গুটিয়ে যাও গুটিয়ে গেলেই সুখ
রোদ-দুপুরে পুড়বে না আর বুক
বুকের তলে হৃদয় নামক আঁখি
টের পাবে না তীর-শিকারী পাখি
গুটিয়ে যাও গুটিয়ে গেলেই ভালো
গহন সুখে জ্বলবে জ্বলুক আলো—
কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা-র ৬৫তম জন্মবার্ষিকী আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর/১৪। ভাবি, কি করে তাঁর সাথে পরিচয় হয়েছিল? তারপর কতদিন তাঁর সংগে আর যোগাযোগ ছিলো না। সক্রিয় ছিলাম না কোন সভা সেমিনার বা কবিতা পাঠের আসরে। মাঝে মাঝে যে একেবারেই দেখা হয়নি তা নয়, সে সামান্য কিছু সময়ের জন্য এবং একেবারে লৌকিক কিছু কথাবার্তা ছাড়া আর কোন আলাপ হতো না। কিন্তু তাঁর আলোচনা বিশেষ করে কাব্য প্রসংগে যখনই তা কোন অনুষ্ঠানে শ্রোতা, শুনতাম। শুনতাম খুব মনোযোগ দিয়ে, কারণ কবিতা লেখা, কবিতার সৌন্দর্য, শিল্প সত্তা, কবিতার কাঠামো, কবিতার বসতি, আধার ও আধেয় ইত্যাদি প্রসংগে সে যে ভালো আলোচনা করে তা প্রায় সকলেই স্বীকার করবেন। আমিও করি এবং একজন গুণমুগ্ধ শ্রোতা হিসেবে তা’ শুনেছি । আজো শুনি।
সে সম্ভবত ১৯৭৬ সালের কথা— আমরা যারা উন্মেষ সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদের সংগে খুউব জড়িত, লেখালেখি করছি, চর্চা করছি সাহিত্য, তাদের মধ্যের অন্যতম মহসিন শস্ত্রপাণি, মানে আমাদের মহসিন ভাই বাংলা একাডেমি-তে পরিচয় করিয়ে দেন কবি নূরুল হুদার সঙ্গে তখন আমাদের বা তাঁরও ভরা যৌবন। আমরা সাহিত্য সম্মেলনের কী এক প্রয়োজনীয় কাজের জন্য তার ওখানে গিয়েছিলাম এবং তিনি সে কাজের সফলতায় প্রয়োজনীয় সহযোগিতাও দিয়েছিলেন। তারপর অনেকগুলো সভা করেছি আমরা বাংলা একাডেমির হলে, করেছি প্রাঙ্গণে, এবং উন্মেষ-র প্রকাশনা নিয়ে স্টল করেছি। সকল কাজে আমরা প্রথমেই দেখা করেছি তাঁর সাথে এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রসংগ তাঁর কাছে রেখে এসেছি— তিনি তা’ করেও দিয়েছেন। অতিরিক্ত এতে কিছু নেই, গতানুগতিক কাজই তিনি করেছেন, তবু বলা এ কারণে যে বাইরে উন্মেষ-র ব্যতিক্রম একটা পরিচয় ছিল; কেবল বাম তা-ই নয় আরো একটু বেশী— এই আর কি। এতে অনেকেই একটু দূরে থাকতেন এবং বলতেন ‘নকশাল‘—
ভালো হতো দেখা হলে অনেক আগেই
ক্ষতির বেদনা শুধু বেড়ে গেলো আজ
প্রশান্ত সৌন্দর্য তুমি যদি দেখালেই
কেন সংগে নিয়ে এলে নিজের সমাজ?
