(তনুর জন্য, যে কখনো হারিয়ে যাবে না। প্রতি মূহুর্তে একটা জ্বলন্ত অঙ্গার হয়ে জ্বলতে থাকবে সকলের মনের দরজায়)
বিকেল হতেই বাইরে রোদ ঝলমল করছে। বারান্দার কোণে বৃক্ষমেলা থেকে কিনে আনা জুঁইয়ের চারায় ফুল এসেছে। বাড়ির গেটের কাছে লাগানো হাস্নাহেনার ঝাড় থেকে ফুলের তীব্র ঘ্রাণ ভেসে আসছে ঘরে। সদ্য কেনা পশমী পর্দা উড়ে উড়ে এসে মেহবুবের গায়ে এসে লাগছে। মেহবুব চিন্তাও করতে পারছে না তার জীবনটা হঠাৎ করে এমন বদলে যাবে। দীর্ঘদিন ধরে একঘেয়ে সময়ের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে মনটাই হতোদ্যম হয়ে পড়েছিল, একেবারে জলশূন্য, যেন মরুভূমির ক্লান্তিহীন পথ চলা। কোথাও কোনো জল নেই, সব মরিচীকা হয়ে এসে চোখ ধাঁধিয়ে চলে যেত। কিছুদিন আগেও মেহবুবের দিনগুলো এমন নিরুপদ্রব, মসৃণ, নিরুদ্বিগ্ন ছিল না। ঘুম থেকে ওঠার আগেই ব্রেকফাস্ট তৈরি। ক্রিম দেয়া ধোঁয়া ওঠা স্যুপ, টোস্ট, ডাবল ডিমের অমলেট, ফল, মিল্ক শেক, পরাটা, ভেজিটেবল, চিকেন। সব টেবিলে থরে থরে সাজানো। সকালের নাস্তা শেষ করে এক্সপ্রেসো কফি খেতে খেতে ২৪/৮ আলাউদ্দিন রোডের ঘুপচি ঘরগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠল। সারি সারি টিনের ঘর, চারপাশে ভ্যাপসা গন্ধ। ঘরের বাইরে এক চিলতে জায়গায় রান্না ঘর, সেখানে কয়েকটি পরিবার একই চুলায় রান্না করে। জায়গাটা সব্জির কাটা অংশ, মশলার গন্ধে ভরে আছে। মেহবুবের মা কোমরে শাড়ি পেঁচিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে চুলার ধারটা পরিস্কার করছে, সব দৃশ্য সিনেমার এডিটিং টেবিলের মতো চোখের সামনে ভেসে উঠছে। এখান থেকেই এক হাঁটু কাদা পেরিয়ে সাড়ে সাতটায় বাস স্ট্যান্ডের দিকে ছুটে যাওয়া তারপর অন্য সকলের মতোই বাসের হ্যান্ডেলে ঝুলতে ঝুলতে কাওরান বাজারে বায়িং হাউজের জোনাল অফিস। সমস্ত দিন কম্পিউটারে অফিসের চিঠি টাইপ আর এক গাদা এসাইনমেন্ট। কয়েক বছর ধরে মেহবুব অফিসটিতে কাজ করছে। এখানে প্রতিদিন একই রুটিন, মনের ভেতর আশা জাগাবার মতো কোনো ঘটনাই ঘটে না। পাংশুটে চেহারার ম্যানেজার প্রতিদিন লাল কালি দিয়ে লেটমার্ক করতো আর বসের হম্বিতম্বি-এই ছিল প্রতিদিনকার রুটিন। দুপুরে পাশের স্বস্তা হোটেল থেকে আসতো রুটি আর ডাল নয়তো সব্জি। শুকনো রুটি ছাড়া আর কিছু কিনে খাওয়ার সাধ্য তার ছিল না। মার হাতে সংসার খরচের টাকা তুলে দিয়ে নিজের জন্য কিছু টাকা জমিয়ে রাখত মেহবুব। সে টাকা থেকে বাঁচিয়ে প্রতিমাসে একটা বই কিনতো সে, কখনো কবিতার, কখনো গল্পের বা সমকালীন কোনো প্রাবন্ধিকের বই। তার জীবনে একমাত্র আনন্দ ছিল এই বই পড়া। বহুরাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে নিমগ্ন হয়ে বই পড়তো। বড় ভাই শফিক বিয়ে করে আলাউদ্দিন রোডের বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে পুরো সংসারের ভার এসে পড়ে মেহবুবের কাধে। ছোট দুই ভাই-বোনের পড়ালেখার খরচ, বাড়িভাড়া, ইলেকট্রিক বিল, পানি-গ্যাসের বিল, মায়ের ওষুধ সব দিতে গিয়ে হাত একেবারে শূন্য হয়ে পড়ত। প্রতিদিন সকালে আলাউদ্দিন রোড থেকে বেরিয়ে চাঁনখারপুলে গিয়ে বাসে ওঠা, সারা রাস্তায় অসহ্য যানজট। এরকম অবস্থার মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে প্রায় দিনই অফিসে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যায়। একদিন অফিসে পৌঁছাতে বেশ দেরি হয়ে গেল। বস ডেকে পাঠালো, মেহবুব খুব টেনশনে ভুগতে লাগল। দরজা ঠেলে বসের ঘরে ঢুকতেই চিৎকার, এত দেরি করে অফিসে এলে চাকরি থাকবে আপনার?
