বাঁয়ে ঘুরতেই ক্যাফেটা নজরে পড়ল– সুন্দর নামটি ‘ক্যাফে নিরো’। ভীড় আছে বেশ– ক্যাফের ভেতরে তো অবশ্যই, কিন্তু সেই সঙ্গে যেখানে খাবারের কথা বলতে হয়, সেখানেও। কিন্তু বিমান থেকে নেমেই কফি-তৃষ্ণা এতো প্রবল হয়ে উঠেছে যে সাত-পাঁচ না ভেবে কোনের দিকে একটা টেবিলে আমার জিনিসপত্র রেখে লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। সময় আছে হাতে। আন্তর্জাতিক বিমান পথের পরে এবার এক ঘন্টার একটি অভ্যন্তরীন বিমান যাত্রা– ছাড়বে তিন ঘন্টা বাদে।
সময় লাগল একটু । তারপরই মিলল আমার প্রার্থিত এক পেয়ালা কালো কফি এবং এক বোতল জল। কফি আর জল নিয়ে বসলাম আমার টেবিলে। না, ভাল টেবিলই বেছেছি।ঘরের ছাদ থেকে মেঝে পর্যন্ত লম্বা শার্সির জানলা, বাইরে পায়ে চলার পথে শত মানুষের পদধ্বনি। কত মানুষ চলেছে সে পথ ধরে– কেউ প্রিয়জনদের বিদায় দিতে, কেউ প্রিয় মানুষদের অভ্যর্থনা জানতে, কেউ বা সম্পূর্ণ একা।
বিমান বন্দরের ক্যাফের এই মজা। কত দেশের, কত বর্ণের, কত বয়সের মানুষের ভীড়। কেউ কেউ দু’টো বিমান-যাত্রার মাঝখানে এসেছেন, কেউ হয়তো বাইরে বেরুবার আগে কিছু একটা খেয়ে নিচ্ছেন, কেউ হয়তো অপেক্ষা করছেন কোন প্রিয়জনকে তুলে নেয়ার জন্য। খাবার তুলে নেয়ার লাইনও বেশ লম্বা– সেখানেও নানা বৈচিত্র্যের মানুষ। বলা বাহুল্য, শিশুরাও আছে সেখানে পিতার কণ্ঠলগ্ন হয়ে, কিংবা মায়ের হস্ত ধারণ করে।
ভালো করে বসে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে দিলাম সারা ক্যাফের ভেতরে। আমার টেবিলের সামনে বাঁদিক ঘেঁসে কৌণিকভাবে যে টেবিলটি তাতে বসে আছেন এক সুবেশ ভদ্রলোক– আমার বয়সীই হবেন। ভদ্রলোকের পাশেও আমার মত টেনে নেয়া যেতে পারে তেমন একটি মাঝারি সুটকেস, তার ওপরে তার ব্যাগ আর বর্ষাতি। জিন্সের জামা আর প্যান্টের সঙ্গে মোটা ফ্রেমের চশমায় ছিমছাম লাগছিল তাঁকে। দেখছিলাম তাঁর সামনে একটি খোলা খাতা, সামনে কফির পেয়ালা এবং এক বোতল পানি। ভদ্রলোক কফির পেয়ালায় চুমুক দিচ্ছিলেন আর মাঝে মাঝে খাতায় কিছু একটা লিখছিলেন।
কিন্তু বোঝাই যাচ্ছিল তিনি মনোসংযোগ করতে পারছিলেন না। একটু অস্থির আর উৎকন্ঠিত মনে হচ্ছিল তাঁকে। বার বার ক্যাফের প্রবেশ পথের দিকে তাকাচ্ছিলেন– দৃষ্টি ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন এদিক ওদিক। বোঝাই যাচ্ছিল কারো জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন তিনি।
অন্যদিকে আমার ঠিক সামনের টেবিলে বসেছেন এক বৃদ্ধ দম্পতি। আন্দাজ করি তাঁদের বয়স আশি-পঁচাশির কম হবে না। ভদ্রমহিলাকে অশক্ত বলেই মনে হল। কারণ সব কাজ ভদ্রলোক একা একাই করছিলেন। ভদ্রলোকটির পোশাক-আশাক দেখে মনে হচ্ছিল যে তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণের কোন রাজ্যের লোক। ভদ্রলোকের জামা, টুপি, প্যান্টের ছাঁট ও বুটজুতো সে সাক্ষ্যই বহন করছিল। তাকিয়ে দেখলাম ভদ্রলোকই টুকটুক করে সবকিছুই করছেন।
প্রথমে নিয়ে এলেন দুকা’প কফি। কিন্তু হাঁটছিলেন খুবই ধীরে। তারপর নিয়ে এলেন দু’ গ্লাস জল। লক্ষ্য করছিলাম, তাঁর হাত একটু একটু কাঁপে। শেষবার আনলেন দু’ পেয়ালা স্যুপ। তারপর দু’জনে ভালো করে বসে খেতে শুরু করলেন। খাওয়ার আগে ভদ্রলোক অতি যত্নের সঙ্গে ভদ্রমহিলার সব কিছু গুছিয়ে দিচ্ছিলেন। লক্ষ্য করলাম, স্যুপ খেতে গিয়ে মহিলার চিবুকে স্যুপের কয়েক ফোঁটা পড়ল। টেবিলের অন্যদিক থেকে ভদ্রলোকের কাঁপা কাঁপা হাত এগিয়ে এলো। পরম যত্নে নিজের রুমাল দিয়ে বড় মোলায়েম করে স্যুপের ফোঁটা ক’টি মুছে নিলেন ভদ্রলোক।
