জর্জিয়া
৫
একটা নিরাপদ জায়গা দেখে তারা গাছে চড়ে বিশ্রাম করার চিন্তা করল। রেকুনের মত তারা গাছে ঘুমিয়ে নিল।
কোরার ঘুম ভাঙল। তখন সূর্যটা বেশ উপরে উঠে এসেছে। দুটো পাইন গাছের আঁড়ালে সিজার আপন মনে কী যেন বলছে। কোরা গাছ থেকে নেমে এলো। তার হাত-পা অবশ হয়ে আছে। অস্বাভাবিকভাবে জড়সড় হয়ে সারা রাত ডালের খোঁড়লে লুকিয়ে থেকে শরীরটা অসাড় হয়ে গেছে তার। ঝিনঝিন করছে। সিজারের মুখের অবস্থা খুব খারাপ। গত রাতের সব কথা মনে পড়ছে। তাদের মধ্যে কী সব কথা কাটাকাটি হয়েছে সে সব। পালানোর পথের খোঁজখবর পেট্রোল পার্টি ভালই জানে। “তুই লভির সাতে রেলরোডের কতা কিচু বলিসিচ?” সিজার জানতে চায়।
“না বুদহয়।”
“আমিও বুদহয় বলি নি। আগেই সাবধান না হওয়াটা বোকামী হয়েচে।”
দুুপুর গড়িয়ে যেতে একটা খাঁড়িতে পৌঁছালো তারা। তাদের জন্য এটা একটা ল্যান্ডমার্ক। “খুব কাচাকাচি আইচি বুদহয়,” সিজার বলল। মাইল খানেক এগিয়ে সে কোরাকে রেখে পথঘাট রেকি করতে গেল। ফিরে এসে বনের মধ্যে আরও সংকীর্ণ একটা পথ ধরে চলতে শুরু করল তারা। বন এত ঘন যে আশপাশে কোন বাড়িঘর আছে কি-না তা প্রায় দেখাই যায় না।
“পাইচি রে।” সিজার বলল। ঘেসোমাঠের ওপারে একটা ছিমছাম ছোট্ট বাড়ি দেখা যাচ্ছে। ফাঁকা মাঠ। কিন্তু চাষবাষও হয় না। লাল পতাকা দেখেই সিজার বাড়িটা ঠিকঠিক চিনে ফেলেছে। পিছনদিকের বন্ধ হলুদ জানালা জানান দিচ্ছে যে ফ্লেচার এখন বাড়িতেই আছেন আর তার স্ত্রী গেছেন তার পরিবারের লোকদের সাথে দেখা করতে।
“লভি যদি ওদের সব কয়ে দেয়? কি হবেনে?” কোরা জানতে চাইল।
তারা সেখানে অন্য কোন বাড়ি দেখতে পেল না। কোন লোকজনও নেই। তবে এমন খোলা মাঠের মধ্য দিয়ে যাওয়া ভয়ের ব্যাপার বটে। কোরার মনে হল, সে যেন আগুনে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছে।
পেছনের দরজায় টোকা দিয়ে তারা ফ্লেচারের দরজা খোলার অপেক্ষায় রইল। ভীষণ ভয় করছে কোরার। মনে হচ্ছে জঙ্গলে যাদের সাথে তাদের লড়াই হয়েছে তারা হয়ত তাদের পিছু পিছুই আছে। আবার এমনও তো হতে পারে, লভির কাছ থেকে শুনেটুনে তারা তাদের পাকড়াও করতে আগেই এখানে এসে এই ঘরেই লুকিয়ে আছে। অবশেষে ফ্লেচার দরজা খুলে তাদের হেঁশেলে ঢুকালো।
ছোট হলেও হেঁশেল ঘরটা বেশ আরামদায়কই। এক কোণায় একটা লালচোখ কুকুর শুয়ে; কিন্তু অতিথিদের দেখেও সে চুপচাপই শুয়ে রইল। ফ্লেচার কলসি থেকে ঢেলে তাদের খাবার পানি দিলেন। দু’জনই প্রচুর পানি খেল। তেষ্টায় তাদের গলা ততক্ষণে কাঠ হয়ে আছে। অতিরিক্ত একজন প্যাসেঞ্জার দেখে ফ্লেচার একটু অখুশি। পয়লা থেকেই বেশ কিছু ভুল হয়ে গেছে।
