পর্ব-১।। পর্ব-২।। পর্ব-৩।। পর্ব-৪।। পর্ব-৫।। পর্ব-৬।। পর্ব-৭ ।। পর্ব-৮
নাহার মনিকা
ছোট্ট সরকারী হাসপাতালের কাছে মেইন বাসষ্ট্যান্ডে বাস থেকে নামলে এক চাউনিতে পুরো মথুরাপুর থানা জরীপ করা যায়। রিক্সার প্যাডেলে খান পঞ্চাশেক চাপ পড়ার আগেই বাজার। বাজার মানে ইট গাঁথা কিছু স্থায়ী দোকান, নচেৎ টিনের ঝাঁপ তোলা বারোমাসি মুদি আর ষ্টেশনারী দোকান। সোম আর বুধের হাটবারে আকাশের নীচে খোলা হাট। সন্ধ্যাবেলার হাটে আলোর রহস্যময় বিন্দুগুলি নিধির ভেতরে জমাট ভয় তৈরী করে, মা সেগুলোকে আকাশ থেকে নেমে আসা তারা- বলে একেক দিন গল্প বানিয়ে নিধিকে ঘুম পাড়ায়। জুট পার্চেজারের সিজনাল অস্থায়ী পোষ্ট। সেখানে যায় সেখানে একটা বাসা ভাড়া করে নিতে হয়। ছোট পরিবারের বসবাস উপযোগী দালান কোঠা মথুরাপুরে ভাড়া পাওয়া গেল না। মা তবু বায়না ধরলো যাবে, বাবার সঙ্গে একসঙ্গে থাকবে। তার বদ্ধমূল ধারণা- বাবা মা দূরে দূরে থাকলে নিধি’র পড়ালেখা আরো খারাপ হবে। এখানে এসে থাকার বায়নায় বাবা গলতে রাজী না, কথা বলা বন্ধ রাখলো কয়েকদিন। মা যখন ঢাকায় থাকতে চেয়েছিল তখনো বাবা ‘হ্যা-না’ কিছু বলেনি। তখনো মা-ই জেদ করে শ্বশুরকে রাজী করিয়েছিল। তাছাড়া নিধির জন্য ঢাকায় একজন ভালো মাষ্টার খুঁজে বের যেতো। মেয়েটা কেন সব কিছু শিখতে এত দেরী ক’রে – এরও যে চিকিৎসা আছে, দু’একটা মেডিকেল টার্মস। হায়দারের সঙ্গে সম্প্রতি তার এ বিষয়ে আলাপ হয়েছে। এসব বললেও মায়ের তেমন ভাবলেশ হয় না। নিধির মা’র কাছে ওষুধপত্র, ডাক্তার দেখানোর ওজর ধোপে টেকে না। তার এক কথা- ‘আর একলা থাকতে পারবো না’। সুতরাং বন্দোবস্ত হলো, পাটক্রয় কেন্দ্র আর তার লাগোয়া গুদামের পাশে টিনশেডের এক বাড়ীতে। দুই রুম, সামনের বসার ঘরে খাবার টেবিল পাতা যায়। উঠানের পেছনে পাকা বাথরুম আর টিউবওয়েল, তার পাশে অপরিসর চৌবাচ্চায় পানি ভরে রাখলে নিধি সেখানে দাপাদাপি করতে পারে। বড় গাছপালা নাই, ছায়া কম এই যা সমস্যা। মথুরাপুর নামটা মা’র পছন্দ হলো, শুনলে নাকি পাখীময় বড় গাছ আর মাটির রাস্তার কথা মনে পড়ে। তাদের কপালে জুটলো বারান্দা ঘেষে একটা আকন্দ গাছের ঝাড়। ‘মিহিলতা’ নামের কালো বেড়াল। আবেদা নামের সদাহাস্যময় মেয়েটার বেড়াল। মিহিলতা নাম কে রাখলো জানতে চাইলে আবেদা হেসেই খুন। ওর হাসির তরঙ্গ সেঁচে যে শব্দগুলি উদ্ধার হয়- সে আগে যে ম্যাজিষ্ট্রেটের বাড়ি কাজ করতো, মিহিলতা সেই বাড়ির। বাচ্চা বিয়ানোর পর বস্তায় ভরে দূরে ছেড়ে দিয়ে আসা আবেদার কাজ ছিল, সে তা না করে নিজের ঘরে সাত দিন চোখ বেঁধে আটকে রেখে ওর বাড়ি ফেরার পথ ভুলিয়ে দিয়েছে। মা’র দেখা কোন সিনেমায় নাকি আবেদার মত দেখতে এক সাঁওতালী মেয়ে ছিল, এর কেবল চুলে লাল জবা গুজে দিলেই হয়। নিধিদের কপালে আরো জুটলো পাটগুদামের কোলাহল-গুঞ্জন। মানুষের স্বাভাবিক কথপোকথনও গরর গরর ডাক হয়ে বিশালাকার গুদামের টিনের বেড়ায় আছাড় খায়। পাশে নিধিদের থাকার বাড়িটা নিতান্ত ছোট মনে হয় যেন পাটগুদামের দূর সম্পর্কের ঋণগ্রস্থ আত্মীয়। মিটির মিটির জ্বলে। স্যুটকেস আর ব্যাগে দৈনন্দিনের প্রয়োজনীয় জিনিস ভরে নিধির মা মথুরাপুরে চলে এসেছিল। ভাড়া করা বাসায় খাট টাট কিছু ছিল না, রাস্তার পাশ থেকে কেনা সস্তা কাঠের দুটো চৌকি জোড়া দিয়ে বিছানায় চাদর পেতে, তোলা উনুনে মুরগীর ঝোল আর চিচিঙ্গা ভাজি রেঁধে প্রথম দিনই কি সুন্দর সংসার পেতে বসলো (এগুলো দাদু’র কথা, মা’র প্রসঙ্গে এভাবে পঞ্চমুখ)। তিনমাসের মাথায় পাটগুদামের চত্তরে লাউ-শীমের মায়াময় মাঁচা বেঁধে দিয়ে গেলো আবেদার স্বামী মজনু। বারান্দার পাশে পাথরকুচি, কাঁচা মরিচ আর কদবেলের চারা পোতা হলো, কদবেল মা’র খুব পছন্দের ফল -‘গাছটা বড় হয়ে গেলে আমরা নিবো কিভাবে? কত্ত বড় টব লাগবে?’ বাবার বদলী হলে এ জায়গা ছেড়ে চলে যেতে হবে, ছেড়ে যাবার নিয়মতান্ত্রিকতা নিধিও বুঝে গেছে। মা একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায়, – ‘নিবো না, থাকবে’, -মা চিহ্ন রেখে যেতে চায়। কুসুমে কদবেলে চরণ চিহ্ন।
কেনা হলো একপ্রস্থ বেতের চেয়ার টেবিল। উঁচু পায়ার যে টেবিলটা অকারণে বিশাল পাটগুদামের কোনের দিকে পরে ছিল, প্রথমদিন বাবা মা’কে গুদাম ঘুরিয়ে দেখাতে নিলে সেটা মা’র নজরে পড়েছিল। কে বলে গুদামে দেখার কিছু নাই? পৃথিবীর অষ্টমাশ্চর্যের মত আস্ত একটা টেবিল ছিল! পরে সেটা ধুয়ে মুছে ঘরে তুলে একটা শাদার ওপরে শাদা এমব্রয়ডারী করা টেবিলক্লথ বিছিয়ে দিলে পায়ার ঘুণে ধরা অংশটা ঢেকে গিয়ে নিধিদের ঘর ঝিকমিকিয়ে উঠল। থাকুক ঘূণে ধরা তবুতো আস্ত একটা ডাইনিং টেবিল! মা আর নিধি টেবিলের চারপাশ ঘুরে প্রায় নেচে ফেলে আর কি! একটা টেলিভিশন কেনার ক্ষীণ সাধ ছিল মা’র, কিন্তু বছর বছর পাততাড়ি গোটানোর চাকরীতে এর বেশী ফার্নিচার বাবা কিনতে চায়নি। সেই টেবিলের