যার নাড়িতেই কবিতা থাকে, দেহের তন্তুতে বাক্ ও ছন্দের প্রতি আকর্ষণ। তার অন্য পথে যাবার উপায় নেই যে! তাকে শেষ পর্যন্ত কবিতাই লিখতে হয়। কিন্তু তারও তো সামান্য প্রস্তুতি থাকতে হয়? সে আবার কি? আমার গল্পটিই না হয় বলি, প্রসঙ্গে যাবার আগে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ছাত্রী আমি। সময়টা, সদ্য সমাপ্ত মহান মুক্তিযুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশে লাল-সবুজ পতাকা উড়ালের কাল। বাঙালি জাতীয় জীবনের চূড়ান্ত অর্জনের মাহেন্দ্রক্ষণ। আকাশ-বাতাস-রৌদ্রজল মথিত এক মহাকাব্য রচনার শুভ সূচনাকাল। মনো-বীণায় ঝংকৃত সমুজ্জ্বল আনন্দে মাতানো দেহহীন সময় এক। তরঙ্গসংকুল সেই সময়স্রোত পেরিয়ে নবীন প্রভাতের পথ বেয়ে আলোকোজ্জ্বল যে সূর্যদীপ্ত সময় এসেছিলো আমাদের প্রত্যেকের জীবনে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যুজ্জ্বল সেই ১৯৭২-৭৩ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলাম আমরা। বাংলা বিভাগের করিডোরে, সেমিনারে সারাক্ষণ চলতো সুরেলা খুশির হৈচৈ।
ড. নীলিমা ইব্রাহীম বিভাগীয় প্রধান তখন, আমাদের পড়াতেন মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রহসন একেই কি সভ্যতা এবং বুড়োশালিকের ঘাড়ে রোঁ। একই সঙ্গে তিনি বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করতেন অনায়াসে। ড. আহমদ শরীফ পড়াতেন বঙ্কিমচন্দ্র, ড. সনজিদা খাতুন রবীন্দ্রকাব্য। পাঠ্যতালিকা অনুযায়ী বাংলা কবিতার ছন্দ পড়াতেন ড. মনিরুজ্জামান স্যার। জানি না কেন, স্যার পনের মিনিট লেটে ক্লাসে উপস্থিত হতেন সব সময়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যারদেরও লেট হয়, মানতে পারতাম না। এতো আমার গড়পাড়া গ্রামের ফ্রি প্রাইমারী স্কুল না, যে, বড় স্যার ছোট স্যার প্রায় সকলেই হালচাষ করে গরুর মুখে ঘাস তুলে দিয়ে তবে স্কুলের ক্লাস নিতে আসবে?
এনারা হলেন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে খ্যাত ঐতিহ্যবাহী কত প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক, তাঁরা নিজেরাও এই প্রতিষ্ঠানের কৃতি ছাত্র ছিলেন একদা। এজন্যে মনের ভাবনাকে বাস্তবতার সঙ্গে মেলাতে পারতাম না।
সে যাই হোক, পরে স্যারের নিয়মই হৃষ্ট চিত্তে মেনে নিলাম। স্যার পনেরো মিনিট পরে আসবেন এটাই যেন স্বাভাবিক। কোনো কোনো দিন একটা কালো ব্রীফকেস হাতে হুড়মুড়িয়ে স্যার ক্লাসে প্রবেশ করতেন, সঙ্গে সঙ্গে মনটা প্রসন্ন হয়ে যেতো আমার। স্যারকে খুব ব্যস্ত-সমস্ত মনে হলেও সর্বদা ঠোঁটের কোণে এক ফালি হাসি যেন ঝুলেই থাকতো তাঁর। স্যারের ঐ সরল হাস্যময় কমনীয় মুখখানা দেখে হৃদয় মথিত হতো কবি ও কবিতার কথা ভেবে।
স্যার যে কবি ছাড়াও একজন গীতিকার “সে যে কেন এলো না, কিছু ভালো লাগে না, ছায়াছবির এরকম জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা, সেতথ্য জানতে একটু সময় লেগেছিলো বৈকি।
