(পূর্বপ্রকাশিত-র পর)
হকসেদের অগস্ত্যযাত্রা
হকসেদ আজ হনহন করে হাঁটছে উত্তরের দিকে। সঙ্গে তিন জন। একজন একটু আলে-খাটো, বোঝে কম, বা বুঝলেও দেরিতে বোঝে। আরেকজন ঘাউরা স্বভাবের, কথায় কথায় খালি উজানি ধরে। আজ হয়েছে কী হকসেদের! যা কিছুই করছে, সবই দ্রুতবেগে– হাঁটছে দ্রুত, কথা বলছে দ্রুত। আর সেই সাথে আশপাশের প্রকৃতিতেও সবকিছু ঘটে যাচ্ছে বিদ্যুৎগতিতে… হকসেদ হাঁটছে যে পথ দিয়ে সেই পথ আর তার দুপাশ বরাবর বয়ে যাচ্ছে যেন একধরনের তড়িৎ-চুম্বকীয় ঝড়। শোঁ-শোঁ বাতাসে উড়ছে নাটবোল্ট, স্ক্রু, তারকাঁটা, পেরেক ও আলতারাজ, সেইসঙ্গে উড়ছে কাগজ ও কাকাতুয়া। আর কে যেন মাছরাঙা ছেড়েছে প্রচুর, অজ্ঞাত স্থানাঙ্ক থেকে। একইসঙ্গে ছেড়েছে বিচিত্র রঙের সব মাছও। বাতাসে মাছ উড়ছে, মাছরাঙাও উড়ছে প্রচুর। কিন্তু ছুটছে সব উল্টা তরিকায়। যেমন মাছরাঙার পেছন পেছন মাছ, পেরেকের পেছনে আলতারাজ। স্ক্রু-ড্রাইভারকে ধাওয়া করছে স্ক্রু, বল্টুকে নাট। বহুমুখী ঠোকাঠুকি হচ্ছে খাদ্য-খাদকে, নাটে-বল্টুতে, পেরেকে-আলতারাজে। ফুলচার্জড বাতাসে হকসেদ আর তার সফরসঙ্গীদের চুলগুলি সব মোহক-কাট ডিজাইন… গলাপাগোস দ্বীপের মেরিন ইগুয়ানাদের শিরদাঁড়ার খাড়া-খাড়া সব শলাকাসারির মতো।
হঠাৎ দেখা গেল, সরু একটা গুইসাপ গলায় মাফলারের মতো করে পেঁচিয়ে ঝড়ের বেগে এগিয়ে আসছে লম্বুপাড়ার মনতাজ লম্বু। তার দুই কানের সঙ্গে ফিট-করা অ্যালুমিনিয়ামের খুব ছোট্ট-ছোট্ট দুটি বাটি– মাইক্রো ডিশ অ্যান্টেনা। অ্যান্টেনা দুটির ওপর এক-পায়ে দাঁড়িয়ে আছে মিনি-মাছরাঙার দুটি বাচ্চা; আর মনতাজের ব্রহ্মতালুর ওপর লাগানো যে বজ্রনিরোধ-ব্যবস্থা, সেটার সেই চিকন তামা-শলাকার ওপর বসে আছে ছোট্ট একটা চড়–ই পাখি। দূর থেকে লম্বুকে দেখে মনে হচ্ছে যেন তুফান-গতিতে এগিয়ে আসছে এক হিজিবিজি শৈল্পিক মন্তাজ। কিংবা এক উল্লম্ব বিমূর্ত চিত্রকলা।
