সেলিম জাহানের স্মৃতিগদ্য: স্মৃতির আয়ু কত দীর্ঘ?

ছবি কৃতজ্ঞতা: মাহমুদুল হাসান চিশতী

কড়া নাড়ব না বৈদ্যুতিক ঘণ্টিটি বাজাবো তা ভাবতেই মিনিট খানেক কেটে গেল। অকারণে নয়, সময়টার কথা ভেবেই আমার এ দ্বিধা। শীতের পড়ন্ত বিকেল– ইতিমধ্যেই সূর্য এলায়ে পড়েছে পশ্চিম গগনে। চারদিক সুনসান, শব্দদের নীলডাউন করিয়ে রাখা হয়েছে চারপাশে– নিস্তব্ধতার গন্ধ এসে লাগছে নাকে। আমি ক্ষয়ে যাওয়া, বিবর্ণ হয়ে ওঠা লাল মেঝের বারান্দায় দাঁড়িয়ে।

অবশ্য এ পর্যন্ত আসতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কিছু চিহ্ন মেলাতে হয়েছে বেশ মন দিয়ে। যেমন, বড় রাস্তায় রিক্সা থেকে নেমেই প্রথমেই খুঁজে বার করতে হয়েছে যে পুরনো প্রায় ভেঙ্গে পড়া গোল বারান্দাওয়ালা ছাত্রদের মেসবাড়ীটি আছে কি না। ওটা পেয়ে স্বস্তি বোধ করেছি, যদিও বাড়ীটি প্রায় ধ্বসে ধ্বসে পড়ছে। তবু চেনা যায়।

একটু এগোতেই রফিকদের বাড়ীর সামনের মজা পুকুরটি– প্রায় ৫০ বছর আগেও এটা মজা পুকুরই ছিল। এখন ছোট হ’তে হ’তে এটা ডোবা হয়ে গেছে। ভেঙ্গে পড়া পাড়ে জলের ওপর কলমি লতা আর তার বেগুনী রংয়ের ফুল, হেলেঞ্চার ঝোপ, এখানে ওখানে ঢেঁকি শাকের সাপের মতো পেঁচানো শুঁড়। একটা ফড়িং কেবলই উড়ে উড়ে সেই শুঁড়ে বসছে আর সরে যাচ্ছে।

ছবিটির চিত্র কৃতজ্ঞতা সাদিয়া মাহজাবীন ইমাম

শেষ পর্যন্ত কড়াটিই নাড়লাম মৃদুভাবে শুধু এই কারণেই যে কড়ার শব্দ আমার আঙ্গুলের নিয়ন্ত্রণে, বৈদ্যুতিক ঘণ্টি তো নয়। কিছুক্ষণ বাদে ভেতরে সন্তর্পণে ছিটকিনি খোলার শব্দ পেলাম। খুলে গেল দরজার পাল্লা এবং  আমার সামনে দেখতে পেলাম এক ভারী মিষ্টি চেহারার কিশোরীকে। সাপের মতো তার চুলের দু’বেণী দুলছে মাথার দু’পাশে, মুখে একটা ঔৎসুক্য। ‘এটা কি রফিকদের বাড়ী?’  নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করলাম আমি। তার চমকানোটা আমি টের পাই এবং বুঝতে পারি কিন্তু কি করব আমি? ও ছাড়া যে এ বাড়ীর অন্য কোন পরিচয় আমার জানা নেই। ‘দাঁড়ান-একটু’, বলেই সে ভেতরে চলে যায়।

একটু পরেই ভেতরের ঘরের পর্দা ঠেলে এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। আমার দিকে এগুতে এগুতে বললেন, ‘কাকে চাইছেন’? আমি দ্রুত এদিক-ওদিক তাকাই, কথা খুঁজতে চেষ্টা করি, ‘মানে  আমি …’ ততক্ষণে ভদ্রলোক আমার কাছে চলে এসেছেন। তারপরেই তার উচ্ছ্বসিত বিস্ময়, ‘সেলিম ভাই না’? আমি তখনো একটু বিভ্রান্ত দেখে তিনি হেসে বললেন, ‘চিনতে পারলেন না তো? আমি শফিক।’ এতক্ষণে চেনা গেল তাঁকে – রফিকের সবচেয়ে ছোট ভাই।

