একজন জিজ্ঞেস করে কোথায় যাবেন
কেউ গন্তব্য বলে না
পাখিরা কোথায় যায় কেউ জানে
নিষিদ্ধ পল্লীর পাশ ঘেষে যাত্রীদের কাছে
পাখি কেনা-বেচার কৌতুক চলে
প্লাটফর্মের আকাশ সীমাবদ্ধ
হুইসেলের শব্দে হারিয়ে যায় ভূগোল
প্রান্তর গিলতে গিলতে
সামনে এসে দাঁড়ায় বিশাল পিঁপড়ের সারি
রুদ্ধশ্বাস যাত্রীরা অজগরের পেটে
ঢুকতে আর বেরুতে থাকে
কখনো মনে হয় পোড়াবাড়ির প্রাচীরে বন্দী সবাই
ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে একের পর এক ওয়াগান
ঘুমের ঘোরে নাক ডাকে দস্যু ইঞ্জিন
কে কখন মুক্তি পাবে জানে না কেউ
মাঝে মাঝে বগিগুলো ব্যথায় মুচড়ে ওঠে প্রসব বেদনা
ভূমিষ্ঠ হয় শত শত যাত্রী
তারা অশ্রুর আদলে টুপটাপ ঝরে পড়ে স্টেশনে আঁকা বাঁকা
চকখড়িতে কারা যেন প্লাটফর্মের পিঠে এঁকে দিয়েছে উল্কি
প্রতিটি যাত্রী ভাবে সে ব্যতীত যাত্রী নয় কেউ
নয় ধৈর্য্যশীল
শীর্ষনাগ ফণা তুললে
টেনে নামানোর সাধ্য কার
যাত্রীদের চোয়ালের হাড় থেকে থেকে হাততালি দেয়
চুলের লাবণ্য বাজে জন্মস্থানে
বঙ্গ থেকে কলিঙ্গ
হরিকেল থেকে সমতটে লাল পিঁপড়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে
হুইসেলের ধমকে যাত্রীদের প্রশ্ন প্রতিহত
ওয়াগনের টাগরায় ঝাঁক ঝাঁক মৌমাছি আর
দুঃসংবাদের ঝাঁকুনি
প্রতিটি যাত্রীর শেষ দৃশ্য থাকে
পাহাড়ের আলস্য ভাঙা ভূকম্পন
অন্ধকার গুহায় পা তলানোর ছপ ছপ
দূরত্ব দীর্ঘ হলে ইঞ্জিন গতির অনুকম্পা চায়
তখন বোবা বানিয়ে প্রান্তরে ঝাঁপ দেয় প্রত্যেকের চোখ
এতো শব্দের গর্ভেও খলিয়ে ওঠে নৈঃশব্দ্য
দরোজার দাঁতে শীতাতপ হানা দেয়
অভিজ্ঞ ফেরিওয়ালা বাঘের বিকল্প হয়ে ওঠে
রক্তমাখা মাংসের লোভ দোলে স্টেশনের চোখে মুখে
আসলে কেউ কি কোথাও নামে
কারো কণ্ঠস্বরের অপেক্ষায় থাকে কারো শ্রুতি
অনুপস্থিতি পূরণের পদশব্দ কেউ শুনতে পায়
স্টেশনের কানে কানে লাল পিঁপড়ের সারি কি যে কথা বলে
কোথাও ছায়ারা ঘুমায়– কোথাও শূন্য চেয়ার
অশ্বের পীঠ হয়ে ওঠে স্টেশন
পেছনে পিঁপড়েরা স্মরণ করায় দ্বিতীয় যাত্রা
তন্দ্রাচ্ছন্ন আনাকোন্ডা আড়মোড়া ভাঙে
হঠাৎ শত শত সিংহের হুঙ্কারে উৎক্ষিপ্ত জেব্রা
কেউ কি গন্তব্যের অন্তর্গত ইতিহাস জানে
সারি সারি চোখ বাঁধা আর্তনাদ নেমে যায়
হারিয়ে যায় মেষ পালকের দল
মুষড়ে পড়ে আশপাশের গাছজনতা
দিগন্তে টান টান ফুটে ওঠে তুলোর আয়না
কোনো বাড়ি নেই জানালারা দেখছে বৃক্ষের অনশন
লোহার ঘোড়া বিশাল শ্বাস নিচ্ছে ক্লান্তি ভেঙে ভেঙে
