পর্ব-১।। পর্ব-২।। পর্ব-৩।। পর্ব-৪।। পর্ব-৫।। পর্ব-৬।।
নাহার মনিকা
সেই দফায় মা প্রায় দিন দশেক বাড়িছাড়া ছিল। কেউ একদিনও নিধিকে হাসপাতালে নিয়ে যায় নি। মায়ের এই দীর্ঘ (দশ দিনকে তখন কী দীর্ঘ আর ক্লান্তিকর মনে হয়েছিল!) অনুপস্থিতিতেও নিধির জীবন একরকম নিস্তরঙ্গ ছিল, কিছু ঘটেনি। যেন সে কিছু ঘটার অপেক্ষায় ছিল। কি ঘটতে পারতো তার ঐটুক শিশু জীবনে। নাহ, জানলায় একদঙ্গল পতঙ্গের মাথা খুড়ে মরা ছাড়া আর বড় কোন বিপত্তির দেখা পায়নি সে।
জীবনে প্রথম মনে রাখার মত যে ঘটনা ঘটলো তা হলো– নিধির জন্মদিন উপলক্ষে বাবা ক্যামেরা কিনে ফেললো। তার আগে ষ্টুডিওতে গিয়ে তোলা শুধু একটা ফটো। মা, বাবা আর রোগা পটকা নিধি। তার চুলের দুই পোনিটেইলে শাদা ফুল। হাঁটু ঢাকা মোজা। মায়ের মাইশোর সিল্কে কল্কিফুলের প্রিন্ট, মাঝারী মাপের স্বপ্ন বোঝাই চোখ। বাবা কোকড়া চুল সোজা করতে প্রায়ই ভেজা চুলে টুপি পরে থাকতো। কিছুতেই না সোজা হতে চাইতো না, সারমেয় লেজধর্মী চুল নিয়ে মুখর অভিযোগ ছিল তার। এই পারিবারিক ফটোটা সে আসলে দাদু বাড়ীতে গিয়ে দেখেছে। ফ্রেমে বাঁধানো। তার আগের, পরের কোন ফটো নাই কেন– যে বিষয়ে সব জেনেও মন চাইতো ‘ ইশ, থাকলেই পারতো’।
নিজেদের ক্যামেরায় তোলা আরো অনেক ছবি ছিল, নিধি যখন এক, দুই কিংবা আড়াই বৎসরের। মা যখন তাকে কোলে নিয়ে চিলতে বারান্দার ইজি চেয়ারটায় বসে দুলতো। আধলা চুল দিয়ে বেনী পাকাতে পাকাতে বলতো– ‘তুমি একটা পরীর বাচ্চা, এত সুন্দর, এতই সুন্দর যে ক্যামেরা তোমাকে দেখতেই পাইতো না’।
-‘পরীদের বুঝি ফটো উঠে না মা?’ – নিধি তখন বাকপটু।
– ‘উ উ হু…’ মা হাসতে হাসতে হাম হাম করে নিধিকে চুমু খেতো।
– সেই ক্যামেরাটা কই? বললে মা মন খারাপ করে ফেলতো।
নিধির জন্মের পরে বাবা তার বন্ধু হায়দারের কাছ থেকে একটা ক্যামেরা কিনেছিল, হায়দার রাশিয়াতে পড়ার সময় ছুটিতে দেশে ফিরে ক্যামেরা বেচতো।
– ‘শেষবার হায়দার কি কি আনলো শোন,’ বাবা মথুরাপুরের বাসায় এক বিকেলে ক্যামেরার প্রসঙ্গ উঠলে বাবা বলেছিলো, ‘মস্কো ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতির ডিগ্রী, রং করা কাঠের পুতুলের মধ্যে পুতুল, তার ভেতরে আরো ছোট পুতুলের অনেকগুলো শো-পিস আর সতেরটা ক্যামেরা!’