লম্বুপাড়ার সবাই অস্বাভাবিক উঁচালম্বা। সাড়ে-সাত আট ফুটের নিচে কোনো মানুষ নাই ওই পাড়ায়। লম্বুপাড়ার লোকেরা ঝড়বৃষ্টির দিনে একটু ফাঁকা জায়গায় বেরুলেই বাজ পড়ে তাদের মাথায়। তড়িতাহত হয়ে মুখে গাঁজলা তুলে লালবর্ণ হয়ে মারা যায় অনেকেই। আর কবরের ভেতর, উচ্চ ভোল্টের বিজলি-খাওয়া তাদের সব দেহকঙ্কালে চলতে থাকে এক দুর্বোধ্য তেজস্কর বিক্রিয়া, বছরের পর বছর। তাতে কঙ্কালগুলির অস্থিমূল্য বাড়তে থাকে দিনে দিনে। যত পুরনো কঙ্কাল, তত দাম। কবর থেকে চুরি হয়ে যায় মহামূল্য কঙ্কাল, তাই লম্বুপাড়ার গোরস্তানের চার দিকে সার্চলাইট লাগিয়ে পাহারার ব্যবস্থা করেছে লম্বুরা। ঠাটা পড়ে যে সবাই মরে তা নয়। অনেকে পঙ্গু ও বধির হয়ে যায়। শেষটায়, পরীক্ষামূলকভাবে ওদের শরীরে এক ধরনের জৈবযান্ত্রিক ডিভাইস লাগিয়ে দিয়েছে হকসেদ। বজ্রনিরোধ শলাকা, ফিউজ, সার্জ ভোল্টেজ প্রটেক্টর এবং অটো গ্রাউন্ডিং সিস্টেম…। আর যারা ইতোমধ্যেই ঠসা হয়ে গেছে, তাদের জন্য বাড়তি ব্যবস্থা হিসাবে কানে স্থাপনযোগ্য বিশেষ বাটিব্যবস্থা যা কাজ করে তেজি অ্যান্টেনার। হকসেদের ইমপ্রোভাইজ-করা ওইসব বিশেষ যন্ত্র লাগানোর পর থেকে লম্বুদের ওপর আসমানি উপদ্রব কম, অন্তত ঠাটা পড়ে আর মরে না তারা।
মনতাজকে আসতে দেখে হকসেদ দিল এক অট্টহাসি, তার সেই বিখ্যাত সিগনেচার-অট্টহাসি। তারপর মনতাজ লম্বুকে দেখিয়ে বলে ওঠে, “ওই দ্যাখ্, আইতাছে পারপেচুয়াল মেশিন অব দ্য সেকেন্ড কাইন্ড– ইনপুট লাগে না, কিন্তু বেজায় আউটপুট। লম্বুগো খাওয়াখাদ্য লাগে খুবই কম, কিন্তুক দ্যাখ্ কীর’ম অ্যাক্টিভ আর এনারজেটিক! অলওয়েজ বিজি। যে কিনা একবার আসমানি বিজলি খাইছে, তার তো আর লাগে না কিছু। কী কস রে কোঁকড়া, ঠিক কিনা?” মনতাজ লম্বু কাছে এসে পড়লে “কি রে মনতাজ, বিস্টি নাই বাদল নাই, মেশিন লাগায়া ঘুরতাছস যে?” ব’লে হকসেদ যেই তার মাথার ওপর লাগানো সরু শলাকা আর হাই-পাওয়ার চুম্বকগুলি ধরে ঠিকঠাক করতে গেছে, অমনি ঝটকা মেরে হকসেদের হাত সরিয়ে দিয়ে তাকে একটা চটকনা মারে দশাসই চেহারার মনতাজ লম্বু।
এতক্ষণ হকসেদ সবাইকে চড়চাপাটি মেরেছে, এবার খায় সে। হকসেদ থতমত খেয়ে বলে ওঠে, “আরে! এ দেখি গরম ভাতে বিলাই ব্যাজার। ওই ব্যাটা লম্বু, আমি গেলাম তোর মেশিন ঠিক কইরা দিতে, আর তুই মারলি চটকনা…।” হকসেদ যেই আবার ঠিকঠাক করতে গেছে লম্বুর মেশিন, অমনি কাছাকাছি কোত্থেকে যেন ভেসে আসছে ঝুনঝুন শব্দ। হকসেদ ছেড়ে দিয়ে আবার ধরে, আবার সেই ঝুনঝুন শব্দ। অবাক কাণ্ড!
