ছোটফুপুর শুভবিবাহ
আমরা আমাদের দাদীকে ডাকতাম দিদি। আমার দিদির কথা ‘মায়াপারাবারে’ বহুবার বহুভাবে আমি বলেছি। সে ছিল আমাদের জন্য অতি আহ্লাদের জায়গা। অত্যন্ত সহজসরল আর ভালোমানুষ ছিল আমার দিদি।শাশুড়ি হিসেবে আম্মা-চাচিমাদের দিদি দিয়েছিল অবারিত স্বাধীনতা।গভীর স্নেহমমতা ও উদারতায় দিদি ছিল খানিকটা বাউল কিসিমের মানুষ। আর আমার দাদা ছিল ঠিক ততোটাই উলটা। ভীষণ রকম রক্ষণশীল ও ডিক্টেটর টাইপের লোক। হয়তো সে সময় সব পরিবারের কর্তাব্যক্তিরাই দাদার মতো মাতুব্বর টাইপ ছিল।তবে দাদাও ছিল স্নেহ-মমতায় পরিপূর্ণ হৃদয়ের অধিকারী। আর দাদার ছিল প্রচণ্ড সহ্যশক্তি।হয়তো বা সারাজীবনের মাতুব্বরি করার খেসারত নিদানের পূর্বে সে দিয়ে গিয়েছিল।
আব্বা-চাচাজানের নয়নের মনি ছিল দিদি। সুযোগ পেলেই আব্বা দিদিকে আমাদের বাসায় এনে রাখতো। ফলে দিদির সান্নিধ্য চিরকালই আমাদের জন্য কাঙ্ক্ষিত ছিল। শুধু দিদি নয়, আমার অতি আবেগী আব্বা আত্মীয়-স্বজন যাকে পেত, তাকেই ধরেবেধে সাথে করে নিয়ে আসতো। সংসারে এতে যে খরচের বাহুল্য ছিল বা আমাদের পড়াশুনারও ব্যাঘাত ঘটতো, আব্বার সেসব মাথাতেই থাকতো না। আব্বার এই আবেগের বাহুল্যের জন্য আমাদের জীবনে আমরা অনেকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।
দিদির শহরবাসের সময় গ্রামের সাথে যোগাযোগ হতো চিঠিতে। দাদা সরাসরি দিদিকে চিঠি না-লিখলেও আব্বাকে নিয়মিত চিঠি লিখত। আব্বা অফিস থেকে একদিন দাদার চিঠি নিয়ে ফিরলো। কড়া হলুদ রঙের লেফাফা। সেই লেফাফা থেকে ঝাঁপ দিয়ে বেরিয়ে এল সুসংবাদ। আমার দুই ফুপুর একজন তখনো কুমারী ছিল। সেই ছোটফুপুর কাবিন সম্পন্ন হয়েছে কুমিল্লার এক পাত্রের সঙ্গে। পাত্র গ্র্যাজুয়েট। সোনালী ব্যংকে কর্মরত। সব চাইতে বড় কথা পাত্রের খানদান উঁচু। আমার দাদার আবার উঁচা খানদানের দিকে সাংঘাতিক খেয়াল ছিল। এই ঘাড়-ত্যাড়া মানুষটি যেখানেই আত্মীয়তা করেছে এই খানদানের বিষয়টি সর্বাগ্রে বিবেচনা করেছে। কুমিল্লার নাম করা ‘মুন্সেফ বাড়ির’ পাত্র, এতেই দাদা এককথায় রাজী! আব্বা খুব সুন্দর উচ্চারণে চিঠি পড়ে আমার আনপড় দিদিকে শোনাচ্ছে। দিদি শুধু কোনওমতে নিজের নামটা সিগনেচার করতে পারে। কিন্তু পড়ার দিকে তার খুব ঝোঁক। শিক্ষিত মানুষের প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধা ও মমতা। দিদি যখন আমাদের কাছ থেকে দূরে থেকেছে বহুজনকে ধরেবেধে চিঠি লিখিয়ে আমাদের ঠিকানায় পাঠিয়েছে। দিদির জবানীতে কতজনের হাতের লেখাই না হলুদ লেফাফায় পুরে আমাদের কাছে পৌঁছেছে! (আজ ভেবে অনুতাপ জাগে কেন সেইসব মহামূল্যবান চিঠি আমি সংরক্ষণ করিনি? চিঠি মানে তো একটা মানুষকে স্পষ্ট বুঝতে পারা এবং তার অন্তর্গত কথামালার দলিল)।