মেহবুব মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো, বুক ঢিপ ঢিপ করছে। আপনাকে গতকাল থাইল্যান্ডের যে চিঠিটা তৈরি করতে দিয়েছিলাম, করেছেন?
না স্যার।
কেন?
ভেবেছিলাম সকালে এসে করব কিন্তু আসতে দেরি হয়ে গেল। এখন করে দিচ্ছি স্যার।
মেহবুবের কথা শুনে বসের চেহারায় চরম বিরক্তি দেখা দিল। সে চিৎকার করে বলতে লাগল, আমার অফিসে এ ধরনের গাফলতি চলবে না, কাজ করতে চাইলে সময় মতো অফিসে আসবেন না হলে আসার দরকার নেই।
মেহবুব নিজেকে আর সংযত রাখতে পারল না, বলল আমি সব কাজ ঠিক সময়েই করি স্যার।
মানে?
হ্যাঁ স্যার আমার কাজের কোনো গাফলতি নেই। আপনারই সময়মতো কাজ দেয়ার কথা মনে থাকে না।
মানে? আমার জন্য সব কাজ করতে দেরি হয়ে যায়? আপনি আপনার সীমা লঙ্ঘন করছেন মিস মেহবুব।
সরি স্যার কিন্তু আমি নিজের কাজ শেষ করে অফিসের অন্যদের কাজও করে দেই, আপনি সবই জানেন। এসময় দরজা ঠেলে বেশ সুদর্শন, লম্বা একজন ভদ্রলোক ঘরে এসে ঢুকলেন। বস উঠে দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান জানাল এবং অস্থির হয়ে পড়ল। মেহবুবকে আস্তে করে বলল এখুনি দু-কাপ কফি নিয়ে আসুন। মেহবুব স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বস তাকে আবার বলল কি নিয়ে আসুন…
মেহবুব অহঙ্কারী মোরগের মতো ঘাড় বাঁকিয়ে বলল, আমার পক্ষে কফি আনা সম্ভব না, আমি এখানে আর চাকরি করব না।
বস ব্যস্ত হয়ে মেহবুবকে চলে যাবার জন্য ইঙ্গিত করল কিন্তু মেহবুব এক পা নড়ল না, ভদ্রলোক খুব বিব্রত হয়ে পড়লেন, মেহবুবকে বসার জন্য অনুরোধ করলেন। ভদ্রলোককে ধন্যবাদ জানিয়ে বসের দরজা ঠেলে বেরিয়ে আসল মেহবুব। তার শরীর থেকে যেন জ্বর ছেড়ে গেল। বসের ঘরে দেখা ভদ্রলোকের ভারী গলায় বসবার অনুরোধটা শুধু কানে বাজতে লাগল। চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে মেহবুব যেন এক মুক্ত বিহঙ্গ। কাল সকালে আর অফিসে যেতে হবে না। এতদিন ধরে মনের মধ্যে জমে থাকা আবিলতাকে সরিয়ে ফেলতে পেরে নিজেকে খুব হালকা মনে হচ্ছে। দুদিন মেহবুব বাড়িতে বসে থাকল, দিনরাত নিজের ঘরে বিছানায় শুয়ে, অফিসের ব্যাপারে মাকে কিছু জানাল না। কোনো অসুখও করেনি, মেয়ের আচরন দেখে চিন্তিত হয়ে পড়ল
মেহবুবের মা, অফিসে কিছু হয়নিতো?