‘আসুন, ভেতরে আসুন’, আমার হাত ধরে শফিকের সাদর আহবান। ভেতরে ঢুকি। শীত- বিকেলের রোদ পড়ে এসেছে। ঘরের ভেতরে ধূসর ছায়ার মিহি পর্দা। শফিক বাতি জ্বালে ঘরের। বিবর্ণ আলোয় কক্ষের জরাজীর্ণ অবস্থাই যেন ফুটে ওঠে। ‘বসুন, আমি সবাইকে ডাকি’, বলতে বলতে ভেতরের দরজার পর্দা ঠেলে শফিক কক্ষান্তরে চলে যায়।

আমি বসি না, চারদিকে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাই। এ ঘর, এর আসবাব পত্র আমার চেনা। পড়ন্ত কৈশোরে বহুবার এসেছি এ ঘরে। কাটিয়েছি দীর্ঘ সময়– আড্ডায়, গল্পে, ক্যারাম খেলায়। তখন অবশ্য এ ঘরের জৌলুশ ছিল, যৌবন ছিল বলা যায়। চোখ চলে যায় বাঁদিকের দেয়ালে– ধূলি-ধূসরিত কাত হয়ে ঝুলছে প্রায় বিবর্ণ হয়ে যাওয়া কালো ফ্রেমবদ্ধ একটি ছবি।

পায়ে পায়ে এগিয়ে যাই – বুঝতে পারি ওটা রফিকেরই ছবি। হাস্যজ্জ্বোল এক কিশোরের মুখ। কতদিন হল রফিক চলে গেছে? তা’ প্রায় ৫০ বছর তো হবেই। ‘আপনি কি বড় চাচার বন্ধু?’, প্রশ্ন শুনে চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখি, ভেতরের দরজার পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে আছে সেই কিশোরীটি যে আমার দরজা খুলে দিয়েছিল।

‘হ্যাঁ’, সহাস্যে বলি আমি, ‘একই ক্লাসে পড়তাম আমরা স্কুলে। এসো, এখানে এসে বসো’, নিজে বসতে বসতে তাকে বলি। কাছে এসে দাঁড়াতে তাকে হাত ধরে পাশে বসাই। টের পাই ছাড়ছে না সে আমার হাত এবং সরাচ্ছে না তার চোখ আমার মুখের ওপর থেকে। বুঝতে পারি আমার মাঝে সে তার চলে যাওয়া পিতৃব্যকে খুঁজছে। ‘বড় চাচাকে আমি দেখিনি’, খুব মৃদুস্বরে নরম গলায় বলে সে।

পর্দার দিকে তাকিয়ে দেখি বেশ ক’টি বালক-বালিকা পর্দার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে প্রচণ্ড কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে। নতুন আসা এক অতিথির প্রতি তাদের ঔৎসুক্যের শেষ নেই।  বুঝতে পারি আমার পরিচয় পৌঁছে গেছে অন্দরে। ঠিক তখনই শফিক ঘরে ঢোকে একজন ভদ্রলোক, ক’জন মহিলা ও কিশোর-কিশোরী নিয়ে। বুঝতে পারি, পুরো পরিবার এসে গেছে।

‘বাহ, তিতিরের সঙ্গে গল্প শুরু হয়ে গেছে দেখছি– আমার বড় মেয়ে’, হাসিমুখে শফিক বলে। ‘শুরু করেছি মাত্র’, বলি আমি।তারপর সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার পালা। রফিকের মেজভাই তারিককে সহজেই চিনতে পারি– আমাদের দু’ক্লাস নীচে পড়ত সে। ‘বলুন তো আমি কে?, দুষ্টু হাসির ঝিলিক তুলে জিজ্ঞেস করেন এক মহিলা। আমি হেসে ফেলি, বলি, ‘লিলি। তোমার ঐ বিখ্যাত গালের টোলের জন্য তুমি লুকোতে পারবে না কোথাও কখনও’।  লিলি রফিকের ছোট বোন। আমার কথায় লালের ছোপ লাগে লিলির গালে।

পরিচিত হই পরিবারের বধূদের ও অন্যান্য পরবর্তী প্রজন্মের সদস্যদের সঙ্গে। তারপর গল্প জমে ওঠে। জলখাবার আসে, আসে ধূমায়িত চায়ের পেয়ালা। ওঠে হাস্যরোল। সব গল্পই রফিকে ঘিরে। টের পাই স্মৃতি থেকে উঠে এসে রফিক জীবন্ত হয়ে উঠছে ওর ভাই বোনদের কাছে, পরিবারের বধূদের কাছে, তাদের ছেলে মেয়েদের কাছে। স্মৃতির সঠিকতা নিয়ে ওর ভাইবোনেরা বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করে, কথা কাটাকাটি হয়, আমাকে সাক্ষী মানে। অন্যরা গল্প শোনে উদগ্রীব হয়ে, উপভোগ করে সাক্ষী মানার ব্যাপারটি, হেসে ওঠে পরিণত বয়সের ক’জন মানুষের শিশুদের মতো কলহে।

