বৈশাখের খররৌদ্রে একখানা ‘খড়ের কাঠামো’-র পাশে দাঁড়াইল পথশ্রান্ত পথিক। কয়েক খামচা খড় লইয়া বসিয়া পড়িল কাঠামো পার্শ্বে। চতুর্দিকে চোখ ঘুরাইয়া পর্যবেক্ষণ করিল কাঠামোটিকে। এ-কি কোনো মানসপ্রতিমা? নাকি কাহন দুয়েক খড়ের স্তূপমাত্র! মানসপ্রতিমার কাঠামো হইলে পালমহাশয় ‘আপন মনের মাধুরী’ মিশায়ে মানসী করিবে রচনা, ইহাই স্থিরকল্প করিলেন পথিক আর বৈশাখের প্রথম ফসলের ঋতুচিহৃ হইলে তাহাতে গবাদির গ্রাসাচ্ছাদন হইবে, ঘর ছাওয়া যাইবে, লাকড়ি বাড়ন্ত হইলে চুলাও জ্বলিবে, আগামী শীতে খড়ের তোশক হইবে কিনা তাহাও ভবিষ্যৎ ভাবনায় আনা যাইতে পারে। এই মুহূর্তে পথিক পথশ্রান্তি দূর করিতে আলস্যহীন অবসর বিনোদনে মাতিল। খড়ের খানিকটা বিছাইয়া আপনমনে খড়ে খড়ে গিঁট দিতে লাগিল এবং স্বাভাবিক সংস্থাপনায় খড়ে খড়ে সেই সকল গিঁট লাগিয়াছিল তাহা খুলিতেও লাগিল পরম নিষ্ঠায়। দেখুন, শুরুতেই কী বলছে এই কাঠামো।
“এই লেখাগুলো বাড়তি কোনো রসদ জোগাবে জানি। এই লেখা ইঁদুরমাটি, গর্তের ভেতর থেকেই উগ্লে উঠবে। পালপাড়া থেকে এসে কুমোরেরা ওই মাটি ল’য়ে কোনো জেদী সন্তানের মুখশ্রী আঁকাতে চাইবে। আমি সুতোরদের মতো পেরেক ঠুকে ঠুকে কোনো দালানকোঠার আসবাবপত্রের দামি শৌখিন সামগ্রী বানাতে চাইব, কোনো গৃহিণী তাকে ধুয়ে মুছে ঘরের সৌন্দর্য বাড়াতে চেষ্টা করবে! আমি দূর হতে বাকি কবিদের রোষ ফলো করে যাবো শুধু!”
মনে পড়িতেছে একদা প্রমথ চৌধুরী কহিয়াছিলেন প্রকৃত শিল্পী শিবও গড়িতে জানেন, বাঁদরও গড়িতে জানেন। কিন্তু তাহাদের এক করিতে আর হয়না। হ্যাঁ। ইঁদুরমাটি স্বয়মপ্রকাশের সন্ধানদাতা। ঊচ্ছ্বাসে উগ্লিয়া উঠে বটে। কিন্তু কর্দমে প্রতিমা তো পাল মহাশয়ই গড়েন, নাকি? সূচনাবিন্দুতে যে পথিককে পাই, আদতে তিনি তো তথাকথিত সমালোচকই। আর সচেতনভাবে বাঁদর গড়িলে সেই বাঁদরের বাহুবিস্তারেই তাহার তন্বিষ্টতা। অন্যদিকে সচেতন শিব গড়ায় শৈবগুণেই তাহার নীলকন্ঠত্ব-ঘূর্ণি নাচন-শিবলিঙ্গতা। কিন্তু এক করিতে আর এক করিলে কাঠামোর কথা বলা হয় শুধু, করিবো করিবো বলা হয় মাত্র, করা হয় না কস্মিনকালেও। পথশ্রান্ত পথিক মোটকা হইতে ম্যাচবাকশো বাহির করিয়াছেন, দেখিতে পাইতেছি। তবে কি তিনি বিশ্রাম-বিনোদন শেষ হইবামাত্র