আসমা চৌধুরী
উপজেলা শহর তখনো হয়নি। চিঠি লেখার খামে ঠিকানায় লিখতে হতো থানা,মেহেন্দিগঞ্জ।এখানে একটাই ফটো তোলার স্টুডিও ছিলো। বিত্তবান লোকেরা স্টুডিওর মালিক রমাপদ বাবুকে খবর দিয়ে বাড়ি নিয়ে গিয়ে পারিবারিক ছবি তুলতো।সেসব ছবি তোলার দারুণ এক মজার ব্যাপার ছিলো। একজনকে ছাতা ধরতে হতো রমাপদ বাবুর মাথায়,ছাতা কাত করে ধরতে হতো,রোদে দাঁড়িয়ে হাসি মুখে পোজ দিতে গিয়ে ভ্রু কুঁচকে যেতো মানুষের। গলে যেতো পাউডার,স্নো মাখা মুখের ঘামের লবণ। বৈকালি স্টুডিও তবু সকলেরই প্রিয় ছিলো।
ছবি তোলার জন্য নানা লোকেশন খুঁজতে হতো। কোথায় হিজলগাছ আছে,কোথায় শ্যাওড়া গাছ আছে,সবুজ মাঠ,পুরানো ক্ষয়ে যাওয়া বাড়ি সব খুঁজে বের করতে হতো। রমাপদ বাবু ছবি তোলার কাজে খুব খুঁতখুঁতে ছিলো, একটুও ছাড় দিতে রাজি ছিলো না সে। বারবার ফ্লাসের শব্দ তুলে তুলে নানা ভঙিতে ছবিটি সার্থক করতে হতো।
রমাপদ বাবুর বোন কাকলি আমাদের সাথে পড়তো। ভালো ছাত্রীর অহংকার ছিলো ওর। তা ছাড়া ওর ভাই ছবি তোলে, ওদের স্টুডিও আছে এটা তখন আমাদের কাছে একটা ইউনিক ব্যাপার। আমরা কাকলিকে সমীহ করে চলতাম। রমাপদ বাবু একবার আমাদের বাড়িতে এলেন পারিবারিক ছবি তুলতে।.তাকে চা-নাস্তা খাওয়ানো হলো।.ছাতা ধরে পরপর অনেক ছবি তোলা হলো।.ছবি তুলে যে যার মতো চলে গেলো,রমাপদ বাবু তার জিনিসপত্র গোছাতে লাগলো।.আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো ছবি তুলবে?.আমি বললাম না।.কারণ কিছুক্ষণ আগে রুমি,ঝুমি দুই বোন বাঁশের ঝারে মুখ বাড়িয়ে ছবি তুলেছে, আমিও গিয়ে ওদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম।.আমকে সরিয়ে দিল।.আমি দেখতে সুন্দর নই বলে কেউ আমাকে ছবি তোলায় সাথে নেয় না।রমাপদবাবু ছবি তোলার হিসাব একটা কাগজে লিখে বললো,.বড় মিঞার কাছে দিও।.বড় মিঞা কী চলে গেছে?.আমি বললাম,না আমাদের ঘরে চা খায়।উনি বিড়বিড় করে বলে বড় মিঞাকে একটু দরকার ছিল। আমি কোন কথা না বলে আমাদের ঘরে গিয়ে বললাম,চাচা আপনাকে রমাপদ বাবু ডাকে। চাচা বিস্মিত হয়ে বলে,
ও আমাকে ডাকে?
আমি বললাম, হ্যাঁ ডাকে। কী যেন কথা আছে।
চাচা রেগে বললেন, ওর কাছে যেতে হবে আমাকে কথা শুনতে?
এবার আমি সত্যি ভয় পেলাম। কারণ রমাপদবাবু আমাকে বলেননি চাচাকে ডেকে দিতে।
চাচা দ্রুত অন্যত্র চলে গেলেন।
আমি যখন রমাপদ বাবুকে গিয়ে বিষয়টি বললাম তিনি ভয়ে নীল হয়ে গেলেন। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। রমাপদ বাবু মাথা ঝাকাতে ঝাকাতে বললেন,বড় মিঞা কী আমার কাছে আসতে পারে, আমিইতো তাঁর কাছে যাব। সেই প্রথম বুঝতে পারলাম রমাপদ বাবু বিখ্যাত বৈকালি স্টুডিওর ফটোগ্রাফার,আমাদের স্কুলের ভালোছাত্রী কাকলির ভাই হলেও সে আসলে একজন সামান্য মানুষ।তাকেই সবার কাছে যেতে হয়।
স্কুলের উপরের ক্লাসে পড়ি। আজ সে কথা ভাবলে লজ্জা পাই। হিন্দু-মুসলমান কারা বেহেস্তে যাবে,কারা যাবে না এই নিয়ে তুমুল ঝগড়া হয় ক্লাসে। দু-পক্ষ যার যার যুক্তি দাঁড় করায়। মূল কারণ কাকলিকে হেনস্তা করা। কাকলি ভালো ছাত্রী, অঙ্কে অনেক দখল,সবসময় গম্ভীর হয়ে থাকে সুতরাং ওকে ঘায়েল করতে হবে। এক পক্ষে কাকলি অন্য পক্ষে রাসিদা তুমুল ঝগড়া চালিয়ে কিছুদিন কথাই বলে না। এর ভেতরে একদিন হেড স্যারের রুমে কাকলির ডাক পড়ে। ওর নামে নাকি প্রেমপত্র এসেছে। স্কুলের ঠিকানায় চিঠি এলে হেড স্যার সেগুলো খুলে পড়তেন। প্রায়ই দেখা যেত অফিসরুমে মেয়েদের জোড়া বেত দিয়ে পিটানো হতো। মেয়েরা কাঁদতে কাঁদতে ক্লাসে ফিরতো। যদিও কাকলিকে পিটানো হয়নি তবুও রাসিদা রটিয়ে দিল কাকলির চরিত্র খারাপ। তখন প্রচলিত একটি ধারণা ছিলো হেড স্যার চিঠি বিষয়ে ডেকে নেওয়া মানে চরিত্র খারাপ।
