মাসুদ খান
(পূর্বপ্রকাশিত-র পর)
ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের যৌথবাহিনী
বহুদিন ধরে হকসেদের জ্ঞানকাণ্ডীয় উৎপাতে অতিষ্ঠ ও অপমানিত এলাকার মাতব্বর- ও পণ্ডিত-কুল। তারা ঠিক করেছে আজ ঠেক দেবে হকসেদকে। ঠেঙানিও দেবে ভাবমতন। এ কাজে ছাত্র-সিন্ডিকেটের কয়েকজন মাস্তানও জোগাড় করা হয়েছে চুক্তি ভিত্তিতে। সবাই মিলে যুক্তি করে ওঁৎ পেতে বসে আছে হকসেদের প্রস্থানপথের পাশে। নেতা-গোছের যে, তার নাম ফয়সল করিম, লোকে ডাকে ‘ফয়সালা করুম’। সে একইসঙ্গে হাঁটুভাঙ্গা বহুমুখী ভুবনবিদ্যায়তনের পণ্ডিতসঙ্ঘের সভাপতি, আবার নাম্বার-ওয়ান লোকাল মাতবর, আবার তেল ও ভুসিমাল ব্যবসায়ী সমিতির সম্মানী উপদেষ্টাও। খুব রাগ আর খালি প্যাঁচ আর পলিটিকস। চলাফেরা ক্ষমতাকাঠামোর আশেপাশে। এক অসাধারণ গিরগিটি-প্রতিভার অধিকারী, ক্ষমতার রং বদলে গেলে তালে-তালে নিজের রঙও বদলে ফেলতে পারে দ্রুত। সবসময় পাওয়ারের লোকজনদের সঙ্গে তার ওঠাবসা, আশনাই ও মিথোজীবিতা। তো, সেই নেতা-ফয়সল কয়েকজন চ্যালাসহ ঠেক-বাহিনীর অগ্রবর্তী মারমুখী দল হিসাবে ধেয়ে আসে হকসেদের দিকে। অবস্থা বেগতিক আঁচ ক’রে সামনে ওঁৎ-পেতে-থাকা ঠেক-ঠেঙানি-পার্টিতে আগাম ভীতিসঞ্চারের উদ্দেশ্যে হকসেদও তেড়ে যায় কয়েক কদম, বেশ আগ্রাসী ভঙ্গিতে। হাউৎ করে ওঠে হকসেদ, “এই! ব্যাটা ফাউল ফয়সল! হটাৎ গর্মা জাগো দিছে দেখতাছি, আয় দেহি ফয়সালা করি তোর।” বলেই থাবড়া দিয়ে ধরে ফেলে ফয়সলের চকরাবকরা গিরগিটি-আঁকা শার্টের কলার। ধরেই ঠাসঠাস করে দেয় কয়েকটা কানসা বরাবর। জোরে জোরে বলতে থাকে, “পাওয়ারের আশেপাশে মেনি বিলাইয়ের মতন ঘুরঘুর করোস, উটাকাঁটা যা ছিটায় তা-ই খাস আর ভাব দেখাস চরম বুদ্ধিজীবী, না? চুরিদারি টাউটারি ছাইড়া দিয়া অটো-সাইজ হয়া যা কইলাম। নাইলে কিন্তুক খবর আছে হুঁ! জব্বর খবর!”
