শিবলি সাদিকের কবিতা

কন্যার সাথে খেলা


আমার শিশুকন্যার সাথে
খেলার নেশায় সাত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরি,
শহরের মেট্রো, বাস, বাতিস্তম্ভ— সকলেই জানে
শিশুকন্যাটিই শুধু এসবের খবর রাখে না

আমাদের খেলার নিয়ম খুব ঠিক করা নাই,
তবে হামাগুড়ি দিয়ে শুরু হলে সবচেয়ে মজা হয়,
কারণ হামাগুড়ি দিয়ে এমন সব সুর আর সুড়ঙ্গের
ভিতরে যাওয়া যায়, যার শেষে প্রজাপতিদের দেশ

সেই দেশে যাওয়ামাত্র আমার কন্যা হারিয়ে যায়,
আর এই রকমের রীতি নাকি সেখানকার যে
ধূলিকণা থেকে তারকা পর্যন্ত কারো নাম নেই,
নাম-পরিচয়হীন যত প্রজাপতির পিছনে ছুটে
যাকে আমি ছুঁয়ে দেই, সে-ই খিলখিল হেসে মেঘের আড়ালে পালায়,
আর রংধনুদের উপদেশ নিয়ে আমি হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরি

এইভাবে আকাশ-পাতাল ছুঁয়ে ফিরবার পথে কন্যাটিকে হারানোর কথা
খুব মনে থাকে না, কেননা আমার কন্যা জগতের শুরু থেকে
দূর ভবিষ্যতের দেশে, সব সুর ও সুড়ঙ্গে সদা খেলা করে যায়

 

গাছ


যাকে পাতা বলে আমরা ধরে নেই
তা গাছের চোখ, পাখিরা তা জানে

মাঠে পুঁতে রাখা উলম্ব দণ্ড—
যাতে টোকা দিলে সুরের ঝড় ওঠে
সেই আদি দেহ— ঝড়-বৃষ্টির নিচে
কালাকাল ধরে ছন্দে গীতে যাকে
সবাই বাজায়, ঘিরে নৃত্য করে বায়ু

যুগ যুগ ধরে আলো তাপ বিদ্যুতে
রূপ-অরূপের নিত্য স্পর্শে ঘর্ষণে
পঞ্চভূতের তাবৎ উৎপীড়নে
ধূলাবালি সোনায় মাখামাখি হয়ে
গাছের শরীরে ক্রমেই ফুটে উঠে
কোটি ঋষিচোখ— সবুজ বিষ্ময়মাখা,
যাদের আমরা পাতা বলে ভুল করি

আমি যদি পাখি হতাম, মুহূর্ত বিলম্ব না করে
সেই ঋষিচোখে ঢুকে উড়ে যেতাম কালসমুদ্রে

পরমার্থ-ঘাটে


অতলে নামার দিয়েছ পিপাসা
দাও নি নামার কোনো সিঁড়ি
পরমার্থ-ঘাটে বসে আছি

নম্র জলে আঁক কত রং, যাদুর পরাগ
ফোটে ফুল পদ্ম হয়ে বিবিধ প্রকাশ
সুন্দরের রঙে ধরে না সবটা
তারো বেশি নিরঞ্জন চুপ করে আছ
মাছের ঝিলিকে কত কী আভাস

বেলা বয়ে যায় কত রঙ্গ দেখে দেখে
আমার সর্বস্ব দগ্ধ হয়, জ্বলো তবু ফুলে
ঢেউয়ে ঢেউয়ে দূর থেকে দূরে নানা রঙে
রূপের ব্যঞ্জনা বারবার জ্বলে আর নেভে

ভাবি, রাত নেমে এলে আজ বেলাশেষে
দু্ই চোখ তুলে নিয়ে রূপের আঁধারে
ঝাঁপিয়ে পড়ব আমি পরমার্থ-জলে
পদ্মের সহিত কোন কথা কইব না
নিরঞ্জনে মাছ হয়ে রব শুধু চেয়ে

 

সিল্ক প্রবাহ


সিংহের রতির মত জ্বলজ্বলে এক
রেশম-গ্রন্থনা দেখি দুপুরের রোদে;
সময়ের তাঁতকল থেকে
বের হয়ে-আসা কত সিল্ক—
জাপানি, দূরপ্রাচ্যের—
ছড়িয়ে পড়ছে দৃশ্যপটে,
যুগে যুগে সহসাই জেগে
আবার হারিয়ে-যাওয়া
সৌন্দর্যের, বয়নসূত্রের নানা রং।

