এই মধ্য বৈশাখে তপ্ত রোদের ভেতর, হাঁটতে হাঁটতে কুদ্দুসের জিহ্বা আধহাত বের হয়ে আসে। বলতে গেলে বিনে পয়সায় বা আধা-মাগনা পেটে-ভাতে নাইট ডিউটি। সে কাজে ফাঁকি নেই। সারারাত প্রায় জেগেই থাকে। আজ ভোর ভোর সকাল থেকে দুচোখ ঢুলু ঢুলু। মাথা টলমল করছে। হলুদ প্রাচীর ঘেঁষে একটি কাঁঠাল গাছ, সেটির নিচে এককোণায় বসে ছিল। নতুন কান্দা এসেছে গাছের সারা শরীরে। জীবনের এক অভিনব সম্ভাবনার আশ্বাস। আর সকালের রোদ দুচোখ ঝিলমিলিয়ে যায়। উজ্জ্বল এক সকাল। তেমন খারাব লাগে নি। সে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকে। রাতে দেখা নানা দৃশ্যের কথা ভাবে। রাতের পৃথিবী অদ্ভুত মায়াময়। বিস্ময়কর রাতের আকাশ। সে এক স্বপ্নের দুনিয়া! সে বেশ কিছুক্ষণ ভাবালুতায় ভেসে যায়। আর কিছুক্ষণ ভেসে যেতে পারলে ভালোই হতো, কিন্তু পারল না। সেই ক্ষুধা জেঁকে বসেছে? পেটের কোণায় চুঁইচুঁই যন্ত্রণা জানান দিচ্ছে, কিছু খেতে হবে। সে বারকয়েক দরজার দিকে দৃষ্টি হানে। রুবির মা ডাকছে নাকি? অবশ্য এত সকালে এ বাড়ির লোকেরা নাস্তা খায় না। সেটি সারতে সারতে সকাল ন’টা। তারপর আজ আবার শুক্রবার। ছুটির দিন। অনেক ঢিমেতালে আলস্য ভাঙবে সকলের। সুতরাং বেশ দেরি হবে। এতকিছু ভেবে অবশেষে সে ঘুরে এসেছে বাহাদুর বাজার। সেখানে আবুল কশাইর কাছে কিছু পাওনা ছিল। তার সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয় না। তাই মনে একবুক আশা, আজ কিছু খাওয়াবে সে। নাস্তা পাওয়া যাবে। অথচ যখন প্রত্যাশার কিছু হয় না, মন ভাবনা আর হতাশায় ডুবে যায়। অবশেষে সে আবার কাঁঠাল গাছের নিচে পাতা বেঞ্চের ওখানে বসে জিরোয়। ফোঁস ফোঁস করে তুমুল নিঃশ্বাস ছাড়ে। রুবির মা যদি একবার খোঁজ করে এই ভাবনায় আধ-কিলো রাস্তা খুব দ্রুত দৌড়ে এসেছে।
আবুলের গায়ে কি সুন্দর পাঞ্জাবি! সেখান থেকে বের হয়ে আসছে মযমুয়ার কড়া-মিঠেল সুবাস। কুদ্দুস তার কাছে দাঁড়ায়। আবুল তাকে চেনে নি। খেকিয়ে ওঠে। অবশেষে কুদ্দুস দুচোখ কপালে তুলে সরে আসে। দুঃসময়ে চেনা মানুষ অচেনা হয়ে যায়। তার দৃষ্টি ঘোলা হতে শুরু করে। আজ তার চেহারা এমন কি হয়েছে, চেনা বন্ধুও অচেনা! নাকি না চেনার ভাণ করছে! সে কোনো প্রতিবাদ করে নি। আজকের রাশিচক্র অনুকূলে নেই। সময় খুব খারাব। কোটি কোটি জনপ্রাণির গিজগিজে দেশে কে কাকে মনে রাখে! কে কাকে চিনে রাখে! তারপর সে তো আবার মূল্যহীন এক সামান্য পেটভাতায় নৈশ্যপ্রহরী। এখানে এসেছে অনেকগুলো দিন, দিন নয় অনেকগুলো মাস পেরিয়ে। তা প্রায় বছর। সে মন খুব উদাস করে চলে আসে। সব ভাগ্য! উপরওয়ালা কপালে যা লিখেছে খণ্ডাবে কে?
