পর্ব-১।। পর্ব-২।। পর্ব-৩।। পর্ব-৪।। পর্ব-৫।।
দেশে এসে পৌঁছার আগেই নিধি স্থির করেছিল এবার সব পুরানো বাক্স টাক্স হাঁটকে দিয়ে দেখবে। ‘জীবনের ধন কিছুই যায়না ফেলা’–আপ্তবাক্যে বিশ্বাসী ফুপুর বাড়িতে একবার ঢুকে পড়লে কোন বস্তু ফেলা হয় না– এটাই ভরসা। তাছাড়া, নিধি চায় ফেরত পেতে, মায়ের ড্রাগনমুখো নাইটির ঘোর, আজমত কাকার হাত ধরে লাফিয়ে হাঁটা, বাবার তোলা ছবিগুলি, সব। আর অতি অবশ্যই চিঠিগুলি, যেগুলি একটা খামবন্দী পুরানো স্কুলব্যাগের ভেতর পকেটে থাকতে থাকতে রং জ্বলা হচ্ছিল তার দেশ ছাড়ার আগে থেকেই। কেউ দেখে ফেলার আতংক, অভিমান আর কী এক অনুচ্চারিত নিষেধ তাকে সেই চিঠিগুলির কাছে ঘেষতে দেয়নি। আছে, নিরাপদে আছে, নিজের কাছে না থাকলেও নিরাপদে আছে- এরকম এক অলস নিশ্চিন্তি নিয়ে নিধি পড়া আর ছবি আঁকা নিয়ে থাকলো। ততদিনে ক্লাসের জিনিয়া চাকমার সঙ্গে বন্ধুত্ব ঘন হয়েছে। লাউ ফুলের মত দেখতে জিনিয়া তাকে নিজের বাড়ি বেড়াতে নিতে চায়। ডিজাইন কোর্সের এয়্যাসাইনমেন্ট সঙ্গে নিয়ে জিনিয়ার সঙ্গে বান্দরবান যাওয়ার কথা ফুপুকে বলাতে প্রথমে গাইগুই করেছিল। অয়ন আরেক কাঠি ক্ষাপ্পা– ‘ওইসব গারো চাকমারা সাপ ব্যাং খায়, যা তুই মরতে’। ফুপুর সেসব পরোয়া না, মুখের হাসি নিবিয়ে দিয়ে বলে– তোর বাপের পারমিশন নিলে ভালো হইতো না?’ মুখ শক্ত কালো করে সেই যে ফুপুর বাড়ির দোতলা থেকে নামে নিধি, দু’সপ্তা বান্দরবানে কাটিয়েও আর ফুপুর বাড়িমুখো হয় না। জিনিয়া চাকমার বাবার ব্যাবসাপাতি আছে, তিনচারটা ট্রলার সাঙ্গু, মাতামুহুরী দিয়ে ভাড়া খেটে সাগরে যায়, আবার ফিরে আসে। টিলার ঢাল বেয়ে মাটি আর বাঁশ কাঠের বাড়ি। সকালে ঘুম থেকে উঠে জিনিয়ার মা’এর বানানো গুড়ের চা খেয়ে স্ক্র্যাপবুক আর ব্যাগ নিয়ে মাঠের দিকে চলে যেত দু’জন। ভোমরাদহ ছেড়ে আসার পর প্রকৃতির জন্য একটা কান্না শুরু হয়েছিল বুকের ভেতর, মেজাজ খিটখিটে হতে থাকলেও বুঝতে পারে নি। জিনিয়াদের গ্রামে এসে নিজের ভেতরে শান্তশিষ্ট নিধিটাকে আবার খুঁজে পায় সে। ব্লাউজ থামি পরা জিনিয়ার দাদি মলিনা চাকমা লাঠি ঠুকে ঠুকে গাছের সঙ্গে কথা বলে। নিধি কাছে গেলে তাকে হাত ধরে টেনে বসায়। আদিবাসীরা নিজের প্রয়োজনে বৃক্ষ রোপণ করে না, গাছগাছারীর সঙ্গে পৃথিবীর সম্পর্ক রক্ষা করতে গাছ লাগায়। নালি শাকের পাতায় পাতায় নিধি মলিনা চাকমার মত আদর করতে করতে তার পাতা সিরিজের স্কেচগুলি আঁকে। পাতাকে প্রকৃতির পুরুষ ভূমিকায় দেখতে দেখতে নিজের কল্পনাকে ছেলেবেলায় পড়া রূপকথার গল্পগুলির সঙ্গে জুড়ে দিতে পারে। একে একে বত্রিশটা স্কেচ দিয়ে স্ক্র্যাপব্যুক ভরে উঠলে মনস্থির করে নিধি, এবার ফুপুর বাসায় গিয়ে চিঠিগুলি নিয়ে আসবে।