সম্রাটের বাহু থেকে নর্তকীর আত্মা
উড়ে যায় আর অজস্র সিল্কের পর্দা
জুড়ে জ্বলে ভয়ানক সেই তেজ ।

সুমেরীয় নারীদের জাদুকরী হাতে
বীজ হতে প্রথম শস্যের সোনা,
সেবাদাসীর নাচের অগ্নিরেখা ধরে
পাথরের দেবতারা জেগে ওঠে
পরাক্রান্ত ক্রোধ আর
মন্দির ম্যুরালে কামার্ত আগুন—
সিল্কের পর্দায় সব আজ
উঁকি দেয় সময়ের রঙে।

 

সাগরতটে প্রথম এলাম


সরল রোদের নিচে আজ আমি প্রথম এলাম।
এত জটিলতাহীন রোদ যেন ঘুঘুদের আত্মা।
আহা, আজ আমি সব রংধনুদের প্রথম ধরছি,
জানলাম— সবকিছু সহজ আত্মীয়, রংধনু
দিয়ে গড়া বলে কোনো জটিলতা নেই— অনায়াসে
পাহাড়ের সাথে হাত মিলিয়ে সমুদ্র নাচতে পারে।
এই রোদে আমি যত খুশি পালক লাগিয়ে নিতে
পারি, আর উড়ে যেতে পারি সহজ বিশ্বাসে।

আজ আমি সমুদ্রের শিশু, ঢেউদের শিশু আর
যত কিছু শূন্যতার নাভি থেকে সহসা জন্মায়
বা জন্মাবে না কোনোদিন, সকলের শ্বাস আমি
স্পর্শ করে এক এক করে রংধনু গড়ে নিই,
আর সব রংধনু নিয়ে খেলতে খেলতে ফের
আকাশ সাগর জল মাছ দূরবর্তী গ্রহশিশু হই।

 

দানবাক্স


রূপ যত দেখি, বিভ্রমও তত বাড়ে, রাত তত বাড়ে—
আলো নিভে আসে, টের পাই অন্ধতাই লক্ষ্য কবিত্বের।
রাজহাঁস বিষয়ক সব পঙ্ক্তি লিখবার পর ব্যর্থ হয়ে বুঝি—
সব শিল্প আসলে বয়স্কভাতা, শৈশব হারিয়ে ফেলবার দুঃখে
ঈশ্বরের দানবাক্স থেকে ঝরে-পড়া খুচরা পয়সা।
আজ অন্ধ হয়ে আমি দানবাঙ্ খুঁজে যাই, খুঁজে যাই
রূপের আঁধারে রাজহাঁসের আসল নিরাকার সেই পাখা।

অন্ধকারের হাঁসের পাখনায় সমস্ত জগৎ উড়ে যায়—
তার সে-ঝাপটা লেগে রূপের লণ্ঠন নিভে আসে,
আমার অন্ধতা দিনরাত যায় শুধু বেড়ে।

 

স্বরলিপি ও বাতিঘর ১


আমি স্বরলিপি খুঁজি রঙে আর গানে।
বেশ কিছু দিন ধরে আমার নতুন রোগ—
ঘোড়াদের কাছে শেখা, সহসাই যারা আসে;
কাঠ বিষয়ক এক রচনা লিখতে গিয়ে
দাবানল শব্দে থামা মাত্র গান বেজে ওঠে,
কাঠ শব্দ ঘোড়া হয়ে যায়; আমি বুঝি
এসবই বিভ্রাট— তার উৎস কি ভাষা,
নাকি সীমান্তের পারে, শব্দের আড়ালে
যত গোলমাল, ভুল বানানের গানগুলি?