আব্বা চিঠি পড়ে শোনাচ্ছে আর দিদি কাঁদতে কাঁদতে আকুল হয়ে যাচ্ছে। আমি দেখছি তার শরীর মৃদু মৃদু কাঁপছে। চশমার কাঁচ খুব দ্রুত ঘোলা হয়ে উঠছে! দিদি সেই কাঁচ মোছার কোনো চেষ্টা করছে না। চোখের জল আড়াল করার কোনো ইচ্ছাই তার মাঝে নেই। কম্পিত দেহে আকুল হয়ে সে কেঁদেই যাচ্ছে। আব্বার চারপাশে বসে আমরাও শুনছি দাদার চিঠির বক্তব্য। দাদা ছোটফুপুর কাবিন সেরে বিয়ের তারিখ-দিনক্ষণও জানিয়ে দিয়েছে। তার মানে বিয়ে উপলক্ষে এইবার আমাদের ফিরে যেতে হবে গ্রামে। এবং দিদিকেও। দিদির সেই অঝোর কান্নার কারণ আজ আমি খুঁজে পাই। তখন বালিকা ছিলাম বলে তেমন কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। দিদি আকুল হয়ে কাঁদছিল– তার অনুপস্থিতিতে ছোট কন্যাটির কাবিন সম্পন্ন হয়ে যাওয়াতে। সে পাত্র সম্পর্কে কিছুই জানলো না শুনলো না, কিন্তু সবই ফাইনাল হয়ে গেল কী করে? বা নিজের মেয়ের বিয়ে নামক এত সিরিয়াস বিষয় ঘটে গেল দিদির অবর্তমানে? এইসব কিন্তু দিদি মুখ ফুটে কোনোদিনই কাউকে বলে নাই। আমিও যে লিখছি তাও আমার অনুমান-নির্ভর মাত্র। আমাদের পরিবারের রেওয়াজ ছিল, কোনোকিছু অপছন্দ হলেও কেউ মুখ ফুটে কিছু বলতো না। একেবারে টুঁ শব্দও কেউ উচ্চারণ করতো না। সবাই নতমুখে বড়দের চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত মেনে নিত। বয়সে যারা বড় তাদের মান্যিগন্যি করে চলা ছাড়া ভিন্ন মত বা পথের কেউ ছিলনা।
ছোটফুপুর বিয়ের তারিখ যত ঘনিয়ে আসতে লাগল আব্বাও তত যেন বেদনার্ত হয়ে উঠতে লাগল। আমরা ছোটরাও বুঝতে পারলাম, আব্বার পকেটের গতিক বেশি সুবিধার নয়। কিন্তু আব্বার পকেটের অবস্থা যাই-ই হোক না কেন বিয়ে তো আর আটকে থাকবে না! ফলে আম্মাকে নিয়ে আমরা করটিয়ায় চলে গেলাম। এসেই শুনি ছোটফুপুর বিয়েতে দেয়া জিনিসপত্র নিয়ে নানান চমকপ্রদ কিসসা-কাহিনীর জন্ম হয়েছে। কাবিনের সময় ছোটফুপুকে অত্যন্ত মূল্যবান শাড়ি-ব্লাউজ-স্যান্ডেল ইত্যাদি দেয়া হয়েছিল। সংগে কসমেটিক সামগ্রী। আর সেসব দেখতে আশপাশের গেরস্থবাড়ি থেকে বউঝিরা ভীড় জমিয়েছে। তাদের বিশেষ আগ্রহের বস্তু ছোটফুপুকে দেয়া স্যান্ডেল জোড়া। স্যাণ্ডেলের সোনালি রঙ, কারুকাজ ও কোলাপুরী ডিজাইনের জন্য গ্রামে চাউর হয়েছে– ‘সওদাগড়বাড়ির ছোডু মাইয়ার সোনার নৌকাজুতা দিয়া বিয়া হইছে’
আম্মা-চাচিমারা এসব কিসসা-কাহিনি বলছে আর খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে। এদিকে ছোটফুপু লজ্জিত মুখে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। ছোটফুপুর লজ্জিত মুখে একদিন আরও কিছু রঙ এসে লাগল। আম্মা একটা ট্রেতে করে দুধ-ধান-দূর্বা এনে ছোটফুপুর কান থেকে দুল আর মুক্তার নাকফুলটি খুলে দুধে ভিজিয়ে দিল। আম্মা বলল– বিয়ার ছিরি উঠাইতেছি!