লভি যে নেই তা পয়লা নজরে আসে লভির মা, জারের। ঘর থেকে বেরিয়ে সে গোপনে মেয়েকে খুঁজতে লাগল। ছেলেগুলো লভিকে খুব পছন্দ করত, লভিও তাদের পছন্দ করত। একজন কর্তাব্যক্তি জারকে লভি কোথায় তা জানতে চাইল। একজনের কাছে তিনি জেনেছেন, কোরা আর সিজারকে চোখেচোখে কথা বলতে দেখেছে ও। ছ’ ঘন্টা আগে থেকে তারা লাপাত্তা। এ ছ’ ঘন্টা ধরেই পাহারাদাররা তাদের হন্যে হয়ে খুঁজছে।
তখনও দুপুর হয় নি। ফ্লেচার তাদের জানাল, এ তল্লাটের সবাইকে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে তোমাদের পাকড়াও করতে। টেরেন্স নজিরবিহীন বড় অংকের পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। সর্বত্র হারানো বিজ্ঞপ্তি সাঁটা হয়েছে। জঘন্যতম দুর্বৃত্ত, মাতাল, ঘাঁগু বদমাশ আর গরিব সাদারা, যাদের এমন কি পায়ের জুতো কেনার পয়সা পর্যন্ত নেই তারা হন্যে হয়ে পলাতকদের খুঁজছে। কালোদের মহল্লায় মহল্লায় লুটপাটের ভাল এক মওকা জুটেছে তাদের। পাহাদাররা দাসগ্রামগুলো তছনছ করে ফেলেছে। আর স্বাধীন হওয়া কালোদের বাড়িতে করছে লুটপাট; মারধরও করছে।
খোদা পলাতকদের দিকে মুখ তুলে চাইলেন। যে শিকারীরা তাদের তাড়া করেছিল, তাদের ধারণা পলাতকরা এই বিলেই কোথাও লুকিয়ে আছে। মেয়ে দুটোকে হয়ত দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়েছে যাতে অন্ধকারে হারিয়ে না যায়। তাই অন্যদিকে ফালতু সময় নষ্ট করে লাভ নেই। তাদের জানামতে, জর্জিয়ার এত দক্ষিণে গোলাম পাচারের জন্য সহানুভূতিশীল কোন শ্বেতাঙ্গ নেই। কোন আন্ডারগ্রাউন্ড রেলরোডও নেই। তারা জানে, বেশির ভাগ গোলামই এই দুর্গম বিলের পানি ভেঙেই পালাতে চেষ্টা করে। পাকড়াওকারীদের এই ভুল ধারণা ও পদক্ষেপের সুযোগে আর শুকর শিকারীরা হামলা করার আগ পর্যন্ত তিনজনের দলটা বিল পেরিয়ে অনেকটা উত্তর-পুবে চলে আসতে পেরেছিল।
লভিকে ধরে আনা হল র্যান্ডেলে। ফ্লেচারের বাড়িতে দু’বার এসে খোঁজখবর নিয়ে গেছে পাকড়াওকারী দল। তারা তাদের ছায়ার মত খুঁজছে। মারাত্মক খবর হলো, বছর বারোর যে ছোকরাকে কোরা পাথর দিয়ে আঘাত করেছিল সে মারা গেছে। ফলে একজন শে^তাঙ্গ হত্যাকারীকে খুঁজতে তারা হন্যে হয়ে উঠেছে। সাদাদের এখন একটাই চাওয়া, খুন কা বদলা খুন।
কম্বলে মুখ ঢেকে লুকিয়ে রইল সিজার। ফ্লেচার তার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে অভয় দিলেন। ফ্লেচারের বাড়িতে খোঁজাখুঁজির খবরে সিজারের কোন ভাবান্তর নেই। কোরা রুটি ছিড়ে টুকরো করছিল। বনের মধ্যে শুকর শিকারীদের সাথে লড়াই আর লভির হারিয়ে যাওয়ার কথা শুনে ফ্লেচারের দুঃশ্চিন্তা বাড়ল। রান্নাঘরে তিনজন সব কিছু পর্যালোচনা করে আশ্বস্ত হতে চাইল যে, লভি আন্ডারগ্রাউন্ড রেলরোড সম্পর্কে কিছু জানে না। আর দোকানী ফ্লেচারের নামও তারা তাকে বলে নি। তাহলে এগিয়ে যাওয়া যায়।
