[এ রূপকথা তোমাকে দিলাম-
শাদা কাগজে, শাদা কালিতে…
৭ই জানুয়ারি, ২০১১]
“He continued on, on to the glacier, towards the dawn, from ridge to ridge, in deep, new-fallen snow, paying no heed to the storms that might pursue him. As a child he had stood by the seashore at Ljósavík and watched the waves soughing in and out, but now he was heading away from the sea.
‘Think of me when you are in glorious sunshine.’
Soon the sun of the day of resurrection will shine on the bright paths where she awaits her poet.
And beauty shall reign alone.”
— Halldór Laxness (World Light)
মানুষ একা। তার পিঠে আঁকা জন্মদাগের মতো একা। এতই একা যে মানুষ তা নিজেও জানে না। আয়নার সামনে ঘুরে দাঁড়িয়ে, ঘাড় কাত করলেই দেখা যায় পিঠের সেই দাগ। কালো গোলাপের পাপড়ির মতো।
মানুষের শরীর ও সেন্টরের শরীর এক। আয়নার ভিতর দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির ছায়ার দিকে হৃত্পিণ্ডটা ছুটে যায়। আর ঘোড়ার খুরের পাগুলো হেঁটে, হেঁটে চলে যায় এক হারানো নদীর পাড়ে। সম্নাম্বুলিস্ট পা…সেখানে ভেজা খড়ের গন্ধ। ঝিরঝিরে বাতাস। ঘাসের মাঝে নীল রঙের ফরগেট-মি-নট ফুটে আছে। বুকের ভিতর ছোট্ট হলুদ টিপ পরা ওদের। বুনো ব্ল্যাকবেরী, ব্লু-বেরী আর এলডারবেরীর ঝাড়। শাদা-কালো ছিটছিট, লাল মুকুট ডাউনি উডপেকাররা বাসা বেঁধেছে – মাথা উড়ে যাওয়া ওক গাছের খোদলে। হঠাৎ খুঁজে পাওয়া মোরেল মাশরুম ছড়িয়ে, ছিটিয়ে পড়ে আছে ভাঙ্গা পথের ধারে। ইতিহাসের বই থেকে ফিরে আসা মানুষগুলোর মতো।
আয়নার ভিতর বৃষ্টি বেড়ে চলেছে…মেয়েটি ভিজে যাচ্ছে…সেন্টরের বুকের লোমও জলে ভিজে একাকার। তবু যেখানে ওর কোমর শুরু হয়েছে, সেখানে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে দুই পৃথিবীতে আটকে পড়বার দাগ। এক একা দাগ। দুই আকাশে ঝুলে থাকা, দুই জীবনে বন্দী এক একলা চাঁদ।
আসলে যে বৃষ্টির গল্প এটা, সে বৃষ্টি কখনো কোথাও হয় নি। কেননা সেই সেন্টর আর সেই মেয়েটির সে দিনের সেই পথহীনতা কোন সামাজিক গল্প ছিল না…
(এক)
কাল স্বপ্নের ভিতর তুমি আমার শরীরে অনেক ঘুরে বেড়িয়েছিলে। মুঠো মুঠো ব্লু-বনেট আর ইন্ডিয়ান পেইন্ট ব্রাশ তুলে বার্চ গাছের কাছে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিলে। পায়ের কাছের নরম সবুজ মসে বার্চ গাছের শাদা বাকল ঝরে পড়ছিলো।
