৩.
ফ্লাইট দেরী করে নি, শুধু মুষলধারার বৃষ্টিদিন ছিল। নিধি রোদ ভালোবাসে– ফুপু জানে। মন্ট্রিয়ালে কি রোদের কমতি? আসলে ন্যাপথলিনের ঘ্রাণগন্ধী বারোমাস সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে ইচ্ছে করে নিধির। এয়ারপোর্টে নেমে বৃষ্টির ওজনদার ফোটা থিতিয়ে আসা ঘুষির মত গায়ে লাগলে সে ইচ্ছে আরো জোরদার হয়েছে।
–‘এই কয়দিন ভালো রোদ দিতেছিলরে নিধি! ফুপু বলে-‘কালকেই দেখবি আবার খটখটা, এইটা হইল আমাদের ট্রপিক্যাল দেশ, বুঝলি’–নিধিদের স্কুলে ভুগোল শেখাতো ফুপু।
এয়ারপোর্টের এ্যারাইভাল গেটে দাঁড়িয়ে থাকা আধভেজা ফুপুকে দেখে নিধি তাদের এতদিন না দেখা দিনগুলো কল্পনা করতে চেয়েছে, যেন তা করলেই সব দৃশ্য সামনে এসে হাজির হবে। বারোয়ারী শখ! আর একটু অবাক হয়ে গেছে, দেখে যে ফুপুরও খুব পেছন বাতিক আছে। নইলে এই বাদলায় কেউ জামদানী গায়ে চাপায়? হোক না তা ভাইঝি এই পেয়ারা রং শাড়িটা দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে কিনে দিয়েছিল! নিধি ভাবছিল এ নিয়ে ফুপুকে একটু খুঁচিয়ে দেবে, কিন্তু তার স্নাত মুখে অপ্রস্তুত হাসির সঙ্গে ত্বকের ভাঁজ, যেন ভাজা মাছ নতুন চুরি করে খেতে শেখা বন-বেড়াল–, দেখে, এতদিন পরে আর কিছু বলে না।
পুরানো অভ্যাস নিজেরও মনে আছে– আর সেইমত আঁচলের কোনা আঙ্গুলে জড়ায় নিধি। ফুপু কৌতুহলী, ঝুঁকে আসে, যেন বুক ঠেলে উঠে আসে ‘আহা রে’ ভাব! নিঃশব্দে হাসে নিধি–কাঁচের বৈয়ামে আচারের তেলের মত থিতিয়ে আসা, গম্ভীর হাসি। পরিপক্ক আনাজের মত ফুপুর এই মুখভাব সে চেনে, এই ‘আহা রে, আহা রে’ সঙ্গে সেঁটে থেকে থেকে তাকে বড় করে তুললো।
গাড়ির খোলা দরজা দু’খাবলা পানি ছিটিয়ে নিধিকে বসিয়ে দিলো ভেতরে। চলতে শুরু করলে নিধি জানতে চায়–‘আমের সিজন আছে এখনো’? না, নিশ্চয়ই ফুপু তাকে শুধু আনারস, আমড়া, চালতা, কুমড়া এসব খেয়েই চলে যেতে দেবে না। আম খুঁজলে পাওয়া যাবে নির্ঘাত, আজকাল কত কত সুপারষ্টোর, গ্রোসারী হয়েছে এই শ্যামলীতেও। কোথাও কোন একটাতে নিধির প্রিয় লিচু আর আম্রফলের সন্ধান নিশ্চয়ই থাকবে। আম কিন্তু মন্ট্রিয়ালেও পাওয়া যায়, তবে সেসবে মন ভরে না। সূর্যাপুরী আমের মিষ্ট নধর শাসে মন মজেছে নিধির।
ভাই ঝি’র না ঘুমানো ফোলা চোখের দিকে চেয়ে থাকে ফুপু। কতদিন পরে দেখছে তারা একজন আরেকজনকে। অদেখা এই দিনগুলিতে ফুপু বুড়িয়ে যায়নি বললে বোকা বোকা শোনায়। আর নিধির মুখে অভিজ্ঞতার ছাপ!