নিধি আর মা’র চোখ গোল গোল হয়ে যায়। সতেরটা!
-‘ রাশিয়া তো আমারও যাওয়ার কথা ছিল, কাগজপত্র সব জমা দিলাম, মার্কশীট, সার্টিফিকেট। আমার রেজাল্ট হায়দারের চে’ কত ভালো ছিল, ও যাইতে পারলো আর আমি চান্স পাইলাম না’।
ইশ, যেতে পারলে কি মজাই না হতো! (এ জন্যই বোধহয় বাবা তাকে সব রাশান রূপকথার বই কিনে দিতো) নিধি দেখতে পায়– কোকড়া চুল, অল্প মেদ, শ্যামলা দেহত্বক, চশমায় চোখ ঢাকা বাবাকে, মস্কোর ঘন তুষারপাতের মধ্যে ওভারকোট গায়ে হেঁটে হেঁটে ক্লাসে যাচ্ছে। একটু তেরছা হয়ে মঞ্চে বসে ছাত্রদের অনুষ্ঠানে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইছে– ‘প্রিয় এমন রাত যেন যায় না বৃথাই,’ গান গাওয়া ঠায় জনপ্রিয়তা তাকে সবার মধ্যে পরিচিত করে তুলছে।
-‘হায়দারের পড়া শেষ করে দেশে ফিরতে বেশ সময় লাগল, ততদিনে আমি রাজশাহী ভার্সিটি থেকে বের হয়ে গেলাম’।
তারপর জুট পার্চেজারের চাকরীটা পেলো বাবা। প্রথমে নেবে কি নেবে না দ্বিধা ছিল, স্বায়ত্বশাসিত পাটকলের জন্য জেলায় জেলায় সোনালী আঁশ ক্রয়ের এজেন্সী। সরকারী চাকরী না। বেতনও খুব বেশী না। তবে অফিস থেকে একটা মোটর সাইকেল দেবে, আর ডিজেলের ভর্তুকি।
নিধির দাদু ইসমত মাষ্টার নাকি বলেছিলো- ‘নিয়া নে। এইটা তোর ষ্ট্যান্ড পয়েন্ট। এইখান থেইকা লাফ দিলে আরেকটা সিঁড়ি পাবি, সেখান থেইকা আবার লাফ। এইটাই চাকরীতে উন্নতির নিয়ম’। শুরুতে প্রাইমারী স্কুলশিক্ষক, পরে চাষবাস সামলানো সম্পন্ন গৃহস্থ বাপের পরামর্শটা বোধহয় বাবার ভালো লেগেছিল।
দাদু আরেকটা দায়িত্ব সেরে ফেললো, রাজশাহীতে পড়ার সময় বাবার বান্ধবীকুলকে (মনগড়া, বাবা বলে) সোজাভাষায় নাকচ করে দিয়ে মায়ের মত সহজ সরল আর স্নিগ্ধ (দাদু’র কাছ থেকে অবিরল জলের ধারার মত প্রসংশা শুনেছে সবাই) মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে সোজা ভোমরাদহে নিয়ে এলো। মেয়েটি দাদির বোনের মেয়ে, বেশী খোঁজখবর করতে হলো না। বাপের বদলীর চাকরীর সুবাদে বড় হয়েছে মফস্বলে। ইডেন কলেজে বাংলায় অনার্স দিলো, মাষ্টার্স করে নাই, সুতরাং কম বয়স, মানে উপযুক্ত বয়স।