এই তার জীবন! রাস্তার ধারে ফুটপাতের কোনো পরিত্যক্ত কোণায় কেটে যাওয়া অচ্ছুতের বেঁচে থাকা। তার কোনো ঘর নেই। একটু ছায়া নেই। একটু আলো নেই। কোনো বন্ধু কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই…কারও প্রতীক্ষা নেই। আশা ভালবাসা নেই। কিছু নেই। হাত-পা ঝাড়া এক অকর্মণ্য মূল্যহীন প্রাণ মাত্র। কুদ্দুস আশেপাশে তাকিয়ে একটু থামে। তারপর কী ভেবে এক চিলতে হাসির রেখা ঠোঁটে উঠে মিলিয়ে যায়। সে হাসি খুব দুর্বোধ্য…সেখানে চাওয়া পাওয়ার কোনো হিসাব বা খতিয়ান রেখাপাত করে না। সেটি এক বিমূর্ত লেখচিত্র মাত্র।
অনেক আগে, হয়তো গত বছর, জুলির সঙ্গে একটু সম্পর্ক গড়ে উঠছিল। সেই অতলান্ত দুচোখের গভীরে কখনো পূর্ণিমার চাঁদ কখনো তপ্ত দুুপুর খেলা করত। কুদ্দুস তা দেখে মুহূর্মুহূ কেঁপে গেছে শরীরে আর ভাবনায়। আদি-অন্তের প্রাচীন খেলায় বুঝে নিয়েছিল, এই প্রেম। প্রেমে বড় জ্বালা…অহর্নিশ পোড়ায়। পুড়তে হয়েছিল তাকেও। কেননা আদরের কেউ দূরে সরে গেলে সেখানে কান্না আর জ্বালা ছাড়া অন্য কী অবশিষ্ট থাকে! তার চেয়ে অনেক শক্তিশালী কালু মাস্তান। জুলি ওর সঙ্গে প্রেমে পড়ে গেল। কুদ্দসের বিশ্বাস কালু ভাগিয়ে নিয়েছে। আসলে তার আছে কী! দুটো হাত দুটো পা আর গভীর কালো ভাবলেশহীন একজোড়া চোখ। সেখানে বুকের ভালবাসা হয়তো কোনো ছায়া ফেলে না। গভীরতার কোনো রেখাপাত নেই। বুকের ভাষা যে মুখের কথায় আনতে হয়। শব্দ করে বলতে হয়। গায়ে একটু জোর থাকতে হয়। যে শালার নেই সে পারে না। তার আবার প্রেমের শখ কি! জুলি একদিন উজ্জ্বল বিকেল ছায়াম্লান করে দিয়ে চলে গেল। যাওয়ার আগে তার কাছে এসে খুব শুকনো গলায় বলে, –
‘যাইরে কুদ্দুস…কটা দিন ভালোই কেটে গেল। পারলে আমাকে মনে রাখিস।’
‘সেতো যাবিই, আমার কোন্ সাধ্যি তোর মতো রূপসীকে আটকায়। আমার কি শক্তি আছে…টাকা আছে? জমি জিরেত বাড়ি! যার আছে মেয়েমানুষ তার কাছে যায়।’
‘রাগ করিস না, জানিস তো একটু আরাম আয়েশের জীবন সবাই চায়। তুই কাজ কর, মাল কামা, টাকা পয়সা ধন দৌলত থাকলে কত টসটসা মাগি পাবি। মনের সুখে রাতে কোলে নিয়ে থাকবি। তখন সেই ওমে আরাম নিতে নিতে তোর এই জুলিকে একটু শুধু মনে করিস। এরচেয়ে আর কি চাই! চলিরে ঘাসিপাড়ায় এক ঘর পেয়েছি। সেখানে দুজনে থাকব।’
জুলির চোখেমুখে খুশি আর উচ্ছ্বলতা উপচে পড়ে। কুদ্দুসের বুকে হাহাকারের ঢেউ। চলে গেল পুরোনো সঙ্গী। কুদ্দুস কত স্বপ্ন দেখেছিল! সব বৃথা। জীবন এক মায়ার অচিন খেলা। শুধু মায়া আর বিভ্রম। তখন কোথায় যে প্রেমের নাম বেদনা গানটি বেজে উঠল; সে বোধহয় তার বুকের ভেতর।
তারপর থেকে বড় কষ্টের এই বেঁচে থাকা। বড় বেদনার জীবন। সারাদিন শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত অস্থির ঘোরাঘুরি। তখন কখনো মনকে বোঝায়, যা জীবনে ঘটে গেছে, মনে রেখে কী লাভ! জীবন আর বেঁচে থাকা সে এক গোলকধাঁধা, এখানে কেউ কেউ নিজের নিষ্পাপ মন অসচেতনতায় কিংবা নির্বুদ্ধিতায় খুইয়ে বসে; অন্য কাউকে দোষ দেয়। এই অভিযোগ করে দুর্বলেরা। সে তেমন একজন যদিও জানে পুরোনো অতীতকে ডেকে এনে কেঁদে কেঁদে কোনোকিছু হয় না। বরং বর্তমানের দিকে তাকিয়ে মুখোমুখি হতে হয়। কুদ্দুস মনকে এ রকম অটো-সাজেশন দিতে দিতে রাস্তায় নিজেকে গড়িয়ে দেয়।
মুন্সিপাড়ার গলিতে অনেকগুলো ঝুপড়ি ঘর। তারই একটি কোণায় পড়ে ছিল। বড় গলির পেছনে আর একটি সরু গলি। মূলত একটি বড় ড্রেন, আবর্জনার গলি। চলে গেছে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর। সেখানে সবসময় প্রস্রাবের বিকট গন্ধ। কখনো মানুষের তাজা গু পড়ে থাকে। বাতাসে ভুরভুর গন্ধ ছাড়ে। রোদের তাপে তীব্রতা বাড়ে। তারপরও সেটি ছিল তার আস্তানা। একাকী জীবনের ঠাঁই। সেখানে রাত হলে কতগুলো অচেনা লোক আসে। ধীরে ধীরে রাতের গভীরতা বাড়ে। লোকগুলোর উঁচু গল্পগুজব স্তিমিত হয়। একেবারে অনেক শান্ত। তার স্পষ্ট মনে আছে, প্রথম যেদিন এ গলিতে এসব ছেলেছোকরা আর লোকদের দেখেছিল, সকলে হাড়গিলে টাইপের। তখন সে হুঙ্কার দিয়ে জিজ্ঞেস করে, –
‘আবে তোরা কারা বে? এই গলির ভেতর কী করিস।’
তার কথা কে শোনে! কে তাকে পাত্তা দেয়! শুকনো গাল টসকানো চেহারায় কোনো শক্তি থাকে না। কেউ ভয়ে সমীহ করে না। তার পাশ থেকে এক বুড়ো কথা বলে ওঠে। এ চান্দু মাল কোন্ অন্ধকার থেকে কখন যে এসেছে কুদ্দুস টের পায় নি।
‘ব্যাটা এখানে নতুন এসেছ তো বুঝতে পারো নি। এরা কলেজের ছোড়া ক’ জন মাস্তান হেল্পার ড্রাইভার আছে। ডাইল খায়।’
‘সেইটা আবার কি চাচা? মদ?’
‘ও রকমই। ভালো ঘুম ধরে। মনে ফূর্তি আসে। শরীর-মন চাঙ্গা হয় আর কি?’
‘তুমি কেমনে জানলা, খাইছ?’