সিজারের রুটি আর মাংস খাওয়া শেষ হলেই কথা উঠল এখনই রওনা হওয়া ঠিক হবে, না কি রাতে? এবার কোরা কথা বলল। জীবনে এই প্রথম সে তার চেনা গণ্ডির বাইরে এসেছে। এসবের কিছুই সে জানেবোঝে না। তার মত হল, যত তাড়াতাড়ি র্যান্ডেল থেকে যত দূরে চলে যাওয়া যায় ততই ভাল। যত বেশি দূরে যেতে পারবে, তত বেশি বিজয় হবে তার।
সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল, সবার নাকের ডগা দিয়েই যাবে তারা। ফ্লেচারের গাড়ির পিছনে হোসিয়ারি কম্বলের গাঁটের নিচে লুকিয়ে তাদের নিয়ে যাওয়া হবে। সেটাই হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। এর ফলে মিসেস ফ্লেচার আসার আগেই তারা সটকে পড়তে পারবে। কোরাও তাতে সাই দিল। এমন সময় কুকুরটা বায়ু ত্যাগ করল।
নীরব রাস্তায় কোরা আর সিজার ফ্লেচারের গাড়ির পেছনে ক্রেটসের নিচে লুকিয়ে রইল। রাস্তার দু’ ধারের লম্বা লম্বা গাছের ছায়া আর রোদের ঝিকিমিকি খেলা চলছে তাদের ঢেকে রাখা কম্বলের উপর দিয়ে। ফ্লেচার ঘোড়াদের সাথে আপন মনে নানা বাতচিৎ করতে করতে গাড়ি চালাতে লাগলেন। চোখ বন্ধ করে আছে কোরা। কিন্তু তার মনের পর্দায় বার বার ভেসে উঠছে বারো বছরের ছোকরাটার রক্তাক্ত থেঁতলানো মুখ আর সেই দাঁড়িওয়ালা লোকটার ভয়ংকর চেহারা। এসব ভাবতে ভাবতে আধোঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে রইল কোরা। “ছোকরাটা বয়সে আমার চে’ ছোটই হবে”, কোরা ভাবছে। আর যা-ই হোক, আমার গায়ে হাত দেয়া উচিত হয় নি ওর। বেচারা! রাতে শুকর শিকার করে না বেড়িয়ে সে অন্যভাবে আনন্দে সময়টা কাটাতে পারত! যাগ গে, কার কী হল তাতে আমার কি! আমরাই তো মরতে বসেছিলাম তাদের হাতে! কোরা ভাবে।
শহরের কোলাহলে কোরার ঘুম ভাঙল। কল্পনায় সে দেখতে লাগল, নিজ নিজ কাজে শহরের মানুষজন ছোটাছুটি করছে, দোকানগুলো বেচাবিক্রিতে ব্যস্ত, সার সার চলছে গাড়ির বহর। ক্রমেই তা আরও স্পষ্ট হচ্ছে। কোলাহল বাড়ছে। কোরার হাতটা গুটিয়ে দিল সিজার। ক্রেটের মধ্যে দু’জনে গুঁটিশুঁটি এমনভাবে শুয়ে যে কোরা সিজারের মুখও দেখতে পাচ্ছে না; তবু সে সিজারের অনুভূতি অনুমান করতে চেষ্টা করল। ফ্লেচার গাড়িটা থামালেন।