আমি প্রেইরীর উপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছিলাম। লাল রঙের ‘হারভেস্ট মুন’ আমার শরীরের চামড়া ছুঁয়ে ফেলেছিলো। সে আলো আমি পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখি নি। আমার আকাশ জুড়ে সারা রাত কত যে অরোরা জ্বলেছিলো। আমি তাকিয়ে, তাকিয়ে দেখছিলাম সে বেগুনি রঙ কীভাবে কাঁপতে, কাঁপতে হাত পা অবশ করে দিতে পারে। কীভাবে তোমার চোখ আমাকে বরফ করে দিতে পারে।
আকাশের চোখ ফেটে ঝরঝর করে বরফ ঝরছে এখন। বরফের ফুল। আর আমি তার ভিতর দিয়ে রুপালি-শাদা ইউনিকর্ন উড়িয়ে চলেছি। হ্যাঁ, আমার এ ইউনিকর্ন উড়তে পারে। স্বপ্নের ভিতরে, স্বপ্নের বাইরে।
ইউনিকর্নের পিঠে মাথাটা আমার কাত হয়ে আছে…গাল নরম লোম ছুঁয়ে…চোখের জল ওর পিঠ ভিজিয়ে দিয়ে মাংস, চামড়া ফুঁড়ে শরীরের রক্তে মিশে যাচ্ছে। এত্ত জোরে হাতটা মুঠো করে ধরেছি যে হাতের তালুতে আমার সবগুলো নখ দেবে যাচ্ছে। বিন্দু, বিন্দু রক্ত ফুটে উঠছে, আকাশে যেভাবে তারা ফোটে, শীত্কারে ঘাম।
মনে পড়ছে তুমি বলেছিলে, ‘দেখা আমাদের হবেই। একদিন। আমি লাঠি ঠুকঠুক করে তোমাকে দেখে আসব। তুমি পান বানিয়ে খাওয়াবে, জর্দা ছাড়া।’
আসলে কি জান? পুরোটা জীবন আমি নিজ ঘরের চৌকাঠে, একই জায়গায় দাঁড়িয়ে হাতদু’টো শুধু পাখির ডানার মতো ক’রে নেড়ে চলেছি। একবিন্দু কোথাও যাচ্ছি না, মাটি থেকে একটুও উপরে উড়ছি না। তবু কোনভাবে যদি আজ তোমার কাছে পৌঁছতে পারি। কোনদিন।
আমার পরজন্ম নেই। পূর্ব জন্ম নেই। শুধু হাতের মুঠোয় এই এখনকার এইটুকুই সময়– সবুজ মার্বেল এক। কাচের ভিতর বন্দী এ কারো চোখের জল। এক ফোঁটা জল।
দূরে কোথাও হাজার তারে হার্প বাজছে। পৃথিবীতে ভোর হচ্ছে। সূর্য যখন ওঠে, তখন ফুলের কুঁড়ির প্রাণ সারা রাতের সব রক্তপাতই মুছে দেয়। অপেক্ষার রঙ বদলে গিয়ে এত বেশি উজ্জ্বল হয় যে সব রাজকন্যারা পথ ভুলে যায়। তামাক রঙের মেয়ে শুধু তাকিয়ে থাকে–পলক পড়ে না।
(দুই)
সেদিন বিকেলবেলা হাঁটছিলাম। হঠাৎ পায়ের বুড়ো আঙুলে কি যেন লেগে হোঁচট খেয়ে পড়লাম। ভাবলাম স্বপ্ন। কিন্তু না! একটা ঝিনুক। পিঠের দিকটা কালো, বিচ্ছিরি। কিন্তু ভিতরটায় রঙধনু আঁকা আছে। এত্ত বেশি সবকিছু ভালোবেসে ফেলতে ইচ্ছে করল! অথচ যেই নীচু হয়ে ঝিনুকটা কুড়িয়ে বুকের কাছে নিতে গেছি, দেখি আসলে আমার বুড়ো আঙুলটা কেটে গেছে। একটু, একটু করে রক্ত বের হচ্ছে…তাড়াতাড়ি মার্বেলটাকে মুঠো করে সবুজ জঙ্গলটার কাছে যেতে থাকলাম।
জঙ্গলের পাশে ছোট নদী। বহুদিন আগে এই ছায়ার ভিতর ‘হবিট’-দের মতো একটা গর্ত খুঁড়েছিলাম আমি। গর্তের উপর পৃথিবীর সবুজ ঘাস। হরিণ ছুটে যাচ্ছে…বুনো তিতির। কাঠবিড়ালিরাও পুরো শীতকালটাই বেঁচে থাকবে বলে কোথায় কোথায় যেন পাইন বাদাম লুকাচ্ছে। ইয়েলো মে পপি ফুটে শেষ হয়ে গেছে সেই কবে!
