অস্তিত্বের অফুরান উৎস রবীন্দ্রনাথ

মহিউদ্দীন মোহাম্মদ

প্রতিবছরের মতো এবারও বাংলা পঞ্জিকার বাইশে শ্রাবণ কবিগুরু, বিশ্বকবিসহ নানা অভিধায় সম্বোধন করে বাঙালি প্রাণের ডাক পৌঁছে দিয়েছে তাদের সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের অফুরান উৎস রবীন্দ্রনাথের কাছে।

আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি – কবিগুরু রচিত এই গান বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতাও বহুমাত্রিক অনন্য এই লেখক।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসহ নিকট অতীতের অনেক সংগ্রামে রবীন্দ্রনাথের লেখনী ও সুর হয়ে উঠেছিল বাঙালির উদ্দীপনার অন্যতম হাতিয়ার। চিরায়ত বাংলার রূপ-প্রকৃতি তাঁর কলমে যে মাধুর্য পেয়েছে তা বিরল। শিল্পের প্রায় সব শাখায় কৃতিত্বের ছাপ রাখা রবীন্দ্রনাথের সমাজচেতনা, দর্শন আর মানবতাবোধের উজ্জ্বল আভায় আলোকিত হয়েছে সমকালীন আন্তর্জাতিক বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডল।

একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিকার, সুরকার, নাট্যকার ও দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের যুগবদলের সূচনাকারী। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯১৩ সালে প্রথম এশীয় হিসাবে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন অমিত প্রতিভাবান এই লেখক। ১৮৬১ সালে কলকাতার জোড়াসাঁকোর অভিজাত ঠাকুর পরিবারে জন্ম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট (২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) ৮০ বছর বয়সে মৃত্যু হয় তাঁর।


আমাদের সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব সত্যিই বিস্ময়কর। তাঁর কাব্যসাধনার ঐশ্বর্য এবং বৈচিত্র্য বাঙালি মানসকে যেভাবে অভিতূত করেছে, পৃথিবীর অন্যকোন দেশে কোনো কালে বোধহয় তার তুলনা মেলে না। একজন কবির সাধনায় প্রাদেশিক ভাষা বিশ্বসাহিত্যের পর্যায়ে পৌঁছে গেল, ইয়োরোপে দান্তের জীবনে তার দৃষ্টান্ত মেলে। কিন্তু তার চেয়েও বোধ হয় রবীন্দ্রনাথের সিদ্ধি সুদূরপ্রসারী ও যুগান্তকারী।

কলকাতার ব্রহ্ম সমাজের শীর্ষ ব্যক্তিত্ব দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তিনি চতুর্দশ সন্তান। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের প্রথম কবিতা লিখেছিলেন মাত্র আট বছর বয়সে। ১৮৭৭ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি প্রথম ছোট গল্প এবং নাটক লিখেন। এর আগেই প্রথম প্রতিষ্ঠিত কাব্যের জন্ম দিয়েছিলেন যা ভানুসিংহ ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়। পারিবারিক শিক্ষা, ক্ষয়িষ্ণু জমিদারি পরিচালনা করতে গিয়ে লোকজীবনের সাহচর্য এবং প্রচুর ভ্রমণ তাঁর সমাজবীক্ষণ ও সৃষ্টিভাবনায় ব্যাপক প্রভাব ফেলে।

জমিদারি কাজের জন্য তৎকালীন পূর্ববঙ্গের পদ্মাপাড়ের শিলাইদহ ও পতিসরে দীর্ঘ বসবাসের অভিজ্ঞতা রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প ও কবিতায় উঠে এসেছে। বিশেষ করে ছোটগল্পে তাঁর প্রগাঢ় জীবনঘনিষ্ঠ কাহিনীর প্রেরণা এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়ার ফল।

ব্রিটিশ ভারতে পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে নিরপরাধ নিরস্ত্র মানুষদের ওপর নৃশংস প্রাণঘাতী হামলার প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাইট উপাধি ফিরিয়ে দেন। মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে ছিল তাঁর গভীর সখ্য। শুধু ভাবনাতেই সীমাবদ্ধ না থেকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর চিন্তার প্রায়োগিক নিদর্শনও রেখে গেছেন। শান্তিনিকেতন তাঁর সমাজ ও শিক্ষা ভাবনার প্রতীক হয়ে টিকে আছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখনো অনেক কিছুর অনবদ্য দৃষ্টান্ত। অফুরন্ত প্রাণপ্রাচুর্য রবীন্দ্রপ্রতিভার বৈশিষ্ট্য, এই প্রাচুর্যই কবি, সুরকার, সঙ্গীত ও গীতি রচয়িতা, ঔপন্যাসিক এবং শিক্ষাবিদ রবীন্দ্রনাথ বিকাশ ও প্রগতির কবি, চিরদিনই ধ্বংসের চেয়ে সৃষ্টির প্রতি তাঁর আকর্ষণ বেশি।

ঐক্যের সাধনায় বিশ্ব মানবের ইতিহাস মুখর, কিন্তু চরম সত্তা ও ঐক্যের মধ্যেও যে  পার্থক্য আছে, মৃত্যু ও বৈচিত্র্যের সমন্বয় করেই যে সত্য ও জীবন, অভিজ্ঞতার সজ্ঞান ক্ষেত্রে তার উপলব্ধি সহজ নয়। শেষ বয়সে রবীন্দ্রনাথের জীবনে এ সমন্বয়ের সজ্ঞান উপলব্ধির পরিচয় মেলে বলেই সেদিন তাঁর কবিতায় নতুন ও সহজ মানবরসের এত পরিব্যাপ্তি। ২৫ শে বৈশাখ আর ২২ শে শ্রাবণ বাঙালির কাছে আজো তাই নতুন আলোয় উদ্ভাসিত।

 

Facebook Comments

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top