(পূর্বপ্রকাশিত-র পর)
মর্কটে কর্কট এবং সারস্বত সঙ্কট
পাশের ভাঙাচোরা স্কুলঘর থেকে ভেসে আসে সুকুমার রায়ের ছড়ার লাইন। বৃন্দস্বরে পাঠ করছে ছাত্ররা, “কাঁচাও ভালো, পাকাও ভালো/ সোজাও ভালো, বাঁকাও ভালো…//” এগিয়ে গিয়ে দেখি, ও মা, মাস্টার তো সেই প্রবীণ শিয়ালপণ্ডিত— নাম যার ‘চিকন জ্ঞানী’ ওরফে ‘কাঁঠালগন্ধা’। ভিজিটিং লেকচারার হিসাবে ক্লাশ নিচ্ছে। তাজ্জব ব্যাপার! শিয়ালপণ্ডিতটা আগে শালিশ-দরবারে মাতব্বরি করত জানতাম, এখন দেখি ক্লাশও নেয়। ক্লাশভর্তি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সে কী উত্তেজনা-উদ্দীপনা! স্কুল পরিদর্শক এসেছে আজ স্কুলে। হা করে স্মিতমুখে কীর্তিকাণ্ড দেখছেন। হেডমাস্টারও কিছুটা হা-মুখ হয়ে তাকিয়ে আছেন পরিদর্শকের ওই হা-করা হাসি-হাসি মুখের দিকে। আর চিকন জ্ঞানী সামনের দুই পা টেবিলের ওপর তুলে পেছনের দুই পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে তার সেই ভাঙা-ভাঙা অনুনাসিক হুক্কাহুয়া বাংলায় ব্যাখ্যা করে বোঝাচ্ছে ছাত্রদের, “আচারের জন্য ভালো কাঁচা আম আর আমদুধ খাওয়ার জন্য পাকা আম। ঠিক কিনা ক’ তোরা? আমি তো শিয়ালবংশীয়, কিন্তু তোরা তো মনুষ্যসন্তান, তোরাই তো ভালো কইতে পারবি। আবার দ্যাখ্, লগি-র জন্য ভালো সোজা বাঁশ, আর ভার বওয়ার জন্যে যে বাইং বানাস তোরা, তার জন্যে ভালো ব্যাঁকা বাঁশ। সেই জন্যই তো কবি কইছেন, ‘কাঁচাও ভালো, পাকাও ভালো/ সোজাও ভালো, বাঁকাও ভালো//’। আর এত-এত ভালো জিনিশের নাম কওয়ার পর কবি শেষে কইছে একখান সুপার ফাইন কথা, ক’ দেখি সেইটা কী?” ছাত্ররা সমস্বরে বলে ওঠে, “কিন্তু সবার চাইতে ভালো পাউরুটি আর ঝোলাগুড়।” শিয়াল-মাস্টার বলে, “আহ্! দ্যাখ্ কী ফাইন ফ্যান্টাস্টিক কথা একখান!”
হকসেদকে এক নজর দেখেই লেজ নাড়াতে নাড়াতে বাইরে চলে আসে চিকন জ্ঞানী, পা ছুঁয়ে সালাম ক’রে আবার ঢুকে পড়ে ক্লাশে। হকসেদ সবার উদ্দেশে বলে ওঠে, “এই যে দ্যাখ্, এই-না হলো কবিতা! আহা! কী সহজ তার ভাষা, কী মোলায়েম তার ছন্দ, আর কী সোন্দর তার ভাবব্যঞ্জনা! তা-না, আকাইম্মা কবিগুলান, সাহিত্যিকগুলান আইজকাল কীসব খটোমটো কবিতা লেখে, নিরীক্ষা-মাড়াইন্যা গল্প লেখে… আগা নাই মাথা নাই, রস কষ সিঙ্গা বুলবুলি মস্তক…কাঁহা কুচ্ছু নাই… হুদাহুদি জিল্লিক পাড়তে থাহে!”