‘তা একটু খাইছি ব্যাটা। এখনো সুযোগ পাইলে খাই। পয়সা-টয়সা তো নাই। এরা একটু-আধটু দেয়। এদের মন খুব ভালো। তুমিও খাও। একটু খাতির করবার পারলে ফ্রি খাওয়াবে। এরা মানুষ খুব উদার, মনটা বড়।’
খাতির থাকলে সব পাওয়া যায়। খাতিরের লোক হতে গেলে পিছে পিছে ঘুরতে হয়। একটু মোসাহেবি করতে হয়। তা কুদ্দুস বেঁচে থাকার জন্য কতকিছু করেছে। একটু সুখের জন্য এ আর তেমন কি? মুখে মুখোশ এঁটে কত লোকে কত ফায়দা হাসিল করছে। নেতা-গোতারা তো ভোটের সময় চেহারা পাল্টায়, কত রঙের কথা বলে। শুকনো রোগা পটকা, গায়ে ঘামের দুর্গন্ধ তাদের সঙ্গেও কোলাকুলি করে। শেষে হাত মেলাবার অছিলায় অতি-আন্তরিক আবদার করে, –
‘মিয়া ভোটটা দিও।’
‘ভোট বাবা তোমার নিশ্চিত। আমার বাড়িত তিনটা ভোট একেবারে বুক হয়া গেল বাবা।’
‘এই তো গণতন্ত্র। এভাবেই একদিন স্বপ্নের জীবন শুরু হবে। কেউ না খেয়ে রাত কাটাবে না।’
‘জি বাবা এইটাই শুধু চাই। আমরা গরিব মানুষ। বড় গাড়ি বাড়ি চাই না। মোটা চালের ভাত মোটা কাপড় আর রাতে ঘুমাতে চাই।’
‘পাইবা পাইবা আমাদের দল এইটার জন্যই কাজ করে। ভোট তাহলে পাক্কা বুঝব না কি?’
‘এক্কেবারে পাক্কা…মনে করেন সীল পইড়ে গেছে।’
কুদ্দুস দূরে বসে কখনো দাঁড়িয়ে দেখে। সে এক যাত্রা-পালার মতো। তার ভালো লাগে। সে ভোট দেয় না। ভোট দেয় ভোটার। সে ভোটার নয়। হওয়ার কথাও নয়। কুদ্দুস শুধু জানে, লোকেরা ভোট না দিলে বড় বড় মেকআপ মারা হাসিখুশি চেহারার নেতারা খাবে কী? মজা করবে কী? এইসব অনিচ্ছুক ভাবনায় কুদ্দুস শুধু দেখে, মানুষগুলো এই ফাঁকে একটু বুকে বুক মিলিয়ে নেয়। নেতাদের পরীর মতো বউবেটিদের দেখে মনের খায়েস পূরণ করে। তা সে দুধের স্বাদ ঘোলেই মিটুক। মিটছে তো! না হলে তারা তো আসমানে থাকে। কবে সেখান থেকে নেমে আসবে, তুই শালা কুদ্দুস আর দেখতে পাবি না। সে ড্যাব ড্যাব করে দৃষ্টি নাচায়, মন বাতাসে ওড়ায় আর…। সামনে নির্বাচন। এখন দেখে নে। সে চোখ বড় বড় করে তাদের দেখে। মনে শান্তি আসে। আবার পাঁচ বছর। ইচ্ছে হলে তো তাদের দেখা পাওয়া যায় না। কেউ পারে না। তার জন্য পাট্টি করতে হয়। পিছে পিছে ঘুরতে হয়। মিছিল করতে হয়। জান পেতে দিতে হয়। কুদ্দুস জানে, কিন্তু সেখানে তার অংশগ্রহণ নেই; সে এতসব পারে না। সে শুধু মানুষের ভোট দেয়া দেখে আর সারা জীবন হিসাব কষে, তারা কী করতে চেয়েছিল; কী করেছে? তাদের কী পাওয়ার আশা ছিল; কী পেয়েছে? অবশেষে ‘তুই শালা বাড়ার বাল হরিশংকর পাল, তোকে কে পোছে বে!’ কুদ্দুস মনে মনে নিজেকে গাল দেয় আর তার মানসচোখ যে খুলে গেছে, অনেক জ্ঞান হয়েছে বুঝে নেয়। তাই কলেজের ছোড়াগুলোর সঙ্গে ড্রাইভার হেল্পার তা তারা যেই হোক একটু খাতির জমাবার চেষ্টা করে। সফলও হয়। সেও বোতলের তলানিতে চুমুক দেয়। ঢুলু ঢুলু দৃষ্টিতে দুনিয়াকে দেখে, যাহ্ শালা মাইরি গলিটা এত সুন্দর!
এভাবেই কেটে গেল কয়েক মাস। তারপর একদিন আবার কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হলো। সে তখন আবুলের কাছে যাচ্ছিল। মাথার উপর শীতের রোদ। টানা ছয়-সাত দিনের ঘন কুয়াশা চাদর ভেঙে আলো ফুটেছে। চমৎকার আকাশ। দু চারটি পরিযায়ী অচেনা পাখি ইলেকট্রিক তারে বসে, গাছের ডালে পাতার ফাঁকে লুকিয়ে গান ধরেছে। তার মন ফুরফুরে বাতাসের মতো শিস দিতে চায়। ঠিক তখন আকস্মিক চোখে পড়ে, জুলি হেঁটে যাচ্ছে। কে বলবে শেষ দেখার সময় কত চনমনে টগবগে যুবতী ছিল! এখন চেহারা-ছবি ঝুলে গেছে। এই শালা জীবন! দুদিনের যৌবন! তারই এত ঠাঁটবাট। তা জুলি জীবনকে ভোগ করেছে। কুদ্দুস করল কী? সে একটু থমকে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে ডাক দেয়, –
‘হেই জুলি…কেমন আছিস রে?’
