__________________________________________________________________________________________
কবি মাসুদ খানের কবিতা কী তা পাঠকেরা জানেন। কিন্তু এবার মাসুদ খানকে আমরা অনুবাদক হিসেবে দেখতে পাব সাহিত্য ক্যাফের পাতায়। নিকারাগুয়ার তিন কবি পাবলো আন্তোনিও কুয়াদ্রা (১৯১২-২০০২), আলফানসো কোর্তেস (১৮৯৩-১৯৬৯) ও ডেইজি সামোরা (১৯৫০-)’র বেশ কিছু কবিতা অনুবাদ করেছেন তিনি নিজের ভাষায়। ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হবে তাঁর এই অনুবাদ। তাই চোখ রাখুন সাহিত্য ক্যাফের পাতায়। – সম্পাদক
__________________________________________________________________________________________
পাবলো আন্তোনিও কুয়াদ্রা
(১৯১২-২০০২)
[নিবিড় অন্তরঙ্গতার কবি পাবলো আন্তোনিও কুয়াদ্রা। বাচনিক ভাষাভঙ্গি-জড়ানো তাঁর কবিতা। শৈশব নিয়ে, নানান জায়গা নিয়ে, নিজ ভূখণ্ড আর নিসর্গের সঙ্গে তাঁর যে জানাশোনা, জান-পেহচান, সেসব নিয়ে কবিতা লিখেছেন তিনি। যদিও সেগুলি ছিল তার প্রথম দিককার লেখা, তবুও ওই কবিতাগুলিই তাঁকে করে তুলেছে ‘ভ্যানগার্ডিয়া’-র অন্যতম পাণ্ডা। ‘ভ্যানগার্ডিয়া’ হচ্ছে রুবেন দারিয়ো-পরবর্তী নিকারাগুয়ান কবিতার পুনর্নবায়ন। নিজ ভূখণ্ড, আপন জায়গাজমিন যেভাবে যে-পথে উঠে আসার আভাস পাওয়া গিয়েছিল দারিয়োর কবিতায় (কিন্তু আসেনি শেষপর্যন্ত), উত্তরকালে সেগুলিকে যথার্থরূপে উঠে আসতে দেখা যায় কুয়াদ্রার লিরিক্যাল কবিতায়। থিমের দিক থেকে বিচার করলে, কুয়াদ্রার কবিতায় পরিলক্ষিত হয় জাতীয়তাবাদের প্রতি তাঁর দৃঢ় অঙ্গীকার, যদিও উপরিতলের ভাসা-ভাসা জাতীয়-লোকসাহিত্যের বিপদের দিকগুলির ব্যাপারে তিনি ছিলেন পুরাপুরি ওয়াকিবহাল, আর তিনি তা স্বীকারও করেছেন অকপটে। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের প্রতি তাঁর ছিল তীব্র অবিশ্বাস। আবার তাই ব’লে হাল-আমলের নিকারাগুয়ান কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতিও ছিল না তাঁর কোনো প্রত্যক্ষ একাত্মতা। নেরুদার আইকন-গুঁড়ানো, আমূল সংস্কারকামী রাজনৈতিকতা, কিংবা ভায়েহোর মনস্তাও্বিক নিরীক্ষাধর্মিতা, এসবের থেকে আলাদা ছিল কুয়াদ্রার রাজনৈতিক অঙ্গীকার; যদিও কখনো-কখনো তাঁকে তুলনা করা হয় ওই লেখকদ্বয়ের সঙ্গে। কুয়াদ্রার নন্দনতত্ত্ব উৎসারিত হয়েছে মূলত এক গভীরবোধ খ্রিস্টীয় মানবতাবাদ থেকে, যে-মানবতাবাদ লাতিন আমেরিকান বাস্তবতার এই যে গণতন্ত্রায়মান চেহারা, আর সে-বাস্তবতার যে নিখিল-লাতিনীয় সামান্য ভাবমূর্তি, তাকে বিবেচনা করে যন্ত্রণাক্লিষ্ট আর্ত যিশুর আদলে। — কবিতা ও কবি সম্পর্কিত ভাষ্য অনুবাদ: মাসুদ খান]
