছে বারবার, তালুতে গুলি লেগেছে তার, কিন্তু রক্তের রং লাল না হওয়ায় বোঝা যাচ্ছে না ঠিক…

“মানুষ-প্রাণী ভাই-ভাই” নামের এক পশুপাখিপ্রেমী সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অনিল বিশ্বাস এসে তার চৌকস বক্তৃতায় মুগ্ধ করে ফেলে নানা রঙের, নানা মেজাজের মানুষকে। প্রশমিত করে আনে উত্তেজিত মানুষদের জিঘাংসাভাব। এরপর শুরু হয় উদ্ধারপর্ব, শহরে খবর পাঠানো…, তারপর ক্রেন, কনটেইনার, প্রশাসন, থালাবাসন (কাদাপানি সেঁচার জন্য), ল্যাডার, ক্যাডার, জেনারেটর, ইনজিনিয়ার, দড়িদড়া, দমকল, বিশেষজ্ঞ, উকিল-মোক্তার, পশুডাক্তার… সে এক এলাহি কারবার। প্রচুর হাঁকডাক, ‘এই করো সেই করো, এই লে-আও সেই লে-আও’ এইসব আওয়াজ আর প্রচ- ভিড়ের মধ্য দিয়ে শুরু হলো অসহায় এলিয়েনের উদ্ধারকাজ। বেশ কয়েক ঘন্টা ধরে অকহতব্য শ্রম ও মেধা ব্যয় করে তিন-তিনটি ডালাখোলা কনটেইনার জোড়া দিয়ে বিপুলায়তন গালিভারটাকে তার ভেতর উঠিয়ে নিয়ে দুই জোড়া ক্রেন লাগিয়ে বহু কায়দা ও কসরৎ করে ওপরে তুলে আনে লিলিপুটের দল। প্রাণীটার কাছে মানুষগুলি সব হাস্যকর-রকম খর্বকায়।

বিশাল হাসি-হাসি মুখ এলিয়েনটার। সদানন্দ। কিছু মানুষ থাকে-না, যাদের চেহারাটাই এমন যে মনে হয় যেন হাসছে, সেরকম। এলিয়েনটা কথা বলছে, হাত নাড়ছে, হাসছে। পৃথিবীর চেয়ে বহুগুণ বড় দূরের প্রায়-জলমগ্ন কোনো এক গ্রহের বুদ্ধিমান অথচ নিরীহ শান্তিপ্রিয় প্রাণীপ্রজাতি। একেবারে উন্নততম নয় বটে, তবে মধ্যম স্তরের প্রজাতি। এলিয়েনদের গ্রহের স্থলদেশ, জলদেশ উভয়দেশেই রয়েছে তাদের সভ্যতা… সম্ভবত।

(চলবে…)

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top