স্যারের নিজের লেখা ‘বাংলা কবিতার ছন্দ’ বইটি আমাদের প্রত্যেকের হাতে শোভা পেতো। স্যার তাঁর নিজের বই ধরেই মাঝে মধ্যেই বোর্ডে ছক অঙ্কন করে তিন প্রকার ছন্দের পার্থক্য বোঝাতেন। অক্ষর, মাত্রা, পর্ব, বদ্ধাক্ষর, মুক্তাক্ষর, স্তবক বিন্যাস নানা বিষয়ে অত্যন্ত আন্তরিক প্রচেষ্টায় জ্ঞান বিতরণ করতেন তিনি। আমিও খুব আগ্রহ সহকারে নোট নিতাম।
নিজে যেহেতু কবিতা লিখতাম, সেজন্যে আগ্রহটাও ছিলো প্রবল। ছন্দের ক্লাসটিতে সব সময় আগে চলে যেতাম, প্রথম নয়তো দ্বিতীয় বেঞ্চে বসে স্যারের লেকচার শুনতে চেষ্টা করতাম গভীর মনোনিবেশ যোগে। সাঁইত্রিশ বছরের অধ্যাপক জীবনে নিজেও শিক্ষার্থীদের ছন্দ অলংকার এবং সাহিত্যতত্ত্বের পাঠদান করেছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত লব্ধজ্ঞানের আলোকে, এ কথাই বলবো যে, প্রাথমিকভাবে ছন্দ বোঝার জন্যে স্যারের বইটি অসামান্য।
কবিতা লেখার জন্যে এরচেয়েও সহজ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর “কবিতার ক্লাস” বইটি। গল্পচ্ছলে ছন্দ শেখার সবচাইতে মোক্ষম পুস্তক এটি, নবীন লিখিয়েদের জন্যে। কবিতার ক্লাসের পরে শঙ্খ ঘোষের “ছন্দের বারান্দা” এর পাঠ বাধ্যতামূলক হতে পারে পরবর্তী ধাপ হিসেবে। ছন্দের এই আঁকর গ্রন্থটি আর এক ধাপ এগিয়ে মিল-অমিলের ঘটকালি শেষে ভাষা-ছন্দের বিবাহযজ্ঞে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে যায় কবিকে। পরিশেষের শ্বাসাঘাতের কাহারবা তাল-লয় ছুঁয়ে ছন্দের মৃদুমন্দ হাওয়ায় দুলিয়ে ধীরলয়ে লয়ে যায় অক্ষরবৃত্তের মহাসমুদ্রে।
শ্রবণেন্দ্রিয় খাড়া না হয়ে কি পারে তখন? অধিক জানার জন্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রবোধ চন্দ্র, মোহিতলাল মজুমদার এবং সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে আবদুল কাদিরের “ছন্দসমীক্ষণ” ও পড়তে পারেন যে কেউ।
তো, যা বলছিলাম, নিজের গল্প।
কবিতা লিখতে শুরু করেছিলাম ৭/৮ বছর বয়স থেকে। কি যেন ভাবতে ভাবতে একদিন একাকী আমাদের বেলতলায় বসে মাটিতে আঁক কেটে চার লাইনের একটি ছড়া লিখে ফেললাম। নিজেই চমকিত হয়ে দৌড়ে ঘরে গিয়ে তা হুবহু খাতায় লিখে মাকে পড়ে শুনিয়েছিলাম। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, চার চরণের ছড়াটি শুনে তিনি যেন খুশি হয়েছেন। এরপর ৪ পঙক্তি আর ৬ পঙক্তির অন্তমিলের ছড়া লিখে খাতা ভরে ফেলেছিলাম। তো, ১৯৭২ সালে দেবেন্দ্র কলেজের বার্ষিক ম্যাগাজিনে কবিতা প্রকাশের পরে ঢাকার পত্র-পত্রিকায় কবিতা ছাপানোর পথ-ঘাট যেন খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
এমনিতে বোকাসোকা ধরণের মেয়ে আমি। জনা দু’য়েক সহপাঠীর পাশে দাঁড়িয়ে সাবলীল কথা বলতে পারতাম, কিন্তু ২/৩ অতিক্রম করে ৪/৫ জন হলেই আমার মুখে কুলুপ এঁটে যেতো। লজ্জায় কথা বলতে পারতাম না। কিন্তু এজন্যে অন্যে সহপাঠীরা ভাবতো, আমি অহংকারী, কথা বলি না। এই অপবাদ মুছে গেছে অধ্যাপনায় এসে। শ্রেণীকক্ষে ৪৫ মিনিটের সোনাঝরা রোদ আমাকে কথা বলিয়ে ছেড়েছে।