রাতে খাওয়ার জন্য ডাকলে মেয়ে বলল, মাথা ধরেছে এখন খাব না, যন্ত্রণা করো না। কেন কাল অফিস যাবি না? খেতে হবে না? মেহবুব মায়ের কথায় কোনো উত্তর না দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দরজা বন্ধ করে দিল। ছোট ছেলে-মেয়েদের খাইয়ে দীর্ঘক্ষণ মেহবুবের মা খাবার নিয়ে বসে থেকে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। সকালে ছোটন আর তোতন স্কুলে যাবার পর দরজা বন্ধ করে মেহবুবের মা আবার একটু শুতেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। মেহবুব কি আজ অফিসে যাবে না? মায়ের খুব চিন্তা হতে লাগল। খুব সকালে দরজায় একজন খাকি পোশাকের লোককে দেখে চমকে ওঠে মেহবুবের মা।
এটা কি মেহবুব আহমেদের বাসা?
হ্যাঁ। ওনার বাসা কিন্তু আপনাকেতো চিনতে পারলাম না।
আমাকে স্যার পাঠিয়েছেন মেহবুব আহমেদকে চিঠিটা দেয়ার জন্য।
আপনি দাঁড়ান, আমি ওকে ডেকে দেই।
দরকার হবে না, আপনি দিয়ে দিলেই চলবে, আসি স্লামালাইকুম।
মেহবুবের মা হন্তদন্ত হয়ে মেয়ের ঘরের দরজা ধাক্কাতে লাগল। ভেতর থেকে মেহবুব বলতে থাকে, মা একটু ঘুমাতে দাও দরজা ভেঙে ফেলবে নাকি?
মেহবুব শোন তোর কাছে কে একজন এসেছে, একটা চিঠি দিয়ে গেছে। চলে গেছে। মেহবুব তড়াক করে বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলে চিঠি হাতে নিলো। একটা এপয়ন্টমেন্ট লেটার কিন্তু মেহবুব কিছুই বুঝতে পরল না। কে পাঠাতে পারে? আর আজই জয়েনিং। মেহবুব বলল মা আমাকে তাড়াতাড়ি এক কাপ চা আর একটা রুটি দাও, এক্ষুনি বেরোতে হবে। মা অবাক হয়ে বললেন দুদিন অফিস গেলি না আজ হুড়মুড় করে কোথায় যাচ্ছিস? কিছুইতো বুঝতে পারলাম না।
এখন কথা বলার সময় নেই মা, দশটার মধ্যে পৌঁছাতে হবে। ওহ তোমাকে বলা হয় নাই আমি আগের চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি। আজ অন্য জায়গায় যাচ্ছি, দেখি কি হয়!
কি? মেহবুবের মা আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি কখনোই মেয়েকে বুঝতে পারেন না, ও যে কি ভাবে আর কি করে? কিন্তু এতদিন তো সব ঠিকঠাক চলছিল, ওর চাকরিটাই এই সংসারের ভরসা, তা নিয়ে ছেলে-খেলা করা যায় না।
রাস্তায় প্রচণ্ড জ্যাম, কোনো মন্ত্রি বা উচ্চ পদস্থ কেউ যাচ্ছেন তাই অনেকক্ষণ ধরে সব অচল হয়ে আছে। মেহবুব টেনশনে ঘামছে, গুলশানে দশটার মধ্যে কিছুতেই পৌঁছানো যাবে না, কিন্তু কোথায় চলেছে মেহবুব এখনও নিশ্চিত নয়। সিএনজিওয়ালাকে তাড়া দিলে, সে বলে আপনি চুপ কইরা বইসা থাকেন আমি আপনাকে ঠিক সময়ে পৌঁছাইয়া দিমু।
ঘড়ির কাঁটা দশটায় পৌঁছানোর একটু আগেই মেহবুব গুলশান দুই নম্বরের রহমান প্লাজায় পৌঁছায়। লিফটের তিন তলায় অফিসটি। রিশিপশনে গিয়ে চিঠি দেখাতে খুব স্মার্ট এক মেয়ে বলল স্যার আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন, প্লিজ সোজা গিয়ে বামের করিডোরে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের রুমে চলে যান। মেহবুব একটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে ভুগতে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই চমকে উঠল। আগের অফিসে সেদিন স্যারের রুমে যে ভদ্রলোক বসতে বলেছিলেন তিনি।