কত কি যে রেখেছিলাম সেই গর্তে আমি। রাজস্থানের পথে কুড়িয়ে পাওয়া ময়ূরের পালক। পালকের গায়ে আঁকা নীল চোখ গর্তের অন্ধকার আলো করে রেখেছিলো। তবে ময়ূরের নির্জীব পালক নয়, আমি সত্যি সত্যি কি রাখতে চেয়েছিলাম জানো?
ষট্-উত্সবের জলে ভাসিয়ে দেওয়া কবেকার সেই সব ঝিলমিলে প্রদীপ।আমাদের গ্রামের নদী আর জলের উপর যা ভেসে যেত – কি অদ্ভুত ছিল সে আলো! কালো জলের উপর ভাসতে, ভাসতে তারা ইতিহাসের গল্পের মত হারিয়ে যেত। যেন বাদশা আকবর, নূরজাহান। আর তানসেনের গান।
ছেলেবেলার বাড়ির পাশে একটা অদ্ভুত, ভুতুড়ে গাছ ছিল। লাল, লাল বিচি। জানি না কেন তাকে সবাই রক্তচন্দন বলত।
হৃত্পিণ্ডের লাল কি সত্যিই মাখা ছিল ওতে? একটু নরম থাকতে কুড়িয়ে আনলে বিচিগুলো দিয়ে মালা গাঁথা যেত। ছোট, ছোট লাল ডিমের মতো আর একটা বিচিও ছিল। কুচ বুঝি? মাথাভর্তি কালো চুল, কপালে কালো টিপ। যেন পৃথিবীর সব সুন্দরী মেয়েদের মুখ। আমার ‘হবিট’ গর্তের পুরো মেঝে এইসব লাল, লাল বিচি দিয়ে ভরা। সেই সাথে ভাঁজ করে রাখা প্রত্যেক বিচি কুড়ানোর এক একটি গল্প – জীবনের সব বৃষ্টির ফোঁটা। আসলে আমি ভেবেছিলাম একদিন এই সবকিছুই তোমাকে দেব। কাচের মার্বেল হয়ে যাওয়া এক ফোঁটা চোখের জলে ভরে।
প্রথম যেদিন কালবৈশাখী দেখেছিলাম, এত্ত ভয় পেয়েছিলাম জানো। আকাশ যে সত্যি সত্যি কখনো এত রেগে যেতে পারে, কোনদিন আমি তা স্বপ্নেও ভাবি নি। দূরের নারকেল গাছগুলোর পাতা গাছগুলোকে ফেলে রেখে পাড়ার সব ঝগড়ুটে বউগুলোর মতো কোমরে আঁচল পেঁচিয়ে খুন্তি, হাতা নিয়ে পথে নেমে পড়েছিলো। জানালার কাচ ভেঙে চোখ ঝলসানো আলো সারা মেঝে জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। আমার ঝাঁকড়া, কোঁকড়া চুল হুমড়ি খেয়ে চোখের উপর। সব আলো নিভে গিয়ে চোখ একদম অন্ধকার হয়ে গিয়েছিলো। জীবনের সেই প্রথম ভয়টুকুও আমার এই ‘হবিট’ গর্তে আছে। যা কিছু আমার, সব সব – তোমার!
তখন আমি খুব ছোট। মাত্র হাঁটতে শিখেছি। খুব ভালো নিজের তাল সামলাতে পারি না। টলমল করে দু’পা যেতে গিয়ে চার পা চলে গিয়ে একটা মরা বুলবুলিতে প্রায় হোঁচট খেয়ে পড়েছিলাম। মৃত্যু কত সহজে রাস্তার উপর পড়ে থাকতে পারে। আমি তখনো কবর দিতে শিখি নি। কেউ একটা এসে সেই বুলবুলিটা আমার এই ‘হবিট’ গর্তে মাটি চাপা দিয়ে গিয়েছিলো। কোন একদিন সেই মরা জীবনের কথা মনে করে আমি সারা রাত ধরে তোমার বুকে মুখ গুঁজে কাঁদব বলে। হয়তো!
