মাসুদ খান
(পূর্বপ্রকাশিত-র পর)
ওরসের দিনে ঝরে লাল চা’ল পিরের কবরে কিংবা জাত-পাত-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী সব একাকার
মাজারে আজ বার্ষিক ওরস মোবারক। লাল সালুর নিচে শুয়ে আছেন যে পির, তিনি একাধারে নারী এবং শিশু, নাম বিলকিস বানু। সবাই ডাকে ‘পির-মা বিলকিস বানু’। তাঁরই স্মরণে এই বার্ষিক ওরস। প্রতিবছর শ্রাবণ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে আয়োজন করা হয় এই বিখ্যাত ওরসের। আশপাশের দশ গ্রাম তো আছেই, এমনকি দূরদূরান্ত থেকে এসেছে পির-মা বিলকিসের মুরিদ, ভক্ত, আশেকান। মুরিদানদের মধ্যে যেমন আছে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, সাঁওতাল, রাজবংশী ইত্যাদি নানা জাত, তেমনি আছে শেখ সৈয়দ খান পাঠান কলু জোলা রাজিল ফাজিল ডোম চাঁড়াল ব্রাহ্মণ কায়স্থ কৈবর্ত নমঃশুদ্র ইত্যাদি নানান পাত, এমনকি আছে জানোয়ার-জাতির শৃগাল আর বায়সও। জাত-পাত-ধর্ম-বর্ণ ভেদাভেদ নাই কোনো। বিশাল এক ডেকচিতে খিচুড়ি রান্না হচ্ছে বাবুর্চিবিহীন। বাবুর্চিবিহীন মানে সুনির্দিষ্ট কোনো পাচক বা পাচিকা নাই এই রান্না-এক্সপ্রেসে। আর খিচুড়ি মানে যে-সে খিচুড়ি নয়, মহাখিচুড়ি… ঘ্রাণ ছুটেছে সাঙ্ঘাতিক… যে যা পারছে, যার যা সাধ্য, সব এনে ঢেলে দিচ্ছে বিশাল ডেকচিতে। ঠেকাচ্ছে না কেউ।
ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িকভাবে সাংঘর্ষিক এরকম কিছু খাদ্য বাদে দুনিয়ার এমন কোনো খাদ্যদ্রব্য নাই যা ঢালা হয় না ওই ডেগের গহ্বরে। রসু মাতবর ঢেলেছে ১০ কেজি দো-সেদ্ধ নাজিরশাইল, ৫ কেজি আতপ কাটারিভোগ, ২ কেজি সুগন্ধী কালিজিরা, কাজেম কসাই এইমাত্র কয়েক কেজি ভেড়ার গোশত, রমেশ ডোম কুচি-কুচি করে কাটা কালেম পাখির মাংস। আজিজ বিএসসি কয়েক বছর ধরে বিশেষ কায়দায় ইলিশ ফলাচ্ছে পুকুরে, সেখান থেকে দুটি বড়সড় মাছ সুন্দর পিসপিস করে কেটে এনেছে আর সুবল মাঝি এনেছে বাঘাড় মাছের টুকরা। অমূল্য দপ্তরি ঢেলেছে ২ কেজি সোনামুগ আর ২ কেজি বুটের ডাল; লতিফ লস্কর মশুর আর অড়হড়। তাগড়া মহিষ জবাই দিয়েছে রজ্জব মৃধা, সেখান থেকে সে দিচ্ছে সিনা ও গর্দানের গোশ। তহুরা বেওয়া ভেঙে দিয়েছে গলাছিলা মুরগির হালি চারেক ডিম, রবিন সাঁওতাল দিয়েছে জংলি খরগোশের মাংস। কাছিমের ডিম নিয়ে এসেছিল দুই বদ ছোকরা, দিতে দেওয়া হয়নি। মানিক ময়রার বউ দেড় কেজি স্পনজের রসগোল্লা আর এক কেজি রসমঞ্জরি। তোতলা তোসাদ্দেক, পেশায় পল্লিচিকিৎসক, ঘরের