(পূর্বপ্রকাশিত-র পর)
মধু ও বিষাদের ঐকতান…
এ অঞ্চলে যে কত মধু ও বিষাদের ঐকতান, বেদনা ও হাসাহাসির অর্কেস্ট্রা, ইয়ত্তা নাই তার। ওই যে কার্তিকের জ্যোৎস্নায় শিশিরভেজা নাড়ার খেত মাড়িয়ে হেঁটে চলেছে অসমবয়সী দুই মানবসন্তান। পিতাপুত্র। পিতা ছাত্তার। পুত্র ডেভিড; ছেলেবেলার নাম মোস্তফা। বহুবছর পর দৈবাৎ দেখা বাবায়-ছেলেতে। ফিরে-পাওয়া ছেলেকে নিবিড় অপত্য স্নেহে ভিজিয়ে একাকার করে দিতে চাইছে পিতা। দেখা হবার পর থেকেই একনাগাড়ে ভাবাবেগ দিয়ে, বাৎসল্য দিয়ে কতরকম চেষ্টা করছে পুত্রের ভেতর রিশতাভাব জাগিয়ে তুলতে। শৈশবের কত কথা, কত স্মৃতি জাগিয়ে তুলতে চাইছে পুত্রের মনে। কিন্তু যোগাযোগ হচ্ছে না কিছুতেই। অচেনা বেদনায় বিমর্ষ হয়ে পড়ছে বৃদ্ধ বাবা, তবু হাল ছাড়ছে না। খুব ছোটবেলা থেকেই ছেলে বিদেশে, পড়ালেখা করেছে অনেক, তাই হয়তো সমীহাবশত হাইস্কুল-পাশ বাবা শুদ্ধ ও প্রমিত বাংলায় ছেলের সঙ্গে খুব মিস্টি করে কথা বলছে। অবশ্য মাঝে-মধ্যে ছুটে যাচ্ছে তার প্রমিত ভাষাভঙ্গি। ছেলেকে মোস্তফা বলবে নাকি ডেভিড বলে ডাকবে, আপনি বলবে না তুমি বলবে, এইসব দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে ছাত্তার অবশেষে… “আহা! কতদিন পর দেখা! এতকাল কোথায় থাকা হলো বাবা, কীভাবে আসা হলো, পথে কষ্ট হয় নাই তো” এভাবে কথা বলতে থাকল ভাববাচ্যে। পরক্ষণে আবার ছেলের সঙ্গে আপনি-আপনি করতে লাগল। ছেলে বলে উঠল, “আব্বা, আমি মোস্তফা, আপনাদের হারিয়ে যাওয়া ছেলে, বহুকাল পর পালিয়ে ছুটে এসেছি… এইভাবে কথা বলছেন কেন, আব্বা, আমার সাথে?” পুত্রের আন্তরিকতায় পিতা একটু একটু করে ভাববাচ্য থেকে সম্বোধন বাচ্যে আর আপনি থেকে তুমি, তুমি থেকে তুই-য়ে নেমে এল।
ডুগডুগির মেলা থেকে ছাত্তার মিয়া ঘুরিয়ে নিয়ে এল ছেলেকে। “তোর কি মনে পড়ে বাবা, তুই যখন ছোট, তোকে একটা শোলক শিখায়েছিলাম, ধাঁধা দিয়া শোলক..! তোর মা যখন তোর নানির পেটে, তুই তখন কোথায় ছিলি, বল তো?… পারলি না? মা যখন নানির পেটে/ আমি তখন ডুগডুগির হাটে//। এই হলো সেই ডুগডুগির হাট। একবার হলো কি, মেলায় খুব ভিড়। তুই আমার পিছন পিছন। হঠাৎ কী হলো, আমি হারিয়ে ফেললাম তোকে। মনে পড়ে, মোস্তফা? সন্ধ্যা পার হয়-হয়। বহুৎ দূরের পথ। মেলার মধ্যে আমি তোকে খুঁজি, তুই আমাকে…কেউ কাউরে পাই না… পাই না তো পাই-ই না। পরে, এই মেলার মধ্যে ওই যে অর্জুন গাছ, ওইটার তলায় বসে তুই কানতেছিস আর আ-ব্বা আ-ব্বা… বলে জোরে জোরে ডাক পাড়ছিস। তখন ইল্লৎ হকসেদ− মনে আছে নাকি বাবা, হকসেদের কথা?− মেলার মধ্যে কোত্থেকে-না-কোত্থেকে এসে তোকে দেখে বলে, “কীরে, আব্বা-আব্বা কইয়া ডাক পাড়তাছস, মেলার মধ্যে তো কত আব্বা! ছা-ত্তা-র… ছা-ত্তা-র… কইয়া জোরে জোরে ডাক দে, দেখবি তর বাপ তরতরায়া ঠিকই আয়া পড়বো।” আর বাবা তুই হকসেদের কথামতো আমার নাম ধরে ডাকতে শুরু করেছিস আর আমি পেছন থেকে এসে তোর কান মলে দিয়েছিলাম আচ্ছা ক’রে। হা হা হা… তখন তোর সে কী কান্নামিশানো লজ্জা! মনে পড়ে, মোস্তফা?”