চুল অনেকটা কেটে ফেলেছে নিধি। হাতের নখেও সযত্নের ছাপ। মুখের বেয়াড়া ব্রণের দাগ মিলিয়ে গিয়ে কি মসৃণ আর কোমলই না হয়েছে মেয়েটা! ওর পরনের সূতীর স্কার্টের ওপরে হাতিয়ে আদর করে ফুপু। মুষ্টিবদ্ধ হাতের ছবিঅলা টি-শার্ট, অনতিদীর্ঘ ওড়না চটকে আদর করতে ইচ্ছে করে। এতটুকু একরত্তি মেয়েটা কত বিপত্তি দেখে দেখে বাইরের দুনিয়ায় একলা একা চলে ফিরছে,–অবাক লাগবে না তার ফুপুর? না লাগে না। নিধিই একবার অয়নকে নিয়ে ক্রন্দনরত ফুপুকে খহলিল জিব্রানের কবিতার কোটেশন পড়ে পড়ে শুনিয়েছে- ‘দে কাম থ্রু ইয়ু বাট নট ফ্রম ইয়ু’। এমনতর কত অমূল্য শিক্ষাদীক্ষাই যে ফুপুর বাড়ির জিনিষে ঠাসা ঘরে বন্দী থাকতে থাকতে বাতিল হয়ে যাচ্ছে। এখন নিধি ফুপুকে আঁকড়ে থাকতে পারলে ভালো হতো, দূরে থাকলে কি হয়, অয়নের প্রায় সমবয়েসী হলে কি হয়, নিধিকে নাকি ফুপু পেয়েছিল লটারী জেতার মত, পরিশ্রম ছাড়া বিনা আয়াসে।
ফুপুর লুকোছাপা নেই, দীর্ঘনিঃশ্বাস সে দেখিয়ে দেখিয়ে নির্ভার হয়ে ফেলে। বিশেষ করে গত কয়েক বছর ঢাকা শহর নিজের ক্ষয়াটে, পোড় খাওয়া জীবনে জড়িয়ে গিয়ে যত ভার চাপিয়েছে তার বুকের ওপর, নিধিকে কাছে পেয়ে তা উড়ে যাচ্ছে– যেন ফুরফুরে চালবিহীন ধানের চিটা।
নিধি চোখ বড় করে সোজা হয়ে বসে– ‘জানো এই জামাটা কোথায় পাইছি? মেইড ইন বাংলাদেশ! ওয়ালমার্টে দেইখাই কিইনা ফেললাম। একটা কিচেনের এপ্রণ কিনলাম সেইদিন- ইয়েস, মেইড ইন বাংলাদেশ, এখন সব দোকানে ভর্তি… দাঁড়াও দাঁড়াও আরেকটা জিনিস দেখাই,’… নিধি হাসিমুখে হাতব্যাগটা উঁচিয়ে ধরে,‘দ্যাখো…’ দাঁতের ঝকঝকে সারি ছাপিয়ে ফুপুর মনে পড়ে নিধির ছোটবেলার ক্যাভেটি আক্রান্ত দাঁত। খাকি-তামা রং ক্যানভাসের চৌকোনা ব্যাগের ওপরে প্রিন্ট করা চে-গুয়েভারার হাসিমুখ, চুরুট।
…‘চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়, চে…’ , ফুপু ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে স্কুলের খাতা দেখে আর নিধি বিছানায় উপুড় হয়ে থাকে, একসঙ্গে কাটানো তাদের দু’জনের মহার্ঘ সময়। ক্যাসেটে সুনীলের কবিতা আবৃত্তির ধীর ললিত কন্ঠ ঘরের ভেতর চড়ে বেড়ায়। নিধির মা’র সঙ্গে আর একটা পুরুষ কণ্ঠ। মা কলেজে থাকতে আবৃত্তির গ্রুপে নাম লিখিয়েছিল। ঘরোয়া টেপরেকর্ডারে ধারণ করা, অপটু ব্যাকগ্রাউন্ডে তানপুরা বাজে। ফুপু আর সে শুনতো আর ভাবতো এই অগতানুগতিক যৌথ আবৃত্তির কারণ কি (পুরুষ কন্ঠে এই কবিতা বেশী মানানসই–এমন ভাবার রেওয়াজ ছিল, এখনো আছে হয়তো)। হাতে নাম লিখে পেন্সিল স্কেচ দিয়ে কভার করা। বহু ব্যবহারে আবৃত্তিকারদের নাম নিশানা মুছে গিয়েছিল, একসময় কভারটা হারিয়েও গিয়েছিল, ক্যাসেটটা শুধু নিধির সঙ্গে সঙ্গে এখান থেকে ওখান করতো।