এইভাবে নেতা-ফয়সল ধেয়ে গিয়ে পেয়ে যায় হকসেদীয় ফয়সালা। হকসেদের রাম-ঝাড়ি আর জাম্বো-মার খেয়ে রাগে রীতিমতো কাঁপতে থাকে সে। তোতলাতে তোতলাতে নালিশ দেয় ওঁৎ-পেতে-থাকা পণ্ডিতসমাজে, “দ্যাখেন দ্যাখেন, আমি কিন্তু কি-কি-কি-কিচ্ছু করি নাই, আমি আসতিততিততিতচ্চি আর হা-হা-হারামজাদা হকসেদ হামাক খালি মারতিততিততিতচ্চে… আমি আসতিততিততিতচ্চি আর হকসেদ মারতিততিততিতচ্চে…।” ঠেক ও ঠেঙানি-রেজিমেন্টের মধ্য থেকে কেউ একজন উত্তেজিত হয়ে যেই কিছু একটা বলতে গেছে, অমনি গর্জে ওঠে হকসেদের বিস্ফোরক কণ্ঠ, “খা-মো-শ!” হাঁক দিয়ে ওঠে হকসেদ, “খবরদার! আর একটা আওয়াজও হবে না কইলাম। কী হবে না? -আ-ও-য়া-জ।”
তারপর সমবেত ঠেক-পণ্ডিত ও ঠেক-মাতব্বরদের উদ্দেশে বলতে থাকে, “ভাইসব, আপনারা শান্ত হন। নো উত্তেজনা, একদম চুপ। আর একখান কথা কই আপনাগো, টাল্টিবাল্টি বাদ দিয়া টাইম থাকতে পিওর হন। ধুমায়া আসিচ্চে কিন্তু জনগণ। খালি পাওয়ার-পলিটিক্স কইরেন না, পাবলিকের পাল্সও বোঝার চেষ্টা করেন। যহন যেইদিক মধুবৃষ্টি, ছাতি ধরেন খালি হেইদিক, না? আপনাগো একেকজনের বিশাল বিশাল জ্ঞানকাণ্ড গজাইছে, মাগার কাণ্ডজ্ঞান গজায় নাইক্কা। কইতাছি-কি, খালি পাওয়ারের দিকে ঝুঁইকা থাইকেন না কইলাম, পাবলিকের দিকেও থাইকেন। আপস করতে করতে তো ময়লা পাপোশ হয়া যাইতেছেন-গা, হেই হুঁশ আছে? হুঁশে আসেন, ঠিক হয়া যান, নাইলে কিন্তুক হাচাই খবর আছে কইলাম।”
এরই মধ্যে দেখি সফরসঙ্গী আলে-খাটোটা বেশ স্মার্ট হয়ে উঠেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেবার উদ্দেশ্যে উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে ঝটপট ঘোষণা দিয়ে দিচ্ছে, “উপস্থিত সুধী ও সুশীলবৃন্দ, দয়া করে শান্ত হন আপনারা। উত্তেজনা ভালো না, আয়ু কমায়, হার্টফেল ঘটায়। আজ আপনাদের উদ্দেশে কিছু বলবেন বিশ্ববিশ্রুত জাঁহাবাজ পণ্ডিত, জাঁদরেল বক্তা, ওলামাশ্রেষ্ঠ, আপনাদের আমাদের সবার প্রিয় আল্লামা হকসেদ।” এরকম এক সঙ্কটমুহূর্তেও কৌতুকে কুঁচকে ওঠে হকসেদের বিরলকেশ জোড়াভুরু। বিড়বিড় করে বলে, “আল্লামা!? ওলামাশ্রেষ্ঠ!? হায় হায় এগুলা আবার কোন গজব? কী-কস-না-কস ব্যাটা আলে-খাটো! এ দেহি আস্ত বিখাউজ একখান!”
