পাথর, তোমার ভেতরেও উদ্বৃত্ত
রয়েছে আর এক নৃত্য।
পাথরেও নৃত্য?
নাচ তো রয়েছেই। পরাবাস্তব দৃশ্যপটে আছে। দৃশ্যাতীত বাস্তবতায়ও আছে।
নাচে নাচে রম্য তালে। নাচে নটরাজ। নাচে শ্মশানকালী। ইলেকট্রন। প্রোটন। নিউট্রন। কোয়ার্ক।
কোনো স্থিতি নেই। আবার আছেও।
নটরাজ পরম যোগী। পাথরের মতো স্থির। মা কালীর পায়ের নিচে শবাসনে মগ্ন।
শিব যখন শব তখনই তো শক্তির জাগরণ। কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন।
এমনই স্থিতি নিয়ে বসেছিলেন বাল্মীকি।
বসেছিলেন বুদ্ধ। মুহম্মদ। শেখ ফরিদ। লোকনাথ।
প্রজ্ঞার নৃত্য জাগিয়ে তুলেছিল আবার।
অন্যরকম নাচও অবশ্য স্থিতি ভাঙে। মেনকার নাচ যেমন ভাঙিয়েছিল বিশ্বামিত্রের ধ্যান।
অনন্য এই দ্বৈততা। গতি আর স্থিতি। স্থিতির ভেতরেও গতি। অবিরাম। নিত্য।
তর্ক হয়তো চলবে। হেরাক্লিটাস আর জেনোর মধ্যে। চলুক।
কিন্তু এইসব তর্ক, তত্ত্ব আর তথ্য কবিতা নয়। কবিতা অতিরিক্ত কিছু। উদ্বৃত্ত। দ্যোতনাময়।
পাথরকে সম্বোধন করে — তাও আবার ঘনিষ্ঠতাজ্ঞাপক ‘তুমি’ দিয়ে — যখন কিছু বলা হলো, তখনই জড়পাথর একটা ব্যক্তিত্ব অর্জন করল। “তোমার ভেতরেও উদ্বৃত্ত” বলায় — ‘ও’-এর সংযোগে — অনেক না-বলা কথার ভাব চলে এল: হয়তো, ‘আমার ভেতর যেমন যুগল নৃত্য চলছে সেই রকম’; অথবা, ‘তোমার এই দৃশ্যমান স্থিতি একটা বিভ্রম’…. এই রকম অনেক সম্ভাব্য অভিব্যক্তি রয়ে গেছে। উপরন্তু, “আর এক নৃত্য” — এই আর একটা কোনটা? অন্যটাই বা কী? এইসব জিজ্ঞাসা থেকেই যায়। এই না-বলা বাণীর ঘন যামিনীর মাঝে চলতে থাকে কবিতার রহস্যময় নৃত্য।
তা ছাড়া, পাথর তো কেবলই উপলখণ্ড নয়। পাথরের সাথে মানবের প্রাচীন যোগ।
প্রত্নপাথর। নতুন পাথর। হাতিয়ার। চকমকি। সমাধিপাথর। শিলাালিপি। শালগ্রাম শিলা। রত্নপাথর।
পাথরের ওপর আদমের পায়ের ছাপ। শিবের পায়ের ছাপ। বুদ্ধের পায়ের ছাপ। কদম রসুল।
নিল আর্মস্ট্রং চাঁদ থেকে নিয়ে এলেন পাথরের টুকরা। নিউটন কুড়ালেন সাগরপারের নুড়ি।
পাথরের বুকে নাচে ইতিহাস। কিংবদন্তী। ঐতিহ্য।
আর, পাথর কেটে, খোদাই করে ভাস্কর গড়ে তুললেন অপরূপ সব রূপকল্প।
প্রতিমা। তাজমহল। অজন্তা। ইলোরা। পিরামিড। স্টোনহেঞ্জ। বামিয়ান।
পাথরেই লুকিয়ে আছে সৌন্দর্যের নৃত্যঝংকার।
এইসব নিযুত-অর্বুদ ভাবের অনুষঙ্গে পাথর শব্দটা মোড়ানো। চেতনে-অবচেতনে-নির্জ্ঞানে।
কবিতা সেইসব ভাবানুষঙ্গকে উসকে দেয়। নাচিয়ে দেয়। গোপনে গোপনে।
নাচিয়ে দিয়েছেন শহীদ কাদরী। কী জানি! কী জানি!