আমি যত ভাবি, শব্দ তত অর্থ বদলায়,
মৌমাছিরা শব্দ থেকে শব্দে ওড়ে,
গান আরো বাড়ে, মধু বাড়ে,
তবু কোনো শব্দে এ গানের নোটেশন
আমি নিতে পারছি না; আমার মাথায় গান—
কাঠগোলাপের ঝাড়— বাড়ে, তারা পরস্পর
মোম আর মৌমাছির মতো মধুর যন্ত্রণা আনে;
আমি ক্লান্ত হই, ঘুমাই; ভাষার বাইরে আসি—
বুঝি স্বরলিপি নেই, বাঁশি দূরে কোথাও বাজছে,
ভাষার বাইরে— দূরে।

 

স্বরলিপি ও বাতিঘর ২


স্তব্ধতার তীরে পৌঁছে গানের ময়ূর দেখা যাবে—
এইসব ভেবে আমি গান ধরে চলাচল করি
কত-না পাতার দেশে, গুল্মের অন্তরে মৌনতায়
আলোছায়াসুর ধরে জলের মাছের ধ্যানলোকে
পাথরের শিবলিঙ্গে স্তব্ধ হয়ে থাকা ঝর্না-সুরে

চাঁদ থেকে তুলে নিয়ে মদের অস্ফুট তাপ
রাতভর আমি পুড়ি মাছ হয়ে, মোম হয়ে
পুষ্পের ভিতরে পরে শূন্যতার জামা
মেঘের কিনারে হাঁটি কত রংধনু বরাবর
কত নীল বাতিঘরে ঢুকে পড়ি স্বরলিপি

নদীর কিনারে কত পাখিদের পদচিহ্ন
আঁকে সময়ের গান, গোধূলির আগে
আকাশ ও পতঙ্গের রব নিভে গেলে
নম্র স্তব্ধ রেখা ধরে সেই সুর খুঁজে যাই

শূন্য-সিক্ত মাঠে নামি নরম বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে
গাছের শিকড়ে নেমে শুনে যাই মৌনতা-সানাই
দেহ থেকে খুলে ফেলে চাকা, যত দৈনন্দিন গতি
চিতার ছাইয়ে ঢুকে আমি খুঁজি গানের ময়ূর

 

স্বরলিপি ও বাতিঘর ৩


নীল বাতিঘর, তাকে আমি আজো দেখি নাই।

ময়ূরের লেজ নিয়ে আমার বাণিজ্য-সফলতা,
মাছের আড়তে গিয়ে আমি দরদাম ভালো করি,
নীলবর্ণ হাঙ্গরের বিনিময়ে দিতে চাই সব—
আমার আঙুল, ছন্দ, কবিতার সব কটি খাতা।
তবু সমুদ্রের বাড়ি থেকে আজো চিঠি পাই নাই।
তাই আমি রোজ এক পাতকুয়ায় চাঁদের সাথে
বন্দোবস্ত করে রাখি যেন ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি।
রাতে সাগরের ঢেউ আর গান শেষে ঝড় হলে,
নীল বাতিঘর যদি সুরের অপর পাড়ে ডাকে,
রাতভর আমি হেঁটে পার হব গান আর বালি।

 

স্বরলিপি ও বাতিঘর ৪


বস্তুত হেমন্তে আমি হামাগুড়ি দিয়ে রং পার হব,
বনে যে-এস্রাজ থাকে, তার ছড়খানি সব জানে।
গানের ইস্কুল থেকে পালিয়ে কোথায় আর যেতে পারি?
যে-ঘোড়াটি রাতে রোজ রং-চিত্রের দেশে নেয় বয়ে,
তার মাংসের ঘ্রাণ গানের আগুনে শুধু টানে।
তবু রাতে পিঁপড়ার ভয়ে আমি পালাতে পারি না।
উল্কাপাত সয়ে শেষে চিনির পাহাড়ে চাঁদ খুঁজি,
হাঁসের পালকে শাদা যৌন স্বরলিপি পোড়ে দেখি।

তবু মোম ভালবাসি না, তারার মোমচোখ নয়,
অধরা নামের এক বিদূষীর কাটা-হাত ডাকে,
তার হাতে চুরি-করা সব অর্থালংকার তুলে দিয়ে
লোকালয় থেকে দ্রুত পালাতে চাইছি সব ছেড়ে।
নক্ষত্রের যৌনতাপ, গান আর পাখিদের ছেড়ে
আমি বনে যেতে চাই আমার আত্মার নির্বাসনে—
রঙের সমাধি আর সময়ের শেষে শুনে যাব
নির্জনতার বেহালা নিয়ে পিঁপড়েরা হেঁটে যায়।

 