ধুলো ঢাকা বৃক্ষরা কৃতদাসের ভঙ্গিতে অভিবাদনরত
পীত দানবের দেশ খেয়ে ফেলছে দূরের অজানা
কারা যেন শুকনো যাত্রীদের ঠেলে দিচ্ছে ইঞ্জিনের আগুনে
চলমান শহর গড়ে উঠেছে পথের আত্মার উপর
অন্ধকার ভেদ করে এক বিশাল ধনুর্বাণ
ছুটে যাচ্ছে বাণপ্রস্থে
যে স্টেশন তার অতিথিদের জুগিয়েছে উৎসাহ
আজ অনিশ্চিত জাদুর বাঁশিতে সে শিলীভূত
দেঁতো রাক্ষসের হাসিতে দিশেহারা
অনায়াসে হতে পারতো শীতের দুপুরে ছুটে যাওয়া প্রজাপতি
পরাগায়ণের পর ভূমিষ্ঠ হতে পারতো ক্ষুদিরাম-দিনেশ
জানি নির্বাসনে যাদের জন্ম তাদের প্লাটফর্ম নেই – টিকিটও না
এই অবিশ্বাস্য জিন
আলাদিনের স্বপ্ন থেকে বেরিয়ে
আবার রূপান্তরিত হচ্ছে ধোঁয়ায়
আর পৃথিবীর সব বিস্ময় টেনে নিচ্ছে
সামনের স্টেশনে-দূরে অসীমে
রেজাউদ্দিন স্টালিন
রেজাউদ্দিন স্টালিন (জন্ম ২২শে নভেম্বর, ১৯৬২) কবি, লেখক ও টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব। তিনি আশির দশকের অগ্রগণ্য ও সফল কবি হিসেবে বিবেচিত। তার রচিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশটি। কবিতায় অবদানের জন্য তিনি ২০০৬ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।
রেজাউদ্দিন স্টালিনের উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: “পূর্ণ্যপ্রাণ যাবে”-১৯৮৩ সাল, “দাঁড়াও পথিকবর”-১৯৮৬ সাল (একটি যৌথ প্রকাশনা), “ফিরিনি অবাধ্য আমি”-১৯৮৫, “ভেঙে আনো ভিতরে অন্তরে”-১৯৮৭, “সেইসব ছদ্মবেশ”-১৯৮৯, “আঙ্গুলের জন্য দ্বৈরথ”-১৯৯২, “আশ্বর্য আয়নাগুলো”-১৯৯২, “ওরা আমাকে খুঁজছিল”-১৯৯৭, “সম্ভাবনার নিচে”-১৯৯৬, “পৃথিবীতে ভোর থেকে দেখিনি কখনো”-১৯৯৭, “আশীর্বাদ করি আমার দুঃসময়কে”-১৯৯৮, “হিংস্র নৈশভোজ”-১৯৯৯, “আমি পৃথিবীর দিকে আসছি”-২০০০, “লোকগুলো সব চেনা”-২০০১, “নিরপেক্ষতার প্রশ্ন”-২০০২, “পদশব্দ শোন আমার কন্ঠস্বর”-২০০৩, “পুনরুত্থান পর্ব”-২০০৪, “অবিশ্রুত বর্তমান”-২০০৫, “মুহুর্তের মহাকাব্য”-২০০৬ সাল, “অনির্দিষ্ট দীর্ঘশ্বাস”-২০০৮, “ভাঙা দালানের স্বরলিপি” ২০০৯, “কেউ আমাকে গ্রহণ করেনি”-২০০৯ সাল। রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতা ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, উড়িয়া, রুশ, জার্মান, চীনা, জাপানী ও ফরাসী ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
রেজাউদ্দিন স্টালিন দীর্ঘদিন নজরুল ইনস্টিটিউটের উচ্চপদে কর্মরত ছিলেন।