–‘ডিসেম্বরে মেক্সিকো গেলাম যে, ঘুরবো? কিভাবে! নিকোলাসের এত শরীল খারাপ হইল যে হাসপাতালে নিতে হইছিল। যে হাসপাতালে নিতে পারলাম জানো সেইটা কোনটা! সেইখানে চে’ কাজ শুরু করছিলো। ভাবতে পারো ফুপু, আমার মনে হইছে নিকের অসুখ হওয়াও সার্থক! (নিক এর কথা সামনা সামনি উচ্চারণ করে ফুপুর মুখের ভাংচুর দেখার ইচ্ছা হয় নিধির)। আর সারাক্ষণ এই কবিতার আবৃত্তি খালি মনে পড়ছে। মনে আছে কত গল্প করতাম আমরা! কেন জানি মনে হইতেছিল চে’র সঙ্গে আগে দেখা হইছে…’। এই প্রসঙ্গের উল্লেখে ফুপুর চেহারায় অস্বস্তির রেশ। কপালের দৃশ্যমান ভাঁজ আর চুলের কুঞ্চনের কাছে বয়সী রোমান্টিকতা বেপরোয়া মনে হয়? তবুও ফুপুর আরো সামনের দিকে ঝুঁকে আসা হাসিমুখ-‘দেখাতো হইছেই, তা নইলে কি আর তুমি তার এত ভক্ত হও!
আর্ট কলেজে পড়ার সময় চে’গুয়েভারার জীবনী’র একটা ঝরঝরে বই অনেকদিন নিধির নিত্যসঙ্গী ছিল (একটা মাত্র শোনা কবিতা বিশাল এক মহাজীবনকে জানার উৎসাহ উস্কে দিতে পারে তাহলে!)। আর সেই ঢ্যাঙ্গা, মুখে ফ্যানা তুলে কথা বলা খালেদ ইউসুফের কথাও বলে ফেলবে নাকি যে তাকে গুচ্ছের এইসব বই সাপ্লাই দিতো (নহে নহে প্রিয় এ নয় আঁখিজল, প্রেমও তো নয় কমরেড)! সজোর কষায়িত সেইটুক পাঠ কাজে দিয়েছে, এখনো এ সংক্রান্ত কিছু পেলে নিধি জমায়, আর প্রয়োজনমাফিক রেফারেন্স দিয়ে কথা চালালে নিজেকে স্মার্ট লাগে, আরো খোড়ার ইচ্ছা তৈরী হয়। এইতো গেলো মাসে ইউটিউবে চে’র নিজের কন্ঠে আবৃত্তি’র লিংক আবিস্কার করে কী উত্তেজিত নিধি! চে’ হাসতে হাসতে বলছে-‘ কবিতাটা আমি না, কোন সাহসী কবি লিখেছে, আমার স্মরণশক্তি বেশী সুবিধার না, তবু বলছি… ‘ভালোবাসা আর দয়া দিয়ে ক্ষেতের ফসল পাকানো যায় না’, স্পেনিয় ভাষার এক ঝলক হাওয়া মুহূর্তে বইতে শুরু করে দ্রুতই হারিয়ে যায়, জেগে থাকে সুদর্শন চে’।
নিকোলাস বলে-‘হি ওয়াজ এ্যাবসোলিউটলি আ গুড লুকিং ম্যান, এ্যামেজিং পার্সোনালিটি! একজন বাড়ির রং মিস্ত্রীর কাছে (নিককে কখনো কারুর কাছে নিজের স্মার্টনেসের ভাইবা দিতে হয় না) মেক্সিকো বা কিউবা সপ্তা খানেকের রিল্যাক্সেশন ছাড়া বড় কিছু না, নিধি ওকে ঘাটায় না, আপনাতে আপনি বিভোর যদি থাকা যায়। কত কাঠ খড় পুড়িয়ে এই আড়াল শেখা! না হলে মন্ট্রিয়াল মিউজিয়াম অফ ফাইন আর্টস এর দু’সপ্তার ওয়ার্কশপে আসার ভিসা নিয়ে ক্যানাডা এসে একেবারে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত কি নিধি নিতে পারে!
(চলবে)