হায় আফসোসের একটা লম্বা হাত চিঠিগুলির দিকে ধেয়ে গেছে যখন সে প্লেনে বসে সিটবেল্ট বেঁধেছিলো। ফুপুকে বলে দিলে চলতো, তবে নিজে পড়ার আগে এগুলোর খবর আর কাউকে দিতে ইচ্ছে করেনি। বাবাকে তো নয়ই। বাবা কোন প্রশ্ন করেনি (প্রাণের টান কতটুকু নাই হয়ে গেলে স্ত্রীর চিঠি হারিয়েও মানুষ খোঁজ করে না!), এ ক্রোধ, মনোকষ্ট বহুকাল ঠান্ডা হয়নি নিধির। ছাদের সিঁড়িঘরের জিনিষপাতি আর পুরনো পাঠ্য বইয়ের দঙ্গল, ছেঁড়া পর্দ্দা আরো কি কি সবের নিচে নিধি তার হাইস্কুলের ক্যানভাসের শাদা জুতা জোড়ার একপাটি খুঁজে পায়, একটা ট্রাংকের কোনায় চাপা পরে আছে, ফিতে গোজার আংটায় জং এর দাগ, দীর্ঘ দলিত অবহেলা। নাহ, এ দুটোর গায়ে বাবার হাতের স্পর্শ থাকার কথা না, ততদিনে তো সে স্যু লেইস বাঁধা শিখে গেছে! বাবা যখন তাকে জুতার ফিতা বাঁধার ওয়ার্কশপ করাচ্ছিল তখন সে তার প্রথম স্কুল থেকে ‘পড়ায় মন নাই’- এই অভিযোগে খারিজ হয়ে গেছে। কতদিন সকাল বেলা এলিফ্যান্ট রোডের প্লেন মসজিদের গলির বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে স্কুলগামী বাচ্চাদের দেখেছে, মা হয়তো তখনো ঘুমিয়ে আছে। পরে ঘুম ভাঙ্গা আলুথালু উঠে এলে ছয় বছরের নিধি জানতে চেয়েছে- আমি কেন স্কুলে যাই না মা? –‘যাবা মা মনি, তুমি সবচে ভালো স্কুলে যাবা। খুঁজতেছি আমরা, স্কুলটা পাইলেই তোমাকে ভর্তি করে দিবো, ঠিক আছে সোনা? তার আগে তোমার আর আমার প্রাইভেট স্কুল! তুমি আমার একটাই ছাত্রী, আর আমি তোমার টিচার, কি মজা না?’
মা তার বাহু তুলে আড়মোড়া ভেঙ্গে উচ্ছাস দেখিয়ে মুখ ধুতে ভেতরে গেছে। মায়ের সঙ্গে টিচার টিচার খেলা নিধির এত প্রিয়, সে সুতরাং ক্ষিরসা দিয়ে প্যাচানো রুটি বিনা বাক্যব্যায়ে খায়, এক থেকে বিশ গোনার মধ্যে গ্লাসের দুধ খালি করে দেয়, তারপর ডাইনিং টেবিলে বসে এক থেকে পাঁচ পর্যন্ত লেখার অনুশীলন করে। এক দুই তিন চার পাঁচ সংখ্যায় লিখতে তার দুপুর গড়িয়ে যায়। দু’চারটা চড় থাপ্পড়ের পরও যখন নিধি গুনতে ভুল করে, মা হাল ছেড়ে দিয়ে আদর করার অবসরে তাকে আবার ছবিতে রং করতে দেয়। শুক্রবারে বাবা বাড়ি ফিরলে মা’র কাছে নিধির পড়াশোনার অগ্রগতি জানতে চায়, চায়ের কাপে তাদের চুমুকগুলি দীর্ঘতর হয়ে ওঠে। ঢাকা শহরের ঘেমো বাতাসেও রাস্তার মোড় ঘেষে এক চিলতে চাঁদ উঠলে বাবা বিড় বিড় করে বলে– ‘এই মেয়েকে এখন এখানে কোন স্কুলে পড়াবো?’ বড় হয়েও অনেকদিন পর্যন্ত ছবির বই টই ছাড়াও নিধির আরো কিছু সম্পত্তি ছিল, মায়ের শখের একজোড়া তামার দুল আর চাকমা গ্রাম ঘুরে কিনে আনা বার্মিজ থামি (মা বাবার একমাত্র দূরযাত্রার স্মারক, কখনো পরিধেয় নয়)। আর তাদের তিনজনের ফ্রেমে বাঁধাই একটা ফটো। ষ্টোররুমের হাবিজাবির ভেতর নিধি তার ক্ষুদ্র সম্পত্তিসকল খুঁজে পাবে তো! ছোট্ট ব্যাগভর্তি এইসব দেশছাড়ার আগে সে ফুপুর কাছে রেখে গিয়েছিল। অয়ন খুব নির্দয়ভাবে এইসব জিনিষ ঘরছাড়া করেছিল, ফুপু বলেছে। সে কি কারো নিষেধ শোনে? অনেক অনুরোধের পর শুধু একবার নাকি মাছি ওড়ানোর মত বলেছে–‘একবার বিদেশ গেলে আর কেউ ফিরে নাকি? আর যদি আসেও, এইসব খুঁজবে? সেইখানে কত মেটিরিয়ালিষ্টিক এট্রাকশন!’