প্লিজ মেহবুব আহমেদ আসুন।
থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। অবাক হয়েছি কে পাঠালো এপয়েন্টমেন্ট লেটার।
হা..হা..হা..কিন্তু এখনতো বুঝতে পারছেন। আমি আসলে সারপ্রাইজ দিতে পছন্দ করি। ওদিন রফিকের অফিসে আপনাকে দেখেই মনে হয়েছিল আপনি আলাদা রকম, ওখানের কাজটা যেভাবে ছেড়ে দিলেন আমি একটু অবাকই হলাম আপনার স্মার্টনেস দেখে। সচরাচর এমন দেখা যায় না, আপনি ইজি হয়ে বসুন, রফিকের সাথে কথা বলেই আপনাকে এপয়ন্টমেন্ট লেটার পাঠানো হয়েছে। সো ডোন্ট ওরি।
না না ইটস ওকে স্যার। আমি আসলে ঘটনার পরম্পরায় একটু নার্ভাস হয়ে পড়েছিলাম।
হুম তাতো হতেই পারে। কিন্তু আমি আরও একটা কথা বলে আপনাকে চমকে দিতে পারি।
মেহবুব বলল একদিনে এর বেশি নিতে পারবো না স্যার।
পারবেন মেহবুব, আর স্যার না বলে আমাকে রোবায়েৎ বলে ডাকবেন।
জি? মেহবুব একটু চমকে উঠল।
হ্যাঁ মিজ মেহবুব। আমার সম্পর্কে তার আগে কিছু জানানো দরকার। আমি রহমান গ্রুপের ম্যানেজিং ডিরেক্টর আর একজন ব্যাচেলার, মাকে নিয়ে ধানমন্ডি ৮/এ-তে থাকছি, ভাই-বোনরা সব দেশের বাইরে। ওহ চা বা কফি? না না আপনি ঘামছেন কোল্ড ড্রিঙ্কস দিতে বলি।
মেহবুব অনেকটা পাথরের মতো বসে রইলো। দরজা ঠেলে শাদা শাড়ি পরা একজন মেয়ে অরেঞ্জ স্কোয়াশ দিয়ে গেল। মেহবুব যন্ত্রচালিতের মতো ড্রিঙ্কসে শিপ দিতে দিতে একটা ঘোরের মধ্যে ঢুকে পড়ল।
রোবায়েৎ ফেওদৌসের প্রতিটি কথা, বলার ধরন,তাকানো সবকিছু মেহবুবকে মুগ্ধ করল। প্রায় দুপুর পর্যন্ত মেহবুব ঐ রুমেই থাকল, তারপর ফর্মালিটিস সেড়ে নিজের বসার জায়গা বুঝে নিলো। রোবায়েৎ ফেরদৌস মেহবুবকে নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে নানা জায়গায় ঘুরতে লাগল, পরে রাতে ডিনার শেষ করে মেহবুবকে আলাউদ্দিন রোডে পৌঁছে দিল। মেহবুব কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না, সব যেন স্বপ্নের মতো, চোখের পলকে ঘটে গেল। নতুন অফিসে মেহবুবের খুব সুন্দর সময় কাটতে লাগল। সারাদিন এসাইনমেন্টের নানা কাজ শেষে সন্ধ্যায় বসের সাথে বেরিয়ে পার্কে, সিনেমা হলে, মার্কেটে ঘুরে শেষে রাতে ডিনার করে বাড়ি ফেরা। অল্প কদিনেই দুজনের সম্পর্কের মধ্যে এমন একটা কিছু তৈরি হল যাকে মেহবুব কিছুতেই এড়াতে পারছে না। মনে মনে যতই ভাবছে এটা ঠিক হচ্ছে না, এর পরিণতি ভাল হবে না, আকাশ আর পাতাল কিন্তু পরদিন অফিসে গেলে আবার সব কথা ভুলে মনের মধ্যে স্বপ্নের একটা ঘোর তৈরি হতে লাগল। মেহবুবের মা মেয়ের ভাবভঙ্গি দেখে একদিন জানতে চাইলো, সত্যি করে বলতো অফিসটা কেমন? তোকে কি কাজ করতে হয়? মায়ের কথা শুনে মেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো, মানে, অফিসে অফিসের কাজ করতে হয়। কেন এতদিন তো জানতে চাওনি..