ছাদের উপর অনেক রাতে একবার ভীষণ বৃষ্টি নেমেছিলো। আমার এত একা লাগছিলো। আর বৃষ্টিও এমন জোরে হ’চ্ছিল যে আশেপাশের বাড়িগুলোর সব মানুষ দরজা, জানালা বন্ধ করে ঘরের ভিতরই শুয়েছিলো। পা টিপে, টিপে আমি সেই গভীর রাতের বৃষ্টি ছুঁয়ে ফেলব বলে একা একা ছাদে গিয়েছিলাম। চোদ্দ বছর বয়স। বৃষ্টি ছাড়া আমার শরীরে সেদিন আর কোন রেশমি সূতাই ছিল না। শরীরের সেই ভালোবাসাটুকুও তোমার জন্য– এইখানে, এই গর্তের ভিতর।
আসলে সার্কাসের আফিম দেওয়া বাঘের মত ঝিমিয়ে, ঝিমিয়ে পুরোটা জীবনই কাটিয়ে ফেলেছি আমি। হাতদু’টো দিয়ে হাঁটু চেপে ধরে, হাঁটুর ভিতর মাথা গুঁজে বসে বসে কাঁদছি শুধু। আর কেবলই ভাবছি যে হয়তো কোন একদিন এত জোরে বৃষ্টি নামবে যে কোথাও আর যাওয়া যাবে না। বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে ছেলেবেলার গল্প বলবে তুমি– যে গল্প কোনদিন কাউকে বলনি। হয়তো পরের জীবনের গল্প বলবে – যে গল্প তুমি নিজেও জানো না। কত গল্প গাছের শরীরে…
(তিন)
পুরো শরীর দিয়ে কোনদিনই তোমাকে পাব না আমি। আমার আঙুল ভর্তি কি সব হীরে আর ব্লু স্যাফায়ারের আঙটি সারাটাক্ষণ ঝমঝম করছে! ফ্যাঁকাশে শাদা প্ল্যাটিনামে গেঁথে বসানো! মাংসের ভিতর লোহার পেরেক ঢুকিয়ে দিয়েছে কেউ। এ আমার শরীর। পাথর তো নয় যে পেরেক গাঁথতে গেলে পেরেকই বেঁকে যাবে। এখন আঁকড়ে ধরতে যদি যাই, তোমার শরীর চিরে গিয়ে রক্ত বের হবে।
তবে এসো, শুধু আঙুলের এই একদম সামনের ডগাটুকু দিয়েই না হয় তোমাকে একটু ছুঁই। মানুষ যেভাবে মেঘ ছোঁয়। মেঘের জল ছোঁয়।
জানো, কাল পথের পাশের মরা ওক গাছটায় একটা সোনালি রঙের ঈগল দেখেছিলাম। কি অসম্ভব রাজকীয়। পেটের নিচটায় নরম বাদামি তূলোর মতো, পালকে ঢাকা হলদে পা। ভাবছিলাম ওকে বলি ওর পাখায় করে আমাকে একটু তোমার কাছে নিয়ে যেতে।
ভীষণ ঝড় হচ্ছে এখন। এই ঝড়ে তোমার চুল এলোমেলো হ’য়ে তোমার চোখে এসে পড়ছে। তুমি তো কিছু দেখতেই পাচ্ছ না। আমার ইচ্ছে করে তোমার চোখের উপর থেকে শুধু ওই চুলগুলো একটু আলতো করে সরিয়ে দিতে। আর তো কিছু না…
আচ্ছা, তুমি কি সেই ব্লু-বনেটের প্রাচীন লোকগাথাটা জানো? সেই সে একাকী মেয়ের গল্প? প্রত্যেক বসন্তে ওর মানুষেরা সেই যে পরম পিতার কাছে গান করত আর ঘুরে, ঘুরে নাচত। বৃষ্টি নামত তাতে।