এইসব সংলাপকে নিজের কল্পনাপ্রসূত ভাবতে আর সঙ্গে সঙ্গে সজোরে বাতিল করে দিতে ইচ্ছে করে নিধির। তারপরও নিজের জিনিষের অযত্ন তার সহ্য হয় না, অবহেলার হাল দেখে সপাট একটা চড় কষাতে হাত উঠে যায়, বাতাসে। চোয়াড়ে স্বভাবের অয়নকে খুব তুচ্ছ করতে মন চায়। অথচ ফুপু বলে– ‘ছেলেটার মনটা নরম, বাইরে থেকে বুঝা যায় না’ (তালের আঁটির ভেতরে ফোপড়া), সে নরমের সন্ধান কম তো করেনি নিধি! দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেয়নি অয়ন, ‘এই দেশে মানুষ থাকে নাকি?’,র উন্নাসিকতায় নাক কুঁচকে এ লেভেল দিলো। ছাত্র খারাপ না, তবু অয়নের বছর শেষে কোথাও ভর্তি হওয়া হয় না। একবার হরতালের জন্য পোষ্টাপিস বন্ধ, ডেডলাইন পেরিয়ে গেছে, আরেকবার ভয়াল জন্ডিস তাকে শয্যাশায়ী রাখে, তৃতীয়বার তার মানি অর্ডার হারিয়ে যায় (দূর্ভাগ্যের ফেরে পড়ে যায় অয়ন)। চতুর্থবার সে সিদ্ধান্ত নেয়- আর কোথাও ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করবে না। সে ট্যুরিষ্ট ভিসা নিয়ে ইউ এস এ চলে যাবে, সেখানে প্রথমে কাজ করে পয়সা জমিয়ে সে ভর্তি হবে মেডিক্যাল স্কুলে (বড় হয়ে কি হবে? ডাক্তার)। ঢাকার ইউ এস এ্যামবেসী বেখেয়ালে অয়নের ভিসার দরখাস্ত বাতিল করে দিলো। একবারের প্রত্যাখানের বার বার পূণরাবৃত্তি হতে থাকলো। প্রথমে নাকি সে জি আর ই টোফেল পরীক্ষা দেয়ার পড়া পড়তো, তারপর ঘর বন্ধ করে শুরু হলো– ভাগ্যের মাছ ধরার পড়া। ফুপুর দিকে তাঁকিয়ে নিধির আবারো মন খারাপ হয় (ফুপুকে কি অভিযুক্ত করা যায়?)– কেমন করে অয়ন খামখেয়ালীপনার বুজরুকি শিখে নিলো, ফুপুর চোখের সামনে! –‘একটা প্রেম ট্রেম করলেও তো পারে’ (জীবনের মানে খুঁজে পায়)! -‘ঘর থেকে না বাইর হইলে কে ওর প্রেমে পড়বে বল?’ (কিছু মানুষ প্রেমবোধ ছাড়াই জন্মে!)। আর অয়ন জানে কেবল দোষ দিতে, তার মায়ের দোষ, বাবার দোষ এমন কি তার মাতৃস্নেহে ভাগ বসানো নিধির দোষ, অথচ নিধিতো সেই কবে আর্ট কলেজে ভর্তি হয়ে এ বাসা ছেড়ে গেছে। প্রথম প্রথম কলেজ হোষ্টেল থেকে কতদিন এ বাড়িতে ফিরতে মন চাইতো নিধির! রাস্তার কোলাহল, এমন কি অয়নের স্বেচ্ছাচারিতার অনুপস্থিতিও যে তার ঘুমের ব্যঘাত ঘটাতে পারে তা অভাবনীয় ছিল। সচেতনে ফিরতে চায়নি। তাছাড়া, সোমত্ত নিধির ডেরা হিসেবে হোষ্টেলই ভালো– ফুপুর এ ফায়সালা খুব বিবেচনাপ্রসুত, এতদিন বাদে আবার ফিরে এসেও নিধি বুঝতে পারে। সিঁড়িঘরের দরজা ক্যাচ ক্যাচ করে, হুড়কোতে আটকে থাকা নতুন কাঠও এ বাড়ির সবকিছুর সঙ্গে অথর্ব হয়ে যাচ্ছে! তবু নিধি নেমে গেল সিঁড়িঘরের মেঝেতে, যেন খনি– ডুবতে ডুবতে-ভাসতে ভাসতে কয়লার গুড়োতে মাখামাখি হতে হতে খুঁজে পেতে চায় স্মৃতিময় হীরা মানিক্য, অভ্রকণা।
(চলবে)