জুলির কোনো স্মৃতি মনে পড়ে যায়। বেশ দ্রুত তার কাছে এসে দুচোখ মেলে ধরে, আহা কত কাল দেখে নি! তাই তো! কুদ্দুস হা করে তার দিকে তাকিয়ে এও বোঝে, একটু বার্ধক্য এলেও জুলির দৃষ্টি আগের মতোই পুরুষপটানো গরমাগরম; বরং আরও চৌকস।
‘জানিস লোকটা মরে গেল। আজকালকার ড্রাইভার রাস্তাঘাটে জনমনিষ্যি দেখে না। অমন যোয়ান পুরুষ তাকে পিষে দিল।’
‘আহা কালুটা মরে গেছে, শুনিনি তো! তা সড়ক অবরোধ করিস নি? দু চারটা বাস ভাঙতি।’
‘শালা মসকরা করিস?’
‘সেকি রে এখন তো হরহামেশা এসবই হচ্ছে! তা যাক কত দিন পর দেখা না? বাচ্চাকাচ্চা কয়টি?’
‘আছে আছে, একদিন ঘাসিপাড়ায় আয় চিনিয়ে দেব। চেনা থাকলে ভালো, না হলে কোনোদিন রাস্তা ঘাটে চাচা ভাতিজা ধাক্কা লেগে মারামারি করবি আবার! আসিস।’
‘তা ঠিক বলেছিস। তবে এখন কে চাচা আর কে ভাতিজা! কার মাল কে খায়!’
‘তাও ঠিক। তা কোথায় যাচ্ছিস?’
‘এই একটু আবুলের ওখানে, লোকটা ভালো। দিলদরিয়া। সকালের খাওয়া হয় নি। ওকে পটিয়ে কিছু খেতে হবে। তুই কোথায় গিয়েছিলি?’
‘না যাচ্ছি…একটু তো ধান্ধা করতে হবে।’
‘আর সাঙ্গা করবি না?’
‘কেন তোর শখ হচ্ছে?’
‘না রে আমি এখন দেবদাস। পুরুষত্বহীন নায়ক হা হা হা ! গলিতে মাল খাই আর ঘুমাই।’
‘শালা তুই আগের মতোই ছ্যাঁচোড় আছিস। যাইরে…একদিন আসিস।’
‘আচ্ছা যাব।’
জুলি চলে গেল। কুদ্দুস তার পেছনে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। মেয়েমানুষ। একবার কারও বিছানায় গেলে আর কিছু থাকে না। পুরুষেরাও বোঝে না তার মেয়েমানুষ কার বিছানায় কতবার শুয়ে এসেছে। এই হলো ভালবাসার জীবন। ধিক এই ভালবাসা…তার মুখে পেচ্ছাব করে দিই! সত্যি তার প্রশ্রাবের বেগ চাপল। সে খুব ভদ্রলোকের মতো মিশন স্কুলের দেয়াল ঘেষে আড়াল হয়ে কাজে লেগে গেল। তখন তীব্র গন্ধে ভরে ওঠে চারপাশ। সেদিকের ফেনায় তাকিয়ে অস্ফুটে বলে বসে, এই হলো তোর ভালবাসা… এই হলো তোর ভালবাসা।
কুদ্দুসের জীবনভর তিক্ততা। দিনের বেলা কোনোমতো কোনো এক বারান্দার এককোণায় পড়ে থাকা। রাত হলে সামান্য চারটে খেয়ে রাত পাহারা। সে পাহারাদার। মানুষের ঘরদোর পাহারা দেয়। মন পাহারা দেয়া যায় না। কারও মনের খবর সে রাখতে পারে না। কেউ পারে না। সেখানে তার দরকার কী! তবে ফ্লাটের সরকার সাহেব যখন পোটলাপুটলি বেঁধে ছেলেমেয়ে আর বউকে নিয়ে ট্যাক্সিক্যাবে ওঠে, তার মন চেয়েছিল গ্রামের হাওয়া-বাতাসে সেও না হয় দুদিন কাটিয়ে আসে। কত দিন পুনর্ভবার হাঁটু জলে পা ভেজায় নি। সেই যে ছোটবেলায় খাওয়ার অভাবে মাঝ শহরে চলে এলো, কে তার খোঁজ রাখে! সে এদিক ওদিক ধাক্কা খেয়ে খেয়ে অবশেষে আমিন সরকার বাড়িতে এক ছোট কাজ পেয়েছে। লোকটি ভালো। চোখে চতুষ্কোণ চশমা, কোঁকড়ানো চুল আর কাঁধে ঝোলান চটের শৌখিন এক ব্যাগ। শোনা যায়, কবিতা লেখে। সেটিই হবে, নইলে মধ্যরাত জেগে জেগে কেউ ছাদের উপর পায়চারি করে না! কোনো কোনো গভীর রাতে আকস্মিক মোড়ের দোকানে যায় না! লোকটি কোনোদিন রাস্তায় নামার আগে লনে থমকে দাঁড়ায়। কুদ্দুসের দুচোখ আলো আঁধারে চক চক করে। সেদিকে আলগোছে একবার দৃষ্টি ফেলে। তারপর বেশ উৎফুল্ল মনে ভারী গলায় বলে ওঠে, –
‘কুদ্দুস রে একটু দেখে রাখিস বাপ, দিনকাল ভালো না। আমি এই যাব আর আসব। মনে এক ভাব এসেছে বুঝলি, এখন একটু টান দিলে ফাটাফাটি একখান লেখা যাবে।’