কিন্তু একবার সব বৃষ্টি থেমে গেল। জল না পেয়ে মানুষগুলো মরে গেল। আগুনের ভিতর প্রাণের পুতুল ছুঁড়ে দিল মেয়ে। পুতুলের মাথার নীল পালক আগুনে পুড়ে, পুড়ে পরদিন ভোরে সারা পাহাড় জুড়ে ব্লু-বনেট হ’য়ে ফুটে উঠল। আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামল।
আমারো ইচ্ছে করে ঠিক অমন করেই নিজ হৃত্পিন্ডটাকে তোমার দিকে ছুঁড়ে দিতে…
বরফ ঝড়গুলোর পর আজ আবার একটা ব্লু-জে খাবার খুঁজতে এসেছিলো। ওকে দেখে আমি পড়িমড়ি ফ্রেজার ফারের গায়ে রেড-কার্ডিনাল, জাঙ্কো আর চিকাডিদের জন্য বার্ড-ফীডার উপচে খাবার ঝুলিয়ে দিতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি নদীর পাড়ে বরফের উপর অনেকগুলো হরিণের পায়ের ছাপ। বরফের মরুভূমিতে হরিণ জল খেতে এসেছে। চারপাশের সব জল সেই কবে জমে গেছে। শুধু নদীতে এখনও স্রোত।
হরিণেরা যখন জল খায়, তখন আমার পাতালে এই নৌকা নিয়ে ঘুরে ঘুরে আর লাভ কি? ভাঙ্গা স্বপ্নের নদীতে?
টুপটাপ স্নো-ড্রপস ফুটে উঠছে…বসন্তে রবিনের বাসা ভরে যাচ্ছে নীল ডিমে…আমার দু’মুঠো ভর্তি হলদে ড্যাফোডিল। নেবে?
(চার)
ইউনিকর্ন এসে দাঁড়িয়েছে মায়া সভ্যতার ধ্বংসস্তূপের ভিতর। দূরের ক্যারাবিয়ান জল পায়ের পাতা ভিজিয়ে দিচ্ছে। আমি সব শক্তি নিঃশেষ করে প্রাণপণ হাততালি দিয়ে চলেছি। মেক্সিকোর ভেঙ্গে পড়া পিরামিডে সেই শব্দ ঠিকড়ে গিয়ে প্রেমের গল্পের নীচে হারিয়ে যাওয়া কুইত্জল্ পাখির ডাক হ’য়ে যাচ্ছে। তোমাকে ডাকছি আমি। আর তারপর যাদুর মত কুইত্জল্ পাখিগুলো মন্দিরের গুহায় রাটল্ স্নেকের ঝুম্ ঝুম্ শব্দ হ’য়ে কিভাবে যেন বদলে যাচ্ছে। আমি সাপ ভালবাসি না।
অথচ বিশ্বাস ক’র, সেই ছেলেবেলাতেও মিসিসিপি নদীর পাড়ে যতবার হাকল্ বেরি ফিনের সাথে হেঁটে গেছি, ঠিক ততবার তোমার কথাই ভেবেছি। যতবার কদম ফুল ফুটে উঠবার সব অজানা আনন্দ আমাকে পাগল ক’রে দিয়েছে, ততবার সেই আনন্দের দু’ এক ফোঁটা তোমাকে না দিয়ে আমি তো কোনদিনও কোন রাজপ্রাসাদে ঢুকি নি। নদীর পাড়ে সন্ধ্যা হ’য়ে গেছে, গা ছমছম করা কালী মন্দিরের পাশে আমি কতবার একা দাঁড়িয়ে থেকেছি। আর কেবলই মনে করেছি যে কোন একটা সময় হঠাৎ ভুল করে তুমি ঠিকই চলে আসবে।
আটলান্টিকের উপর দিয়ে উড়ে চলেছে ইউনিকর্ন। ভীষণ বরফ ঝড় শুরু হয়েছে। বড়, বড় ঢেউ সমুদ্র ফুঁসে একদম আকাশ ছুঁয়ে ফেলছে। থরথর করে কাঁপছে পক্ষীরাজ। আমি চাঁদ দেখতে পাচ্ছি না। আর যতই হাতটা মুঠো করছি না কেন মনে হচ্ছে এই চোখের জলটুকু আমার হাতের মার্বেল হ’য়ে আটলান্টিকে পড়েই হারিয়ে যাবে। কিছুই আর তোমাকে দেওয়া হ’বে না। সমুদ্র কত বড়!
