গতকাল হাঁটুর নিচে পায়ের মাঝখানে একটা চুলকানি মতো ছিলো। আমল দেবার মতো কিছু না। আজ ভুলে তাতে ঘ্যাঁচ করে চুলকে দিতেই দরদর করে রক্ত বেরিয়েয়ে গড়িয়ে একসা। কিছু না পেয়ে পরনের স্কার্ট দিয়ে মুছতে গিয়ে আঠাআঠা হয়ে গেল। কি আর করা বাধ্য হয়ে খুঁজে পেতে খানিকটা স্যাভলন নিয়ে ঢেলে দিলো। এরকম প্রায়ই হয় তার। বহু বছরের মোটা শরীর। জায়গায় জায়গায় কালো কালো ছোপ। এগুলোকে কি যেন বলে পিগমেনটেশন না কি যেন শুনেছিল। তেমন আঁটোসাটো জামা সে পরতে পারে না। হাতা কাটা সুতির ফতুয়া এবং গোড়ালির সামান্য উপর পর্যন্ত লম্বা ঝুলের স্কার্ট। এই তার সাকুল্যে পোশাক। হাতের খোলা বাহুতে আফ্রিকা, আমেরিকা নানা দেশের ম্যাপের মত মেদ ঝুল ঝুল করে। একাই একাই রেখা এঁকে ডিজাইন হয়ে থাকে। মনে হতে পারে তিনি এসব খেয়ালই করেন না। আসলে করেন, তার এই মেদগুলো নিয়ে খেলতে মজা লাগে।
ছোট ছোট ঘা দিয়ে তার শরীরের দিকে দিকে দাগ হয়ে যাচ্ছে। বেদম ফরসা রঙ্গে এরকম কুৎসিৎ দাগ দেখলে তার নিজেরই অদ্ভুত লাগে। মায়াও লাগে। শত হোক নিজের শরীর। হারানো উপত্যকার মতো হারানো দিনের অগোচরে হারিয়ে ফেলেছে সে তার ছিপছিপে চোখ ধাঁধানো শরীর। মাঝে মাঝে আয়নায় নিজে কে দেখে অজান্তে চোখ ভরে জল আসে। আহারে লিন্ডা, তোকে আজ আর কেউ ভালবাসে না। আবার অনেক সময় এই সব ক্ষতগুলো নিয়ে খেলায় মেতে ওঠে সে। এক রকম কৌতুক লাগে। ক্ষত আধা শুকালে ফের খুঁচিয়ে ক্ষত বানানোর খেলা জানে সে। তেমন ব্যথাও লাগে না শুধু মজা। আর কেউ তো দেখবে না। শুধু লিন্ডা আর তার বেলজিয়ান আয়না।
এক সময় লিন্ডার গায়ের এই রঙ সেইরম গোলাপী ছিলো। পাড়ার ছেলেরা বাপের দেয়া লিন্ডা মেলিসা নাম রেখে পিংকি বলে ডাকতো। তা সে কোন যুগের কথা। মনেও নেই। তিন কূলে কেউ ছিলো না। বাবা নাকি রেলে কাটা পড়েছিল, মা অন্য ঘরে বিয়ে বসেছিলো। ব্যাস কেচ্ছা খতম। কেবল ছিলো দাদি। যেটুকু খাওয়া জোগাড় করার, অর্ডারি কাপড় সেলাই করে তিনিই করতেন। আর কিছু ধানি জমি থেকে ফলটা মূলোটা আসতো। এভাবেই দুইটা পেট চলে যেত।
নাতনীটা দাদির চোখের মনি ছিলো। সেই নাতনীকে কোন এক তাড়াহুড়ায় অসময়ে অনেক বয়সের ব্যবধানের পাত্রের সাথে মোটামোটি সচ্ছল ঘরে বিয়ে দিয়ে তিনি হাপ ছেড়ে বাঁচলেন। না না থুক্কু মরলেন। নাতনী বিদায়ের হপ্তা যেতে না যেতেই স্ট্রোক করে মরে বেঁচে গেলেন পরম ভালবাসার দাদি। আহা, আছাড়ি পিছাড়ি দিয়ে রাত কে রাত অঝোরে কাঁদলো লিন্ডা। বুকটা তার ফেটে যায়। শেষ দেখা দেখে নাই। কাঁদতে কাঁদতে এক সময় শুকিয়ে যাওয়া ঝর্ণার জলের মতও কান্নাও শুকিয়ে গেলো। তারপর সে একদম থেমে গেল। আর দাদির কথা ভবে কাঁদেনি।
