কামরজ্জামান জাহাঙ্গীর
দেবেশ রায়ের মতো নিরন্তর জীবনজিজ্ঞাসার স্বজন আমাদের কথাসাহিত্যে তেমন একটা আছে বলে মনে করা মুশকিল— তার কাজই যেন ক্রমশ নিজেকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী করে তোলা। তাঁর সৃজনকৃত তেমনই এক উপন্যাস ব্যক্তিগত ফ্যাসিবিরোধী যুদ্ধ নিয়ে একটা উপন্যাস। এটি অবভাস থেকে ২০০৬-এর বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। দেশে-বিদেশ এর পর এটিই বোধ করি তাঁর অত হাড় জিরজিরে উপন্যাস। গ্রন্থটির পৃষ্ঠাসমূহে ডানে-বায়ে প্রচুর জায়গা-জমিন রাখার পর এর পৃষ্ঠাসংখ্যা ৭৯। একে কেন উপন্যাস বলতে হবে তা অবশ্য আমার বিচার-বিবেচনায় আসছে না— কারণ, উপন্যাসের তুমুল সৃষ্টিশীলতা এতে আছে বলে ধারণা করা যায় কি?
গ্রন্থটি থেকে ফ্যাসিবিরোধী প্রবণতা বুঝতে হলে অতি ঠাণ্ডামগজে এতে লিপ্ততায় নিমজ্জিত না-হয়ে উপায় নেই। এটি দেয়া-নেহার নামের মা-মেয়ের গল্প হতে পারে, যৌনচিকিৎসাবিজ্ঞানের গল্প হতে পারে, পুরুষপেষিত সমাজের যৌনআধিপত্যের গল্পও হতে পারে। এতে অনেককিছু হওয়ার প্রবণতা রাখা হয়েছে। আমরা অতি সংক্ষেপে গল্পটি স্মরণ করি। নেহার একমাত্র মেয়ে দেয়া যখন বিয়ে হয়ে অন্য বাসায় চলে যায়, তখন নেহার বয়স ৬০-৬৫। এ বিয়ের ফলেই এ গল্পের শুরু কিংবা নতুন করে শেষ হচ্ছে। তখনই যে গল্প শুরু হয় তাতে লিঙ্গজিজ্ঞাসা নেহাকে একেবারে নিঃশেষ করতে থাকে। আমরা একে একে জানতে থাকি নেহার যৌনইতিহাস। সেই ইতিহাসে যৌনতা বলে কিছুই থাকে না; বা, আমরা পাই না। এমনকি ওর স্বামীর প্রায় নাই ধরনের লিঙ্গযোগে একেবারে না-হওয়ার মতো যৌনক্রিয়ার মতো কথা এখানে আছে, তাতে আবার দেয়ার জন্মের এক ইতিহাস যোগ হয়। দেবেশ যেন আমাদের এক নব্য-মাতা-মেরির গল্প শুনাচ্ছেন। প্রায়-যৌনতাহীন বাচ্চাপ্রসবের গল্প আছে এতে। সংসারের গল্প, যে সংসারে নিষ্কর্ম-যৌথতা আছে, শহুরে উচ্চমধ্যবিত্তের মুখস্থ জীবন আছে, আছে দিনক্ষণের মর্মবেদনা। একসময় মেয়ে দেয়ার জীবনেও দেখি একই জীবন, যৌনতার একই বন্দিত্ব শুরু হয়। দেবেশ রায় যৌনতার বায়োলজি দেখাতে দেখাতে তাঁর গল্প শেষ করেছেন। তিনি কি যৌনতার সারাৎসার হিসাবে বায়োলজিকেল যোগ্যতাকেই মহান করে দেখেন? লিঙ্গ নিয়ে তার শক্তপোক্ত কথা আছে, ডেস্পারেটনেস আছে তবে যৌনতাবিষয়ে নাই সৃজনশীলতার তুমুল আকাঙ্ক্ষা। তাঁর লেখাতে এটাই মনে হয় যে বডি ফিটনেসই সেক্সে মৌলস্বর! এ যে আবিষ্কারের বিষয়, প্রেমজ কামনা-বাসনার বিষয় তা দেখার স্কোপই রাখেন না। সেক্সুয়েল পিউরিফিকেশনও এ লেখার বড়ো সীমাবদ্ধতা। মা-মেয়ে এত যে যৌনতার অসারতার মুখোমুখি হচ্ছে, তারা ভুলেও নিজেদের সীমিত জীবনের বাইরের জগৎ দেখে না। নাকি সংসারের পুরুষ এমনই প্রাবল্যের আধার যে তাতে বাইরের জগৎ দেখার কোনো প্রণোদনাই আসে না! তবে এটা বলতেই হবে দেবেশ যৌনজীবনকে বড়োই যান্ত্রিকভাবে দেখেছেন।
এতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনেকদিকই আছে। তবে তাতে তিনি প্রচুর স্বাধীনতা নিয়েছেন, মনের মাধুরী মিশিয়ে লেখকসকল যা ইচ্ছা তাই লিখতে পারেন— তাই যেন দেবেশও প্রকাশ করলেন! লেখকসকলের ঈশ্বরত্ব অর্জনের বিষয় বলে কথা— তবে, যে কোনো প্রফেশনকে বিষয় করলে তা অবশ্যই নিপুণভাবে খোঁজখবর নিয়েই করা উচিত। এই যেমন নেহা যেভাবে ডাক্তারের সাথে কথা বলে, তাতে ডাক্তারিবিদ্যা দারুণভাবে হেলাফেলার এক বিষয় হয়ে গেছে। প্রথম কথা হচ্ছে, একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বাচ্চাপ্রসবের