(পূর্বপ্রকাশিত-র পর)
অচল হীরকের জাগে সচল রত্নরীতি দিকে দিকে…
কত অলৌকিক ঘটনা ঘটে এই লৌকিক দুনিয়ায়! বাস্তবতার রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হয় কত অবাস্তব নাটক! কিন্তু মহাস্থানগড়ের এই এলাকাটুকুতে মাঝেমধ্যে এমনসব ঘটনা ঘটে যেগুলি একাকার করে দিয়ে যায় লৌকিক-অলৌকিকের ভেদরেখা। পেরিয়ে যায় বাস্তব-অবাস্তবের সংজ্ঞা ও সীমানা। এইসব অবাক-অচেনা ঘটনায় লোকে এতটাই বেকুব বনে যায়, হয়ে পড়ে এতটাই বিহ্বল যে, ওগুলিকে তারা ঠিক কোথায় ঠাঁই দেবে– সংবাদে, ইতিহাসে, রূপকথায়, নাকি কিংবদন্তিতে– স্থির করতে পারে না। তাই তারা মহাস্থানের চালু ইতিহাস আর প্রচল কিংবদন্তির আড়ালে ঢেকে রেখে দেয় এইসব অতিপ্রাকৃতিক ঘটনাপ্রবাহকে। এমনকি বগুড়ার বাইরে থেকে যারা আসে, পর্যটন, প্রশাসন বা গবেষণার কাজে, তারাও কী এক অজ্ঞাত কারণে বেমালুম চেপে যায় সবকিছু। মনে হয় কখনো কিছুই ঘটেনি, আর আমরাও দেখিনি কিছুই।
একবার প্রকাশ্য দিবালোকে আকাশ অন্ধকার করে নেমে আসে পাখির বিশাল বিশাল ঝাঁক। আবাবিল পাখি নয়, তবে তাদের মতোই ছোট ছোট, অসংখ্য, অগণিত। বৃষ্টির মতো তারা ঝেঁপে পড়ল লালে-লাল হয়ে থাকা মরিচের মাঠে। পাখিদের ঠোঁটগুলি লাল, ডানায় ছোপছোপ লালের মাঝে সবুজ-সবুজ পালক। মাথায় ছোট্ট সবুজ ঝুঁটি। মরিচ খেতের মরিচ লাল, পাতা সবুজে-হলুদে মেশামেশি। পাখি আর মরিচগাছের এক অদ্ভুত ম্যাচিং। রঙের অভূতপূর্ব ঐকতান। প্রতিটি মরিচগাছে অন্তত তিনচারটি পাখির ডানা ঝাপটানো আর দ্রুত ঠুকরে ঠুকরে লঙ্কাভক্ষণ…। কিন্তু ক্ষণস্থায়ী এই কাইনেটিক আর্ট। পাতাঝলমলে তুঁতগাছে তুঁতপোকা ছেড়ে দিলে যেমন মুহূর্তের মধ্যে সব ডালপালা পুরোপুরি নাঙ্গা, নিষ্পত্র হয়ে যায়, তেমনই এই নব্য আবাবিলের ঝাঁক কয়েক মিনিটের মধ্যে সম্পূর্ণ মরিচশূন্য করে ফেলল মাঠকে মাঠ। তাজ্জব ব্যাপার! তবে তাজ্জবের আর দেখলেন কী! আরো তো বাকি। মরিচখেত সাবাড় করে ঝাঁকের পর ঝাঁক উড়ে গিয়ে পড়ল পাশের পাকা ধানের খেতে। লঙ্কাকাণ্ডের পর এবার ধান্যকাণ্ড। ধানখেতে গিয়েই পাখিগুলি সব হাই তুলতে শুরু করে দিল চঞ্চুব্যাদান করে। বগুড়ার মরিচ– যখন পাকতে থাকে, ঝাঁজ বাড়তে বাড়তে পৌঁছে যায় এমন এক পর্যায়ে, যেখানে লঙ্কার ঝালাঙ্ক গিয়ে মিলে যায় তার দাহ্য তাপমাত্রায়। তখন মরিচ আর তার উগ্র দাহিকাশক্তি হয়ে ওঠে অভিন্ন, অভেদ। মরিচ কথা বলে ওঠে আগ্নেয় ভাষায়। লঙ্কার সেই দহনঝাঁজের প্রভাবে পাখিদের চঞ্চু আর জিহ্বা থেকে ছুটল ছোট-ছোট আগুনের ফুলঝুরি। নিমেষে আগুন ধরে গেল পাকা ধানের মাঠে। চাষীরা রোপণ করেছিল মরিচের গাছ, এখন লোকন করছে সরিষার ফুল! পাখির ঝাঁক উড়ে উঠল ফের। আকাশটা যেন ছেয়ে গেল ঘন কালো মেঘে। নেমে এল রাহুগ্রাসের অন্ধকার…সেই অন্ধকারের মধ্যে মাঠের ধানপোড়া ভস্মের ভেতর ফুটে উঠল অজস্র শাদা-শাদা খই। লোকে ভাবল