সূর্যের অভ্যুদয়
আবিষ্কার করেছি আমি নতুন নতুন জগৎ। স্বপ্নে দেখেছি
অনির্বচনীয় সব দ্রব্যে রচিত রাত্রিনিচয়।
বানিয়েছি জ্বলজলে নক্ষত্ররাজি, সূক্ষ্ম আলোমালা
আধ-বোজা চোখেদের পাশে।
তবু কখনোই
পারব না ফিরিয়ে আনতে সেই প্রথম দিনটিকে
যেদিন স্যাঁতসেঁতে জঙ্গলের মধ্য থেকে ঝাঁৎ করে জেগে উঠল আমাদের পূর্বপুরুষ, তাদের কৌমগোত্রসহ,
এবং তাকাল পূর্বদিকে। শুনল জাগুয়ারের হুঙ্কার, পাখির কূজন; আর দেখল
জ্বলন্ত সুরত নিয়ে ওই জেগে উঠছে এক পুরুষপুঙ্গব,
উজ্জ্বল চেহারা নিয়ে একটি যুবক,
যার তীব্র জ্যোতির্ময় চাহনি মুহূর্তে শুকিয়ে ফেলল সব জলাভূমি,
দীর্ঘদেহী এক জ্বলন্ত যুবক, অবয়ব যার চিরবহ্নিমান:
মুখ তার আলোকিত করে দিল সমগ্র জাহান।
(Pablo Antonio Cuadra, The Birth of the Sun [1959].
English Translation by Thomas Merton)
জলাশয়ে অশ্ববাহিনী
খুব ভোরে নেমে পড়ে ঘোড়াগুলি।
ঢুকে পড়ে তারা সোনালি জলাশয়ে, আর চলতে থাকে জোর-কদম—
যেন ঢেউয়ের পর ঢেউ, ঢেউয়ের বিরুদ্ধে ঢেউ,
খিলানের আদলে দুলতে থাকে তাদের কেশর ও গর্দান—
এগিয়ে যেতে থাকে চোখ-ধাঁধানো আলোর ভেতর।
আর ন্যাংটা-পোংটা যত পোলাপান
ঘোড়াদের পাছা ধরে ধরে
পানিতে ডোবায়, চোবায়
আর অশ্বদল তুলে ধরে তাদের প্রাচীন অঙ্গসৌষ্ঠব,
আলোকে মাতাল।
সহসা উৎকর্ণ হয়ে শোনে বিউগলের ধ্বনি
ঘোড়াগণ দেয় মন বিউগলের
প্রভাতী-কোমল সুরে
আর দ্যাখে
বিস্তৃত লড়াইয়ের ময়দান।
অতঃপর স্বপ্ন দ্যাখে তারা—
ভেঙেচুরে তেড়েফুঁড়ে
মারদাঙ্গা ছুটে চলে দূরের এক দুরন্ত হিম্মৎ—
তুরন্ত তাড়িয়ে নিয়ে চলে সেই বীর-বাহাদুরদের যুগে
যখন তলোয়ারের ঝাঁঝালো ঝিলিক ফিরিয়ে দিত
রৌদ্রের গনগনে যত আক্রমণ,
সাদা-সাদা যত মর্দা ঘোড়া,
রুপালি-রুপালি যত অক্ষৌহিণী,
আর পাখিদের আর হাওয়াদের
দূরবর্তী যত হু-হু আর্তনাদ।
তবে ফিরে আসে অশ্বকুল
(কাল এক অব্যর্থ চাবুক)
চাবুকের চোটে
সার বেঁধে চলে অশ্বদল ডাঙা-অভিমুখে
হেঁটমুণ্ডু,
আর শকটের সাথে বাঁধা আস্টেপৃষ্ঠে
স্বপ্ন
পড়ে থাকে
পশ্চাতে;
বাতাস,
ঘুমে।
(Pablo Antonio Cuadra, Horses in the Lake [1977].