কুদ্দুসের জবাবের তোয়াক্কা কেউ করে না। সে তখন বেঞ্চের ওখানে বসে থাকে। মাথার উপর কাঁঠাল গাছ। সেখানে একজোড়া কাক, কখনো তার বেঙ্গমা-বেঙ্গমী মনে হয়। হয়তো কিছু বলে উঠবে। সে উন্মুখ শ্রুতি মেলে জেগে থাকে। তার ঘুমানো চলে না। রাত জেগে জেগে সবদিক সামলে দেখে রাখতে হয়। নির্ঘুম রাত পাহারা চোখ তার। আর মাঝে মাঝে খুব জোরে দু-চারটি হাঁক দেয়া। পাহারাদার তো তাই করে। সে মানুষ আর তাদের সম্পদের পাহারা দেয়। তাকে দেখার কোনো মানুষ নেই। তার কথারও কোনো মূল্য নেই। কে তার সঙ্গে কথা বলল কি বলল না তাতে কারও যায় আসে না। কেউ তার উত্তরের অপেক্ষা করে না। সে সামান্য এক ছোট পেশায় লেগে আছে। নিজের দুচোখ খুলে রেখে অন্যের দুচোখে ঘুম এনে দেয়। সেই ঘুমে নিরাপদ স্বস্তি মিশে থাকে। তার নিজের কোনো নিরাপত্তা নেই। স্থিরতা নেই। কোনো মূল্য নেই। রাস্তার ফুটপাতে জন্ম, সেখানেই হয়তো মৃত্যু। সে এই বিশাল পৃথিবীর কোটি কোটি প্রাণির মধ্যে এক ক্ষুদ্র পোকা মাত্র। তার সতর্ক দৃষ্টি ধরে রাখে শুধু রাত। অন্ধকার রাতের সহস্র রূপ জেগে জেগে দেখে দেখে পার করে দেয় তার রাত পাহারা চোখ।
কোনো কোনো সন্ধ্যে রাতে ফ্লাটে চেঁচামেচি চিৎকার হয়। থালাবাসন আছড়ে ফেলার বিস্তৃত আওয়াজ। জিনিসপত্তর ভেঙে যাওয়ার শব্দ। কুদ্দুস প্রথম প্রথম অস্থির হয়ে পায়চারি করত। এখন বুঝে গেছে। তাই চুপ করে শোনে। জুল জুল করে দৃষ্টিকে দূরবীন করতে চায়। সেখানে নজর যায় না। যাওয়ার কথাও নয়। যতটুকু বোঝে আর তা হলো, মাঝখানে কোনো এক মেয়েছেলে রয়েছে। সেই মানুষটি আমিন সরকার আর তার স্ত্রীর মধ্যে এক বিষবৃক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কুদ্দুসের সতর্ক কান।
‘তুমি তাহলে রিনির কাছেই যাও না, কেন আমার সাথে থাকো য়ু বাস্টার্ড?’
‘চুপ, একদম চুপ করে থাক, বেশি কথা বলিস! একজন মানুষের সাথে একটু গল্পটল্প করলে কিছু হয় না। তোর খালি সন্দেহ।’
‘গল্পটল্প? সেদিন তোদের হাতে-নাতে ধরলাম। তোরা শেষ বিকেলে ফাঁকা অফিসে কী করছিলি? লম্পট কোথাকার!’
‘যা মুখে আসছে তাই বলছিস কিন্তু, আর সহ্য করব না।’
‘কী করবি তুই? কী মনে করিস নিজেকে, দেখে নিবি? আমিও থানা পুলিশ চিনি।’
‘অপি যা বলেছ বলেছ আর নয়, এবার চুপ করো। ছেলেমেয়েদের সামনে এসব কথা আর বলো না।’
‘ওসব করার সময় তাদের কথা মনে থাকে না?’
কুদ্দুস আর তেমন চিৎকারের শব্দ পায় না, বাতাসে যা ভেসে বেড়ায়, শুধু ফোঁপানো কান্না আর কেমন পরিচিত অপরিচিত আওয়াজ। অস্থির নিঃশ্বাসের পদাবলি। সে বুঝে ফেলে চলতি মাসের বরাদ্দ ধারাবাহিক নাটকের দ্বিতীয় পর্ব শেষ হলো। কালকের ভোরে দুজনের চেহারায় নাটকের কোনো দৃশ্যের ছায়াছবি আর থাকবে না। কি অদ্ভুত জীবন মানুষের! এত কথা চিৎকার…তারপরও কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারে না। কুদ্দুসের জীবনে তেমনকিছু হলো না। জুলি তাকে এক ধাক্কায় সরিয়ে চলে গেল।
তার বেঁচে থাকা এক কুকুরের দাসত্ব জীবন। তাকে কেউ গ্রামে নিতে চাইল না। কেউ বলল না, ‘কুদ্দুস তুইও চল, দুটো দিন থেকে চলে আসবি।’ না কেউ বলল না। তারপর সেই অবহেলার দৃষ্টি নাকি গ্রাহ্যতার অযোগ্যতা সে ভুলে গেছে। সে ক্ষুধায় কাতর হলো। কয়েকবার দরজায় গিয়ে রুবির মাকে খুঁজল। সে আধবুড়ি সুন্দরী কোথায় গেছে কে জানে! কুদ্দস তাকে খুব চুপেচুপে এই নামে ডাকে। এত ধিঙ্গি বয়স, তারপরও সাজগোজের বাহার! মুখে ঠোঁটে ক্রিম-লিপিস্টিক মেখে রান্নায় বসে। মসলা বাটে। মাংস কষায়। সে-সবের সৌরভ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। তখন কুদ্দুসের ক্ষুধা জিহ্বার সবটুকু জুড়ে চনমন করে ওঠে। সে ধৈর্য ধরে বসে থাকে। চাকর-বাকরেরা ডায়নিং’এ বসার সুযোগ পায় না। পাওয়ার কথা নয়। আসলে সে চাকরও কি না এ নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ তার কোনো বেতন নেই। নিয়োগপত্র নেই। অবশ্য চাকরবাকরের কোনো নিয়োগপত্র থাকে না। মৌখিক আলোচনায় চাকুরি হয়…মুখের ধাক্কায় চলে যায়। সে রবাহূত এক চাকুরে। পেটেভাতে রাত পাহারা দেয়। তাই চুপ করে বসে থাকে। নাকের দুটো ছিদ্র উন্মুখ মেলে ধরে। ঘ্রাণেন অর্ধভোজনম। সকলের খাওয়া হলে কিছু মেলে। সে নিজের জায়গায় বসে তারিয়ে তারিয়ে খায়। খাবার বা উচ্ছৃষ্ট যাই বলা হোক। সে পরিত্যক্ত জিনিস খায়। এ ছাড়া আর কিইবা তার নিয়তিতে আছে! তবু সে খুশি। এভাবেই কাজ করতে করতে কোথায় তলিয়ে যাবে কে জানে!