বলা যায় দুনিয়াতে বেদম ফর্সা তথা পিংকি তথা লিন্ডার আধা বৃদ্ধ স্বামী ছাড়া আর কেউ রইলো না। তবু আপত্তি ছিলো না লিন্ডা মেলিসা গোমেজের। এতটুকুও পায়নি সে এতকাল নিজের করে। বেশ মন দিয়ে সংসার সংসার খেলা শুরু করলো। ছোটবেলার হাড়িপাতিল খেলার মত মিথ্যে মিথ্যে নয়। এবার মাটির উনুনে লাকড়ি ঢুকিয়ে সত্যি আগুন ধরাতে হয়। পাটকাঠি ভেঙ্গে ভেঙ্গে দিতে হয় তাতে । মাটির হাড়িতে ভাত উথলে উঠলে ভাতের হাড়ি গড় দিয়ে পর পর কড়াইতে মাথা লেজসহ শোলমাছ লাউশাক দিয়ে বেশ বাঁধতে শিখে গেল। স্বামী শান্ত মানুষটা দুপুরে এসে পেট উচু করে খেয়ে ফের দোকানে গিয়ে বসতো। মাঝে মাঝে একটু ক্রিম /লিপিস্টিক /সিনেমা /পার্ক এসব চলছিলো। গায়ের রঙের ছটা কিছুটা কাজে এসেছে। মনে মনে লিন্ডা তাই ভেবেই হাসে। নইলে এই বাপ-মা ছাড়া এই মেইয়ে প্রায় বিনা পণে দাদি পার করতে পারতো না।
যা হোক। এর মধ্যে কয়েক বছরে দুই ছাওয়াল এসেছে। বাপের ব্যবসা বেড়েছে, ছেলেপেলে সময় দিতে গিয়ে লিন্ডা তার নাম যে লিন্ডা না পিংকি না হতচ্ছাড়ি তাও ভুলে গেছে। স্বামী ইদানিং হতচ্ছাড়ি ডাকে। কেননা তার নেই বাপের বাড়ির চালচুলো। বাড়িথেকে টাকা আনার জন্য কেউ বেঁচে নেই। তার ওপরে বিছানায় সে মোটেই সুবিধা দিয়ে পারে না। দেবেই বা কি করে। ছেলেরা তো সাথেই ঘুমায়। ঘর তো সোয়া এক খান। আর স্বামীও খালি ঐ বিদেশী ন্যাংটা মেয়েলোকদের ছবি দেখে। এর মধ্যে ক্রমশঃ ফুলতে থাকা লিন্ডার শরীর বিছানার ১০০ রকম শিল্পকলায় নাড়ানোই বিষম বিপদের কথা।
একবার মাঝ রাতে উঠে দেখে বসার ঘরে ভিডিও চলছে। পাত্র পাত্রীর কারো গায়ে কোনও পোশাক নেই কিছু না। কার উপরে কে শুয়ে ঠিক মতো বোঝাও যাচ্ছে না। এক ব্যাটার শরীরে দুইখান মেয়ে মহাব্যস্ত। তারা যেন ভাগাভাগি করে বানরের পিঠা খাচ্ছে। ওমা কতক্ষণ বাদে আরেক নাঙ্গা বাবা এসে গেলো। তখন পুরোনো ব্যটাকে ছেড়ে নতুন ব্যটার পিছনে দুই ছেমড়ির একটা এতক্ষণের উঠবস থুয়ে ঐ লোকেরে খামচে ধরে বিছানায় শুয়ে পড়লো। ঐ লোক তাকে মূহুর্তে উল্টিয়ে পেছন দিয়ে প্রবল বেগে ধাক্কা দিতে লাগলো। লিন্ডা আধা ঘুম ভেঙ্গে এসব ঠিক মতো কিছুই বুঝতে পারছে না। এতসব ঠেলা ধাক্কার ভিতরে তার স্বামী হা করে ঘুমুচ্ছে। ভয়ে ঘেন্নায় এই সব বন্ধ করে দিলো লিন্ডা। ছেলেরা ভাগ্যিস ঘুমাচ্ছিলো। ছি! ছি! কি সব জঘন্য নোংরা জিনিস দেখে ফেল্লো। হে ঈশ্বর, রক্ষা করো।
কিছুদিন বাদেই লিন্ডা একটা কথা খুব ভাল বুঝলো, যে পুরুষের যত পাকা চুল তার ততো হাঁটুর বয়সী মেয়ে হাতানো লাগে। মেয়েগুলোও সাইরেন শুনলেই বুড়াগুলোর পিছনে ছোটে। বেশী বয়স্ক পুরুষের মোটা টাকা চিকন বুদ্ধি।
স্বামী আলাদা হয়েছে বহুকাল। বহুমাত্রিক সম্পর্কে সে অভ্যস্ত। কাজেই রদ্দিমাল নিয়ে সংসার চলে না। ছেলেরা সরকারি অনুদানের কলেজে পড়ে, হলে থাকে। তারা ছুটিছাটায় মাঝে মাঝে অবশ্য মায়ের কাছে আসে। তাদের মর্জি। কিসব নেশায় পড়েছে পাশের বাড়ির মহিলার কাছে শুনেছে লিন্ডা। আহা কী গর্বের বিষয়! বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হয় লিন্ডার। ছেলেরা বাসায় আসলেও ঘরের দরজা বন্ধ থাকে। কথা খুব কম বলে। ঈশ্বর এবার রক্ষা করলেন বটে !