এতদিন দরকার হয়নি, কিন্তু এখন এই নতুন অফিসে ঢোকার পর তোর টাকা-পয়সা, সাজসজ্জা, চাল-চলন সব বদলে গেছে, তোকে যেন চিনতে পারি না। মা তুমি কোনো চিন্তা কোরো না, আমি ভাল আছি, সব কিছু ঠিক আছে।
কি জানি! মেহবুবের মা রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। কয়েক মাস পর মেহবুব নাজিমুদ্দিন রোডে একটা ভাল ফ্লাট দেখে ভাড়া নিলো, সবাইকে নিয়ে নতুন বাসায় উঠে এলো, নতুন আসবাবপত্র কিনলো। মেহবুব যেন রাতারাতি সব বদলে ফেলতে শুরু করলো। একদিন সন্ধ্যায় মেহবুব আর রোবায়েৎ আলাউদ্দিন রোডের বাসায় এলো। রোবায়েৎ মেহবুবের মার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিল। খুব দ্রুতই সব ঘটে গেল। খুব ধুমধাম করে মেহবুবের বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পর মেহবুব নাজিমুদ্দিন রোডের বাসা ছেড়ে রোবায়েৎদের ধানমণ্ডির ফ্লাটে চলে এলো। রোবায়েৎ এর মা রাশভারী, কথা খুব কম বলেন, দরকার না হলে ঘর থেকে বের হন না, খাবারও নিজের ঘরে নিয়ে খান, মেহবুব ভদ্রমহিলাকে একটু ভয় পায়। যত দিন যেতে লাগল রোবায়েৎ অফিসের কাজে, ব্যবসার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। নানা দেশ-বিদেশে যেতে লাগল। আজ সিঙ্গাপুর, কাল ব্যাংকক, পরশু মালয়েশিয়া। মেহবুব যেন রোবায়েৎকে কাছেই পায় না, মন খুলে কথা বলতে পারে না। মেহবুব কিছুটা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ল, প্রায়ই অফিস থেকে মার বাসায় চলে যেতে লাগল, রোবায়েৎ দেশে না থাকলে মার কাছে গিয়ে থাকতে লাগল। মেহবুবের মা মেয়ের আচরণে চিন্তিত হয়ে পড়ল। তুইতো সব কিছু নিজের ইচ্ছাতেই করছিস, আমি কি বলব, আর তুইতো আমার কথা শুনিসও না। কিন্তু ইদানিং তোর মুখটা খুব শুকনো লাগে, মনে কোনো আনন্দ নেই যেন। মেহবুব মায়ের কথার উত্তর না দিয়ে টিভির রিমোটটা টিপতে লাগল। সত্যি সে আজ বুঝতে পারছে ক্লাস কতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রোবায়েৎ তাকে এতো ভালবাসলেও কেমন যেন দূরের, ওর অনেক কথাই মেহবুব জানে না। ইদানিং ঘন ঘন মালয়েশিয়া গিয়ে থাকছে, এমনকী মাসে পনের-বিশ দিন। মেহবুব একবার বলল, তুমি এতো মালয়েশিয়া যাও আমাকে একবার নিয়ে গেলেই পারো। শুনে রোবায়েৎ একটু চমকে তাকালো, কেন? মালয়েশিয়া কেন? এমনি। আমার বেড়াতে ইচ্ছে করে না? হ্যাঁ চলো আমরা ইন্ডিয়া ঘুরে আসি। সাত দিনের মধ্যে ভিসা যোগাড় করে রোবায়েৎ মেহবুবকে নিয়ে ইন্ডিয়া ঘুরতে গেল। কোলকাতা, দিল্লী, আগ্রা, রাজস্থান নানা জায়গায় ঘুরল। কটা দিন রোবায়েৎ যেন মেহবুবকে পাগলের মতো ভালবাসলো, কিন্তু ফিরে এসে আবার ভিন্ন মানুষ। দিন-রাত কাজ আর কাজ। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ১২টা/ ১টা। এর মধ্যে একদিন মেহবুব অফিস থেকে ফিরে পুরো বাসা অন্ধকার দেখতে পেয়ে রোবায়েৎ এর মায়ের ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকলো, অদ্ভূত দৃশ্য, সারা ঘরে মোমবাতি জ্বালানো, ধূপের গন্ধ, তার মধ্যে রোবায়েৎ এর মা উলঙ্গ হয়ে বসে আছেন, তার উল্টোপাশে একজন মধ্য বয়সী ভদ্রলোক্ নানা মন্ত্র আওড়াচ্ছেন। দরজায় শব্দ শুনে রোবায়েৎ এর মা এক লাফ দিয়ে উঠে চিৎকার করে উঠল, বেরিয়ে যাও, বেরিয়ে যাও, কোন সাহসে তুমি আমার ঘরে ঢুকেছো? মেহবুব এক দৌড়ে নিজের ঘরে চলে এলো, ভয়ে তার সারা শরীর কাঁপতে লাগল। রোবায়েৎকে ফোন করল কিন্তু সারাক্ষণ ব্যস্ত পেল। শেষে না খেয়ে মাঝ রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করে ঘুমিয়ে পড়ল, রোবায়েৎ ভোরের দিকে বাসায় ফিরলো, ফিরে আসার পর মেহবুব রোবায়েৎ এর বুকে ঝাপিয়ে পড়ল, কাঁদতে লাগল। কি হয়েছে মেহবুব? এমন করছো কেন? মেহবুব সব বলল। শুনে রোবায়েৎ বলল, একটা কথা শোনো মেহবুব, আমাদের পরিবারে কারো ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে অন্যের কৌতুহলকে বরদাশত করা হয় না, এটা তুমি মনে রাখবে, নিজের সীমার মধ্যে থাকবে, এটা অতিক্রম করবে না। তোমাকেতো অনেক আরাম-আয়েশে রাখা হয়েছে তোমার কিসের চিন্তা? চিন্তা না, আমি তোমার আম্মার এমন ব্যবহার মেনে নিতে পারছি না, উনি আমার সাথে এভাবে কথা বলতে পারেন না। দেখো মেহবুব মা তার ইচ্ছামতো জীবন কাটান, আমরা কখনো তাতে হস্তক্ষেপ করি না, তুমিও করবে না।
আর তোমার জীবনে?
মানে?
মানে তোমার জীবনে হস্তক্ষেপ করাও কি আমার নিষেধ?
যদি সেটা বাড়াবাড়ি হয়, তাহলে অবশ্যই নিষেধ, আমার ব্যক্তিগত সব বিষয়েতো তুমি হস্তক্ষেপ করতে পারো না। মেহবুব অবাক হয়ে রোবায়েৎকে দেখতে লাগল। এই ক’মাসে যে রোবায়েৎকে সে চিনেছে, এ যেন সে না, অন্য এক মানুষ। নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ লাগতে লাগল মেহবুবের। এর মধ্যে একদিন অফিসে লাঞ্চের সময় রোবায়েৎ মেহবুবকে জানালো কয়েকদিনের জন্য তাকে মালয়েশিয়া যেতে হচ্ছে , সে যেন আজই নাজিমুদ্দিন রোডে চলে যায়। মেহবুব বলল কেন নাজিমুদ্দিন রোডে যেতে হবে কেন? আমি বাসাতেই থাকব। না সমস্যা আছে। কি সমস্যা? সব কথা তোমাকে বলা যাবে না। কেন বলা যাবে না। একবার বললামতো তোমার বাসায় যাওয়ার দরকার নাই, আমি তোমার জিনিসপত্র আনিয়ে দিচ্ছি, অফিস থেকে সোজা তুমি তোমার মায়ের বাসায় চলে যাও। মেহবুব কিছুই বুঝতে পারল না, মন খুব বিষন্ন হয়ে উঠল, মনে হলো ও কি কোনো ভুল করেছে? হঠাৎ করে পাওয়া এই স্বচ্ছলতা, সুখ এটা কি ওর জীবনে ক্ষণিকের জন্য এসছিল? রোবায়েৎ দ্রুত অফিস থেকে বেরিয়ে গেল। মেহবুব বিকালে অফিস থেকে মায়ের বাসায় চলে গেল, ড্রাইভার তার কাপড়-চোপড় নিয়ে আসল। এর পর কয়েকদিন মেহবুব অনিয়মিতভাবে অফিসে যেতে লাগল। অফিসের সবাই তাকে দেখে কেমন কানাঘুষা করতে লাগল। এইচ আর এর শারমিন জাহান মেহবুবেরর সাথে বিশ্ববিদ্যায়ে একসাথে পড়েছে, সে একদিন অফিসের পর মেহবুবের সাথে কফি খেতে বাইরে এলো, তারপর যা বলল তাতে মেহবুব সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ল। বলল এটা বলা আমার ঠিক হচ্ছে না, স্যার জানতে পারলে অনেক কঠিন শাস্তি দেবেন, কিন্তু তোমাকে না বলে পারছি না, তুমি একটা মিথ্যার মধ্যে আছো, আর কতদিন থাকবে?
