শাহনাজ নাসরীনের গল্প: ভাঙ্গারি

শাহনাজ নাসরীন

কাঁধে একটা চটের বস্তা নিয়ে হন হন করে হাঁটে সালমা। হাঁটে আর গালাগাল করে। খানকির পুত, চুতমারানির পুত, বাঞ্চোৎ বলে যার গুষ্ঠি উদ্ধার করে, যাকে কিনা তার জীবনের সব যন্ত্রণার জন্য দায়ী করে সে কাল রাতে তার জমানো টাকা চুরি করে পালিয়েছে। এখন হয়তো সেই টাকায় হেরোইন নিয়ে পড়ে আছে কোথাও। কথাটা মনে হতে আবার চোখ ফেটে জল আসে তার আর আবারও গালির তুবড়ি ছোটায়।

এই হারামির জন্য সে কিনা মা-বাপ ছেড়েছিল! আজ এই লোক তাকে তো ছেড়েছেই নিজের দুই সন্তানকেও ছেড়েছে। আসে শুধু টাকা নিতে। না দিলে মারধর করে। যেমন তেমন মার না যাকে বলে ‘ছ্যাঁচা মাইর’। একবার তো হাত ভেঙে দিয়েছিল। এবার তো চুরিও করলো। এই চুরি তো শুধু সালমার টাকা চুরি না তার ছেলেমেয়ের হক চুরি! তবে এই লোকের কাছে এখন বউ ছেলেমেয়ে কিছুই না। নেশাই তার সব। যেরকম অমানুষ হয়েছে কবে যে মেয়েটাকে বিক্রি করে দেবে সেই ভয়ে থাকে সালমা। পুলিশে দেয়ার সাহসও পায় না তাহলে খাল কেটে কুমির ঘরে ঢুকানোই হবে।

কী কষ্টে যে আছে সে কাকে বলবে। সারাদিন বাচ্চা দুটি ঘরে একা থাকে আর সে পথে পথে হাঁটে। মাথার ভিতর জট পাঁকিয়ে থাকে ভয়। বাচ্চাগুলিকে বাড়ি গিয়ে ঠিকঠাক মতো পাবে তো। বস্তির বাচ্চারা আগুনে পুড়ে মরে, পানিতে ডুবে মরে হারিয়ে যায় কোথায়। খাদিজা চাচী এখনো তার দশ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া ছেলের ছবি নিয়ে রাস্তায় বসে থাকে। এখন যে এই ছেলের চেহারা আর এমন নাই তা মাথায় নেই পাগল বুড়ির। সালমা মনে মনে গভীর করে আল্লাকে ডাকে। বাচ্চা দুইটারে ভালো রাইখো মা’বুদ। সব সইছি, অগো কিছু হইলে আর সইতে পারমু না।