রাত হ’য়ে গেছে, ইউনিকর্ন এসে থেমেছে আর্লসের ক্যাফে টেরাসে। ভ্যান গগের ঘন নীল আকাশে ল্যান্টার্নের উজ্জ্বল আলো হলুদ তারা হ’য়ে ফুটে উঠছে। পেভমেন্টের পাথরগুলোতে সে আলো ঠিকরে পড়ে গোলাপি-বেগুনি মত এক কোমল আভা ছড়াচ্ছে। রাতের ছবি, অথচ কোথাও কোন কালো নেই। একটা রাস্তা কারো সাথে কথা বলতে না পেরে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে…সবুজ গাছ। নীল-বেগুনি, সালফার-হলুদ, সিট্রন-সবুজ, লাইলাক আর ঝলমলে কমলা এ রাত। আমি ক্যাফে চেয়ারে বসে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। হয়ত তুমি এসেও পড়তে পারো। কে বলতে পারে। মানুষের জীবনটা তো শুধু এমন কোন শিল্পনগরীতে বসে একের পর এক এ্যাবসিন্থ সবুজ স্বপ্ন দেখে যাওয়া। কেবল তাই।
পৃথিবী ঘুরে ঘুরে সামনে শেষ পথ…বেদুইন তাঁবু। জিপ্সি সুর নয়–সিম্বল, ক্ল্যারিনেট, চেলো বাজিয়ে কারা কারা সব অর্কেস্ট্রা বুনে যাচ্ছে…পাশের ঘর থেকে ভেসে আসা কথার মত স্টাইনওয়ে পিয়ানো, ওবো নীচু স্বরে। তুমি এলে না…দেওয়ালহীন আকাশ…হেলান দিতেই মরুভূমিতে বৃষ্টি নামল। থই থই করে উঠল বালু। সব জল ক্যাকটাসগুলো শুষে খেল। আর ভোরের শেষ তারাটা চিনতে গিয়ে আমি শুধু দেখলাম তারাতে তারা ঠুকে তারার ভিতর কেমন করে যেন আগুন জ্বলে উঠল।
তোমার ক্লান্তি এল।
কালীপূজার রাতের ফুলঝুরি তারাবাজি শরীর থেকে অনেকটা দূরে রাখতে হয়। ফুলঝুরির ভাঙ্গা তারার টুকরো চোখে এসে পড়লে পুরো জীবনের মতো অন্ধ হয়ে যায় মানুষ। রাত শেষ হ’লে তারাবাজির ঠান্ডা লাশ ঘাসে পড়ে থাকে। শিশির ভেজা। দু’ হাতের ভিতর সে লাশ মুঠো করে জড়িয়ে ধরলেও তারাবাজির আলোর টুকরোগুলো আর তো জ্বলে না। ফেলে আসা হাজার দরজাগুলো একে একে বন্ধ হ’য়ে যায়। সামনের রাতের ফুলঝুরিগুলো জ্বলতে থাকে। অন্য কোন রাতে। অন্য কোথাও, অন্য জীবনের ভিতর…
(পাঁচ)
বরফের উপর শুয়ে আছি এখন। আমার মত্স্যকন্যা লেজ খসে গিয়ে দু দু’টো পা গজিয়েছে। তবু হাঁটতে পারছি না। গলার সেই গান আর নেই। ফেনা হ’য়ে ভেসে যাচ্ছি–জলকন্যা এক। বিশ্বাস না হ’য় তোমার চোখের জল ছুঁয়ে দেখো। শাদা ফেনায় সব আঙুল ভিজে যাবে।
ফিরে এলেন কল্যাণী? দারুণ! অনেক শুভেচ্ছা!