আমরা এই ‘ছিরি’ শব্দটা জীবনের প্রথম শুনলাম। ভাবেসাবে যা বুঝলাম, বিয়ের দিন না আসা পর্যন্ত ছোটফুপুকে কোনো অলংকার আর পরতে দেয়া হবে না। তাকে একেবারে নিরাভরণ রাখা হবে।
‘ছিরি’ ওঠার দিন থেকেই বিয়ের আমোদ-উল্লাস শুরু হয়ে গেল। লাল-নীল-হলুদ-কমলা-সবুজ রঙের স্তুপ কে স্তুপ কাগজ কেটে কেটে নিশান আর ঝালর বানানো চলল। সুদূরের আত্মীয়স্বজনেরা বাড়িতে এসে গেল। এল আমার নানা আর প্রায় আমার সমবয়সী দুইখালা। বড়চাচিমার বাপের বাড়ি কাছে বিধায় তাদের হরহামেশাই আসা-যাওয়া চলতে লাগল। ঢেঁকির ধাপ্পুরধুপ্পুর শব্দে চলল আতপচাউল থেকে আটা কুটা। এই আটা দিয়ে বানানো হবে মুখশলা, পাটিসাপটা আর আন্দেশা পিঠা। ওইসব পিঠা নতুন জামাইয়ের সম্মুখে সাজিয়ে দেয়া হবে। দিদি রাজ্যির কাপড়চোপড় ক্ষারে (গরমজল আর সোডাতে কাপড় সেদ্ধ করা) দিয়ে কাজের বেটিদের দিয়ে ধোয়াতে লাগল। চারপাশে উৎসব একেবারে ঝেঁপে নামলো। দিদির ভাইয়ের ছেলেরা এল টাঙ্গাইল থেকে। আরও এল প্রচণ্ড রূপবতী দুই-তিনজন যুবতী–যারা নাকি আমার সম্পর্কে ফুপাতো বোন হয়। তারা এল ছোটফুপুকে সাজিয়ে-গুছিয়ে দিতে আর নতুন বরের স্পেশাল খাবার তৈরি করতে।
বিয়ের গেট সাজানোর জন্য বড়ফুপুর আর্টিস্ট দেবরকে তোয়াজতমিজ করে আনা হলো।
উনি সম্পর্কে আমাদের মামা হোন। আমরা ডাকি জহুরুলমামা। তা বিয়েরদিন আর্টিস্ট জহুরুলমামা তিনখানা গেট বানালো। বাইরবাড়ির শেষে মাথায় খাল লাগোয়া যেটা, সেটা বানালো বাঁশ আর কাগজ দিয়ে। কাগজের উপর রঙিন করে তুলি দিয়ে লেখা হলো ‘শাদী মোবারক’।
পরের গেটটা বানালো দেবদারুর পাতা আর মাটির সরা উলটে দিয়ে। গুচ্ছের দেবদারুর লম্বাটে পাতার ফাঁকফোকরে সরার উপর লেখা হলো ‘শুভবিবাহ’। পরের গেট অতি সাধারণ। বানানো হলো দুইদিকে দুই কলাগাছ পুঁতে। সেই কলাগাছে সরু রশি বেঁধে তাতে কাগজের রঙিন নিশান ঝুলিয়ে দেয়া হলো। ‘বাংলাঘরে’ বরের জন্য ধপধপে শাদা চাদর বিছিয়ে পাতা হলো ফরাস।
উঠানের কাঁঠাল গাছে বেঁধে রাখা চার-পাঁচটা খাসী করুণ গলায় ম্যাঁ ম্যাঁ রবে ডাকতে লাগল। আর দিদির খোয়ারের পালা মোরগ-মুরগীর ক্কক ক্ক্ক শোনা যেতে লাগল।
যথারীতি বরযাত্রী এল। তারা এল বাস আর টয়োটা গাড়ি নিয়ে। বরের মাথায় পাগড়ী আর মুখে রূমাল। পরনে শেরওয়ানী। নাকের উপর ধরে রাখা রুমালের বাইরে কালো কুচকুচে দাঁড়ি ।বরের দাঁড়ি দেখে অন্দর মহলে রব উঠলো–
জামাইয়ের বয়স কী বেশি নাকি গো? দাঁড়িগুলান কী পাকনা না কাঞ্চা?