সালমা সুর্যের দিকে তাকায় আর লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটে। আজ দেরি হয়ে গেছে। প্রতিদিন ফজরের আজান দিলে সে, লিপি, মুক্তা, তহুরা আর সখিনা একসাথে তিনটি করে বস্তা কাঁধে নিয়ে বের হয়। সারাদিন রাস্তা, পার্ক, বিল্ডিংয়ের আনাচ কানাচ হাতড়ে কাগজ, বোতল, ওয়ানটাইম খাবারের প্যাকেট, ভাঙা আসবাব, ছেড়া জুতা, কার্টন হেন জিনিস নেই যা তারা বস্তায় ভরে না। সারা সকাল বস্তা ভরে তারপর একজায়গায় সব নামিয়ে আলাদা আলাদা করে গুছায়। ততক্ষণে বিকেল হয়ে যায়। পড়ন্ত বিকেলে এগুলো বিক্রি করে বাজার করে বাড়ি ফিরে। বাচ্চা দুইটার মুখ তখন শুকিয়ে আমসি। কিন্তু কী করবে সে। ভাগের চুলার দখল পেলে তবে তো রান্না করে ছেলেমেয়ে নিয়ে খাওয়া। মাঝে মধ্যে ইনকাম একটু বেশি হলে দুইটা বনরুটি এনে হাতে দেয় কিন্তু বেশিরভাগ দিনই সেই সুযোগ হয় না। টাকা কিছু হাতে রাখাও লাগে। ঘর ভাড়া, ইলেকট্রিক বিলের পরে আবার মাস্তানের চাঁদা। নইলে রাতবিরেতে দরজায় ধাক্কা। তাছাড়া বর্ষাকালে ইনকাম একদম কমে যায় তখনও এসব খরচ তো আর বন্ধ হয় না। এই যে তার হারামজাদা স্বামীটা বাড়িভাড়ার টাকাটা চুরি করে নিয়ে গেল এখন কী হবে ভেবে তার আবার রাগে শরীর চিড়বিড় করে। আজকাল কান্না শুকিয়ে গেছে তার, গালাগালি ছাড়া কথা বলতেই পারে না।
সালমা সুর্যের দিকে তাকায়। আজ আর কিইবা পাবে এতক্ষণে সবার অর্ধেক কুড়ানো শেষ। সে কোনদিক থেকে শুরু করবে ভাবতে থাকে। একা একা সব জায়গায় যাওয়াও যায় না। এলাকার পুলিশ, সিকিউরিটি গার্ড, বাড়ির দারোয়ান, গাঞ্জাখোর সবাই সুযোগ পেলেই তাদের ওপর চড়াও হয়। পরশুদিন তাদের বস্তির শাফিয়াকে ধরেছিল। ও চীৎকার করতে গেলে এমনভাবে থাপ্পড় মেরেছে আর মুখ চেপে ধরেছে যে গাল, গলা সব ফুলে গেছে। এখন পর্যন্ত ওর গলা দিয়ে ফ্যাসফেসে আওয়াজ বের হয় শুধু। মেয়েটা আর কথা বলতে পারবে কিনা কে জানে। এসব কারণেই তারা সবসময় দল বেঁধে চলে। তারপরেও অঘটন ঘটেই।

পথে আজ কিছুই পাচ্ছে না কুড়ানোর মতো। সে বুঝতে পারে তার সঙ্গীনিরা সব তুলে নিয়ে গেছে। তবে ফ্লাইওভারের নিচে দুটি কন্ডম পড়ে আছে দেখে সে ঝট করে তুলে নিয়ে সালোয়ারের খুঁটে গুঁজে ফেলে। ছেলেটা বেলুন কিনতে চায় প্রতিদিন। ওকে দেবে।
গতরাত থেকে না খাওয়া শরীর ভেঙে পড়তে চায় তবু সে দৌড়াতে চেষ্টা করে। কাল একটি আবাসিক এলাকার এক দারোয়ানের সাথে সে খাতির পাতিয়েছে। দারোয়ান বলেছে তাকে অল্পসময়ের জন্য বিল্ডিংয়ের পেছনে ঢুকতে দেবে। দারোয়ান অবশ্য খুব ভোর ভোর যেতে বলেছে। দারোয়ানের মতলব সে বুঝে তবু বিল্ডংয়ের পেছন দিকটায় সাধারণত অনেক কিছু পাওয়া যায় বলেই সে রিস্ক নিয়ে হলেও যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এখন বেলা হয়ে গেছে বলে নাও ঢুকতে দিতে পারে তারপরেও সে প্রথম চেষ্টাটা ওখানেই করবে ঠিক করলো। আর তার ধারণাকে সত্য প্রমান করে দারোয়ান তাকে ‘খুব সেয়ানা হইছ’ বলে তাড়িয়ে দিলো।