বাবার প্রিয় গল্প তার পূর্বপুরুষের কাহিনী, কতবার শুনেছে (নিধি সাগ্রহে আর তার মা বহুল শ্রুত বলে মুখ থমথমে ক’রে)। বাবার দাদা আকামত আলির বাপ মুন্সিগঞ্জে সামান্য জমি জিরাত আর বৌ পোলাপান রেখে গৌহাটিতে গিয়ে কাপড়ের দোকানের কর্মচারী হয়েছিল। আসামই তখন বাঙ্গালীর দূরের প্রবাস। বেতন পাঠানোর বন্দোবস্ত নাই, সারা বছরে একবার গ্রামে ফিরতো, তখন ভালোই মচ্ছব হতো। কতকিছু যে নিয়ে আসতো, চিনেমাটির কাপ ডিশ, ভেলভেটের কোট(তার স্ত্রী একপ্যাচে শাড়ির ওপরে সেসব গায়ে চড়ানোর আদৌ সুযোগ পেত!), ক্রিষ্টালের তসবী, আরো কত কি আর অবশ্যই টাকা, সে টাকা দিয়ে দু এক কানি জমি কেনা যেত। বাপ আবার দূর প্রবাসে গেলে আকামত আলী মা’কে নিয়ে তাদের দৈনন্দিনে ফেরত আসতো। আরো পাঁচ ভাইবোন নিয়ে মায়ের সঙ্গে কোলায় ধান আর কলই তুলতো, ঘোর বর্ষায় নাও বেয়ে বড় বড় জ্যান্ত ইলিশ ধরে নোনা মাছ বানানোর জন্য জাঁক দিতো।
এরকম সুখের জীবন বোধকরি নদী নালার ভালো লাগে না, আর পদ্মা (নিধির মা’র ধারণা) বড় হিংসুটে, লোলুপ নদী। মুন্সিগঞ্জের বাড়িঘর জমিজমা খালি পেটের খোড়লে টানে। আর কে না জানে, বিপদ যখন আসে, চারদিক থেকে ছাপ্পড় মেরে আসে। বাপের মৃত্যু সংবাদ গৌহাটি থেকে যে বয়ে আনলো সে ফিরে যেতে না যেতেই মা আর পাঁচ ভাইবোন নিয়ে তাদেরকে পথে বসতে হলো। এক মধ্যরাতে সর্বনাশা পদ্মা নিজের অস্তিত্ব ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে গ্রাস করে নিলো তাদের বসতভিটার সবটুকু, ধানের জমি, ফলন্ত গাব গাছ আর পোষ্য প্রানীগুলি। আকামত আলীর মা শুধু তার তসবী আর লাল ভেলভেট কাপড়ের সেই কোট বাঁচাতে পেরেছিল।
নিধি চোখ বড় বড় করে গল্প শুনেছে বাবার কাছ থেকে, তার চা খাওয়া শেষ, তর্জনী আর মধ্যমা আঁকড়ে আছে সিগারেট, ধরানোর অপেক্ষা, বাবা বলেই যাচ্ছে।
আসাম গিয়ে কাজকর্মের মত বিদ্যা ছিল না আকামত আলির। বাপ মরে যাওয়ার পর নদীনালা বিল গাঙ এর প্রতি বুক ভর্তি বিতৃষ্ণা নিয়ে সে হাঁটের মধ্যে সদ্য পরিচিত একজনের সঙ্গে রেলগাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছিল। খালি হাতে এই ঊষর অঞ্চলে এসে, প্রথমে মানুষের জমি নিড়িয়ে, মুনীষ খেটে কি করে এক স্থানীয় বালিকার পাণিপ্রার্থী হয়ে এই ভোমরা দহে শেকড় গেঁথে ফেললো সে কাহিনী নিধির বাবার ভাষায় ‘ভাস্কো দ্যা গামা’র পরিযাত্রার মর্যাদা লাভ করে। নিধির এখন মনে হয়, বাবার রং চড়ানোয় আলোছায়ার খেলা ছিল, আর পূর্বপুরুষের প্রসঙ্গে এমন সংবেদনশীলতা স্বাভাবিক।