সৃষ্টিতে সৃষ্টিতে যদি মিল থাকে, তবে
তোমার আমার মিল একদিন হবে।[ দ্রাবিড়ার প্রতি]
শিল্প-সাহিত্যে নকশাল আছে কিনা কিংবা তা’ উগ্র-সাহিত্য কি না তেমন কোন পরিচয় আমাদের তখনকার কবিতা-গল্প-প্রবন্ধ বা আলোচনায় মিলবে বলে মনে হয় না, তবে মানব গোষ্ঠির সংগ্রামে, তাদের চেতনার উদ্দীপনে সাহিত্য সৃষ্টিতে আমরা যে প্রয়াশ করেছিলাম তা যে সত্যি ছিলো-কে আর অস্বীকার করবে? অস্বীকার করবোই বা কেন, আজও তো আমরা যে ক’জন লিখি তা’ সেই বিশ্বাস থেকেই, কোনো রকম পিছনে ফিরি নি, ফিরবার কথাও ভাবিনা। আমাদের মাঝে মহসিন শস্ত্রপাণি কবিতা তেমন একটা লেখেন নি, দ’ুচারটে যা কিছু তার সৃষ্টি তা’ ফাইল বন্দী হয়ে আছে, তবুয়ো তিনি কবিতার একজন ভালো আলোচক বলেই আমরা মান্য করতাম। কবি সমুদ্র গুপ্ত আজ আর নেই, কাজী মনজুর লেখে না, মুনীর সিরাজ লেখেন— ব্যস্ত জীবন পেশায়। আর আমিও লিখছি সেই একই চিন্তা থেকে, সামাজিক দায়িত্বকে স্বীকার করে। সে সব কারণে খুব কম লেখক কবি পত্র-পত্রিকা আমাদের লেখা প্রসংগে আগ্রহী ছিল। তবে দেখা হলে যারা একদম ফেলে চলে যেতেন না [জানিনা আনন্দের সংগে নিতেন কিনা, ] তাদের মধ্যে কবি আহসান হাবীব, কবি আল মাহমুদ, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, নরেন বিশ্বাস, আসাদ চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, সাযযাদ কাদির, রফিক আযাদ, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, মাকিদ হায়দার, একটু ঘনিষ্টতা দেখিয়েছেন। কিন্তু কখনোই আমাদের কবিতা নিয়ে, শিল্প বোধ নিয়ে কোন আলোচনা, বা আলোচনায় উল্লেখ করেন নি। কেবল সমুদ্র গুপ্তের নামটা দু’এক জায়গায় হয়তো বসে গেছে। আমরা কিন্তু তাদেরকে বাদ দিয়ে কিংবা তাদের লেখাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে পড়িনি। পড়েছি কবির/কবিদের লেখা বলে, পড়েছি তা থেকে কিছু শিখবো বলে, পড়েছি তাদের শিল্প-চাতুর্য কি করে গণমুখী কবিতায় সন্নিবেশিত করে আমরাও হয়ে উঠতে পারি আমাদের মতো। সে সময় আমরা তাঁদের বই বেরুলেই কিনতাম এবং পড়তাম। একক ভাবে, কিংবা মিলে, সাহিত্য-সভাগুলোতে প্রসংগক্রমে আলোচনায় উঠেও আসতো, টেনেও আনতাম। এঁদের মধ্যে কবি নুরুল হুদা একটু বেশী এগিয়ে ছিলেন। কোন কাজে তার কাছে গেলে তিনি তা করে দিয়েছেন। মাঝে মাঝে দু’এক কাপ চা তার অফিসের টেবিলে খাইয়েছেন। বিদায় দিয়েছেন সৌজন্যের সংগে ।