আলে-খাটোর ঘোষণা চলতেই থাকে, “…আর এটাই হবে আমাদের প্রাণপ্রিয় আল্লামা হকসেদের বিদায়ী ভাষণ, আখেরি ওয়াজ। মনোযোগ দিয়া শুনবেন সবাই, কাজে লাগবে।” হকসেদ আর তার বাহিনীর অতিশয় স্মার্ট কাণ্ডকারখানা দেখে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়কুল তাকে ঠেক দেবে কি, ঘটনার আকস্মিকতায় একেবারে তুরুপ জব্দ হয়ে বসে থাকে… আর ভয়ে ভ্যাবাচ্যাকা…।
চমক ছাড়তে থাকে হকসেদ একের পর এক। সবাইকে হতচকিত ও খামোশ করে দেবার অভিপ্রায়ে প্রথমেই সে বলে ওঠে, “ভাই ও বোনেরা আমার, বিসমিল্লাতেই কইয়া নেই, মাই স্পিচ কনটেইনস সাম ফাউল ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড কোরস কনোটেশনস। লিসনারস ডিসক্রিশন ইজ হাইলি অ্যাডভাইজড।” তারপর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে চালাতে থাকে তার এলোমেলো চাপা ও চোয়াল। “হোনেন, ফ্রেডরিক নিৎশে কী কইছিল জানেন? কইছিল, ‘গড ইজ ডেড।’ আর ওই দুরমুশা দার্শনিকটা মরছিল যেইদিন, হেইদিন গডে কী কয় জানেন নি? কইতে পারবেন কেউ? হাত তোলেন।” বাঘা-বাঘা সব পণ্ডিত ও প্রফেসরদের নিরুত্তর দেখে হকসেদ ঝাড়ি মেরে বলে ওঠে, “কী লেখাপড়া করছেন আপনেরা? আর পড়ান-ই বা কোন ঘোড়ার আণ্ডা! হোনেন, নিৎসে যেদিন মরে, হেইদিন গডে কয়, ‘নাউ, নিৎশে ইজ ডেড অ্যান্ড আই অ্যাম স্টিল অ্যালাইভ, অ্যান্ড আই উইল রিমেইন অ্যালাইভ ইন সো মেনি ওয়েজ হিউম্যানস ক্যান নেভার ইম্যাজিন ইভেন।’ এক্কেরে নাক্কিন কথা একখান, কী কন আপনেরা? এই যে নাকচুলকানি ফিলোসফির প্রফেসার, কথা কন না ক্যান? আজব!”
পোংটা পণ্ডিতের উপর্যুপরি ঝাড়ি খেয়ে কোনো কোনো পণ্ডিত কাচুমাচু, কোনো কোনোজন আবার ‘জি’ ‘জি’-মাথাঝাঁকানি… হকসেদ বলে যায় একনাগাড়ে, “এই যে দ্যাহেন, এই নয়া জমানায় গড নাইমা আইছে ‘ট্যাকা’-র রূপ ধইরা। হোনেন, কলিযুগের অবতার হইছে-গিয়া মুদ্রা-অবতার। মানি ইজ গড, অ্যান্ড ইন গড উই ট্রাস্ট। তাইলে বোঝেন! আবার ওইদিকে দ্যাহেন, কমুনিস্টরা গড-ফড ধর্ম-টর্ম কাঁহা কুচ্ছু মানে না, কিন্তুক মার্ক্সিজমকে ঠিকই রিলিজিয়াসলি মানে, বিশেষ কইরা স্ট্যালিনের কিত্তি-কারবারগুলা দ্যাহেন। হের লেইগাই তো কই, ক্যাপিটালিজমও ধর্ম, কম্যুনিজমও ধর্ম, নাৎসিবাদও ধর্ম, নাস্তিক্যও ধর্ম, আবার ধর্মও ধর্ম… এই তো? সবতেই হইল-গিয়া ধর্মেরই নিত্তিনোতুন লীলা… আর ধর্ম টানলে তো গড আসেই অটোমেটিক্যালি, ঠিক কিনা? তাইলে ‘গড ইজ ডেড’ কয় ক্যামনে দুরমুশাটা?”