পাশের পালানে চাষ করেছে স্ট্রবেরি। সে ঢেলেছে তার শখের সেই ফল, ঝাঁকাভর্তি। সুরাইয়া হিজড়া ঢেলেছে গাছপাকা তেঁতুল, ডেউয়াফল আর করমচা। শিয়ালপণ্ডিত ‘চিকন জ্ঞানী’ ওরফে ‘কাঁঠালগন্ধা’ এনে ভেঙে দিয়েছে আস্ত একটা পাকা কাঁঠাল, বিচি, ভুতি আর কাঁটা-কাঁটা খোলস-সহ। আর কাকপণ্ডিত ‘শ্রী লালকালচে’, সে তো সমানে উড়ে যাচ্ছে আর আসছে আর ঠোঁটে করে এনে টুপটাপ ঝরাচ্ছে জাম, জামরুল, জয়ত্রী, জায়ফল, বটফল ও যজ্ঞডুমুর… অনবরত। তারপর আলু, পটল, শিম, কাকরোল, ধুন্দুল, গলাধরা ওল, ফুলকপি, কচু-ঘেচুসহ নানা জাতের খান্দানি-অখান্দানি আনাজ, তরিতরকারি… আর নানা জাতের ফলমূল, ডাল, কলাই, কন্দ, শস্য, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, মিষ্টান্ন… আর হলুদ, মরিচ, পিয়াজ, রসুন, আদা, জিরা, তেজপাতা, দারুচিনি, মশলাপাতি তো আছেই। পরিমাণের তোয়াক্কা নাই, অনুপাতের বালাই নাই, যে যেরকম পারছে ঢালছে।
বিশাল ডেগের কানা ধরে এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন মাদকসেবী, পির-মা বিলকিসের নাম ধরে হাউৎ করে কেঁদে উঠছে থেকে থেকে। গাঞ্জু ফরিদ, কাকলাস কামাল, ইয়াবা ফারুক, রস রফিক আর চরস গৌতম… একেবারে কেঁদেকেটে জারেজার। কঠোর গোপনীয়তার ভেতর ঘরের ছাদে টবের মধ্যে গাঁজার চাষ করেছে গাঞ্জু ফরিদ। বেশ কয়েকদিন ধরে প্রক্রিয়াজাত ক’রে গাঞ্জু তা আজ নিয়ে এসেছে মুঠায় ভ’রে। এবং এরই মধ্যে তা ঝরিয়েও দিয়েছে খিচুড়ির মধ্যে, সবার অলক্ষ্যে। হেরোইন– এমন যে মহামূল্য এক মাদকচূর্ণ, তা-ও নিয়ে এসেছে রস রফিক, ছোট ছোট পুরিয়া বানিয়ে। তবে ঢালতে পারেনি এখনো। কড়া নজর রেখেছে সবাই। আর ডেগটিকে ঘিরে অদূরে নাচগান করছে হিজড়া সম্প্রদায়। আজ তাদেরও উৎসবের দিন।
এই যে পির-মা বিলকিস বানু, তিনি একাধারে শিশুপির এবং নারীপির। তাঁর মহিমা ও মাজেজা এমনই যে, লোকান্তরে থেকেও তিনি এক অদৃশ্য অঙুলিহেলনে জাতপাতধর্মবর্ণলিঙ্গশ্রেণীপেশা নির্বিশেষে নানা রঙের, নানা মেজাজের মানুষকে বসিয়ে ছেড়েছেন একই পঙক্তিতে। তাঁর এই ওরসের খিচুড়িও একাকার করে দিয়েছে খাদ্যদ্রব্যের সমস্ত রকমের জাতপাতশ্রেণিবিন্যাস। ভূমণ্ডলে এমন ঘটনা সচরাচর খুব একটা দেখা যায় না। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার, ওরসের এই অদ্ভুত রেসিপির খিচুড়িটা প্রতিবছরই হয়ে থাকে অব্যর্থভাবে অপূর্ব– কি রঙে, কি ঘ্রাণে, কি স্বাদে। এক অনাস্বাদিতপূর্ব দিব্য স্বাদগন্ধযুক্ত পরমান্ন।