লিন্ডা খেতে বসেছে পান্তা এবং শুঁটকি। কতগুলো শুকনো মরিচ ডলে নিয়েছে। কেন যেন মুখে কোন রুচি নেই। খেতে বসে দেখে হাতের মাঝে কনুইয়ের উল্টো পাশে কালশিরে মতো পড়ে গেছে। আরো বেড়েছে তার লাল লাল এলার্জি। খাওয়া বাদ দিয়ে অনেকক্ষণ ক্ষতগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো লিন্ডা। এগুলো ছাড়া তার ভালও লাগে না। সারা শরীরে লাল লাল চুলকানি কোথায় কোনটা নতুন হচ্ছে কোথায় কো্নটা সারছে নিজেও খেয়াল রাখতে পারে না। শুধু মনে হয় তার শরীরে অন্ততঃ কিছু ক্ষত আছে। চুলকালেও তাদের জন্য মায়া হয়। আঙুল দিয়ে সস্তা ওষুধ লাগায়। অন্য কোন মানুষের অঙ্গুলির স্পর্শ তো সে পায় না। নিজের হাতে নিজে চুলকায়, কখনও ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে। সুখ চলে গেলে এক সময় মানুষ অসুখ ভালবাসতে থাকে। রক্তেরা জানান দেয়, চামড়া ভেদ করে তীব্র প্রতিবাদ করে তারা বের হয়ে আসতে চায়। একজন ফর্সা কিম্বা পিংকি কিম্বা লিন্ডা গোমেজের রঙ আর নেই, প্রিন্টেড কিম্বা বাটিকের মতো নানা ডিজাইনের ছোপ ছোপ গোটা শরীরে। কেন কোন কারণে নিজের যত্ন তার নেয়া হলো না এ যাবৎকালে এসে তা আর ভাবে না। মাঝে মাঝে মনে হয় মনের ক্ষত সারাবার কোন ওষুধই তার জানা ছিলো না। স্থুলকায়া শরীর তাকে নিংসঙ্গ করে দিয়েছে, স্বামী, সন্তান, পরিচিতজন সবার থেকেই। অনেকেই আজকাল তাকে দেখেও দেখে না। লিন্ডাও খেয়াল করেছে সে নিজেকে লুকায়। একদিন কোণায় বসে বসে ভাল করে সারা শরীর ড্রেসিং করে সে। কিছু সারুক। মানুষকে সারানো যায়না। ক্ষত সারুক। যারা তাকে ফেলে যায়নি তারা এই ক্ষতই। দু;সময়ের বন্ধু। এক সাথেই যাবে।
সুমী সিকানদার
জন্ম ঢাকায় ১৬ ফ্রেব্রুয়ারি ১৯৭২
এ পর্যন্ত একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়েছে পাঁচটি কবিতার বই এবং
প্রথম গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ২০১৮ সালে।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালখি ছাড়াও, অনলাইনের পোর্টালে নিয়মিত লিখছেন।।
গান এবং আবৃত্তি প্রিয় মাধ্যম। অসংখ্যবার বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা রয়েছে। ভালোবাসেন দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়াতে।
সুমি, তোমার লেখায় চরম বাস্তবতার প্রকাশ রয়েছে। সত্যই অসাধারন।
কষ্ট হয়।
তবুও এটাই কঠিন বাস্তব।
অসাধারণ একটা লেখা।
না চাইলেও হৃদয়কে স্পর্শ করে গেলো।।