আমার মনটা কেমন যেন করে উঠল। জীবনে একেবারে শেষপ্রান্তে এসে এখনও একজনের জন্য অন্যজনের কি অপূর্ব ভালোবাসা। ভাবতে লাগলাম, এ দু’জনের একজন যখন চলে যাবেন, তখন অন্যজনের কি হবে? কেমন করে এবং কি নিয়ে বাঁচবেন অন্যজন? টের পাচ্ছিলাম, একটা অব্যক্ত বেদনার দলা আমার গলায় পাকিয়ে উঠছিল।
হঠাৎ করে দেখি, আমার ঠিক টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে টেবিলের কোনা ধরে আমার মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে একটি শিশু। কত বয়স হবে বাচ্চাটির– বড়জোর চার বা পাঁচ। আমি দেখেছি শিশুরা কেন জানি সব সময়েই আমাকে অবাক চোখে দেখে। একবার একটি শিশু তো এক বাসভর্তি লোকের মধ্যে জোরালো ঘোষণা দিয়েছিল যে সে বড় হয়ে আমাকে বিয়ে করবে। তার বিব্রত মা– বাবা তাকে থামাতে পারে নি তার পুন:পুন: উচ্চারিত ঘোষণা থেকে।
‘কি গো, কি নাম তোমার?’, ভাব জমাবার চেষ্টা করি আমি। টের পাই খাবারের লাইনে দাঁড়ানো শিশুটির মা পাশ ফিরে আমাদের দু’জনকে দেখছিলেন। মৃদু হাসি ফোটে তরুণী মা’টির মুখে। কালো কুচকুচে একমাথা কোঁকড়া চুলের দেবশিশুর মতো চেহারার ছেলেটি উত্তর দেয়, ‘জিম’। বলেই বোধহয় তার মনে হয়, আমি যেহেতু আমি তার নাম জিজ্ঞেস করেছি, আমার নামও জিজ্ঞেস করাও তো শোভনতা আর ভদ্রতার পর্যায়ে পড়ে।
তাই জিম অভ্রান্ত ভাবে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার কি নাম?’ আমার নাম শুনে জিম বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ে– যেন সবকিছু বুঝতে পেরেছে। ইতিমধ্যে তার মা এসে গেছে আমার টেবিলের কাছে। ‘আপনাকে খুব বিরক্ত করছে নিশ্চয়’, স্মিতমুখে জিমের মা বলে। ‘মোটেই না, আমরা দু’ভদ্রলোক ইতিমধ্যেই পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি’। জিমের মা উচ্চস্বরে হেসে উঠে ছেলেকে নিয়ে অন্য টেবিলে গিয়ে বসেন। আমি জিমের দিকে চেয়ে হাত নাড়ি। সেও প্রত্যুত্তর দেয়।
ঠিক সে সময়েই দেখি, বাঁ পাশের যে সুবেশ ভদ্রলোক এতক্ষণ যাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন, তিনি এসে গেছেন। ভারী সুন্দরী এক মহিলা– সুন্দর পোশাকে সুসজ্জিত, চোখে আধুনিক চশমা। আমাদের বয়সী হয়তো, কিন্তু বয়স তাঁর ওপরে জরার থাবা বসাতে পারেনি। দুষ্টুমি করে মনে হল, ভদ্রলোকের অপেক্ষা সার্থক– এঁর জন্য সারা জীবন অপেক্ষা করা যায়। ভদ্রমহিলা উৎসুক চোখে যখন কাউকে খুঁজছিলেন, ঠিক তখনই ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। দু’জনে যখন দু’জনার চোখে চোখ রাখলেন তখন আমি দূর থেকেও বুঝতে পারলাম যে সেখানে অনেক দিন পরে দেখা হওয়ার পরম আনন্দ আর একে অন্যকে কাছে পাওয়ার আকুতি ছাড়া আর কিছুই নেই।
ভদ্রমহিলা একটু ঘুরে এসে ভদ্রলোকের সামনে দাঁড়ালেন। তারপর অভ্রান্তভাবে একে অন্যকে কাছে টেনে নিলেন– ধরে রইলেন একজন অন্যজনকে। তারপর একসময়ে তাঁরা দুজন টেবিলে মুখোমুখি বসলেন। টেবিল পেরিয়ে চারটে হাত দু’টো হাত হয়ে গেল। দু’জন দু’জনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। হঠাৎ দেখি দু’জনের মুখে একটু খানি মৃদু হাসি– তারপর সে হাসি ছড়িয়ে পড়ল ওঁদের দু’জনের মুখে।