জীবনের নানা চড়াই উৎরাই, পতন আর উত্থান আনন্দ এবং বিষাদের মধ্যদিয়ে যাপিত এই জীবন অনেকগুলো বছরের সমাহার, তবু ভালো লেখা শেখার অপরিসীম এক ইচ্ছে নিয়ে ফেরা। এরই মাঝে একদিন কবি ফরিদ আহমদ দুলাল এর নিমন্ত্রণে এলাম রাইটার্স ক্লাবে কবিতাবাংলার কবিতা সভায়। কবি নূরুল হুদার সংগে কবিতার আলাপ কবিতা পাঠ, পাঠ প্রতিক্রিয়া শুনতে শুনতে মনে হলো কিছুতো নতুন করে জেনে নেয়া য়ায় নতুন আর প্রবীণদের থেকে। তারপর নিয়মিত আসা যাওয়ায় হুদা ভাইয়ের সংগে সম্পর্কটা গড়াতে গড়াতে এলো ব্যক্তিক পর্যায়। এখন আমরা কত কিছু নিয়ে আলাপ করি, তর্ক-বিতর্ক করি, শুনি ও শোনাই। আমি খুব অল্পই গদ্য লিখেছি, আর যে টুকু লিখতে শুরু করেছি তার মূল উৎসাহ যুগিয়েছেন তিনিই—।
কবি নূরুল হুদার কাব্য-ভাবনা এখনো আলাদা। তিনি কবিতা লিখছেন বিস্তর। লিখে চলেছেন আজও। নানা স্বাদের, নানা আকারের আকাঙ্খার নানা বিস্তার-ভাবনার। আছে প্রেম, দার্শনিকতা, মরমিয়া বোধ, দেশ বিদেশের নানা কবিতার নির্মাণ শৈলীর তত্ত্ব ধারণ, আছে নিখুঁত ছন্দের দুলুনি, অন্যরকম জীবন দেখা,এক বাস্তবতার প্রান্ত ভেঙে আরো এক বাস্তবতায় হেঁটে যাওয়া। আধুনিকতার নানা তত্ত্ব তার কবিতায় খুঁজে পাওয়া যাবে। ‘মৌলাধুনিক কাব্যে’ তাঁর ‘ঘোষণা ও ধারণা ও নমুনা’ কাব্যাকারে নানা দর্শন তত্ত্ব সূত্রাকারে উপস্থিত করেছেন [আমি অস্তিত্বের ঘোষণা] ‘যেহেতু আমি যা ঘোষণা করি আমিই তা শ্রবণ করি আমিই তা গ্রহণ করি…সে হেতু স্বীকার অস্বীকার নির্বিশেষে সকলেই যে যার অস্তিত্বে মৌলাধুনিক … বিশ^সত্যের সর্বাদি ও সর্বশেষ নান্দনিকতা মৌলাধুনিকতাবাদ বা মেটামডার্নিজম বা ইউনিমডার্নিজম/আর কোনো নান্দনিক সত্য নেই,থাকার প্রয়োজন নেই , থাকবেও না… … আমি থেকে সূত্রায়ন ও শনাক্তকরণ শুরু হলো, এই দর্শন ও তাঁর কাব্যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মৌলিক হয়ে উঠেছে। তাঁর ষাট বছরের কবিতা গ্রন্থে অনেক গুলো কাব্যের একই মলাটে অবস্থানের পরেও এখনো রয়ে গেছে আরো আনেক কিছু যা অন্তর্ভূক্ত হলে এই বইয়ের আকার আকৃতি যাবে বেড়ে। এগার শ’ পৃষ্ঠার অধিক এই বইয়ে স্থান পেয়েছে নুন্যতম এগার শ’ কবিতা। আরো বেশী হতে পারে ছোট বড় মিলিয়ে। বাকী গুলো এ ভাবে গ্রন্থবদ্ধ হলে সে কলেবর বাড়বেই তো। সম-সাময়িকতা, জীবন বীক্ষণ নানা দর্শনের ভাবান্দোলন যেন অনন্বয়োপমা। আছে চটুলতা,চপলতা, হাল্কা মেজাজের হৃদ-বন্ধনের ছন্দবদ্ধ কবিতা। এতো বিরাট বিপুল বিস্তার আমাদের কাব্যাঙ্গনে দুই একজন ছাড়া খুব বেশী আমার চোখে পড়েনি এখনও। আর একারণে তিনি কারো কারো ঈর্ষার কারণ ও হয়ে থাকতে পারেন।
টোঁটা ও রজনীগন্ধা
এক বৃন্তে কখনো ফোটে না—
যে হাতে ভোজালি ওঠে
সেই হাতে কোন দিন
কবিতা ওঠে না—
কবি নূরুল হুদা এবারে ৬৬-র প্রারম্ভে উপস্তিত হলেন, আর আমি থাকলাম আরো ২ বছর সামনে। তবু আমি তার সান্নিধ্য-প্রভা নম্রতার সংগেই নেই এ কারণে যে সৃষ্টি প্রসংগে এবং কাব্য বিশুদ্ধিকে জানতে সে আমার জন্য মান্য করে যাবারই মতো।
২০.০৯.১৪.