অগ্নিসংযোগ করিবেন এই ‘খড়ের কাঠামো’-য়? না না তাহা কী করিয়া হয়? হয়তো কিয়ৎকাল কান খোঁচাইবেন ম্যাচের কাঠিতে। নতুবা নূতন কেনা স্টারলাইট প্যাকেট হইতে ধূম্রশলাকা বাহির করিয়া অগ্নিসংযোগ করিবেন। ঐ তো ঐ তো। যাহা ভাবিয়াছিলাম তাহাই হইল। অগ্নিসংযোগমাত্র শুরু হইল সুখটান। আর সুখে থাকিলে মন্দে মুকুতা পায়, চাঁদ দ্যাখে অমাবশ্যায়…।
সেই যে সনাতন প্রেম ও প্রগতিশীলতা। তাহারই টানাপোড়েন, তাহারই তত্ত্বতালাশ কবি তালাশ তালুকদারের। একদিকে প্রতিক্রিয়াশীলতা, অন্যদিকে মুক্তমন। প্রতিক্রিয়াশীলতা বারবার ফোঁস করিয়া আগুনের হলকা ছাড়িতে থাকে প্রেমের মধ্যখন্ডনরূপে। আর এই প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নীচে ব্যক্তির নাভিশ্বাস ওঠা নিয়তি, যাহা আদতে নিয়তি নহে। তাহাই তনুধিক স্বরে তুলিয়া ধরেন কবি তালাশ তালুকদার। কহেন,
“কেউ বলেছিল কি, কেউ বলেনি, শুধু মিতা বলেছিল
রোজ রোজ চুমু খেতে কেন আসো অগ্নিকে–!”
কবির অনুভূতি সাপেক্ষে বুঝিয়া লইতে হয় মনুষ্য মনের দ্বিরাচার। কবি কহেন,
“এত এত গোসলে শরীর ভেজালে–
তবু কখনোই পারলে না ভেতরের মানুষটাকে ভেজাতে।”
দাম্পত্যকলহকে দূর্নিরীক্ষণের দুরবিনে দেখিয়া তাহাকে সোপর্দ করেন সমাজ-রাষ্ট্র-রাজনীতির দ্বৈতকলহের সমান্তরালে কহেন,
“সবখানেই গনগনে আঁধার
পারলে শুকনো কাঠের তক্তাতেও ছোবল মারে”।
পথশ্রান্ত পথিকের ধূম্রসেবন দেখিতেছিলাম এতক্ষণ। সর্বশেষ সুখটানের সীমান্তে সন্দেহ জাগিয়াছিল এই বুঝি মোথাটা না-মাড়াইয়া ‘খড়ের কাঠামো’তে ফেলিয়া যাইবেন অসচেতনভাবে। আর তাহাতে পুড়িয়া পোড়াকাঠের পরাকাষ্ঠা হইবে এই কাঠামো। কিন্তু না। কবি এমন কাউকে দেখাইতে চাহেন যাহাদের একমাত্র কর্ম ‘কলার ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে’ অন্যের বিশ্বাস ভাঙ্গিবার বীরগিরি প্রদর্শন। কিন্তু পরবর্তী কবিতাতেই কবির বিশ্বাসে ফাটল ধরিয়াছে দেখিতে পাই। কবি কহেন,
‘যাদেরই খুব করে স্মৃতিতে ধরেছিলাম তারা সবাই ঠকিয়েছে আমায়, নিয়ে গেছে কাদা পিচ্ছিল পথে। কেবল মধ্যরাতের অমোঘ যৌনতা সে আমাকে ঠকাবে না কখনো জানিয়েছে।”
