[কবিতা হতে পারে অভিনবত্বের রঙে রাঙানো কিংবা নানান রকম। চেনাফুলের বাগানে হঠাৎ অচেনা ভিন্ন ধরনের ফুল দেখলে অস্বস্তি হওয়া স্বাভাবিক। বিচিত্র গান শুনে অভ্যস্ত কানও অন্যতর কোনো সুরে চমকে উঠতে পারে। গত দশকে আমেরিকার পোয়েট লরিয়েট বিলি কলিন্স (জ. ১৯৪১) চাইলেন গোটা পৃথিবীর সমকালীন কবিতাভাণ্ডার পর্যটন করে এমন একটি সংগ্রহ গড়ে তুলতে যেখানে মিলবে আনকোরা কবিতার স্বাদ। কবিতাবিশ্বের ১৮০ ডিগ্রি পরিভ্রমণ কি এতটাই সহজ! নতুন কবিতার দিকে ফিরে তাকাতে তিনি গ্রন্থের নাম দিলেন পোয়েট্রি ১৮০, প্রায় দেড় শতাধিক কবির ১৮০টি কবিতার সংকলন। এখানে অনূদিত হলো বিলি কলিন্স ছাড়াও অন্য দুজনের কবিতা; যার একজন ফ্লোরিডায় বসবাসকারী বহু পুরস্কারে ভূষিত পিটার মিইঙ্ক। নব্বুই ছুঁইছুঁই বয়সী এ কবি ফিকশনও লেখেন। আর লি-ইয়াং লী (জ. ১৯৫৭) আমেরিকান কবি হলেও চীনা বংশোদ্ভূত। তাঁর প্রপিতামহ ছিলেন চীনের প্রথম রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট।]
বিলি কলিন্স
কবিতার পরিচয়
ওদের বললাম একটা কবিতা নাও
আর মেলে ধরো আলোর নিচে
রঙের স্লাইডের মতো
অথবা চেপে ধরো কান তার মধু-র বিপরীতে
বলেছি একটা ইঁদুর ছেড়ে দিতে কবিতার ওপরে
আর লক্ষ্য করা যাক তার বেরুবার পথ
কিংবা কবিতার কক্ষে হেঁটে বেড়াও
বাতির সুইচের জন্যে অনুভব করো দেয়াল
চাইলাম কবিতার উপরতলে তারা করুক স্কি
সৈকতে কবির নামের দিকে তুলুক ঢেউ
অথচ চাইলো তারা দড়ি দিয়ে কবিতাকে
চেয়ারের সঙ্গে বাঁধতে, আর স্বীকারোক্তি
আদায়ের জন্যে শুরু হলো পীড়ন
কবিতাটি সত্যিই কী বলছে জানবার অভিপ্রায়ে
মোজা দিয়ে তারা কবিতাকে
শুরু করলো প্রহার।
লি ইয়াং লী
ছোট পিতা
আমার বাবাকে আমি প্রোথিত করেছি নীলাকাশে
সেদিন থেকেই প্রতি ভোরে পাখিদল তাকে
পরিচ্ছন্ন রাখছে, আঁচড়ে দিচ্ছে তার চুল
আর রাত্রিবেলা কম্বল টেনে দিচ্ছে তার চিবুক বরাবর
আমার বাবাকে আমি প্রোথিত করেছি ভূগর্ভে
এরপর থেকে আমার সব সিঁড়ি শুধু নিচেই নামছে
আর গোটা পৃথিবী হয়ে উঠেছে একটিমাত্র ঘর
সে-ঘরের কক্ষগুলো হলো ঘণ্টা, সন্ধেবেলা দরোজাগুলো
উন্মুক্ত, অভ্যর্থনা জানায় একের পর এক অতিথি
কখনোবা তাদের টেবিল জুড়ে বিয়ের ভোজসভা
আমার বাবাকে আমি প্রোথিত করেছি আমারই হৃদয়ে
এখন আমার ভেতরেই তার বেড়ে ওঠা, আমার আশ্চর্য পুত্র
আমার ছোট শেকড় দুধপানে অসম্মত নয়
ছোট পাণ্ডুর পা ডুবে গেছে রাতের মৌনতায়
ছোট ঘড়ি প্রস্রবন সদ্য ভেজা আগুনমাঝে
ছোট আঙুর, আগামীর মদের জনক,
পুত্রটি তার নিজেরই পুত্রের ফল
ছোট পিতা আমি প্রায়শ্চিত্ত করি আমার জীবনসমেত
পিটার মিইঙ্ক
প্রেমের কবিতা
যখন তরুণ ছিলাম
অভিজাত বাগানের চকচকে আপেলের মতো
ভালোবেসেছিলাম সেই নারীকে
যার সৌন্দর্য চাঁদের মতো ঘুরে বেড়াতো
গুঞ্জরিত সবকটি স্বর্গে গান হয়ে
যতোক্ষণ না নক্ষত্রের ছোট্ট দাঁত প্রস্ফুটিত হতো সে গানে
