রথো রাফির একগুচ্ছ কবিতা

ভার

একশ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে
একটি নিষ্ফল গাছ
তুমি কি তার কষ্ট বোঝো!

অথচ এর পেছনে
আজো তার কোনো হাত নেই!

তাহলে বন্ধ্যা এ শব্দটি
কেমন করে
উচ্চারণ করো
ঠোঁটে মৃদু বাঁকা হাসি নিয়ে!

একশ বছর, একশ বছর
ব্যর্থতা নিয়ে
বসন্ত বাতাস
বুকে নিয়েছে এই গাছ!

দেখেছে সে প্রতিবেশী
গাছগুলো কত রঙিন হয়ে ওঠে!

 

প্রতিভা

যে দীর্ঘ দুর্ভোগের ভেতর হাবুডুবু খেয়ে তোমাকে সৃষ্টি করেছি ঈশ্বর
তুমি তার সমাধান জানো না

ঘন অন্ধকারে বসে জোনাকি ছড়িয়ে কী লাভ আমি জানি না
তবু ছড়িয়ে চলেছি অবিরত ব্যর্থ প্রবোধের এই বিজ্ঞাপন

অন্ধকারের পাথর পাঁজর আঙুলের টোকায় কখনো ফাটে না
ভাঙা রংধনুর মতো অদ্ভুত কোনো দৃশ্য বলো মানুষের কোন কাজে লাগে!

আয়নার সামনে এলে ওইপাড়ে অবিশ্বাসী আমি
তোমাকে দেখতে পাই

ওই অলৌকিক দেশ ছাড়া আর কোথাও দৃশ্যমান নয় এই নীল প্রতিভা!

মেরাজ

রাইনার মারিয়া রিলকে-কে

গোলাপের নীল কান্না ঘুমোতে দেয় না সারারাত, ওই ডাইনিকান্না সারাদিন ঘুরে বেড়ায় আমার পিছু পিছু, আপন ছায়ার চেয়েও অনেক বেশি শাসন করে সে আমাকে। এই মহাজাগতিক রোদের দেশে কখন-যে তার রক্তমাংস চিবুতে শুরু করি, কখন-যে রাক্ষস হয়ে উঠি আমি! হায় আত্মনিয়ন্ত্রণ, দেখো আমার ভেতর-আকাশে তার কান্নার প্রতিধ্বনিগুলো, বিষণ্ন স্বরলিপিগুলো, অনন্ত নক্ষত্রজন্ম লাভ করেছে! আর গোলাপের রক্তমাংস থেকে অবিচ্ছেদ্য চিরশীত উঠে এসে আমাকেই গ্রাস করছে, আমি টের পাই এক চিরসবুজ অসুখ!

আমার ভেতর তার সুদীর্ঘ কান্না! আর এই আমি তার শীতের চারদেয়ালে নিঃসঙ্গ সিংহের মতো দিনরাত আটকে থাকি। আর গর্জন করি আর গর্জন করি, যে-গর্জন নৈঃশব্দ্যশাসিত। হায় আমি এই পৃথিবীর এক অদ্ভুত সাধারণ গোলাপের কাছে উপহার পেয়েছি অনন্ত শীতের ঋতু!

আগুনের পাপড়িগুলো, ভুলে যাই, গোলাপ নয় গোলাপ নয় গোলাপ নয় কখনোই। আর আমি ঝাঁপিয়ে পড়ি আমারই বিরুদ্ধে, বারবার, ওই অনন্ত টকটকে লাল শীতের ভেতর, আমাকে উদ্ধার করব বলে, এসব দেখে এক আপেল বারবার হেসে ওঠে, এক সাপ হাহা হিহি হাসির তরঙ্গে অন্তহীন লুটোপুটি খায়, আমি বলি দেখো আমাকে উদ্ধার করবই করব, সেই চারদেয়ালের হাত থেকে, সেই স্মৃতির হাত থেকে, সেই বিস্মৃতির হাত থেকে। দেখি এক আদম আর এক হাওয়া হাসে, আর হাসতেই থাকে, কিছুই বোঝাতে পারি না আমি আর।