শেষ হলো বোধহয় এই গজবনাট্য। কিন্তু না, এ-দৃশ্যও ক্ষণদৃশ্য; ঝাঁক আবার নেমে এলো মাটিতে। নেমেই খুঁটে খুঁটে সাফ করে খেয়ে ফেলল সব খই। ভুরিভোজের পর পাখিদের খানিকক্ষণ বিরতি। তারপর আবার উড়াল। এবার সত্যি-সত্যি বিদায়। রাহু কেটে গেল, হেসে উঠল আলো। পরে একসময় দিনের আলোও নিভে এল। সন্ধ্যা নামল। মহাস্থানের মানুষ দাঁড়িয়ে রইল মহাস্তব্ধ হয়ে, মাঠ ঘিরে, অর্ধবৃত্তাকারে। তেলেসমাতির মতো মাঠকে মাঠ লাল মরিচ, পাকা ধান, নিমেষে সব ফৌত হয়ে গেল একবারে! গুঁড়িয়ে-দেওয়া, গায়ে-হিমধরানো ভয়মেশানো বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই গ্রামবাসীদের আবার অবাক হবার পালা। সেদিন ছিল প্রতিপদ তিথি। প্রতিপদের সময় লোকে শোলক কাটে ত্রুটিপূর্ণ ছন্দে– ‘আইজ প্রতিপদ কাইল দ্বিতীয়া / চান উঠব আসমান গুতিয়া।’ তো, সেই প্রতিপদের রাতে, অন্ধকারের মধ্যে গ্রামবাসী তাজ্জব তাকিয়ে দ্যাখে, মাঠভর্তি ছাইয়ের ভেতর ছোট্ট ছোট্ট অসংখ্য রত্নদানার মতো কী যেন সব জ্বলজ্বল করছে। ভয়ে ভয়ে কাছে যায়, দ্যাখে– অজস্র হিরার টুকরা। হীরকবিন্দুগুলি থেকে অন্ধকারেই বিচ্ছুরিত হচ্ছে বহুতল বর্ণালী-বর্ণমালা। পাখি খেয়ে গেল মরিচ আর ধানপোড়া খই, রেখে গেল রত্নদানা, পুরীষ আকারে। কেমনে কী, কী বৃত্তান্ত কিছুই না বুঝে মহাস্থানের বিস্ময়জব্দ মানুষেরা অন্ধকার রাতে পোড়া মাঠে ছড়িয়ে-থাকা ছাইয়ের ভেতরে রত্ন কুড়ানো শুরু করে দেয়।
ওগুলি আসলেই হীরকখণ্ড। কিন্তু কীভাবে? মাজেজাটা জানা গেল পরে। রহস্যময় ওইসব পাখি যখন আহার করে, তখন তাদের পেটের ভেতর ঘটতে থাকে এক জটিল আন্ত্রিক আলকেমি। মাটির গভীর নিচে তাপে চাপে নিষ্পেষণে দিনে দিনে বৃক্ষের কার্বন হয়ে যায় কয়লা, আরো-আরো তাপে চাপে আরো বহুকাল পরে ওই কালো-কুৎসিৎ অঙ্গারই ফের রূপান্তরিত হয় জ্বলজ্বলে হীরকে। সেই একই সিলসিলায়, একই প্রক্রিয়ায় পাখির পাকস্থলির রসায়নের দাপটে এমন তাপ ও চাপের সৃষ্টি হয় যে ওই মরিচের কার্বন, খইয়ের কার্বন সব রূপান্তরিত হয়ে যায় কাঁচা হিরায়। তবে ভূগর্ভে যে-প্রক্রিয়া চলে হাজার-হাজার বছর ধ’রে, পাখির পেটে তা ঘটে যায় বড়জোর আধা-ঘন্টায়। রহস্য-পাখির পেটে-পেটে যে এত রস রহস্য রসায়ন, এত তেলেসমাতি, কে জানত! শোনা যায়, এরকম ঘটনা নাকি ওই একবারই ঘটেছে দুনিয়ায়।
এরপর থেকে দেখা গেল মহাস্থানের বউঝিদের নাকফুলে, কানের দুলে হিরার কুচি। ভেরুয়া টাইপের আলসে ঘরজামাইদেরও আংটিতে হীরকদানা… এমনকি ঠিকমতো খেতে পায় না, কিডনি বেচে ঋণ শোধ করে মহাজনের, এমন ফ্যামিলিতেও আছে হিরার অলঙ্কার। হিরার টুকরাগুলি খনিজ হিরার মতোই বহুতল। বিচ্ছুরণও হয়, কিন্তু কেমন যেন দুইনম্বরি-ভাব, অতটা শক্ত নয়, কাচ কাটা যায় না ঠিকমতো। এই হিরা তাই অলঙ্কারে সচল, কিন্তু বাজারে অচল। অচল হিরার জাগে সচল রত্নরীতি দিকে দিকে…।
(চলবে…)