এস,এস,সি পরীক্ষার আগে হঠাৎ একটি ঘটনা ঘটে,শুনতে পাই কাকলিকে কারা যেন তুলে নিয়ে যায়। থানা,পুলিশ চলে। ওকে উদ্ধার করা হয় যখন তখন ওর অবস্থা খুবই খারাপ।কাকলি সে সময় স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়েছে।
আমরা কয়েকজন বান্ধবী ঠিক করেছি যেহেতু স্কুল জীবন শেষ সবাই মিলে একটা গ্রুপ ফটো তুলবো।বৈকালি স্টুডিও কদিন যাবৎ বন্ধ। এখানে আর কোন স্টুডিও নেই তাই স্কুল থেকে লুকিয়ে একদিন ওদের বাড়ি যাই। রমাপদ বাবু বাড়ি ছিলেন না। কোথায় যেন ছবি তুলতে গিয়েছেন। ওদের বাড়িতে গিয়ে অবাক হই। ওরা খুবই গরীব। বাবা,মা বেঁচে নেই। বড় একজন দিদি আছেন,লেখা-পড়ার সুযোগ পাননি। ওদের ছবি তোলার স্টুডিওটিও ভাড়া করা ,নিজেদের নয়। ছবি তুলে যা আয় হয় তাতে ঘর ভাড়া দিয়ে কোনরকমে সংসার চলে। কাকলি টিউশনি করে নিজের পড়ার খরচ চালায়। কাকলিকে পরীক্ষার কথা জিজ্ঞেস করলে বলে, ওরা খুব সমস্যার ভেতরে আছে। মাস্তানেরা প্রভাবশালী কারো হয়ে ওদের স্টুডিও দখল করতে উঠে-পড়ে লেগেছ। রাত,দিন হুমকি দিচ্ছ, ইন্ডিয়া চলে যেতে বলছে।কাকলি নিজেই বলে,এই দেখনা আমার নামে বদনাম দিচ্ছে আমাকে নাকি কারা ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করেছে। থানা-পুলিশ হয়েছে। এসবের ভেতরে পড়াশুনা হয়?
…বললাম,আমরাতো সে-সবই শুনেছি। তোমাকে নাকি তিনদিন পর ফিরে পাওয়া গেছে, এইসব কথা। সে যা-ই হোক তোমাকে কিন্তু ভালো রেজাল্ট করতে হবে। এই ‘উম্মেকুলসুম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ‘নাম রাখতে হবে। আমরা চলে আসার সময় কাকলির ভাই ফিরে আসে বাড়িতে। খুশি খুশি গলায় বলেন বড় মিঞা সবকিছু ঠিক করে দিবেন। বৈকালি স্টুডিও সরাতে হবে না। যেখানে আছে সেখানেই থাকবে। সমস্যা হলে অন্য ঘর ভাড়া করে দিবেন।
আমরা ছবি তোলার এবং টাকা-পয়সার ব্যাপারটি ফয়সালা করে বাড়ির পথে রওয়ানা দেই। বৈকালি স্টুডিওর কাছে এলে দেখতে পাই আজও কয়েকটি বদ ছেলে চেয়ার পেতে স্টুডিওর সামনে বসে আছে। ওরা আমাদেরকে দেখে সিটি বাজায়,সিনেমার সংলাপ আওড়ায়। আমরা দ্রুত মাথায় কাপড় টেনে পথ থেকে পালিয়ে যাই ।
আসমা চৌধুরী
আসমা চৌধুরী জন্ম–৩০নভেম্বর ১৯৬৫ মেহেন্দিগঞ্জ,বরিশাল । তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সহকারী অধ্যাপক। লেখালেখি – গল্প,কবিতা,প্রবন্ধ ও শিশুতোষ সাহিত্যে বিচরণ। বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকার। প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ, বসবাস,গল্পগ্রন্থ। প্রকাশকাল–১৯৯০। প্রকাশিত গ্রন্থ– ১৭টি। পুরস্কার– ২০০০সালে শিশুতোষ সাহিত্য রচনায় ইন্টারলাইফ বাংলাদেশ কর্তৃক সুনীতি পুরস্কার। ২০১৩তে জয়িতা পুরস্কার, ২০১৬তে শ্রেষ্ঠ কলেজ শিক্ষক, ২০১৬তে জাতীয় কবিতা পরিষদ কর্তৃক কবি সম্মাননা,২০১৭তে বরিশাল জেলাপ্রশাসন কর্তৃক জীবনানন্দ পদক লাভ।