এই যে ব্যক্তির অন্দরমহল ও বৈঠকখানার বৈপরীত্য তাহাই যেন জনান্তিকে জানাইয়া রাখেন কবি। এই ‘খড়ের কাঠামো’র বিশেষ বিবেচ্য দিক ইহার আত্মজৈবনিকতা, অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস, প্রলাপোক্তি এবং উজ্জ্বল পঙ্ক্তি রচনার লিপ্সা। বার বার কবি কাউকে দেখাইয়া দিতে চাহেন, কিছু একটা করিয়া, কিছু একটা ঘটাইয়া। কিন্তু কে সে? এ তাহারই প্রতিপুরুষ, এ তাহারই যমজভ্রাতৃভূগোল…। ‘খড়ের কাঠামো’তে অগ্নিসংযোগাশায় বাড়াইয়া ধরিলেন অর্ধদগ্ধ ম্যাচকাঠিখানা। না, হুতভূত সঞ্চারিত হইল না। বরং বৈশাখের বিদায়ীবাতাস দমকা দাক্ষিণ্যে নিমেষে তাহা নির্বাপিত করিল। মনে হয়, দুর্দৈব নহে দৈবনির্দেশে নিশান ওড়ে।
যাহা উনিশ তাহাই বিশ। কিন্তু যাহা ঊনষাট তাহা ষাট নহে। এই যুগে উনিশ-বিশের তফাৎ তাহার আগের আভিজাত্য বজায় রাখিয়াছে। কিন্ত যাহা ঊনষাট তাহা আশি নহে হইয়াছে। জিপিএ-তে পাসমার্ক না -পাইলে কেহ অনেকানেক সমকালীন সংকলনে স্থান পায় না। তবু তাহাতে টিকিয়া থাকা হয় বটে, বাঁচিয়া থাকা বুঝায় না। অথচ তালাশের বাঁচিয়া থাকা কবিতার বিপরীতপক্ষের বিইতিহাসে। অভিষেক ম্যাচে সেঞ্চুরী হাঁকাইতে হইবে সাহিত্যের ইতিহাসে এমন বাঁধাধরা নিয়ম নাই। খোদ ক্রীড়ারাজ ক্রিকেটের রাজ-দরবারেও এহবাহ্য। আর সেইখানে কবি তালাশ তালুকদার স্বয়ং কাঠামোর তালুক বন্ধক রাখিতে চাহেন সেইখানে সূর্যাস্ত আইন মানিয়া মন্তব্য করিতে হইবে এমন শর্মা মাদল হাসান নহেন। জনান্তিকে জানাইয়া রাখা ভালো, কাহারও কাব্যগ্রন্থের বা যেকোনো গ্রন্থের উপর লিখিতে হইলে বা লিখিলেই তাহা উৎকৃষ্ট বা অত্যুকৃষ্ট বলিয়া বিনাবাক্যব্যয়ে মানিয়া লইয়াছি তাহা নহে। আবার অতি অনুরোধে ঢেঁকি গিলিয়াছি তাহাও বুঝায় না। একটি জাতিকে তাহার সকল সহোদর-সমসাময়িক সন্তানসহ স্বীয় ইতিহাস গড়িয়া লইতে হয়। আর সাহিত্য সেই ইতিহাস সৃষ্টির সহিত-সম্পর্ককারী সম্বন্ধীসূত্র। তাই বলিয়া সাহিত্য সকল শাস্ত্রের সরাসরি সম্বন্ধীর পুতও নহে। যাহাই হউক, তালাশের তত্ত্ব-তালাশই এই মুহুর্তের মনোবাঞ্ছা। উদ্ধৃতি বাড়াইতে চাহি না। উদ্ধৃতির উনিশ-বিশ কখনো কখনো বিষবৎ। কে কোথায় আলো ফেলিবে তাহাতে তস্কর এবং তারকার ভিন্ন ভিন্ন আকুতি। তথাপি তালাশের তরিকার কিছু বৈশিষ্ট্য বিবৃত করিয়া বৈশাখ-সংক্রান্তি সারিবো।