আজ তার খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। ভেবেছিল মালিক লোকটি আমিন সরকার খুব ভালো লোক, তার আহারের বিষয়ে রুবির মাকে বলে যাবে। কুদ্দুস সারাদিন সেই আশায় বসে রইল। দুপুরে কোনো খাবার পেল না। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে। তার চোখের সামনে দিয়ে রুবির মা রান্না করা খাবারের পোটলা বেঁধে নিয়ে চলে গেল। তার দিকে একপলক নজর দিল না। কুদ্দস কী করে! হাঁসফাস করতে করতে এদিক ওদিক তাকায় মাত্র। ক্ষুধায় পেট যত না কাতর তার চেয়ে ধাঁধায় পড়েছে দৃষ্টি। রাত পাহারা চোখ তার সন্ধ্যেয় রংধনু দেখে চলে। বুঝতে পারে, মালিক সত্যি কোনোকিছু বলে যায় নি। কুদ্দুস একলা একটি জীবন, কোনো এক সময়ে এসে পড়েছিল দোতলা এই ভবনের সম্মুখ দরজায়। তখন আমিন সরকার, হাস্যোজ্জ্বল মুখ; তাকে দেখে ভেতরে টেনে নেয়। তার ভারী লেন্সের পেছনের দুচোখে কুদ্দুসের ক্ষুধা ধরা পড়ে গিয়েছিল। অনেক করুণা করে কাঁঠাল গাছের ছায়ায় পাতা বেঞ্চের ওখানে তাকে খেতে দেয় সেদিন। কুদ্দুস নিশ্চুপ খেয়ে চলে। কত দিন সে ভালোমতো কিছু খায় না। লোকটিকে তার খুব ভালো লেগে যায়। তখন রাতকে মহৎ করে এক বড় চাঁদ উঠেছে। কাছে কোথাও বাজছে চমৎকার মন-ভোলানো গান। ছড়িয়ে পড়েছে নরোম রুপালি আলো। আমিন সরকার বলে, –
‘জানিস কুদ্দুস, হ্যাঁ তোর নাম দিলাম কুদ্দুস। তোর আর আমার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তুই যেমন সব আবর্জনা ঘেটে ঘুটে খাস, আমি তেমনি পৃথিবীর সকল নোংরা তারিয়ে তারিয়ে খাই। তুইও মানুষের গাল শুনিস আমিও…। তুই আমার বন্ধু বুঝলি! স্কুলে পড়ার সময় আমার এক বন্ধু ছিল, ওর নাম কুদ্দুস। বড়লোকের আদুরে নাদুসনদুস ছেলে। ক্লাসে প্রতিদিন নতুন নতুন চমক দেখাতো।
‘হ্যাঁ রে শোন, সে-সময় মাথা সুচালো জুতার ফ্যাশন এসেছে। কুদ্দুস একদিন সে-রকম একজোড়া চকচকে জুতো পায়ে স্কুলে এসেছিল। সকলকে দেখাল-সকলে দেখল। দাম কত, কোথা থেকে কিনেছে, আরও আছে কি না, কত আগ্রহ কত জিজ্ঞাসা! আমি চুপ করে আছি। মনের মধ্যে হতাশা। কারণ আমারও খুব পছন্দ হয়েছে, কিন্তু বাবা এমন জুতো কিনে দেবে না। তার পছন্দ বাটা, গোল মাথার কালো রঙের টাইট জুতো। মন খুব খারাব হয়ে আছে।’
কুদ্দুসের শ্রুতিতে তেমন মনোযোগ নেই। সে শুধু মাথা নাড়ায় আর দুচোখে তুলে ধরে এক আশ্চর্য কৃতজ্ঞতা। চর্ব-চস্য যা কিছু পেয়েছে, খুব দ্রুততার সঙ্গে খেতে থাকে। লোকটি তখনো বলে চলে, –
‘টিফিনের সময় কুদ্দুস আমাকে বলে তেমন একজোড়া জুতো কিনে নিতে। কিন্তু আমি তো জানি, সে-রকম ক্রিম কালারের মাথা সুচালো জুতো আমার বাবা কিনে দেবে না। আমি কুদ্দুসকে যত বলি, বাবা কিনে দেবে না; সে তত উপহাস করে। খুব কষ্টে সহ্য করে যাচ্ছি। টিফিনের পর কৃষিবিজ্ঞানের ক্লাস। সবুজসার কাকে বলে তার উত্তর খাতায় লিখে স্যারকে দেখানোর কথা। সেটা খুব মনোযোগের সাথে লিখছি। কুদ্দুস আমাকে রাগাবার জন্য থেকে থেকে বেঞ্চে ঝাঁকুনি দিচ্ছে। নিষেধ করছি শুনছে না। আর সহ্য করতে পারলাম না। বসিয়ে দিলাম এক বিরাশি সেরের চড়। গালের উপর আঙুলের দাগ পড়ে গেল। জানিস কুদ্দুস, আমি খুব শান্ত ছেলে; সাত চড়েও রা করি না। সকলে মনে করে, আমি ভীতু আর দুর্বল। সে যে যাই মনে করুক, আমাকে না রাগালে আমি কিছু করতাম না। কিন্তু…। তারপর সে ঘটনা ভুলেই গিয়েছিলাম বুঝলি? হঠাৎ একদিন স্কুল ছুটির সময় পেছন থেকে খুব বড় এক আঘাত পেলাম। দেখি, কুদ্দুস তার ওই জুতো পরা পা দিয়ে আমাকে লাথি মেরেছে। খুব লেগেছিল রে!