২.
লালমাটিয়া তিন নম্বর রোডের বড় গেটটি সবসময় তালা মারা থাকে। তাই গাড়ি বা রিক্সা নিয়ে যারা আসে তারা তিন নম্বর রোডের কোন বাসায় যেতে হলে মেইন রোড থেকে সাত বাঁক নিয়ে দুই নম্বর রোড হয়ে তিন নম্বওে ঢোকে সোজা ঢুকতে পারে না। তবে যারা হেঁটে ঢুকতে চায় তাদের ঝামেলা নেই। তালা মারা বড় গেটের পাশে একটি ছোট গেট আছে মাথা বেশ খানিকটা নুইয়ে সেটা দিয়ে ঢোকা যায়। তাতে রাস্তা অনেকটা কমে। তবু এই গেট দিয়ে ভদ্রলোকদের চলাচল প্রায় নেই। হতে পারে সাত-আটটি নিম্নবিত্ত মেয়ে ওখানে সকাল সকাল বিশাল সব বস্তা খুলে ময়লা ছড়িয়ে বসে বসে বাছাই করে সেই শেষ দুপুর পর্যন্ত। তবে বিকেলের পর তো তারা থাকে না। তবু তেমন কাউকে ওই পথ মারাতে দেখা যায় না। হতে পারে জায়গাটি ময়লা এবং অনেকগুলি কুকুর এখানে দিনরাত শুয়ে-বসে থাকে বলে। অনেকেই কুকুর ভয় পায়। কিন্তু বিলকিসকে বিভিন্ন কাজে কয়েকবার পায়ে হেঁটে ঘর-বার করতে হয়। কাজেই ঘুরপথ না নিয়ে সে সোজা রাস্তাই বাছে। আর তার কাজের ধরণে সে মাটি থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন থাকতেও পারে না এবং স্বভাবের ধরণেও সে মিশুক প্রকৃতির। তাই এই মেয়েদের সাথে চোখাচোখি, স্মিতহাসির একটা সম্পর্ক তার ছিলই।

তবে একদিন তাকে দাঁড়াতে হলো। শীতের সেই সকালে সে দেখলো মেয়েরা একটি মাঝবয়সী নারীকে শুশ্রুষা করছে। তাদের কুড়োনো কাগজ, লাকড়ি সব পুড়িয়ে হাত পায়ে সেক দিচ্ছে। মহিলার ঠোঁটে কামড়ের দাগ ফুলে আছে। গলায় আঙুলের দাগ। গায়ের বিভিন্ন জায়গায় নখের খামচি থেকে রক্ত ঝরছে। ওরাই বললো, ঠা-ায় জমে নীল হয়ে গিয়েছিল। প্রথমে তারা ভেবেছে মরে গেছে পরে জ্যান্ত দেখে বাঁচানোর চেষ্টা চলছে। নিজেদের কাছে থাকা এক দু’টাকা মিলিয়ে চা আর বনরুটি কিনে এনেছে। খাওয়াচ্ছে যত্ন করে। একটি মেয়ে বললো, দেখছেন ম্যাডাম ব্যাডা মাইনষের খাসলত? এই বয়স্ক বেডিরেও ছাড়ছে না।

সেদিন বিলকিস ওদেরকে চা আর রুটি খাওয়ায়। এরপর থেকে ওদের সাথে বেশ একটা সখ্য গড়ে ওঠে। তাদের কাছ থেকেই জানে ওরা হচ্ছে ভাঙ্গারি। শহরের রাস্তা থেকে বিভিন্ন জিনিষ কুড়িয়ে বিক্রি করে। বিলকিস মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শোনে, খুবই ইন্টারেস্টিং প্রত্যেকের জীবন। কয়েকজনের স্বামী ড্রাগ অ্যাডিক্টেড তারা বললো হেরোইনচি। যাদের স্বামী সিএনজি চালায় তাদের প্রত্যেকের সতীন আছে আর যাদের স্বামী ড্রাগ অ্যাডিক্টেড না হয়েও দ্বিতীয় বিয়ে করেনি তারা হয়তো যক্ষা রোগী নয় হাঁপানি আছে। বিলকিস ওদেরকে ফলো করতে শুরু করে। একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র বানাবে ওদের নিয়ে।