বুঝতে পারি আমার মাঝখান দিয়ে ওরা পৌঁছে গেছে কিশোর বয়সে চলে যাওয়া ওদের অগ্রজের কাছে। টের পাই লিলি কিংবা তারিক কথা বলতে বলতে স্পর্শ করছে আমাকে – যেন আমার মাঝ দিয়েই ওরা ছুঁচ্ছে রফিককে। কত গল্প, কত স্মৃতি– তার কিছু আমি জানি, কিছু জানি না। তারপর ধীরে ধীরে গল্প থিতিয়ে আসে, আস্তে আস্তে নিস্তব্ধতা কালো বেড়ালের মতো ঘরের মাঝে তার থাবা ছড়িয়ে দেয়।

একসময়ে লিলি কথা কয়ে ওঠে। ‘কত বছর পর ভাইয়ার কথা উঠল। কতদিন পরে ভাইয়ার কথা বললাম সবাই মিলে। আপনিই তো ভাইয়াকে আবার আমাদের কাছে এনে দিলেন’। জলের ধারা নামে তার চোখে। ‘সেলিম ভাই, নিত্যদিনের জীবনে ভাইয়া আমাদের কাছে এখন শুধু একটা ছবি। প্রায়ই মনে থাকে না, আমাদের একটা বড় ভাই ছিল। আপনিই তো আমাদের সেই ক’বে চলে যাওয়া ভাইয়া’, ভাঙ্গা গলায় বলে শফিক। চেয়ে দেখি চোখ কারো শুকনো নেই– না যারা রফিককে দেখেছে, না যারা তাকে দেখেনি।

তারপর কেমন করে জানি আমাদের সবার চোখ অভ্রান্তভাবে চলে যায় দেয়ালের বিবর্ণ হয়ে যাওয়া প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে তোলা রফিকের ছবিটির দিকে। সময়ের রেখা ধরে আমাদের সবার বয়স বেড়েছে, কিন্তু রফিক তো রয়ে গেছে তিতিরের বয়সে। মনে হয়, সেই  চির কিশোর মুখের রফিক যেন বলছে, ‘কি হে, কেমন আছো সবাই? সবকিছু ঠিকঠাক? এতো দিনে মনে পড়লো আমাকে’?

কেমন যেন একটা ঠান্ডা নিশ্চুপতা নেমে আসে আমাদেরকে ঘিরে ঐ ধূসর সন্ধ্যায়। তার মাঝেও অনুভব করি আমাদের প্রত্যেকের মনের মধ্যে নানান স্মৃতি, নানান না বলা কথা উঠে আসছে নানান ভাবে। ‘বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু বড় জোর এক বছর’। হতে পারে। কিন্তু স্মৃতির আয়ুর কি কোন সময় আছে, না হতে পারে?

 

সেলিম জাহান

ড: সেলিম জাহান একজন অর্থনীতিবিদ ও লেখক। কর্মজীবনে বছর দু’য়েক আগে জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের পরিচালক ও মূখ্য লেখক হিসেবে অবসর গ্রহন করেছেন।তার আগে তিনি জাতিসংঘের দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগের পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৯২ সালে জাতিসংঘে যেগদানের আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন দীর্ঘ ২৫ বছর। উপদেষ্টা ও পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্হাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে।

ড: জাহান লেখালেখি করছেন গত চার দশক ধরে। আশির দশকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এ সাময়িকীতে নিয়মিত লিখেছেন। রেডিও ও টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জননন্দিত উপস্হাপক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৯১-৯২ সালে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির মহাসচিব ছিলেন।ইংরেজী ও বাংলায় তাঁর প্রকাশিত গ্রণ্হের সংখ্যা এত ডজন এবং প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা দেড় শতাধিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্হ: বেলা-অবেলার কথা, স্বল্প কথার গল্প, পরানের অতল গহিণে, শার্সিতে স্বদেশের মুখ, অর্থনীতি-কড়চা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনীতি, Overcoming Human Poverty, Freedom for Choice, Development and Deprivation.

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top