পরে জানা গেল, শব্দটা আসলে আসছে ঘাউরাটার পোশাকের আড়াল থেকে। ছোটবেলায়, সেই দিগম্বর-বয়সে ঘাউরার কোমরে কালো সুতার তাগা বেঁধে তার সঙ্গে কয়েকটা ঘুঙুর লাগিয়ে দিয়েছিল ওর মা, যাতে সে না হারায়, চোখের আড়াল হলেও কান ও মনের আড়াল যাতে না হয়। কিন্তু ঘাউরা তো ঘাউরাই। বড় হয়ে গেছে, তবু খোলেনি সেই ঘুঙুর। কোমড়ের সাথে একটা আলগা ফেট্টি টাইট করে বেঁধে রাখে, যাতে হাঁটার সময় শব্দ না হয়। কিন্তু হকসেদের বিজলিনিরোধ মেশিনের সঙ্গে ফিট-করা উচ্চ ক্ষমতার যে চুম্বকগুচ্ছ, তাদের কায়কারবারই আলাদা, বের করে আনে গোপন ঝুনঝুনানিটুকুও।
নারীকণ্ঠের খলখল হাসির আওয়াজ আসছে রাস্তার ঢাল থেকে। হকসেদ অবাক। দ্যাখ তো কিত্তি! চুম্বকের টানে মাইয়া মানুষের হাসিও বাইর হয়া আসতেছে। তাকিয়ে দ্যাখে সেই মহিলা, গভীর রাতে গামছায় মুখ ঢেকে যার ঘরে ঢ়ুকেছিল হকসেদ। ঢাকায় দারোয়ানের চাকরি-করা স্বামীটা তার পেছন পেছন। হকসেদের দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপের হাসি হাসছে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই। হকসেদও হাসতে হাসতে বলে, “কিরে ঘোড়াওয়ালি, তোর ঘোড়ার হর্স পাওয়ার কত?” “না, না, ঘোড়াওয়ালি না তো, ও তো আফিয়া বানু, মিয়াবাড়ির জয়নাল মিয়ার বউ। ওই তো জয়নাল, পিছনৎ খাড়া।” সরলভাবে বলে ওঠে হকসেদের সফরসঙ্গী আলে-খাটো লোকটা। “ধুস্ ছেমড়া, বুরুবাক-খেসারি-কা-ডাল, রঙ্গরসও বোঝোস না!” বলেই হকসেদ সাথে-সাথে একটা চাটি মারে আলে-খাটোর টোবা-টোবা গালে।
প্রস্থানের প্রাক্কালে যেমন চোখের সামনে দিয়ে ঝলকে ঝলকে দ্রুত বয়ে যেতে থাকে সারা জীবনের নানা ঘটনাঘটন একের পর এক, সেরকমই ঘটছে আজ এই বগুড়া-অঞ্চলের স্থানিক প্রকৃতিতে। তবে কি আজকের এই হঠাৎ-চরমভাবাপন্ন-হয়ে-ওঠা আবহের ভেতর দিয়ে ঘটে চলেছে হকসেদের প্রস্থানপর্বের চূড়ান্ত মহড়া? অগস্ত্য মুনির একমুখী যাত্রার মতোই কি তবে আজকের এই হকসেদযাত্রা, কোনো এক অজ্ঞাত বিন্ধ্যাচল পার হয়ে? সঙ্গে চলেছি আমরা কয়েকজন। চলতিপথে এসে জুটেছে আরো লোকজন।
চলার পথে একের পর এক পার হয়ে যাচ্ছে ঠসাদের গ্রাম, বিধবা-পাড়া, ছিঁচকে চোরদের আস্তানা, লিলিপুট প্রাণীদের অভয়প্রান্তর…