-‘নদী ভাঙ্গন নাই, কিন্তু এই এলাকায় মানুষ লড়াই করে ক্ষয় করে ফেলা খরা আর ফসলের অনিশ্চয়তার সঙ্গে- বাবা বলেছিল।-‘একবার আকামত আলির তখন খুব দুর্দিন। ধান গজাতে না গজাতেই রোদের তীব্র তাপে পুড়ে কালো হয়ে যাচ্ছে। যেখানে খাবার পানি যোগাড় করতে এক ক্রোশ দূরে যেতে হয়, সেখানে সেচ দেয়ার পানির কথা চিন্তা করাই বাতুলতা! বউ বাচ্চা আধপেটা থাকে, খরার কালে তো কচু ঘেচুও জোটে না’।
কাউকে কিছু না জানিয়ে একদিন ভোররাতে আকামত আলি বাড়ি ছাড়ে। অত ভোরে কেন? হবে হয়তো এই ভোমরাদহে বসে রাগী সূর্যের মুখোমুখি হতে চায়নি সে। দিন যায় আকামত আলি ফেরে না অনেকদিন। বউ ছেলে প্রথমে আধপেটা খায়, কোন অযাচিত খাবার খেয়ে ভেদবমি হয়ে ছেলেটাকে রেখে বৌ মরে যায়। তারপরও আকামত আলি ফেরে না, তার ছেলে ইসমতের মা মরা শোক আর কান্না থিতিয়ে আসতে থাকে। বাপের কথাও ভুলতে বসে প্রায়।
মেঘের নিশানা যেদিন পূবের আকাশকে একটা কালো কচু পাতার আদলে দেখায়, সেদিন আকামত আলি ফিরে আসে, প্রাংশু, সিঁটিয়ে থাকা দেহ কংকালসার। নাহ, কোন গুপ্তধনের সন্ধান পায় নি। ফিরে আসছিলো শূন্য হাতেই। ক্লান্ত হয়ে রেলষ্টেশনে জিরানোর কালে এক দরবেশের সঙ্গে দেখা, একথা সেকথার পর সেই সাধু তার ঝোলার পাশে রাখা খবরের কাগজে মোড়ানো একটা চারাগাছ তাকে উপহার দেয়।
-‘তুই যেখানে থাকিস, সেখানে এই গাছ সোনা ফলাবে’।
খরার কাল শেষ হয়ে ততদিনে মাটি শুষে নেয়া বৃষ্টির দিন শুরু। চারা গাছটা বড় হলো, বড় বড় রসালো লিচু ঝুললো তার ডালে। খেয়ে না খেয়ে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে আকামত আলী লিচু গাছের দুর্দান্ত কলম করা আবিস্কার করে ফেললো। তার চেষ্টা আর দূরদর্শিতায় আজকে চল্লিশ একরের লিচু বাগান, সুখের স্থিরচিত্র। পাইকারদের লাইন পরে যায় তার বাগানের মুখে।
-‘দাদুকে তোমার হিংসা হয় বাবা?’
-‘হবে না আবার! দেখো এক সিজনে লিচু বিক্রি করে কত টাকা তোমার দাদু’র!’
-‘তুমিও তো পাট কেনো’।
-‘সেইটা তো আমাদের জুটমিলের জন্য মা’।
পূর্বপুরুষের সাফল্যে গর্ব অনুভব করার এই আখ্যান সে ছোটবেলা থেকে নিধি মন্ত্রোচ্চারণের মত শুনেছে, আর ভোলে না।
আকামত আলী ছেলের বিয়ে দিয়েছে মুন্সিগঞ্জে এসে। ভোমরাদহের মানুষগুলির কাছে এই বৌ বিদেশী, বাটা মশলা দিয়ে তরকারী পাক করে। মিষ্টি পোলাও তার মুখে রোচে না, বড় বড় মাছের গল্প এমন করে বলে, মনে হয়- রূপকথার গল্প। নিধির বাবা বলে– তার দাদি ভোমরাদহে নিজেকে প্রোথিত করতে পারে নি অথচ মৃত্যু হয়েছে সেখানেই।
(চলবে)