চাঁদনি রাতে হেমন্তের আকাশে দুচারটি হালকা শাদা মেঘের চিলতে। অনেক দূরে দূরে। আঙুল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাবা নামিয়ে আনছে সেই মেঘ ছেলের মাথার ওপর। এক তুড়িতে শাদা মেঘকে নীল করছে, ফের নীল মেঘকে লাল বেগনি কমলা…। রঙিন মেঘের ছেঁড়া-ছেঁড়া ছ্যাঁকড়া-ছ্যাঁকড়া অংশ ক্যান্ডি ফ্লসের মতো আটকে থাকছে রাংচিতা ঝোপের ওপর। কিছুটা আটকে থাকল খেসারি-খেতের কাঁটা-কাঁটা কুসুম্বা-ঝাড়ের বেড়ার ওপর। আর কিছুটা ছেলের চুলে। প্লাবিত জ্যোৎস্নালোকে খুব কাছ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে সওয়ারিবিহীন এক জাদুর গালিচা। বাবা তা লাফ দিয়ে ধরে নামিয়ে এনে তার ওপর ছেলেকে উঠিয়ে নিয়েছে। বাতাসের ঢেউয়ে দুলতে দুলতে গালিচা ভেসে চলেছে বড় পিরের ধাপ থেকে নিতাই ধোপানির পাট…। গালিচা এক্সপ্রেস। ধোপানির পাটে এসে নেমে পড়ল পিতাপুত্র। গালিচা সাঁই করে উড়ে জ্যোৎস্নাকুয়াশার ভেতর মিলিয়ে গেল দূরে। ছেলে খুব অবাক হচ্ছে, পুলক বোধ করছে, কিন্তু কেমন-যেন ঠিক যোগাযোগ হচ্ছে না।
ওই যে লম্বা এক তালগাছ, পাশে জিন্না ভাইদের বাড়ি, একাত্তরে যুদ্ধের সময় মিলিটারিরা প্রথম এসেই এখানে একই বাড়ির সাত-সাতজনকে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরে ফেলেছিল, চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছিল মহাসন্ত্রাস। পাশেই প্রাচীন এক বৌদ্ধ গুম্ফার ধ্বংসাবশেষ। লোকে বলে, বেহুলা-লখিন্দরের বাসর ঘর। যুগ-যুগান্তরের ইতিহাস ও কিংবদন্তির ধূলি আর ঘাস জমে জমে রূপান্তরিত হয়েছে বিশাল এক স্তূপে, ছোটখাটো টিলার মতো। বাবা বলছে, ‘তোর মনে আছে মোস্তফা, একবার পাল্লা দিয়েছিলাম তুই আর আমি, দেখি কে আগে উঠতে পারে ওই টিলার উপর। মনে পড়ে, বাবা? আমি আগে উঠে পড়েছিলাম। তুই ছোট্ট-ছোট্ট হাত-পা দিয়ে টিলার ঢাল বেয়ে উঠে আসছিস আর কাঁদছিস। হেরে গিয়ে তোর সে-কী রাগ! কাঁদতে কাঁদতেই বলছিলি তুই, “বড় হই আগে, তখন দেখো তোমাকে ঠিক হারায়ে দেবো। বাবা, আজ তুই কত বড় হয়েছিস! আমাকে তো একদম গো-হারা হারায়ে দিয়েছিস রে বাবা। এক্কেবারে মহাজব্দ হয়ে বসে আছি!” বাবার কথা শুনে ছেলের ভালো লাগছে, ছেলে খুশি হচ্ছে, স্মিতমুখ বালকের মতো তাকাচ্ছে বাবার দিকে বারবার, কিন্তু ঠিক যোগাযোগ হচ্ছে না।