মেহবুবের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। না বলো, আমি জানতে চাই, এমনিতেই আমি খুব দ্বিধাদন্দ্বে আছি।
মেহবুব স্যার তো মালয়েশিয়া যান নি।
মানে?
হ্যাঁ তিনি এখন হোটেল সোনারগাঁয়ে আছেন, সেখানে তার মালয়েশিয়ান ওয়াইফ এসেছে বাচ্চাদের নিয়ে, তাদের সাথে সময় কাটাচ্ছেন। মেহবুব একেবারে থ’ হয়ে গেল, এমন কোনো কথা শোনার আশা সে করে নাই।
এটা কি অফিসের সবাই জানে?
হ্যাঁ সবাই জানে, স্যারের মালয়েশিয়ান ওয়াইফ আছে, বাচ্চা আছে সবাই জানে, কিন্তু ওরা কখনো বাংলাদেশে আসবে না, এজন্যই স্যার দেশে তোমাকে বিয়ে করেছেন। বাচ্চারা এখন দাদীর সাথে ধানমণ্ডির বাসায় আছে।
মেহবুব হতভম্ব হয়ে গেল, ঘটনার আকস্মিকতায় তার দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইলো। দ্রুত গাড়ি নিয়ে ড্রাইভারকে বলল, ধানমণ্ডির বাসায় যেতে কিন্তু ড্রাইভার যেতে চাইলো না, বলল স্যারের মানা আছে। অগত্যা মেহবুব একটা সিএনজি নিয়ে ধানমণ্ডির বাসায় আসলো। তাকে দেখে দারোয়ান দরজা খুলতে চাইলো না। মেহবুব রাস্তায় দাঁড়িয়ে বলতে লাগল, আমার বাসায় আমি ঢুকতে পারবে না? ভেতর থেকে কেয়ারটেকার এসে মেহবুবকে চলে যেতে বলল। মেহবুব গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে থাকলো। বলল যতক্ষণ আমাকে ঢুকতে দেয় হবে না আমি এখান থেকে এক পাও নড়বো না। প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে এই অবস্থা চলার পর কয়েকজন শক্তপোক্ত দেখতে ছেলে মেহবুবকে গেট থেকে টেনে সরিয়ে দিল এবং একটা সিএনজি ডেকে সোজা নাজিমুদ্দিন রোডে চলে যেত বলল নাহলে ছোট ভাই-বোনদেরকে সরিয়ে ফেলা হবে বলে হুমকি দিল। মেহবুব ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেল। দ্রুত সিএনজিতে উঠে বাসায় চলে এলা।
মা ছোটন আর তোতন কোথায়?
ওরাতো কোচিং এ গেছে।
এক্ষুণি ওদেরকে নিয়ে আসো।
কেন কি হইছে?
আমি এখন কিছু বলতে পারবো না, তুমি ওদেরকে নিয়ে আসো, অনেক বড় বিপদ। মেহবুবের মা দ্রুত কোচিং থেকে ছেলে-মেয়েদের বাসায় নিয়ে এলো। মেহবুব বিকারগ্রস্তের মতো বলতে লাগল, ওদেরকে আর কোচিং এ পাঠিয়ো না। স্কুলে যাওয়ারও দরকার নেই।
কি বলছিস মেহবুব? তোর কি হইছে?