তালাশের কবিতা বিদ্রুপাত্মক। কিন্তু কেমন ধরনের বিদ্রুপ? এই বিদ্রুপ তীর্যক নহে, সরাসরি। এ অনেকটা কলতলার কলাবতীদের কাঁইজাতুল্য। শুরুর কবিতা যতটা কাব্যিকতা দিয়া শুরু ভিতরে তাহার লেশমাত্র নাই। এ যেন শুধু খড় দিয়া বাঁধা খড়াবয়ব। তাহারই কাব্যগ্রন্থের নামের নিয়তিমাত্র। ইহার ভিতরের আগুন ইহাকেই পুড়াইয়া ফেলিয়াছে। আর পোড়াইবার আগে এই কাঠামোর বর্হিদেশে আগুনের দৃশ্যরূপ থাকায় ইহাকে ইহার আকার-আয়তন অপেক্ষা অধিকতর বড়ত্ব দিয়াছে। কিন্তু দগ্ধান্তে অঙ্গারও অত্যাল্প। ইহার ভাষা প্রতিপোড়ান্তে অনর্থপাতের তলানিতে পর্যবসিত। এই ভাষা মানুষ শুধু উপস্থিত শ্রোতার জন্য বলিতে পারে। যাহা বোধ্যগম্য হয় উপস্থিতির অন্যান্য অনুষঙ্গের অরণিপাতে। যাহাতে বাচনভঙ্গির সঙ্গে অঙ্গভঙ্গিও প্রভাব ফেলে অর্থনিষ্কাশনে। এই কবিতা অভিনীত হয় অন্য কোনো অতিজীবিত শিল্পমাধ্যমে। যাহা বুঝাইবার ভাষা পায় নাই। রাখিয়া গিয়াছে তাহার উপার্জিত গোয়ার্তুমি এবং ব্যক্তিজীবনের গঞ্জনা ও গ্লানি।
এইবার পথশ্রান্ত পথিক উঠি উঠি করিতে করিতে উঠিয়াই পড়িলেন ‘খড়ের কাঠামো’ হইতে। পশ্চাৎ দেশে দূরাবাস্থায় বিদ্ধ কয়েকখানা খড় ঝাড়িয়া সাফ করিয়া লইলেন দক্ষিণহস্তে। ভুলবশত বামহস্তে ধৃত ধূম্রশলাকার মোথাখানা কি ফেলিয়াই গেলেন ‘খড়ের কাঠামো’তে? তাহাই তো দেখিতেছি। কিন্তু, তিনি তো একবারও পশ্চাতে ফিরিয়া চাহিলেন না! দেখিতেছি সেই ধূম্র শলাকার চিতাবহিৃমান শবে কিছু খড় ইন্ধন হইতে চাহিতেছে বারংবার। উস্কানি দিতেছে দগ্ধ করিতে। কিন্তু, না। কোথা হইতে এক ছাগশিশু ছুটিয়া আসিল। এতকাল জানিতাম, ছাগলে কিনা খায়. পাগলে কি-না বলে। কিন্তু আজিকে চাক্ষুষ করিলাম ছাগশিশুটি উদরে অগ্নিভক্ষণ করিল। বৈশাখের অক্সিজেনভরা অন্তিম বাতাসেও বাঁচিয়া গেল ইন্ধনিত ‘খড়ের কাঠামো’। প্রতিতালাশ তৎক্ষণে সেইখানে আসিয়া আবার পালমহাশয় হইয়া মৃত্তিকাস্থাপন করিতে লাগিলেন কাঠামোতে। দেখিতে দেখিতে তাহা পূর্ণপ্রতিমা হইতে লাগিল। আগের আকৃতি ঢাকা পড়িয়া সেই প্রতিমা যেন বা হইতে থাকিতেছিল পরবর্তী পুস্তক…। কাহাকে যেন বা কহিতে থাকিতে ছিলেন কাদামাটির কারুপাত্রটি কোথায়?
খড়ের কাঠামো।। তালাশ তালুকদার।। প্রচ্ছদ: শিবুকুমার শীল।। প্রকাশক: কুঁড়েঘর।। প্রকাশকাল: বইমেলা ২০১৩।। মূল্য: ১০০ টাকা মাত্র।