মফস্বল শহর মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট করে ঢাবিতে স্থান করে নিয়েছি। কিছুদিন জয়কালি মন্দির রোডের মামার বাসায় কাটিয়ে জুতার সুকতলা ক্ষয় করে তবে হলে সীট পেয়েছি। তাও সোজাসুজি কোনো পথে নয়।
খালাতো বোন কবি জাহানারা আরজুর সুপারিশ, তিনিও ঢাবির বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্রী। তাঁর সহপাঠী-বন্ধু নিলুফার আপা তখন শামসুন্নাহার হলের হাউজ টিউটার ছিলেন। আরজু আপা টেলিফোনে তাকে বলে দিলেন এবং শামসুন্নাহার হলের আবেদনপত্রের সঙ্গে আরজু আপার ছোটবোন শবনু আপার ডাবলিং লেটার যুক্ত করে দিয়ে তবে সীট হয়েছিলো আমার। ৩৩৩ নম্বর কক্ষে তিন বেডে ছয়জনের রাত্রি যাপন। তবু সেকি আনন্দ! অপার স্বাধীনতার আনন্দ যেন। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরে হলে সীট পাবার অপরিসীম আনন্দে নেচে উঠেছিলাম সেদিন। নজরুলের কবিতার অনুসরণে বেশ ক’দিন টানা কবিতা লিখে খাতা ভরিয়ে ফেলেছিলাম।
তারপর জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পেয়ে বসলো আমাকে। এম. এ শেষবর্ষের পরীক্ষা দিয়ে বসে আছি, কবিতা পড়ছি, লিখছি দু’হাতে। কিন্তু কোথাও ছাপতে দিচ্ছি না।
এ রকম এক সময় ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল স্যার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জয়েন্ট করেছেন পুনরায়। আপাতত, থাকেন টিএসসিতে। লিলি, সাঈদা, আমি এই তিন প্রাণের বান্ধবী মিলে শামসুন্নাহার হল থেকে হেঁটে হেঁটে প্রায়ই টিএসসিতে ঘুরতে যেতাম। এভাবেই স্যারের সঙ্গে দেখা হলো প্রথম দিনেই। বাংলা বিভাগের ছাত্রী হিসেবে আমাদের পরিচয় পেয়ে অনেকক্ষণ গল্প করলেন। বাংলা বিভাগেও দেখা করতে বললেন আমাদের।
তখনো স্যারের পরিবার চট্টগ্রামে, ঢাকা বিশিববিদ্যালয়ের শিক্ষক কোয়ার্টারের বাসা বরাদ্দ পেয়ে তবে তাদের ঢাকায় নিয়ে আসবেন বলে জানালেন আমাদের। সে পর্যন্ত স্যার টিএসসির একটি কক্ষেই বাস করছেন একাকী। এরমধ্যে অনেক শিক্ষার্থীর সঙ্গেই তার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। সর্বজনবিদিত তাঁর পাণ্ডিত্য এবং বাচনিক দক্ষতা। সব শিক্ষার্থীকে তিনি আপনি করে সম্বোধন করতেন, এটি ছিলো শিক্ষার্থীদের প্রতি তাঁর সম্মানজ্ঞাপক বিশেষত্ব। ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে চটুল হাসিঠাট্টায়ও ছিলেন তিনিই সেরা।
স্যারের এই গল্পটি আমি কবি রফিক আজাদের মুখে শুনেছি।
১৯৬৭ ব্যাচে রফিক আজাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল স্যারও তখন ঢাবির শিক্ষক। বিকেল হলেই ঢাবির ছাত্র শিক্ষকের অনেকেই তখন নিউমার্কেটের বই পাড়ায় গিয়ে আড্ডা দিতো। কেনাকাটা করতে আসা পরমা সুন্দরীদের প্রতি চকিতে চোখ রাখতো কেউ কেউ। অপার কৌতূহলে, ভ্রুপল্লবে কেউবা চোখের দৃষ্টিতে আস্বাদন করতো তাদের।
এ-রকম এক বিকেলে হেনা স্যার এবং রফিক আজাদ তাঁর ২/৩জন বন্ধুকে নিয়ে হাঁটছেন পাশাপাশি। এই সময় স্যার কবিকে বলছেন, দেখুন, দেখুন রফিক। পাশে তাকান, দেখুন, কাকের মুখে এক্কেবারে পাক্কা আম।