মেহবুব আতঙ্কে জড়োসড়ো হয়ে রইলো। হঠাৎ করে পাওয়া তার ফুলের বাগান তছনছ হয়ে গেছে, সে আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না, কেমন যেন সব গোলমাল হয়ে গেল।
মেহবুবের মা বলতে লাগল, তোকে কিছু বলতে পারি না, তোর উপর এই সংসার চলছে, কিন্তু আজ বলার সময় আসছে।
মেহবুব বলল মা আমাকে কিছু বইলো না, আমি মস্ত বড় ভুল করছি। রোবায়েৎ আমার সাথে চিট করছে, ওর মালয়েশিয়াতে বউ আছে, বাচ্চা আছে, ও, ওর মা সবাই স্বেচ্ছাচারী জীবন কাটায়। মা আমি ছোটনদের কীভাবে বাঁচাব। চলো আমরা এখান থেকে চলে যাই।
এখান থেকে চলে গেলেই কি বিপদ যাবে? তুই বরং রোবায়েৎ এর সাথে কথা বইলা সব ঠিক কর। সে কি চায়, কেমনে চায়।
না মা আমি আর ওই বাড়িতে ফেরত যাব না, ওরা মানুষ না, ওরা আমাদেরকে বাঁচতে দেবে না।
রাতে বোবায়েৎ ফোন করল। মেহবুব ফোন কেটে দিতে লাগল। শেষে মায়ের অনুরোধে ফোন ধরল।
মেহবুব শোনো তুমি আজ যা জেনেছো তা নিয়ে কারো সাথে আলাপ করবে না, নিজের ভালোর জন্যই তুমি তা করবে না। আর আজ রাতের ফ্লাইটে আমি মালয়েশিয়া যাচ্ছি তুমি অফিস করতে থাকো, আমি ফিরে এলে ধানমণ্ডিতে যাবে।
মেহবুব ফোন ধরে বসে রইলো কোনো উত্তর দিতে পারল না। কি সুন্দর করে কথা বলে রোবায়েৎ, যেন কিছুই হয় নি। একজন ঠাণ্ডা মাথার খুনি। মেহবুব সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো আর কখনো ওমুখে পা বাড়াবে না। কাল সকালেই একজন ভাল উকিলের সাথে দেখা করবে। সারা রাত মেহবুবের ঘুম এলো না। বিছানায় এদিক-ওদিক করতে করতে হঠাৎ উঠে বসল, টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে চোখের সামেন মেলে ধরল আনা কারেনিনা। অনেকদিন পর আবার বইটা পড়তে পড়তে চোখের সামনে ভেসে উঠল আনার কালো চোখ, অবিন্যস্ত পোশাক। হ্যাঁ জীবন আজ তাকে পাঁকের মুখে এনে ফেলেছে কিন্তু সেও তো একটা নীলমণি ফুল এই অথৈ জলে ভাসতে ভাসতে ঠিকই পৌঁছে যাবে তার গন্তব্যে। জীবনের ভাটা তাকে টেনে ধরলেও জোয়ারের জল তাকে কোথায় নিয়ে যাবে কেউ বলতে পারে না, মেহবুব একটা খাপ খোলা তলোয়ারের মতো মধ্য রাতে ঝলসাতে লাগল।
নভেরা হোসেন
জন্ম ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫, মাদারীপুর শহরে নানাবাড়িতে। শৈশব হতেই ঢাকায় বেড়ে ওঠা। তিনি নৃবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেছেন জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা হতে। লিটল ম্যাগাজিনে লেখা শুরু করেছেন ২০০০ সালের পর থেকে। তিনি লিটল ম্যাগাজিন, ওয়েব ম্যাগাজিন, জার্নাল ও দৈনিক পত্রিকায় লেখেন। বিশেষত কবিতা, গল্প ও নৃবৈজ্ঞানিক বিষয়ে।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: হারানো দোকান এল দরাদো (জনান্তিক, ফেব্রুয়ারি, ২০০৯); একজন আঙুল শুধু হেঁটে বেড়ায় (সংবেদ, ফেব্রুয়ারি, ২০১০); আর কারনেশন ফুটলো থরে থরে ( শুদ্ধস্বর ২০১৩); একটু একটু করে বোবা হয়ে যাচ্ছ তুমি ( অ্যডর্ন পাবলিকেশন, ফেব্রুয়ারি, ২০১৫); বারুদ লোবানের গন্ধ ; জলে ডোবা চাঁদ ( ২০২০ জানুয়ারী , কলকাতা বইমেলা ) ঐহিক প্রকাশনী। এছাড়া পিয়াস মজিদের সাথে যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন নির্বাচিত কবিতা: শামীম কবীর (অ্যডর্ন পাবলিকেশন, ফেব্রুয়ারি, ২০১০)।
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ :পেন্ডুলাম ও শিশুর দোলনা (শুদ্ধস্বর, ফেব্রুয়ারি ২০১১), জৌলুসী বেওয়া ( দেশ পাবলিকেশন্স, ২০১৬)। তিনি কিছুদিন নৃবিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষকতা করেছেন এবং কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে গবেষণা কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।
ইমেল : [email protected]
বেশ সিনেমেটিক কাহিনি।