আমার মনে হল সে হাসি যেন বলছে, ‘এই তো বহুদিন পরে আবার আমরা দু’জন দু’জনকে কাছে পেলাম। আর তো কিছু চাইবার নেই’। যৌবনোত্তর মানুষদুটোর এই যে ভালবাসা তার তো কোন বয়স নেই। দেখে মনে হল, ঐ দু’জনের জন্য ‘বিশ্ব চরাচর লুপ্ত হয়ে গেছে, এক ঘোর প্রেম ওঁদের জীবন এবং ওঁদের দু’জনকে অন্ধের মত গ্রাস করেছে’। ভারী ভালো লাগল আমার।
আমার যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছিল। এবার উঠতে হবে। জিনিসপত্র গুছিয়ে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে সুটকেসটা টেনে নিয়ে ওই মানুষ দুটোর পাশ দিয়ে যখন বেরিয়ে যাচ্ছি, তখন মনে হল, প্রীতি ও ভালবাসার যে নিদর্শন আমি দেখেছি, তা’তে ওই দু’জনকে কিছু না বলে আমি বেরিয়ে যেতে পারি না। ওদের টেবিলের কাছাকাছি হতেই দেখলাম ওঁরা দু’জনেই পরস্পরের হাত ধরে মৃদু কণ্ঠে গল্প করছেন, একজনের চোখ অন্যজনের চোখের ওপর নিবদ্ধ, দু’জনের চোখে-মুখেই একটা আভা ছড়িয়ে পড়ছে।
আমি একটু দাঁড়ালাম। ওঁরা দু’জনেই আমার দিকে একটি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি ভদ্রমহিলা ও ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘ কিছু মনে করবেন না। আমি ঐ কোনার টেবিলটা থেকে আপনাদের দেখছিলাম। আপনাদের দু’জন এখনও একজন আরেকজনকে যে ভাবে ভালোবাসেন, তাতে আপনাদের প্রতি হৃদয় নমিত হয়ে আসে।’ ভদ্রমহিলা ভদ্রলোকের দিকে একপলক তাকালেন, তারপর মৃদু কিন্তু দাঢ়্য উচ্চারণে বললন, ‘ভালবাসার কি কোন বয়স আছে?’
আমি ভাবলাম এ কথার আসলে কোন জবাব নেই, সব কথার জবাবও হয় না। যে সত্যিকারের ভালবাসতে পারে, সেইই শুধু একথা বলত পারে– তা যে বয়সেই সে ভালবাসা আসুক না কেন। এ উপলব্ধির কথা ভেবেই আমি হাসলাম, তারপর পা বাড়ালাম সামনের দিকে।
সেলিম জাহান
ড: সেলিম জাহান একজন অর্থনীতিবিদ ও লেখক। কর্মজীবনে বছর দু’য়েক আগে জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের পরিচালক ও মূখ্য লেখক হিসেবে অবসর গ্রহন করেছেন।তার আগে তিনি জাতিসংঘের দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগের পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৯২ সালে জাতিসংঘে যেগদানের আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন দীর্ঘ ২৫ বছর। উপদেষ্টা ও পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্হাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে।
ড: জাহান লেখালেখি করছেন গত চার দশক ধরে। আশির দশকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এ সাময়িকীতে নিয়মিত লিখেছেন। রেডিও ও টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জননন্দিত উপস্হাপক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৯১-৯২ সালে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির মহাসচিব ছিলেন।ইংরেজী ও বাংলায় তাঁর প্রকাশিত গ্রণ্হের সংখ্যা এত ডজন এবং প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা দেড় শতাধিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্হ: বেলা-অবেলার কথা, স্বল্প কথার গল্প, পরানের অতল গহিণে, শার্সিতে স্বদেশের মুখ, অর্থনীতি-কড়চা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনীতি, Overcoming Human Poverty, Freedom for Choice, Development and Deprivation.