আকাশ কঠিন হলে তার আগে আমিই পতিত হতাম
সে হাসতো, আলতো করে নামিয়ে আনতো আমাকে
আমি ছিলাম খুবই তরুণ।
যখন পুরুষ ছিলাম
সুঠাম কুঠারের মতো ধারালো উজ্জ্বল
রেণুছড়ানো ফলবাগানে
সেই রমণীকে ভালোবেসেছিলাম
যার সুগন্ধি বাতাসে দোল খেতো, আর
বিনম্র ফুলেরা হতো শিথিল রক্তিম
যতোক্ষণ না নার্সিসাস ফুলগাছেরা মুখ খুলতো
আর ফেটে পড়তো কর্কশ চিৎকারে
তার দরোজায় আমার হাত ভেঙে ফেলতাম, আর
কাঁদতাম অসহ্য পীড়নে
সে হাসতো, প্রত্যাখ্যান করতো
ভিড়ের ভেতর এই মানুষটিকেই।
যখন বুড়ো হলাম
বাগানের মালিকানার ভাগও বাড়লো
নবীন ও সজীব নারীটিকে ভালোবাসলাম
সে ছিল ভোরের অস্বচ্ছ হিমে
কম্পমান দীঘল গাছের মতো
তার চোখ কিছুই দেখতো না, কিন্তু সুন্দর
সূর্যের স্বর্ণ অনিচ্ছায় জড়াতো তার বাহু
আমার বোকামি সে ক্ষমা করে দিতো
হাসতো সে, শান্তভাবে নামিয়ে আনতো আমাকে
আর আমি ছিলাম বেশ বুড়ো।
যখন শয্যাগত হলাম
অভিশপ্ত আমার ঠিকানা হলো কুয়াশাচ্ছন্ন ঘর
ভালোবাসলাম সেই নারীকে যার হাড়ের মর্মর
পতঙ্গ-পাখনার মতো আমার আঁধারঘরে তুললো প্রতিধ্বনি
আর বাগানের মালির নিড়ানির মতো খুলে পড়লো ছাদ
আমার শয্যার পরে
তার দিকে হাত বাড়ালাম, ঈশ্বরের কৃপার আশায়
এবং সে হাসলো, মিষ্টি করে আমাকে জড়ালো
আমি কতোই না মৃত ছিলাম।
মারুফ রায়হান
মারুফ রায়হানের জন্ম ২৩ নভেম্বর ১৯৬২। পৈতৃক নিবাস খুলনায়। স্কুল-কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে পড়লেও অনার্স পড়েন ইংরেজি সাহিত্যে। আশির দশকের প্রথমার্ধে ছাত্রাবস্থায় প্রবলভাবে নাট্যান্দোলন, লেখালেখি ও সাংবাদিকতায় জড়িয়ে পড়েন। আরণ্যক নাট্যদলের হয়ে অভিনয় করেছেন মঞ্চনাটক, টিভিনাটক ও পথনাটকে। ১৯৮২ সালে সামরিক শাসনবিরোধী ভূমিকা রাখায় গ্রেফতার হন। প্রধানত কবিতাই লেখেন। প্রকাশিত হয়েছে আঠেরোটি কবিতাগ্রন্থ এবং নির্বাচিত কবিতার একটি সংগ্রহ। সাক্ষাৎকারমূলক গ্রন্থ আছে দুটি। প্রবন্ধের বই চারটি। দুটি উপন্যাস (রানী ও কেরানি, আর জে রাজহংসী) বেরিয়েছে, আরেকটি (সোহাগপুর) প্রকাশের অপেক্ষায়। পেশা সাংবাদিকতা। কাজ করেছেন প্রথম আলোসহ বেশ ক’টি জাতীয় দৈনিকে। বর্তমানে দৈনিক জনকণ্ঠে কর্মরত। দেশের প্রথম অনলাইন সাহিত্য ম্যাগাজিন বাংলামাটি-র প্রতিষ্ঠাতা। সম্পাদনা করেছেন ‘মাটি’নব্বুই দশকের সাড়াজাগানো সাহিত্য মাসিক। বিগত দেড় দশক ধরে একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে একুশের সংকলন সম্পাদনা করছেন যেটিতে থাকে চলতি বছরে প্রকাশিত ৫০ নির্বাচিত বই নিয়ে ক্রোড়পত্র। রেডিও-টিভিতে সাহিত্য বিষয়ক অনুষ্ঠান করেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনে এখন উপস্থাপনা করছেন বিশ্বসাহিত্য বিষয়ক অনুষ্ঠান ‘নিসর্গ ও নক্ষত্র। ২০১২ সালে পেয়েছেন লন্ডনের ‘সংহতি বিশেষ সম্মাননা পদক’। [email protected]