বরং বারবার নিঃসঙ্গতার চূড়ান্ত চাবুক খেয়ে এসে দাঁড়াই পরিবর্তনশীল এক ঈশ্বরের মুখোমুখি, যার মুহূর্তগুলি অন্তহীন-প্রলম্বিত। এক বেঠিক ব্রহ্মাণ্ড বানিয়ে যে ফের ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছে, এবং কোনো এক দ্বিতীয়সঠিকব্রহ্মাণ্ডের পরিবর্তনশীলপরিকল্পনানিয়ে ডুবে রয়েছে অন্তহীন বিষণ্ন ভাবনায়। আর কী অবাক কাণ্ড, তাকেই রোজ আমার আয়নার ভেতর বহুরূপে সময়ের অবলীন রেখায় দেখতে পেতাম। তাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করত না আর, মৃত্যুই ঈশ্বর কিনা, নাকি আমারই রক্তের ভেতর এক চিরশীতের প্রার্থনা রয়ে গেছে অমলিন!

হায় গোলাপের কান্না, উন্মাদ শীত, আর বরফের ঠাঠা আগুন, এর বাইরে কি কোথাও কোনো দ্বিতীয় পৃথিবী আজ আর নেই!

 

শাশ্বত শীত

প্রশ্নের এই চিরসবুজ প্রান্তরে সে প্রবেশ করেছিল একটি হাতুড়ি নিয়ে। অহর্নিশ পিটিয়ে পিটিয়ে প্রতিটি বাঁকা-প্রশ্নকে সোজা করেই ছাড়বে সে! যেন ওরা হয়ে ওঠে দ্বিধাহীন ও প্রশান্ত সবুজ একেকটা দাঁড়ি!

হাতুড়ির ঘা খেয়ে প্রশ্নচিহ্ন একবার সোজা হলে সেখানে বিস্ময় চিহ্ন ফের মাথা তোলে! এক মুহূর্ত পার না হতেই এর পায়ের নিচের বিন্দুটাকে মনে হতো অতীত থেকে মানে ওই প্রশ্ন-প্রান্তর থেকেই ছুটে আসা সেই অশ্রুফোঁটা। হাতুড়ির চরম ঘা দিয়ে একে মুহূর্তেই হত্যা করত সে! বলত, অশ্রুমাখা চোখে আয়নার সামনে গিয়ে কে কখন নিজের দেখা পায়!
কিন্তু একদিন সে দেখতে পেল, সবুজ দাঁড়িগুলো কুয়াশার জন্য কেমন ওত পেতে থাকে। রাত এলে স্বচ্ছ বাতাসকে ঘোলা করে তোলে। এবং বাতাসের বুক থেকে অদৃশ্য শিশিরগুলো কেমন কুড়িয়ে খায়। আর ধীরে ধীরে বাঁকতে থাকে! এক সময় ওরা ফের সবুজ প্রশ্নে রূপ নেয়! এত চেষ্টার পরও যেটুকু প্রশ্নমুক্ত এলাকা সে পেয়েছিল, তা আসলে প্রশ্ন্নসুপ্ত এক ছোট্ট আশ্রয়-আভাস মাত্র!

আর বাহাত্তর বছরের এক জীবনে বিয়াল্লিশ বছর কামারের মতো হাতুড়ি পেটানো শেষে সে নিজেই চাপা পড়ে গেল কোটি কোটি সবুজ প্রশ্নের নিচে! এর আগে তারও একবার মনে হয়েছিল, এ মাঠ হয়তোবা শীতের হাত থেকে বাঁচার সবুজ পশমি চাদর, প্রশ্ন আর বিস্ময় এই দুই যমজের সঙ্গম যেখানে জোগায় উষ্ণতা! আর অশ্রুফোঁটা থেকেই জন্মায় এসব প্রশ্ন ও বিস্ময়! আর অশ্রুফোঁটার ওপরই দণ্ডায়মান থাকে চিরকাল! লোকে শুধু ভাবে, সবুজ ঘাসের নিচে অন্তিম ঘুমের দেশে কবে চলে গেছে ওই বেচারি।

 

রথো রাফি

জন্ম ৩১ মার্চ, ১৯৭৫; দক্ষিণ তারুয়া, আশুগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। বিএসসি অনার্স, রসায়ন। পেশায় সাংবাদিক। প্রকাশিত কবিতার বই: অক্ষর ও বালির পৃথিবী।

ই-মেইল : [email protected]

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top