ভালো থাকবে, ভালো খাবে, মানুষের মতো মানুষ হবে এই আশায় বুকে পাথর বেঁধে এনজিও-র এক বিদেশিনীর হাতে শিশুপুত্রকে তুলে দিয়েছিল দারিদ্র্যজর্জর বাবা-মা। আর তুলে দেবার পরপরই এক অবাক অচেনা নিঃসঙ্গতা, এক অদ্ভুত বোবা ব্যথায় যারপরনাই কাতর হয়ে পড়েছে তারা। ছেলেকে ফিরিয়ে আনার জন্য কত কান্নাকাটি, কত কাকুতিমিনতি…। বিদেশিনী তো পালকপুত্রকে নিয়ে উড়ে চলে যাচ্ছে জার্মানি। অসহায়, পাগলপ্রায় মা-বাবা ঠিকানা জানে না, পথ চেনে না…তবুও উদ্ভ্রান্তের মতো হাহাকার করতে করতে জলাজংলা ঝোপঝাড় কাঁকর কাঁকড়া ক্যাকটাস আর ফাটাফাটা ভূগোল পেরিয়ে ঢাকার জাহাজঘাটা পর্যন্ত চলে এসেছিল, একজনকে হাতেপায়ে ধ’রে। কিন্তু ছেলেকে পেল না অল্পের জন্য। অ্যালুমিনিয়ামের এক বিশাল পাখি তার পেটের মধ্যে ছেলেকে উঠিয়ে নিয়ে উড়ে চলে গেল এক না-ফেরার দেশে, বেশ কিছুক্ষণ আগে। যারা দেখেছে পুত্রহারা মা-বাবার সেই ব্যথাজর্জর কাতরতা, কিছুটা হলেও তারা জানে বেদনার মাত্রা হতে পারে কতটা তীব্র!
সন্তান ক্ষয়ে ঝরে গেলে মনকে তবু প্রবোধ দেওয়া যায়, কিন্তু নিজের দোষে অল্পের জন্য চিরতরে হারানোর ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছে না কিছুতেই। আহা! ছোট্ট আদর-কাড়া মায়া-মায়া চেহারার ছেলেটা মা-মা ব’লে না-জানি কতবার কাতরে উঠেছে, কাঁদতে কাঁদতে পেছন ফিরে তাকিয়েছে কতবার! বিচ্ছেদ ও অনুশোচনার তাপে মা-টা কিছুদিনের মধ্যেই পাথর হয়ে গেল। শোকে, তাপে, ভগ্নহৃদয়ের অসুখে কয়েক মাসের মধ্যেই মারা গেল শোকাতুরা মা। হৃদয়ে জখম নিয়ে আধপাগলা হয়ে বেঁচে থাকল বাবা।
তারপর, বহুদিন পর শিকড় খুঁজতে খুঁজতে জার্মানি থেকে নানা দেশ ঘুরে উড়ে এসেছে ছেলে। সন্ধানও পেয়েছে তার আকাঙ্ক্ষিত ছেঁড়া শিকড়বাকড়ের। পেয়েছে বাবাকে, কিন্তু পায়নি মাকে। ছেলে আজ বড় হয়েছে, ‘মানুষের মতো মানুষ’ হয়েছে। কিন্তু বাবায়-ছেলেতে যোগাযোগে গোলযোগ! মর্মে-মর্মে পুড়ে যাচ্ছে বাবা, হয়তো ছেলেটাও…
(চলবে…)