স্বরলিপি ও বাতিঘর ৫


গাছে গাছে কেন এত বাতিঘর আমাকে পোড়ায়?
আমি তো বৃক্ষমানব নই, নই নীল-লন্ঠনের ভাই,
যাকে রোজ রাতে কারা বাঁধে শক্ত করে মগডালে!
তার দেহ-থেকে-ঝরা রক্তরত্ন দেখি রাত ভরে।
রণক্ষেত্রে ঘোড়াদের রেখে কবে পালিয়েছিলাম,
বেবিলনের অশ্ববিক্রেতা তবু কেন খোঁজ করে
মাঝরাতে রোজ ডেকে আমাকে ওঠায়, আর
দরদাম শেষ করে ঘোড়া বেচে লাভ নাই বলে
দেখায় সেসব বাতি, যা গাছের যাদুঘরে নাকি নাই।
অশ্ববিক্রেতারা ঠগ বলে আমি স্বপ্নে ফিরে যাই,
আর ঘুম থেকে জেগে দেখি গাছে গাছে
জ্বলছে সে-বাতিঘর, যা আমাকে পোড়াবে দিনভর।

 

বর্ষাকালে যেই প্রশ্ন জাগে


জীবপালিনীর কাছে অনেক জানতে চাই বর্ষার কারণ,
কী অর্থ যখন জ্বলে মেঘে সৌদামিনী,
কী অর্থ কদম্বে ফোটে রংধনুর হরফে?
কুমুদ বিলের জলে কেন করে প্ররোচনা?

উত্তরের মেঘে জানি, নাই কোনো বার্তা,
বর্ষণের শব্দে তবু সহসাই টলে যায় সব,
জন্ম আর জন্মান্তর যায় হয়ে,
ভেসে যাই পদ্ম হয়ে জন্মানত্দরে— জলে,
নাভি ছিঁড়ে ছিঁড়ে যায় শিকড়ের টানে,
কত রূপ জলে জাগে, বাড়ায় বিষাদ!

জীবপালিনীর শ্যাম চুল রোজ পুব থেকে পশ্চিমের মেঘে,
ঊষা থেকে অস্তে মোম হয়ে জ্বলে মম চোখের তারায়।
শ্যাম বর্ষা নামে মনে, শূন্য থেকে কত শূন্যচিহ্ন, শেষে
আমার বিষণ্ন ফুল শুধু ঝরে, বাতাসের সাথে সারাবেলা
বিষণ্ন শাপলা হয়ে খেলি, প্রশ্ন শুধু প্রশ্ন— সৌদামিনী জ্বলে!

Facebook Comments

2 Comments

  1. Masud Khan

    “…হামাগুড়ি দিয়ে এমন সব সুর আর সুড়ঙ্গের
    ভিতরে যাওয়া যায়, যার শেষে প্রজাপতিদের দেশ

    সেই দেশে যাওয়ামাত্র আমার কন্যা হারিয়ে যায়,
    আর এই রকমের রীতি নাকি সেখানকার যে
    ধূলিকণা থেকে তারকা পর্যন্ত কারো নাম নেই,
    নাম-পরিচয়হীন যত প্রজাপতির পিছনে ছুটে
    যাকে আমি ছুঁয়ে দেই, সে-ই খিলখিল হেসে মেঘের আড়ালে পালায়,
    আর রংধনুদের উপদেশ নিয়ে আমি হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরি”

    Bhalo laglo. Seisonge Shibly-r shishukonya “Ishwaree”-keo dekhlam ek-jholok ,tar odomyo uchchhalota, hasikhushi chancholota-soho.

    “সিংহের রতির মত জ্বলজ্বলে এক
    রেশম-গ্রন্থনা দেখি দুপুরের রোদে;”

    “রূপ যত দেখি, বিভ্রমও তত বাড়ে, রাত তত বাড়ে—
    আলো নিভে আসে, টের পাই অন্ধতাই লক্ষ্য কবিত্বের।
    রাজহাঁস বিষয়ক সব পঙ্ক্তি লিখবার পর ব্যর্থ হয়ে বুঝি—
    সব শিল্প আসলে বয়স্কভাতা, শৈশব হারিয়ে ফেলবার দুঃখে
    ঈশ্বরের দানবাক্স থেকে ঝরে-পড়া খুচরা পয়সা।”

    “কী অর্থ যখন জ্বলে মেঘে সৌদামিনী,
    কী অর্থ কদম্বে ফোটে রংধনুর হরফে?
    কুমুদ বিলের জলে কেন করে প্ররোচনা?”

    Bah! chamatkar!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top