উত্তম চক্রবর্তী
কবি আজীজুল হক (জন্ম ১৯৩০, মৃত্যু ২০০১) প্রতিভার স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল, বিশ শতকের পঞ্চাশ-ষাট দশকের এক প্রতিশ্রুতিশীল কাব্যশিল্পী। সমকালীন সমাজ ও রাষ্ট্র বিষয়ে ক্রমাগত দ্বন্দ্ব-দ্রোহ ও রক্তপাতের প্রেক্ষাপটে অনিবার্য মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে তিনি শিল্পীত করেছেন তাঁর কবিতায়। আপন অস্তিত্বকে বোধ করে তা রক্ষার প্রগাঢ় আর্তনাদে মুখর থাকতে দেখা যায় তাঁকে। কখনো এ প্রসঙ্গেই প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন তিনি। কবি আজীজুল হক ছিলেন আপন ইতিহাস-ঐতিহ্যে আস্থাশীল, মানবতায় পূর্ণ, প্রগতিধর্মে দীক্ষিত ও জীবনমুখীনতায় উচ্চকণ্ঠ। তিনি তাঁর সমাজভাবনা ও স্থির কাল-জ্ঞান থেকেই উনিশশ সাতান্ন সালে সিকান্দার আবুজাফর ও কবি হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত সমকাল সাহিত্যপত্রের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন; কাব্যবোধ ও প্রকাশভঙ্গির স্বাতন্ত্র্যে অধিকতর উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন এবং গৃহীত হন এ সময়ের পুরোধা কবিবৃন্দের অন্যতম একজন হিসেবে।
সাতচল্লিশ, আটচল্লিশ, বায়ান্ন, চুয়ান্ন, বাষট্টি, ঊনসত্তর ও একাত্তর-এর উত্তাল রাজনৈতিক ঘটনাপুঞ্জ কবি আজীজুল হকের সময়ভাবনা ও অধিকারবোধকে শাণিত করেছে নি:সন্দেহে। স্থান-কালের অনিবার্য অভিঘাতে রচিত তাঁর গ্রন্থসমূহ-ঝিনুক মুহূর্ত সূর্যকে (কাব্যগ্রন্থ, প্রকাশ ১৯৬৯), বিনষ্টের চিৎকার (কাব্যগ্রন্থ, প্রকাশ ১৯৭৬), ঘুম ও সোনালি ঈগল (কাব্যগ্রন্থ, প্রকাশ ১৯৮৯), আজীজুল হকের কবিতা (প্রকাশ ১৯৯৪), অস্তিত্বচেতনা ও আমাদের কবিতা (প্রবন্ধগ্রন্থ, প্রকাশ ১৯৮৫)।
আজীজুল হকের কবিতায় একদিকে ইতিহাস ও ঐতিহ্যসচেতন শিল্পদৃষ্টি প্রতিভাত– অন্যদিকে, অস্তিত্ববোধ ও ভাবনাপ্রসূত কবিতার বিষয় ও উপকরণ-অনুষঙ্গ অভিনব মর্যাদায় সিদ্ধ হয়ে ওঠে। দুঃস্বপ্ন, মৃত্যু, অন্ধকার, রক্তপাত প্রভৃতি উপমা-প্রতীক সাম্রাজ্যবাদ ও অস্থির সময়কে যেমন নির্দেশ করে, তেমনি দীর্ঘদিনের পরাধীন বিপন্ন জাতিসত্তাকে সংহতি দানের চেষ্টায় তাঁকে সংগ্রামী হতে দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে তিনি কবিতায় নিয়ে আসেন দ্যুতিময় সব মুহূর্ত-প্রতীক। কখনো তীব্র কৌতুক ও ব্যাঙ্গবাণে তাঁকে সমকালীন পরিস্থিতিকে তীক্ষ্ণ করে তুলতেও দেখা যায়—
<
এক. আদিম সমুদ্র থেকে অন্তিমের স্থলভাগ জুড়ে
বিশাল পাহাড় এক অণুতম সূর্যকে ছুঁয়ে
পড়ে আছে, যেন
মহাকাল শিলীভূত, মসৃন পিচ্ছিল।
একদিন মানব সমাজ
ওই খানে যাবে, এখন যন্ত্রণা শুধু আজ, এখন কেবল
শব থেকে শবের সিঁড়িতে একটি আকাঙ্ক্ষা হেঁটে যায়
জীবনের নামে, এখন সে জীবনের নাম
স্বপ্ন আর রক্ত আর ঘাম। (যন্ত্রণা; ঝি.মু.সূ)
দুই. অতীতে প্রোথিত দেখি অর্ধাঙ্গ আমার
এবং দুচোখ
শামুকের ঠোঁটে বিদ্ধ নীলকান্ত মনি
যেন এক নিহত সময়
দুর্ঘটনার পিঠে ঠেস দিয়ে পড়ে থাকে
হাজার বছর। (যন্ত্রণার মৃত্যুতে; ইচ্ছার নায়ক, ঝি.মু.সূ)
তিন. নীলাভ কাঁচের প্লেটে হৃৎপিণ্ড রক্তাক্ত উজ্জ্বল
ছিঁড়ে এনে রাখলে টেবিলে
সূর্যোদয় হলো
সমুদ্রের জলে।
আজকের গ্রগাঢ় সকালে
কী দেবো তোমাকে? কী দেবো, কী দেবো!