‘জানি না সেই ঘটনা কুদ্দুসের মনে আছে কি না, হয়তো ভুলে গেছে। কেননা যারা মার দেয় তারা একসময় ভুলে যায়। কিন্তু যারা মার খায় তারা? আমি ভুলতে পারি না…ভুলতে পারি না । কুদ্দুস, কুদ্দুস…শালা হারামজাদা কুদ্দুস!’
দুচোখের ঝিলমিল দৃষ্টিতে কুদ্দুসের সেই প্রথমদিনের কথা মনে পড়ে যায়। আমিন সরকার লোকটি ভালো, সহজ সরল। এ ধরনের লোকেরা সারা জীবন মার খায়, নিজেদের ভেতর কষ্ট পুষে রাখে। সেও তেমন। জীবনভর কষ্ট আর কষ্ট। এসব ভাবতে ভাবতে ভাবনার ঘোরে সে সকালে আবুলের দোকান থেকে ঘুরে এসেছে। আজ সবকিছু ব্যর্থ। আবুল তাকে চিনেও না চেনার ভান করে। রুবির মা তাকে এড়িয়ে গেল। কী লেখা আছে আজ তার রাশিচক্রে কে জানে! তার রাত পাহারা দুচোখ প্রচণ্ড উদাস। দৃষ্টিতে এক নিরত্যয় বেদনা নিয়ে সামনে আছড়ে পড়ে থাকে। সন্ধ্যে আরও গভীর হয়ে চলেছে। ধীরে ধীরে নামছে গভীর রাত। তার ভেতরে এক অস্থিরতার বিষাদ পরিক্রমণ করতে থাকে। সে দেখে আমিন সরকার লোকটি আসছে। তার সঙ্গে অপি ম্যাডাম, না না এ অন্য একজন। কুদ্দুস তাকে কোনোদিন দেখে নি। তার হাঁটার ধরন আর হাসির মধ্যে কোথায় এক অদ্ভুত বেপরোয়া ভাব। এ রকম ডাঁটু ভাব সে কোথায় দেখেছে? খুব চেনা চেনা, অথচ…কোথায়…কোথায়? জুলির মধ্যে? হ্যাঁ হ্যাঁ জুলি। একদিন ঘাসিপাড়ায় জুলির কাছে যাবে। এখন কালু নেই। বেশ মজা করে কাটিয়ে দেবে কয়টি দিন। এই ভাবনার মধ্য দিয়ে এক জোড়া নারী-পুরুষ তার দুচোখের সামনে দিয়ে স্বচ্ছন্দে ফ্লাটের ভেতরে চলে যায়। তাদের হাসাহাসি আর কথার গুঞ্জন বাতাসে ঢেউ হয়ে ভেসে আসে। শ্রুতিতে ভাসতে থাকে।
কুদ্দুস এক স্বপ্নের ঘোরে ঘুরছে। ঘুরছে আর ঘুরছে। স্থির থাকছে না কোনোকিছু। পেটের ভেতর প্রচণ্ড ক্ষুধা। তার দুচোখ জেগে থাকতে পারে না। ক্লান্তি আর শ্রান্তিতে অন্ধকার মাটির গভীরে নেমে যেতে চায়। নেমে যেতে থাকে। সেখানে এক অন্ধকার সুড়ঙ্গ। সে তার ভেতরে নেমে যায়, নিচে আরও গভীরে আরও নিচে। তখন সেখান থেকে উপরে এক উজ্জ্বল আকাশ দেখা যায়। সে দেখতে থাকে। একটি কাঁঠাল গাছ আর তার ডালে বেঙ্গমা-বেঙ্গমী বসে আছে। তাদের চেহারা পাখির মতো নয়, হয়তো কোনো অচেনা দেবদূত; না কি তারা কী সে জানে না। তারা কথা শুরু করে তখন।
‘আজ তুমি দৃষ্টিতে যা দেখ, সবটুকু সত্য নয়; মিথ্যের রংধনুতে হারিয়ে গেছে। মানুষের ঠোঁটে যে কথা ঝরে, সেখানে অনেক মিথ্যের মায়াজাল। এখন জগতের এই নিয়ম। সত্য অন্যকোনো জায়গায় থাকে, নিশ্চুপ নিঃসঙ্গ একলা। মানুষের সত্য আর নিয়ম এক তপ্ত মরীচিকা মাত্র। দুচোখ ধাঁধিয়ে যায়। তার নিজের কোনো নিয়ম নেই। সে নিয়ম তৈরি করে। ভাঙে আর গড়ে। অনিয়মের নিয়মে নতুন নিয়ম হয়। সে নিয়ম বিভেদ আর স্বার্থের সীমানা ঘেরে। পৃথিবীর সকল জিনিসের ধর্ম আছে, মানুষের নেই। অক্সিজেন জ্বালায়…হাইড্রোজেন জ্বলে। লবণ নোনতা…নিম ফল তিক্ত।
একসময় মানুষের নিয়ম ছিল। আজ স্বার্থের গোলকধাঁধায় পরিক্রমণ তার। সে অনিয়মের নিয়মে শৃঙ্খলিত। তারপর বিভেদ…মিথ্যে আর স্বার্থপরতা…নিদারুণ ভোগ আর ক্ষমতার কারসাজি। আজ তাই মানুষের বুকে সহস্র কুদ্দুস। সে শুধু আঘাত করে। আর এসবের ভেতরে একলা কোথাও জেগে থাকে রাত পাহারা চোখ। তার সত্যের দৃষ্টি আকুল ভেজা। উন্মুক্ত আকাশে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। সেখানে স্পন্দিত হৃদয়ের কোনো গান খোঁজে। কান পেতে শোনে…শোনার প্রচণ্ড চেষ্টা করে। সে সত্য যে তার বুকের ভেতর। সেখানে বসে আছে এক মার খাওয়া কুকুর…বহন অক্ষম তার দাসত্ব জীবন।’