জঙ্গলে-ভরা পরিত্যক্ত পথের দুই পাশে দুই গদিঘর। দুই গদিতে গদিনসীন দুই পণ্ডিত, বুদ্ধিজীবী। দুজনেই এক-চোখা। একজনের ডান চোখ কানা, দ্যাখে কেবল বাম চোখে। আরেকজনের আবার ঠিক উল্টাটা। মজার ব্যাপার, ডানচোখা বুদ্ধিজীবীর গদিটা রাস্তার ডান পাশে, বামচোখারটা বামে। দুজনেই খুব লেখালিখি করে, গবেষণা করে আর বক্তৃতা দেয়-সমাজ রাষ্ট্র রাজনীতি ইতিহাস এইসব নিয়ে। সমাজে ও রাজনীতিতে ঘটতে থাকা নানা আলামত দেখে তারা নাকি শুভ-অশুভ নির্ণয়ে দক্ষ, তাই তাদেরকে কেউ কেউ বলে ‘শকুনজ্ঞ’, কেউ বলে ‘বিশেষজ্ঞ’ আবার কেউ বলে ‘পারদ-খাওয়া পণ্ডিত’। মুশকিল হলো, তাদের একজন দ্যাখে কোনো কিছুর খালি ডান দিকটা, আরেকজন দ্যাখে শুধু বাম দিকটা আর সেই মোতাবেক মতামত উৎপাদন করতে থাকে ক্রমাগত। তারা পথ চলে ঝড়ের বেগে। চলার সময়ও দেখা যায় সোজা চলতে চলতে বামচোখা বিশেষজ্ঞটা ফেরেলের সূত্র অনুযায়ী আস্তে আস্তে বেঁকে যায় বাম দিকে আর ডানচোখাটা ক্যারলের সূত্রমতে ডান দিকে। মাঝে মাঝে দুজনের মধ্যে লেগে যায় আচ্ছামতো। পারে তো মেরেই ফ্যালে একজন আরেকজনকে। রাগের চোটে গজগজ করতে করতে তেড়ে যায় বারবার, কিন্তু পথের সীমা তো আর লঙ্ঘন করতে পারে না, তাই কী আর করবে, ফাল দিয়ে গিয়ে লাত্থি মারে সামনে পড়ে-থাকা টিনের বালতিতে। জঙ্ঘার সামনের দিকে রেডিও-আলনা নামের যে হাড় আছে— যেখানে বাড়ি লাগলে এমন ঠেকে যেন জান বের হয়ে যাচ্ছে– বালতির আঘাত লাগে গিয়ে সেইখানে। ব্যথায় কোঁকাতে কোঁকাতে আহত পা-টা দুই হাতে ধরে এক পায়ের ওপর লাফাতে থাকে বুদ্ধিজীবী।
পণ্ডিত আছে আরো একজন— ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মতো সে উদ্বৃত্ত, এবং নিরন্তর উল্লম্ফমান। জঙ্গুলে রাস্তাটার ডানেও না, বাঁয়েও না, ঠিক মাঝখানে গিয়ে উঁচু এক টংঘর বানিয়ে আস্তানা গেড়েছে সে। এই পণ্ডিত অবশ্য দেখতে পায় দুই চোখেই… তার অবশ্য অন্য সব মজার মজার খাসলত আছে, পরে বলছি, তবে ভাব দেখায় এমন যে, সে ডানপন্থীও না, বামপন্থীও না, খাঁটি মধ্যপন্থী। আসলে সে হামাগুড়িপন্থী । হকসেদ আর ওই তিন পণ্ডিত— চার জনের ছিল গলায় গলায় খাতির, যাকে বলে একবারে ‘জানি দোস্ত’ তারা, পরস্পরের। রতিশক্তি তুঙ্গ ও টেকসই করার জন্য চার পণ্ডিতে মিলে কত কিছুই-না