৩.
আজও সকাল থেকে বিলকিস ক্যামেরা সেট করে বসে আছে। বেশ ক’দিন ধরেই ওদেরকে ফলো করছে সে। ওদের বস্তিতেও যাবে বলেছে। ওরা প্রত্যেকেই বিলকিসকে অনুরোধ করে বিলকিস যেন তার ঘরে খায়। ওরা খুব আগ্রহ নিয়ে বিলকিসের ডাইরেক্ট সিনেমার কথা শোনে, তাকে সহযোগিতাও করে। লিপি, মুক্তা, তহুরা আর সখিনা তাদের কুড়ানো জিনিষপত্র ঢেলে গুছাচ্ছে আর বিলকিস ম্যাডামের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। অনেক্ষণ শুটিং করা হয়েছে কিন্তু আজ তার প্রধান চরিত্র সালমার দেখা নেই। সালমা প্রধান চরিত্র হয়ে গেছে নিজ গুণেই। খুবই লড়াকু একটি মেয়ে আর খোলামেলা কথা বলে।

বিলকিস ওদেরকে জিজ্ঞেস করেছিল বাসায় কাজ করাটা কি এই কাজের চেয়ে ভালো না? তো সালমা তেজের সাথে উত্তর দিয়েছিল: না আফা, গেছিলাম বাসাত কাম করতে। সা’বেরা গায়ে হাত দেয় হেই দোষও আমার, মেমসা’বেরা আমারেই মারে। আর এমন খচ্চর হেরা কী কমু, ম্যাডামের প্যান্টির মধ্যে রক্তের দাগ থাকলেও নিজে ধোয় না আর খাটাস ব্যাডার আন্ডারওয়ার তো সারাবছর সাদা হইয়া থাহে। থু দিয়া আইছি আর যামু না। না খাই কম খাই এমনেই ভালো আছি, স্বাধীন আছি।

অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর বিলকিস জিজ্ঞেস করে আজকে সালমা আসবে না? ওরা বলে কি জানি যখন বাইর হইছি তহন তো ডাকছিলাম আহে নাই। কাইলকা হের জামাই আইছিল। ঘটনা ঘটাইছে। বিলকিস উৎসুক হয়ে ওঠে। জিজ্ঞেস করতে যায় কী হয়েছে এমন সময় মুক্তা বলে, ঐ যে সালমা আইতেছে। সালমাকে দেখা যায় কাছাকাছি এগিয়ে আসতে। বিলকিস ক্যামেরা ধরে তার দিকে কিন্তু সালমা কাছে এসেও না দাঁড়িয়ে মাঠের দিকে এগোতে থাকলে বিলকিস ডাকে ওকে। সালমা তবু তাকায় না। বিলকিস ক্যামেরা হাতে পেছন পেছন ছোটে। তাতেই সালমার খিঁচানো মেজাজ যেন ম্যাচের কাঠির মতো দপ করে জ্বলে উঠে। সে চিৎকার করে বলে আফনের বালের সিনেমা চুদলে ঘরে ভাত আইব আমার? বলে হনহন করে হাঁটতে থাকে।

অন্য মেয়েরা থ হয়ে যায় ওর কান্ড দেখে। সালমার অভদ্রতার জন্য বিলকিসের কাছে লজ্জায় তাদের হাতের কাজ খসে যেতে থাকে। কিন্তু বিলকিসের ক্যামেরা একটুও কাঁপে না। সে স্থির ভাবে ক্যামেরা হাতে সালমার পিছু পিছু যেতে থাকে। চমৎকার একটি সিকোয়েন্স পেয়ে গেছে সে।

 

শাহনাজ নাসরীন

জন্ম  ও বেড়ে ওঠা কুমিল্লায় ।

দেয়াল পত্রিকায় ছড়া লেখা দিয়ে লেখালেখির শুরু। গল্প ও কবিতা দুটোই লিখে থাকেন। চল্লিশটির মতো গল্প একটি উপন্যাস অল্প কিছু কবিতা আর  প্রবন্ধ লেখা হয়েছে এ যাবৎ।

এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে পাঁচটি কবিতা, তিনটি গল্প, একটি উপন্যাস ও দুটি জীবনী গ্রন্থ।

Email: [email protected]

Facebook Comments

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top