English Translation by Grace Schulman and Ann McCarthy de Zavala)
বোতলবার্তা
দেখতাম নারকেল আর তেঁতুল
আর আম্রতরুর সারি
আর রোদে শুকাতে-থাকা সাদা-সাদা পালগুলি
আর আকাশ-ছাওয়া প্রাতঃরাশের ধোঁয়া
ভোরবেলাকার,
আর জালের ভেতর মাছেদের লাফালাফি
আর দেখতাম লালশাড়ি একটি মেয়ে,
চলেছে সাগরতীরে আর ফিরছে কলসিকাঁখে
হেঁটে যাচ্ছে কুঞ্জবীথির আড়ালে আড়ালে আর চপল চকিতে
আর এই দেখতাম একঝলক, এই দেখতাম নাই
সে-অনেকক্ষণ ধ’রে…
লালশাড়ি কন্যার ওই দৃশ্য ব্যতিরেকে
অসম্ভব হয়ে উঠত আমার সমুদ্রসফর
আর মনে হতো সে আছে ব’লেই আছে ওই নারকেল আর তেঁতুল আর আম্রতরুর সারি
আর শায়িতা যখন ওই লাল-পরিহিতা
সাদা পালগুলি হয়ে উঠত সাদা
ধোঁয়াগুলি হতো নীল
আর তখনই কেবল হতো পুলকিত
মাছ আর মাছ, আর মাছেদের জলছবি
আর অনেকক্ষণ ধ’রে, চেয়েছি লিখে ফেলি কবিতা একখানি
লালশাড়ি কন্যাটিকে নিয়ে
কিন্তু কী ক’রে প্রকাশ করি ওই চিত্তহারী অবাক বিস্ময়
কিছুতেই খুঁজে পেতাম না উপায়
আর সেই কথা বলি যদি বন্ধুদের, তারা খালি হাসে
আমি পাল তুলে চলে যেতাম সুদূরে
কিন্তু ফের যখন আসতাম ফিরে
সদাই যেতাম আমি লালশাড়ি কন্যাদের ওই দ্বীপটির পাশ দিয়ে
আর এইভাবে একদিন ঢুকে পড়লাম তাদের জলসীমার ভেতর
নোঙর ফেলেই লাফ দিয়ে নামলাম মাটিতে তাদের
আর লিখলাম কয়েকটি পঙ্ক্তি এখন
আর বোতলে পুরে ঢেউয়ে ঢেউয়ে দিলাম ভাসিয়ে সেই পঙ্ক্তিনিচয়
কেননা এ-ই তো আমার উপাখ্যান, রূপকাহিনি আমার
কেননা তাকিয়ে আছি আমি নির্নিমেষ নারকেল আর তেঁতুল
আর আম্রতরুর সারির দিকে চেয়ে
রোদে শুকাতে-থাকা সাদা-সাদা পাল
আর আকাশ-ছাওয়া প্রাতঃরাশের ধোঁয়ার দিকে চেয়ে
আর বেলা বয়ে যায় মধুমতী গাঁয় ওরে মন ছুটে চল্ চেনা ঠিকানায়…
আর প্রতীক্ষা করি, আর করতেই থাকি
আর উসখুস করি
আর আসে না তো সে ভুট্টার মঞ্জরী হাতে, আসে না তো আসেই না, আহা
লালশাড়ি শ্রীমতী আমার
(Pablo Antonio Cuadra, Manuscript in a Bottle [1977].
English Translation by Grace Schulman and Ann McCarthy de Zavala)
Pingback: মাসুদ খানের অনুবাদ (২) » সাহিত্য ক্যাফে
Pingback: মাসুদ খানের অনুবাদ (৩) » সাহিত্য ক্যাফে
Much appreciated for the information and share!