এরপর আরো বেশ কয়েকটি বিষয়ে জ্ঞান ঝাড়তে থাকে হকসেদ– সেগুলির দু-একটি প্রাসঙ্গিক, বেশিরভাগই অপ্রাসঙ্গিক, অসংলগ্ন। মাঝে-মাঝে দুম করে ধরে বসে কঠিন-কঠিন সব ধাঁধা। যেমন বলে,
“কন তো দেহি, ‘হটেনটটেন টেনটেন টেনটুসটেলিং’ কথাটার মানে কী?, সব মাছ যায় উজান দিকৎ, কোন মাছ ভাটির দিকৎ?, কিংবা, ‘আমি মিথ্যা বলিতেছি’ এই বাক্যটা যদি সত্য হয়, তাইলে আমি কি সত্য বলতেছি, নাকি মিথ্যা?” ইত্যাদি ইত্যাদি। এমন সময় হকসেদের নজর গিয়ে পড়ে এক কাহিল যুবকের ওপর। সুবল লাল বসু। নবীন লেকচারার। বেশ ভদ্র। কিন্তু মাথা ন্যাড়া-করা, গলায় পৈতা, পরনে একপ্রস্থ সেলাইবিহীন শ্বেতবস্ত্র। কয়েকদিন আগে বাবা মারা গেছে বেচারার। অশৌচ শেষ হয়নি, এই অবস্থাতেই তাকে যোগ দিতে হয়েছে ঠেক-ঠেঙানি-বাহিনীতে। বেচারা! তাকে দেখেই কৌতুকের সুরে বলে ওঠে হকসেদ, “কি রে সুবল, মুণ্ডিতমুণ্ডু… দোস্তো, নতুন-নতুন বাপ মরল, খাওয়ালু না তো কিছু। খাওয়াবু লয়?” তারপর বলে, “হোন, মনোযোগ দিয়া অশৌচ পালন করবু, পিতৃতর্পণ করবু, আমাগো খাওয়াবু দাওয়াবু…তা লয়, আইসা যোগ দিছোস অগো ওই ঠ্যাংঠ্যাঙানি পাট্টিত, হামাক ঠ্যাঙ্গাইবার লাইগা, না? দোস্তো, তোর কথা আর কী কমু! তোর নাম ধইরা তোরে সোজা রাখলেও যে সুবল লাল বসু, উল্টাইলেও হেই সুবল লাল বসু, যে-কে-সেই। আর তোর দুলাভাই রমাকান্ত কামার, হেইটাও তা-ই…হি হি হি…” উপস্থিত সবাই এ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। দেখাদেখি সুবলও হেসে ওঠে শুকনামুখে, এত কষ্ট ও শোকের মধ্যেও।
আরো কিছুক্ষণ লাগামছাড়া মুখ বাজানোর পর একপর্যায়ে বলে ওঠে হকসেদ, “ওই, ওই দ্যাহেন, দ্যাহেন, পিছন ফির্যা চান, পাওয়ার বেশি হইলে মানষে কী করে দ্যাহেন? কী করে জানেন নি? এই যে দ্যাহো এহন আর কেউ জবাব দিবার পারে না, সব চুপ মাইরা রইছে! আপনেরা সব প্রফেসর নাকি প্রসেসর? নাকি প্রসেসার্ভার? ধ্যাৎতেরি, এইটা কিছু হইল! হোনেন, বেশি হইলে পাওয়ার, বানায় উঁচা-উঁচা টাওয়ার। কে কত উঁচা বানাইতে পারে তার পাল্লা লাইগা যায়। টাওয়ারগুলা দেখবেন খুব টানটান, খাড়া। ফ্যালাসের লাহান। আবার দেখবেন, টাওয়ারের আগার দিকে আস্তে-আস্তে ক্যাংকা-জানি চোক্খা হয়া গ্যাছে। টাওয়ারগুলা ক্যান বানায় জানেন? বানায় অন্যরে ডর দেহাইবার লাইগা। দুনিয়ার পাওয়ারফুল দ্যাশগুলার কিত্তি দ্যাহেন… কেউ বানায় টুইন টাওয়ার, কেউ বানায় সিএন টাওয়ার, আবার কেউ বানায় বুর্জ দুবাই… শা-লা! আমাগো ভয় দ্যাহাইবার লাইগা এইগুলা বানাও, না? খাড়াও দিতাছি… এই কয়া দিছে গুঁড়ামুড়া কইরা ওই খাড়া-করা টুইন ফ্যালাস… যাহ্! খাল্লাস! দিছে এক্কেরে খাল্লাস কইরা…”
“ওই দ্যাহেন দ্যাহেন, স্ট্যাচু দ্যাহেন, জলজ্যান্ত লাফাইন্যা-ঝাঁপাইন্যা স্ট্যাচু। দ্যাহেন খাড়ায়া আছে হিটলার-ইন-স্পেশাল-অ্যাকশন… না না… হিটলার-অন-স্পেশাল-ডিউটি… অন-ইটারনালি-স্পেশাল-ডিউটি… হা হা হা…” সঙ্গে সঙ্গে পেছনে তাকায় সবাই। অবাক হয়ে দ্যাখে– দিনে-দুপুরে এক আজব কীর্তি। অপরূপ এক ভাস্কর্য– গর্জনকুর্দনশীল, পেশিবহুল, সদামুখর।