কুদ্দুস এসব শুনতে শুনতে আরও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। অতল সমুদ্রের গভীরে হারিয়ে যায়। দিন শেষে তখন ঝিমঝিম করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। তার সরে যেতে ইচ্ছে করে না। অভিমান অনিচ্ছুক মন পোড়ে। সে ভেজে। ভিজতে থাকে। সেভাবে বৃষ্টিধোয়া পরিশুদ্ধ কোনোকিছু হতে চায়। তারপর কতক্ষণ কে জানে, একসময় কি এক কোলাহলে তন্দ্রা ভেঙে পড়ে। আশ্চর্য রাত পাহারা দিয়ে অভ্যস্ত তার চোখে কখনো ঘুম আসে না, সেটি হয় দিনের আলোয়; অথচ আজ কী হয়েছিল তার? সে তবে কোন্ ঘোরের মধ্যে ছিল…কোনো অলীক স্বপ্নে বিভোর? সেখানে জুলি ছিল, না না আমিন সরকার ছিল, না না যার দৃষ্টিতে সে খুব অসহ্য, সেই অপি ম্যাডাম ছিল। না কি সেই নারী যে কি না দেয়ালের দু প্রান্তের মাঝে এক দেয়াল, কি জানি তার নাম! তার কোনো নাম নেই, শুধু বর্ণালি; সে ছিল। কুদ্দুস এক ভ্যাবাচেকার ঘোরপ্যাঁচে ঘুরতে থাকে। পরিক্রমণ করে, করতে থাকে; কোনো থই পায় না। কতক্ষণ কে জানে, তার ঘোর লাগা দুচোখ অসম্ভব ক্লান্ত হয়ে যায়।
তারপর দেখে তার প্রভু ভদ্রলোক, দয়ার্দ্র মালিক কেমন কাচুমাচু দাঁড়িয়ে আছে। জটলার ভেতরে না কি সামনে সেই বিষবৃক্ষ সুন্দরী, মনে পড়ে যায়, তার নাম রিনি। আসলে তার কোনো নাম নেই, কোনো নাম থাকে না। কুদ্দুসের চোখে জুলির কোনো ছবি ভেসে ওঠে। কতগুলো চেহারা। যেদিকে দৃষ্টি ফেলে শুধু সেই মুখগুলো জেগে জেগে ভাসমান হয়। অদ্ভুত রংধনু মায়াজাল। অসম্ভব সুন্দর! কখনো ভুল হয়, এ চেহারাগুলো আসল না কি কোনো মুখোশ? মানুষ মুখোশ এঁটে নিয়েছে তার চেহারায়। এই বেঁচে থাকার দিনকালে সকলেই যে এমন! কুদ্দুসের কোনো মুখোশ নেই। সে শুধু পাহারা দেয়। মানুষের ঘর দোর, তাদের জীবন আর সুখ বিলাস। মানুষের মন পাহারা দেয়া যায় না। সেটি তার কাজ নয়। নিজেকে সে বার বার প্রশ্ন করে। প্রত্যুত্তরে শোনে বিপন্ন বিবেকের আর্তনাদ। নিজের মন পাহারা দেয়া খুব কষ্টের। এ এক অদ্ভুত জীবন!
তার গলি ভালো ছিল। সেখানে নেশা ঢুলু ঢুলু রাত…নিঃসাড় দিন। কেনো ছল-চাতুরী নেই। সবদিকে তার সহজ গতায়াত। মানুষের মন বড় দুর্ভেদ্য। কেউ যেতে পারে না। ঈশ্বরও নয়। প্রত্যেকে নিজ নিজ মন পাহারা দেয়-দিতে হয়। চেহারায় কোনো মুখোশ আছে কি না জেনে নিতে হয়। ভেতরে কোনো এক কুদ্দুস আসন গেড়ে বসেছে কি না খুঁজতে হয়। এসব দুর্বোধ্য ভাবনার মাঝে কে যে তার কানে কানে কী কথা বলে যায়, সে বুঝতে পারে না। শুধু নির্বাক স্থির দৃষ্টিতে জটলার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর আবার, যা তুমি দেখ সত্য নয়…সত্য অন্যকোথাও-অন্যখানে; হয়তো নক্ষত্রের ছায়াপথে রয়ে গেছে। লোকগুলো উচ্চস্বরে, কখনো গুনগুনিয়ে কিছু কথা বলতে থাকে। সে-সব ধীরে ধীরে স্তিমিত আর দুর্বল, বাতাসে মিলিয়ে যায়। হালকা হয়ে পড়ে ভিড়। তখন আমিন সরকার কিছু বলে না। নিশ্চুপ পাথরের মতো মুখ তার। লেন্সের ভেতরে রাত জাগা ঝাপসা-গভীর-ধূসর দৃষ্টি। সেই অন্ধকার রঙের ভেতর কি জেগে উঠেছে কোনো রাত পাহারা চোখ? কুদ্দুস কী করবে? তার বৃষ্টি ভেজা আধ-শুকনো শরীর, ভীষণ অবসন্ন পক্ষাঘাতগ্রস্ত প্রায়; ধুলো-কাদায় একাকার। সে তবু উঠে দাঁড়ায়। বেঞ্চের তলা থেকে বের হয়ে আসে। জ্বল জ্বল করে ওঠে তার তীব্র দুচোখ। তারপর অন্ধকার রাত কাঁপিয়ে দিয়ে বসে প্রচণ্ড এক চিৎকার।
ঘেউ ঘেউ ঘেউ-উ-উ! (সেপ্টেম্বর ’১২)