স্যারের কথায় হতচকিত, লাজুক রফিক আজাদ তাকিয়ে দেখেন যে, স্বামী স্ত্রী পাশাপাশি হাঁটছেন। স্বামী বেচারা ঘষাকালো, তারপাশে বউটি চূড়ান্ত ফর্সা রঙের পরমা সুন্দরী এক উপমাবিহীন। হাসির ছটা ছড়িয়ে দিয়ে এরকম দ্যুতিময় চমৎকার উপমায় কথা বলা স্যারের পক্ষেই সম্ভব ছিলো শুধু।
আমরা যখন স্যারকে পেয়েছিলাম, তখন তিনি দ্বিতীয়বারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেছিলেন। অন্যান্যদের মুখে স্যারের এতো গল্প শুনেছি আমরা, যা প্রায় কল্পকাহিনীর মতো।
কাজেই তিন বন্ধু মিলে একদিন বিভাগে গিয়ে স্যারের সঙ্গে দেখা করলাম। পরিচিত হলাম। আমাদের ভবিষ্যৎ ভাবনা জানতে চাইলেন তিনি। গল্পচ্ছলে আমার কবিতা লেখার পরিচয় পেয়ে বললেন, কোন কাগজে ছাপা হয় আপনার কবিতা?
কোনো কাগজে দিইনি স্যার এখনো।
তখন প্রথমে তিনি বেলাল চৌধুরী সম্পাদিত সাপ্তাহিক “সচিত্র সন্ধানী” এবং রফিক আজাদ সম্পাদিত বাংলা একাডেমির “উত্তরাধিকার” পত্রিকায় কবিতা ছাপতে দিতে বললেন, এবং ঠিকানাও দিলেন।
কবি বেলাল চৌধুরীকে কবিতা দিয়ে আসার এক সপ্তাহের মধ্যে “সচিত্র সন্ধানী” পত্রিকায় আমার প্রথম কবিতা ছাপা হলো। এরপর বাংলা একাডেমি গিয়ে “উত্তরাধিকার” পাক্ষিকের জন্যে কবিতা দিলাম এবং কবি রফিক আজাদের সঙ্গে পরিচিত হলাম। “উত্তরাধিকার” এর পরের সংখ্যায় প্রকাশ পেলো আমার কবিতা। আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেলো।
এরপর দৈনিক বাংলার সাহিত্য পাতায় ছাপার জন্যে কবি আহসান হাবীব ভাইকে কবিতা দিয়ে এলাম। সেখানেও ছাপা হলো কবিতা।
আশির দশকের নামকরা সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা শাহাদৎ চৌধুরীর সম্পাদনায় দৈনিক বাংলা ভবন থেকে “সাপ্তাহিক বিচিত্রা” প্রকাশিত হচ্ছে সগৌরবে তখন। তারাও ছাপলো আমার কবিতা।
রফিক আজাদকে যখন দ্বিতীয় অথবা তৃতীয়বারে কবিতা দিতে গেছি, সেদিন অফিসের পরে তিনি আমাকে নিয়ে স্টেডিয়ামের দোতলায় “মেরিয়োটা” নামের একটি ঐতিহ্যবাহী বইয়ের দোকানে গেলেন। কলকাতার কবি সাহিত্যিকদের যৎসামান্য পুস্তক ওইখানেই শুধু কিনতে পাওয়া যেতো তখন।
কবিতার ক্লাস এবং ছন্দের বারান্দা নামক বইদুটো কিনে তিনি আমাকে উপহার দিলেন। মুখে বললেন, কবিতা লিখতে হলে ছন্দটাকে আরো ভালোভাবে জানতে হবে, বুঝলে।আমি তখন সাহসে ভর করে জানতে চাইলাম, গদ্য কবিতা লিখলে ক্ষতি কি? ক্ষতি নেই। তবে ছন্দটা জেনে যদি ছন্দ ভাঙ্গো, অথবা গদ্য কবিতাও লেখো, তা হলে তোমার কবিতায় তৈরি হবে আলাদা ছন্দস্পন্দ। তখন ছন্দ না থাকলেও সে কবিতা পড়তে ভালো লাগবে এবং পাঠকেরা তা পড়ে আনন্দ পাবে। অন্যথায় অতিরিক্ত আবেগের উদ্গীরণে তোমার কবিতা ভাবালুতায় পর্যবসিত হবে। সেখানে কবিতা খুঁজে পাওয়া যাবে না। এরপর দ্বিধায় জড়িত কণ্ঠে জানতে চাইলাম, একজন তরুণ কবি কখন তার কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করবে?