এক ধারে নিধির অ আ কখ শেখার বই, ছবি আঁকার খাতা- তখনো, সাড়ে সাত বছর বয়সেও। ঐ যে দাদু বলে না? সবখানে মানিয়ে নেয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা (‘চোখ নাই, আন্ধা’- দাদুকে এইসব বলে বাবা কালেভদ্রে দাদুর দিকে গর্জেও উঠেছে)। সারাদিন গুচ্ছের মজদূর, পাটের গুদামে বারোয়ারী লোকজনের আনাগোনার মধ্যে নিধির মা মিটির মিটির করে জ্বলতে জ্বলতে দিব্যি মানিয়ে গেল। নারী পুরুষ সব জাতের মজদূরদের সঙ্গে মা তার ফুরসত মতো কথা চালাচালি করতো। সারাদিন কত মানুষ যায়, আসে, নিধির কারো কথা মনে থাকে না, অথচ মা’র নাকি সবার চেহারা, কথা বলা সঅঅব মনে থাকে, সকালে খানিক আর বিকেলে খানিক বারান্দায় বসে থেকেই। কাউকে ভালো লাগলো, তো আবার কাউকে এক ফোটাও মনে ধরলো না। মা’র পছন্দ অপছন্দ বেশ তীব্র। দুপুরের পর মাড় দেয়া শাড়ি পরে শোবার ঘরের খাটে আধ শোয়া হয় মা, শাড়ির খচমচ আওয়াজ আর গন্ধে ঘোর লাগে নিধির। বাবা ফেরার আগে চা’এর জন্য চুলা জ্বালানোর জোগাড়যন্ত্র করে আবেদা। নিধি তখন রং পেন্সিল বের করে একটা মাছের গায়ে রঙ্গিন আঁশ এঁকে দিতে চেষ্টা করছে। বাতাসের ভাপ গালে ঝাঁঝ লাগিয়ে যায়। মা সবদিন দুপুরবেলা ঘুমায় না, বরং খুব গল্পের মুডে থাকে। -ওই মোটকা হোদল কুতকুত ফুড ইন্সপেক্টরটাকে দেখছিলা নিধি? -কোনটা মা? নিধির চোখে রাজ্যের কৌতুহল। -ঐ যে সাফারী স্যুট পরনে, আসলো সকালে, ভুড়ির চোটে বোতাম ঘরগুলা ভালোমত আটকে নাই। ঢেলা ঢেলা চোখ, আমাদের বারান্দার দিকে দেখতে দেখতে তোমার বাবার অফিসের দিকে গেল। কি বিশ্রী চাউনি, পারলে আমাদের বারান্দায় চলে আসে। কালকে যদি দেখো আমাদের কদবেল আর কাচামরিচ গাছগুলি আর নাই, তাইলে বুঝতে হবে এই ব্যটাই রাত্রের বেলা আইসা নিয়া গেছে। – মা, কদবেল গাছতো ছোট্ট। আর ঐ লোকটা শুধু শুধু মরিচ নিবে ক্যান? -তাই তো তাই তো খালি খালি মরিচ নিবে ক্যান? – মা হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে বিছানায়।– সহসাই আবার মুখ গম্ভীর করে-, ‘ না, এমনি বললাম আর কি, তোমার বাবা বলতেছিল- ঐ লোকটাকে চা খাইতে ডাকবে’। মথুরাপুরে আসার পর থেকে মা বেশী খুশী খুশী থাকে। নিধির খুব রাগ হয়, মা এইরকম বেহদ্দ হাসে কেন? সেতো লোকটাকে মনেই করতে পারছে না। যত্তসব বাজে অভ্যাস। বাবা’র মতো করে তার নিজের মাথাও ভাবতে পারছে দেখে ভালো লাগে নিধির। নতুন জায়গায় সাধারণত দ্রুতই মানুষজনের