রক্তমুখী নীলা। (রক্তমুখী নীলা; ঝি.মু.সূ)
চার. অবশ্যই আমি সেই ব্যবহৃতা রমণীর সজ্ঞান প্রেমিক।
জীবনকে সুনিপুণ আলিঙ্গনে বেঁধে
চিরকাল বেঁচে থাকে নির্বিঘ্নে যেমন
মৃত্যুটা; তারো চেয়ে অধিক নিকটে আমি তার। (বিনষ্টের চিৎকার; বি.চি.)
পাঁচ. একালের কবিতা ফুলকে বাদ নিয়েছে।
আকাশে মেঘ, কালো মেঘ
সূর্য নেই।
যে ফুলের নাম সূর্যমুখী সে নামেই সে ফুটলো।
আগুন রঙ পাঁপড়ি কী ধূসর!
আগুন থেকে ছাই। (মেঘমুখী সূর্যমুখী; ঘু.ও সো. ঈ.)
ছয়. রাজার আশ্বাস-দুর্গসঙ্ঘের আড়াল আর
মহান নগর
পলাতক বন্ধুদের নির্বিঘ্ন আশ্রয়। (প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিবিম্ব; ঘু.ও সো. ঈ.)
সাত. দারুন দু:স্বপ্ন ছাড়া গাঢ় কোন মধ্যরাত নেই
নীল নীল মৃত্যু ছাড়া স্বপ্নহীন দীর্ঘ ঘুম নেই
অনিদ্রার জ্বালা ছাড়া নিদ্রাস্নাত জাগরণ নেই। (ঘুম ও সোনালি ঈগল; ঘু.ও সো. ঈ.)
মিথ (Myth) বা পৌরাণিক উপাদানের ব্যবহার আজীজুল হকের কবিতাকে সার্বজনীনতা দান করে। দ্বন্দ্বময় অস্তিত্ব-সচেতন কবিমানস থেকে ভারতীয়, গ্রিক প্রভৃতি পুরাণের উপাদানসমূহ তিনি সমকালীন জীবন-প্রসঙ্গে রূপায়ণ করেছেন-যা মানুষের চিরন্তন ভাবনার মাধ্যম ও রূপকল্প হিসাবে কাজ করেছে। বৃহত্তর জীবনকে কবি ইতিহাস, ঐতিহ্য ও পুরাণ ব্যবহারসূত্রে সম্ভাবনাময় করে তুলেছেন। তাঁর কবিতা থেকে–
এক. সূর্যই আমাদের প্রথম নায়ক
চিরকাল আমাদের নায়কই সে আছে। (মেঘমুখী সুর্যমুখী; বি.চি.)
দুই. খুঁজে দেখ, সেইসব বিদ্ধস্ত ও প্রোথিত নগর
হিংস্র দাঁতের ফাঁকে আর্যদের হাসি,
দ্রাবিড়ের বিচূর্ণ করোটি। (হাড়; ঝি.মু.সূ)
তিন. মনে করো, ইভের সান্নিধ্য ছেড়ে আমি এক আদিম পুরুষ
সুপ্রাচীন ব্যাবিলনে নিগূঢ় চুম্বন রেখে বিবাহিত রূপসীর ঠোঁটে
নিখোঁজ হয়েছি। (প্রাক উত্তর পর্বের সঙ্গীত; ঝি.মু.সূ)
চার. অপহৃতা রমণীর মতো এক স্মৃতিগন্ধা অনার্য রূপসী
ঝিনুক-রহস্য চোখ তুলে
সেই প্রশ্ন সম্প্রতি ও করেছে আমাকে
বঙ্গোপসাগরের উপকূলে। (রূপকথা; বুদ্ধ ও ড্রাগন, ঝি.মু.সূ)
সংখ্যার দিক থেকে কবি আজীজুল হক লিখেছেন অল্প কিন্তু তাঁর সমগ্র রচনা শিল্পবিচারসূত্রে অনন্য এবং একথা বলা প্রয়োজন, তাঁর কাব্যকর্ম বাংলা কাব্যভূমির সমৃদ্ধি প্রসঙ্গে সসম্মানে বিবেচিত ও গৃহীত হতে বাধ্য। ২৭ আগস্ট ২০০১ তাঁর মৃত্যু দিন। তাঁর স্মৃতির প্রতি অমিত শ্রদ্ধাঞ্জলি।
ছবি: নাসির আলী মামুন
কবি আজীজুল হকের কবিতার লিংক:
http://www.facebook.com/note.php?note_id=157083014072