বই প্রকাশের কথা এখনই ভাববে না তুমি। এখন শুধু দুই হাতে লিখে যাবে। আধুনিক কবিদের কবিতার বই পড়বে। অগ্রজদের কবিতার বই পড়ে ধারণা নাও সেখান থেকে। এরপর বিভিন্ন কাগজে তোমার কবিতা ও নাম ছাপা হোক। পাঠকদের কাছে তোমার নামটি পৌঁছাক আগে। তোমার কবিতা সম্পর্কে পাঠকের মনেও একটি ইতিবাচক ধারনা তৈরি হতে দাও আগে। তারপর বই প্রকাশ করবে। তখন বই প্রকাশের জন্যে প্রকাশকের কাছে ধর্না দিতে হবে না। প্রকাশকই এগিয়ে আসবে তোমার বই ছাপতে, কবিতার পাঠকও পাবে বই কিনতে।
বই প্রকাশের জন্যে তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। অপ্রচলিত, দেশজ শব্দ, এমন কি মুখের ভাষা ব্যবহারের দিকে মনোযোগী হবে।
আর হ্যা, লেখা শেষ করেই ছাপতে দেবে না, কিছুদিন ফেলে রাখবে। তারপর কবিতাটির তাৎক্ষণিক আবেগ স্তিমিত হয়ে এলে পুনরায় কয়েকবার পাঠ করে সংশোধন করা যদি প্রয়োজন মনে হয়, করবে। তারপর কাগজে ছাপাবে।
বক্তব্য সরাসরি না বলে কবিতায় রহস্য সৃষ্টি করে তা বলবার চেষ্টা করবে, কেমন?
লেখায় যেন তোমার আলাদা একটি কণ্ঠস্বর খুঁজে পায় পাঠক। নিজের একটি আলাদা ভাষাভঙ্গী তৈরি করা খুব জরুরী। যাকে বলা হয় স্টাইল বা শৈলী। দীর্ঘমেয়াদে কবিতায় টিকে থাকার জন্যে সেটির প্রয়োজন খুব অপরিহার্য। কাজেই মনে রাখবে, কবিতাকে “ওহী” ভাবনায় শর্টকাট পথ নেই কোনো। কবিতা সাধনার সম্পদ, নিষ্ঠার উপাসনা।
এই জন্যে আর যা করতে হবে, তা হলো ভাব-ভাষা-ছন্দ-অলঙ্কারের সমবায়ে তার চর্চার মধ্যে দিয়ে নিজেকে পুনর্নিমাণ করা। পক্ষান্তরে কবিতাকেই সমৃদ্ধ করা।
তিরিশোত্তর কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত কিন্তু ঐশী প্রেরণায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন নিরবিচ্ছিন্ন চর্চার মধ্যে দিয়ে, সাধনায় সন্তরণ করে, তবেই একজন কবি হয়ে ওঠে। সা-রে-গা-মা শিখেই যেমন কারু স্টেজে উঠে গান গাওয়া শোভা পায় না, তেমনি দুই/চার প্যারা কবিতা লিখেই কাগজে ছাপানো উচিত নয়।
কবিতা লেখার জন্যে প্রয়োজনীয় পঠন-পাঠনও কবির জন্যে জরুরী খুব।
এই জন্যে ফরাসী প্রতীকীবাদী কবি মালার্মেকে তিনি তাঁর কাব্যচর্চার আদর্শ কবি হিসেবে হৃদয়ে ধারণ করেছেন। বলেছেন, “মালার্মের কাব্যার্দশই আমার অন্বিষ্ট”। কেননা, মালের্মেও প্রেরণাবাদে বিশ্বাস করতেন না, তিনিও ছিলেন সাধনাবাদী।
বর্তমান ও ভাবীকালের তরুণ কবি বা লেখকদের মাতৃভাষাকে স্ববশে আনার জন্যে, নিজের কবিত্বশক্তিকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে দিনে দিনে অনলসভাবে বিরতী বিহীন তাকে উদ্যমের ব্যথা সহ্য করেই ধীরে ধীরে কবিতার পথে হাঁটতে হবে।