ধীরে ধীরে বিয়ের সব আচার সমাপ্ত হয়ে যাচ্ছে, অথচ আব্বা তখনো আসে নাই। আব্বার নাকি হাতবাত খালি। বোনকে মন ভরে উপহার দিতে পারবে না বলে সে বিয়েতেই আসবে না। আমার অত্যন্ত আবেগ প্রবণ আব্বার জন্য বাড়ির সকলেই পাগল। তাকে সবাই সেরকমই ভালোও বাসে। আমরা বুঝতে পারছি, ছোটফুপুর মন মেঘের মতো ভার হয়ে আছে। তার আদরের মেঝোভাইকে ছাড়াই শশুরবাড়ি চলে যাচ্ছে। কিন্তু ছোটফুপু একবারও বলে নাই
মেঝোভাই আসল না ক্যান?
এরকম কিছু বলার রেওয়াজ আমাদের বাড়িতে নাই।
এইবার বরবউ বিদায়ের পালা। শা-নজরের পরে মুরুব্বিদের জোড়ে সালাম চলছে তখন। আব্বা হাতে একটা লেদারের ব্যাগ ঝুলিয়ে ঢুকল বিয়ের আসরে। একেবারে বাংলা সিনেমার শেষ দৃশ্য যেন! ছোটফুপুর বুকে জমানো মেঘের চাঙারি মুহুর্তেই খান খান হয়ে ভেঙে পড়লো। আব্বাকে জড়িয়ে ধরেই বিকট কান্নায় ভেঙে পড়লো সে। আব্বাও কাঁদছে অঝোরে। ভাইবোনের জড়াজড়ি কান্নার দৃশ্য দেখে বরযাত্রীরাও লুকিয়ে চোখ মুছে চলেছে।প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে আব্বা যে কয়টা নোট পেল, সমস্তই যত্ন করে বোনের হাতে তুলে দিল…! (চলবে)
পাপড়ি রহমান
নব্বই দশকের অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য একজন কথাশিল্পী। এ পর্যন্ত গ্রন্থ সংখ্যা প্রায় পঁচিশটি। কথাসাহিত্যে কাজের পাশাপাশি তাঁর রয়েছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সম্পাদনাও। বাংলা একাডেমী থেকে গবেষণা গ্রন্থ ‘ ভাষা শহিদ আবুল বরকত’ প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে। তাঁর ভিন্নধারার উপন্যাসগুলি প্রকাশ মাত্রই বোদ্ধা পাঠকের নজর কাড়তে সক্ষম হয়। তন্মধ্যে জামদানি তাঁতিদের নিয়ে উপন্যাস ‘বয়ন’ (২০০৮) প্রকাশিত হয় মাওলা ব্রাদার্স থেকে। পালাকারদের জীবন ভিত্তিক উপন্যাস ‘পালাটিয়া’ প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। আট বছর বিরতির পর বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত হয় ‘নদীধারা আবাসিক এলাকা’ (২০১৯)
২০২০ সালে উপন্যাস ‘পালাটিয়া’ রি-প্রিন্ট হয় কলকাতার বনেদী প্রকাশনা সংস্থা ‘অভিযান’ থেকে।
তিনি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সম্মাননা পেয়েছেন ২০১০ সালে। কলকাতার ‘ঐহিক মৈত্রী সম্মাননা’ পেয়েছেন ২০১৭ সালে। ২০২০ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমী পরিচালিত ‘সাদ’ত আলী আখন্দ সাহিত্য পুরস্কার’।
এই শৈশব আমার নেই। শুরু থেকে বর্তমান… রুক্ষ এক জীবনযাপন করে যখন এমন জলের গান শুনি মন টলমল করে।