করেছে! গেঁজে-পচে-ওঠা চর্বি খেয়েছে গন্ধগোকুলের, মালিশ করেছে শান্ডার তেল, শ্রীপুরের ট্যাবলেটও খেয়েছে, খেয়েছে হামদর্দের হালুয়া। কিন্তু কাজ হয়নি কোনো। অবশেষে চার বন্ধু মিলে যুক্তি করে মোতালেব কবিরাজের পরামর্শমতো পারদ খেয়ে নিয়েছিল হাতের কোষ ভরে। বীর্যরঙা সেই অমৃততরলের দ্রব্যগুণ এমনই যে, পারদপানের কয়েকদিনের মধ্যেই শরীরে দেখা দেয় বিস্ময়কর কুদরতি-শক্তির উৎপাত। আট-কুঠুরি নয়-দরোজার এই যে ভূতাবাস, তার সব কয়টা কুঠুরি ঘুরে সেই পারদ জিল্লিক পাড়তে-পাড়তে বেরিয়ে আসে নয়-দরোজার কোনো এক দরোজা দিয়ে। আর যখন তা বের হয় যে-পথ দিয়ে, সে-পথের হালুয়া তখন পুরোপুরি টুয়েন্টি-টাইট। পারদের ঐশী মাজেজায় সংশ্লিষ্ট প্রত্যঙ্গের তখন মহা-ডগমগানি দশা। কোনো-কোনো আগলমার্গ শুলকাতে থাকে লাগাতার, আবার কোনো-কোনো নিগমপথ জিলকায় থেকে-থেকে। তো, ডানচোখা পণ্ডিতটার পারদ বেরিয়ে এসেছিল তার বাঁ-চোখের মণিপথ দিয়ে, আর বামচোখা বুদ্ধিজীবীর পারদ তার ডান নেত্রপথে। দুজনের দুই চোখের মণি তাই পুরাপুরি পারদশাদা। আর তিন নম্বর পণ্ডিতের পারদ বেরিয়েছিল যে-পথে, সে-পথের কথা আর নাই-বা বললাম। কারণ, ওই ঘটনার পর থেকে প্যাসিভ-পণ্ডিতটার অসভ্য জ্বালাতনে এলাকার ডাকসাইটে সব মশলাসুরভিত-গুহা-অভিযাত্রীরা একবারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। পালিয়ে বেড়াচ্ছে তারা ভয়ে ও লজ্জায়।
হকসেদ পণ্ডিতের পারদ অবশ্য নিষ্কাশিত হয়েছিল তার ইপ্সিত পথেই। স্বগতোক্তির মতো বলতে থাকে হকসেদ, “হামার পারদ তো নিকাশ হইছিল মার্গমতোই, কামও হইছিল, কিন্তু কী আর কমু, শালার হাতিয়ারটাই হারাইলাম অকালে। যাইক-গা, প্রকৃতির অঙ্গ প্রকৃতির খাদ্য হয়া মিশ্যা গ্যাছে প্রকৃতির সাথোত, হামার কী!” ঠিক সেই সময় রাস্তার পাশে আকন্দ ঝোপের ধারে হকসেদের দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসছে ওই সেই খাটাশটা যে-কিনা হকসেদের জৈব হাতিয়ার খাবলা দিয়ে ছিঁড়ে নিয়ে খেয়ে ফেলেছিল বছরখানেক আগে। হকসেদ দৌড়ে গিয়ে খপ করে ধরে ফেলল খাটাশটাকে। হাতের পাশের ঝোপ থেকে একগোছা বিছুটির পাতা ছিঁড়ে নিয়ে ডলে দিল খাটাশের এমন এক প্রদেশে যে, চিৎকার করতে করতে খাটাশটা লেজ তুলে দিল ঝেড়ে দৌড়, বিলাইমারির বিলের দিকে।