কবিতার মতো সত্য, সুন্দর, মঙ্গলময় এই মানবতাবাদী শিল্পে দৌড়ঝাঁপ অথবা তাড়াহুড়োর কোনো সুযোগ নেই।
কবিতার কাছে যেতে হয় আত্মসমর্পণের আরতি নিয়ে। ভেতরে বাইরে নিরবচ্ছিন্ন জড়ের সঙ্গে চৈতন্যের সংগ্রাম, ভাবনার সঙ্গে ভাষার, ভাষার সঙ্গে ছন্দ, মিল, অলংকার ও ধ্বনি-মাধুর্যের এক সমন্বিত দ্বৈরথ কবির অন্তরে চলতেই থাকে।
পাশাপাশি নানামুখী অভিজ্ঞতায়, পঠন-পাঠনে নিরন্তর সাধনা চলতে থাকে আত্মোপব্ধির নতুন এক রহস্যময় সৌন্দর্য উন্মোচনে। তারপরও কবিতা ধরা দিবে কি দেবে না, কেউ বলতে পারে না। যদি এতো সহজ হতো তাহলে, এতো বিচিত্রমুখী রচনাসম্ভার সৃষ্টির পরেও রবীন্দ্রনাথকে ১৪০০ সাল কবিতা লিখতে হতো না।
২৬/৭/২০২০
আইসবোট টেরেস, টরন্টো
দিলারা হাফিজ
কবি দিলারা হাফিজ। ১৯৫৫ সালের ২০ নভেম্বর মানিকগন্জের গড়পাড়া গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। পিতা বখশী হাফিজ উদ্দিনআহমেদ, মা রহিমা হাফিজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বি. এ অনার্স ও এম এ করেছেন। ১৯৯৮ সালে ঢাবি থেকে পি এইচ ডি ডিগ্রিলাভ করেন। ৩৭ বছর শিক্ষকতা জীবনে সরকারি কুমুদিনী কলেজ, ইডেন কলেজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যায় ছাড়াও মিরপুরের সরকারি বাঙলাকলেজ ও তিতুমীর কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বশেষ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড, ঢাকার চেয়ারম্যানহিসেবে চাকুরি থেকে অবসরে যান।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ:
১।ভালোবাসার কবিতা, ২।পিতা কিংবা পুত্র অথবা প্রেমিক ৩। প্রেমের কবিতা ৪। কে নেবে দায় ৫। খুঁজে ফিরি ভিক্ষালব্ধ জ্ঞান ৬। অবিনশ্বর আয়না ৭। নির্বাচিত কবিতা
৮। নারী সংহিতা
গবেষণা গ্রন্থ:—-বাংলাদেশের কবিতায় ব্যক্তি ও সমাজ( ১৯৪৭–১৯৭১)
স্মৃতি গদ্য:—আনন্দ বেদনাযজ্ঞে রফিক আজাদ
স্মৃতি উপন্যাস:—-কে প্রথম কাছে এসেছি
শিশুতোষ:—সুষমার গল্প
অনুবাদ:—মার্কিন কবি ক্যারোলাইন রাইট ও ভারতীয় বহুভাষাবিদ পণ্ডিত শ্যাম সিং শশী নারী অধিকার সম্পর্কিত তাঁর অনেককবিতার অনুবাদ করেছেন।
সম্পাদনা : গদ্যের গহন অরণ্যে
১৯৮৩ সালে কবিতার জন্যে লা ফর্তিনা সম্মাননা ও ২০১২ সালে বাংলাদেশ ও নেপাল ফ্রেণ্ডশীপ সম্মাননা লাভ করেন। বিটিভির বহুল প্রচারিত ও জননন্দিত গণশিক্ষামূলক অনুষ্ঠান “ সবার জন্যে শিক্ষা” গ্রন্থনা ও উপস্থাপনার দায়িত্ব পালনকরেছেন ২২ বছর। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অন্যতম প্রধান কবি রফিক আজাদ( প্রয়াত) এর স্ত্রী। দুই পুত্র সন্তান অভিন্ন ও অব্যয় এর জননী।