সঙ্গে পরিচয় হয় নিধির বাবার। এবার ব্যতিক্রম হলো। বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল। নিধি আর মা দুপুরে লুডু খেলে আর ভাতঘুম দিয়ে উঠে জামা কাপড় বদলে বসে থাকে। যদিও বিশ কদম হাঁটলেই বাসা নিধির বাবা তবু দুপুরে খেয়ে আবার অফিসে চলে যায়। বিকেলে বাসায় ফিরে চা খেয়ে মোটর সাইকেলের পেছনে বৌকে, কোলের কাছে স্কার্ফ দিয়ে চুল বাঁধা মেয়েকে বসিয়ে বিকেল বেলায় বেড়াতে বের হয়। অতিক্রান্ত বিকেলে তাদের গন্তব্য থাকে হয় চৌরাস্তার মোড়, লোকে বলে- টাউন, অথবা সিনেমা হল-একমাত্র গণ বিনোদন কেন্দ্র, কিন্তু এইসব ‘কহতব্য নহে’ ধরনের সিনেমা দেখতে ভালো লাগে না বলে তারা নদীর ধারে ভেসপা থামিয়ে নেমে যায়। নদীর তীর ঘেষে নিধি দৌড়ে বেড়ায়। তার পায়ে বাবার বেঁধে দেয়া ফিতেঅলা জুতা। সে একবার একটা গাছের ভাঙ্গা ডাল কুড়িয়ে পায়, তো আরেকবার কুচো চিংড়ির মত মুখ মাথা গানিতিক নিয়ম মেনে মুচড়ে যাওয়া কালো শামুক পেয়ে গেলে খুশী হয়ে নিঃশব্দে হাসে। এই নদীর ধার ভীষণ জোড়ে উত্তরে হাওয়া দেয়, আরো উত্তরে কোন শৈলাবাস থেকে উড়ে আসা ঠান্ডা বাতাস দক্ষিনের ধুলিমাখা উত্তাপে দ্রুতই গরমে আকীর্ণ হয়ে মেশে। খাড়া দুই পাড়ও সে বাতাস আটকাতে পারে না বলে দিক নিশানা না পেয়ে কাছাকাছি বেতাল হয়ে ঘোরে। নিধির মা-বাবা অনতি দূরত্ব রেখে ধীর পায়ে নদীর কোল ঘেষে হাঁটে, তাদের চুল ওড়ে, শার্টের আস্তিন বেলুনের মত ফুলতে চায়, নবজাতকের যত্নে আঁচল সামলিয়ে মা নিধি’র শব্দহীন হাসি দেখে চোখের কোল ভিজিয়ে ফেলে। মেয়ে খিল খিল করে হাসলে তার ভেতর কত আনন্দে পূর্ণ হতো- এটা শুনে বাবা মা’কে মৃদু তিরস্কার করে। সামান্য মান-অভিমান পর্ব উৎরে তারা আবার হেঁটে হেঁটে নিধির স্কুল, ভবিষ্যত, ওর দাদীর ষ্ট্রোক এইসব নিয়ে আলাপ করে। নদীর হাওয়া নিয়ে কথা তুললে বাবার গল্পে রাশিয়ার ঠান্ডার প্রসঙ্গ আর বেজাতের হাওয়ার প্রসঙ্গ চলে আসে। নিধির বাবার বন্ধু হায়দার ছাড়া তাদের চেনাজানা আর কেউ যেহেতু মস্কো যায়নি, ওর মুখ থেকে শোনা শৈত্য নিয়ে একতরফা আলাপচারিতা করে যায়। সেখানকার তুষারপাতের অন্যরকম সৌন্দর্যের কথা আর হায়দারের কাছ থেকে দেখা আলোকচিত্রগুলির অভাব নিধির বাবাকে আরো মুখর করে ফেলে। এসব কথাবার্তার পাশাপাশি দু’চার দিনের মধ্যে তাদের গল্পে ঢুকে যায় সহকারী ম্যাজিষ্ট্রেট অনুপ আর আর তার স্ত্রী তমালিকার কথা।