ব্যাপারে এধরনের কথা বলবেনই না। তাদের কথা শুনলে মনে হয়, একজন মা ইচ্ছা করলেই বাচ্চাপ্রসবের বিষয়টা তার অধীনেই রাখতে পারেন। চিকিৎসাব্যবস্থার আধুনিকতাকে তিনি একে প্রাগ-খ্রিস্টীয় যুগে নিয়ে যেতে চেয়েছেন! এটা তার স্বাধীনতা, ডাক্তারই যেন তা নিয়ে যাচ্ছেতাই করেন! কথাক্রমে বলতে হয়, পৃথিবীতে একজন প্রতিভাবান-চতুর-লোভী ডাক্তার প্রসবের ধরনকে যত সুশৃংখলভাবে নিজেদের অধীনে রাখতে পারেন, অন্য কোনো রোগীর বেলায় তা সেইভাবে হয়ত সম্ভব নয়। একজন ডাক্তার যে পূত-পবিত্র একজন মানবসন্তান তা কিন্তু এখানে বলা হচ্ছে না। কিন্তু সিজারিয়ান অপারেশন তো একজন ডাক্তারের যাচ্ছেতাই সিদ্ধান্তের বিষয় হতে পারে না। এ জন্য গল্পের নেহার দুই-দুইটি বড়ো কারণ হতে পারে ১. নেহা এল্ডারলি প্রাইমি, মানে তার বেশি বয়সে প্রথম বাচ্চা হচ্ছে; ২. ভ্যালুয়েবল চাইল্ড। সিজারিয়ার অপারেশনের আরও কারণ এখানে হতে পারে, ১. বাচ্চার অবস্থা ও অবস্থান, ২. মায়ের শারীরিক প্রস্তুতি, ৩. মা-সন্তানের পারস্পরিক অবস্থান, ৪. পরীক্ষা-নিরীক্ষার নানান রেজাল্ট। এখন এইসবকে এনালাইসিস করতে গেলে আরও কয়েকদিনের লেকচার দেয়া ছাড়া উপায় নাই। আরও বলতে হয় যে এ গ্রন্থে যেমন নেহার বৌদির বাচ্চাপ্রসবের দৃশ্য যেভাবে দেখানো হল, তা একেবারেই হাস্যকর। যেখানে সিজারিয়ান অপারেশনের সিদ্ধান্ত হয়ে আছে সেখানে ডাক্তার-নার্স-আয়া ইত্যাদি মিলে ডেলিভারীর টেবিলে শুইয়ে, (কার্যত ও.টি.তে) এভাবে ঘেরাও করে কেন রাখবে? হাত-পা বেঁধেই কেন রাখবে? ওটিতে তো এধরনের ব্যবস্থাই থাকে না। নর্মাল ডেলিভারীর স্টেপসমূহ আর সিলেক্টিভ সিজারিয়ান অপারেশন সম্পর্কে লেখকের মিনিমাম ধারণা নাই।
যৌননৈতিকতার উপর কি আধুনিকতার কোনোই প্রভাব থাকবে না? কোথায় সে যৌনতা? তার বদলে আমরা কতিপয় নির্জনতা দেখি, হাহাকার শুনি—তাও একেবারে লেখাটির শেষপাদে। নির্জনতা এখানে জ্যান্ত-কবরের আদলে নির্জীব হয়ে আছে। পরিবারপ্রথার চাপ কি উচ্চমধ্যবিত্তে থাকবে না? শহুরে শিক্ষিত জনমানসের চাপ আমরা তো অনুভব করি না। এ সৃষ্টিতে পারিবারিক অর্থনীতির একটা প্রভাব আমরা দেখি। এমনকি আইনি-প্রতিষ্ঠানের প্রচ্ছন্ন আবহ আছে। তবে আরও মুশকিল হচ্ছে, মগজের ক্রিয়াকলাপযোগে যৌনতা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা এখানে আছে। যা এই যুগে, জন্মদানের এই যান্ত্রিক যুগে তা ভাবা কতদূর সঙ্গত ভাবার অবকাশ আছে। এই সময়ে প্রাচীন কৌম-সংস্কার কেন তা বোঝা গেল না। আমরা এটা তো জানি যে বিয়ের মৌলউপাদান হচ্ছে, প্রবৃত্তি, অর্থনৈতিক ভাবনা, নৃতাত্ত্বিক আবহ, ধর্মীয় ব্যবস্থাপনা। এখানে আমরা কি দেখি? আমরা দেখি যে সতীত্ব আর পিতৃঅধিকার বাইরের যৌনকোলাহলময় জগৎকে একেবারে অচল করে দিচ্ছে। অবশ্য এর শেষটায় পাঠককে কতিপয় প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। মা-মেয়ের যৌনঅচলত্বই প্রধান হাহাকার বলে চিহ্নিত হয়। এটাই গল্প, এটাই হয়ত দেবেশের নবতর যৌনইশতেহার। তা এমনই ঘনবদ্ধ যে একে গল্পের আদলই স্পষ্ট করে। এর ভাষা ককার্যত লেখকের তিস্তাপুরাণ আর বাচনভঙ্গি অমিয়ভূষণের বিশ্বমিত্তিরের পৃথিবী বা গড় শ্রীখণ্ড থেকে নাজেলকৃত। এতে তিস্তাপুরাণ-এর ভাষার সেই ধার, নিয়ন্ত্রণ বা এর চৌকসতা নাই; অমিয়ভূষণের লীলাময়-নিরক্ত-কথন মিলে ভাষার আলাদা এক জগৎ আমরা দেখি। তবে একজন রমণীর যৌনলিপ্ততার বিষয়ে কতভাবে সচেতন থাকা উচিত তারই খানিক সারাৎসার এখানে প্রকাশ পেয়েছে।
৭.৭.১১