হঠাৎ যেন কোরার দম বন্ধ হয়ে আসছে। তার ভয়, এই বুঝি কেউ তাদের কম্বলের নিচ থেকে বের করে গণধোলাই দেবে। ফ্লেচারকে গ্রেফতার করে বেধড়ক মার শুরু করবে। সে তো শুধু দু’জন গোলামকেই পালাতে সাহায্য করছে না, পালাতে সাহায্য করছে এমন দু’জন খুনিকে যারা খুন করেছে এক শে^তাঙ্গ তরুণকে। টেরেন্সের কাছে ফেরত পাঠাবার আগে চলবে তাদের গণধোলাই। বিগ এন্টনীর পরিণতির কথা মনে পড়ল কোরার। বিগ এন্টনীর মত তাদেরও টেরেন্স ফুটন্ত তেলে পুড়িয়ে কয়লা বানাবে! লভির ভাগ্যে কী ঘটেছে কে জানে? ভয়ে দম বন্ধ হয়ে আসে কোরার।
এক বন্ধুর ডাকে ফ্লেচার গাড়ি থামালেন। লোকটা গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়াতেই গাড়িটা দোলনার মত দুলে উঠল আর কোরা ভয়ে আঁতকে উঠল; লোকটা অবশ্য তা শুনতে পায় নি। ফ্লেচারকে স্বাগত জানিয়ে সে দোকানিকে কিছু দরকারি খবর জানাল। “খুনিরা ধরা পড়েছে হে।” ফ্লেচার ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালেন। এই গুজবে আরও একজন যোগ দিয়ে বলল যে, গোলামরা এক গেরস্থ বাড়িতে মুরগিঘরে লুকিয়ে ছিল। কুকুর ঠিকই গন্ধ শুঁকে তাদের চিনে ফেলে এবং তারা ধরা পড়ে যায়। গভীর মনোযোগ দিয়ে সব শুনছে এমন একজন শ্বেতাঙ্গের দিকে তাকিয়ে তিনি আবারও ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালেন। কিন্তু ছেলেটার কোন খবর পাওয়া যায় নি, তারা বলাবলি করছে।
“খুবই দুঃখের কথা”, ফ্লেচার আক্ষেপ প্রকাশ করলেন।
সরাসরি গাড়িটা ফিরে চলল গ্রামের রাস্তা ধরে। “লেজ ধরেছ তোমরা, হে হে লেজ ধরেছ।” ঠিক বোঝা গেল না কথাটা তিনি ঘোড়া না অন্য কাউকে উদ্দেশ করে বললেন। কোরা তখন ঝিমোচ্ছে। এখনও ধকল কাটে নি তার। ঘুমের কারণে লভির কথা আর মনে পড়ছে না। ঘুম যখন ভাঙল ততক্ষণে রাত হয়ে গেছে। সিজার তার পিঠে মৃদু টোকা দিয়ে তাকে আবারও আশ্বস্ত করল। ক্যাঁচর ক্যাঁচর আর বোল্টের ঝনঝন শব্দ করে গাড়িটা থামল। ফ্লেচার কম্বলটা সরিয়ে নিলেন। একটা গোলাবাড়িতে ঢোকার পর জড়সড় শুয়ে থাকা দুই পলাতক এবার একটু হাতপা ছেড়ে আয়েশ করার সুযোগ পেল।
গোলাঘরে ঢুকেই ভাঙা শেকলের উপরই কোরার পয়লা নজর পড়ল। সেখানে আছে শত শত ভাঙা হাতকড়া, পা, মাজা আর গলায় বাঁধার জন্য নানা রকমের শেকল আর দেয়ালের পেরেকে ঝুলছে পুরনো কিছু আঙরাখা। যাতে পালাতে না পারে তাই এসব শেকল দিয়ে কালো গোলামদের হাতে-পায়ে-গলায় বেঁধে রাখা হয়। যাতে নড়াচড়া না করতে পারে তাই হাত-পা শেকলে বেঁধে গাছে ঝুলিয়ে বেদম পেটানো হয় তাদের। নির্মম অত্যাচারের এসব আলামত রাখা আছে ঘর জুড়ে। এক সারিতে বাচ্চাদের বাঁধার হালকা শেকল, ছোট হাতকড়া রাখা হয়েছে। একটা শো-কেসে রাখা এত মোটা মোটা আর ভারী হাতকড়া আর শেকল যে লোহাকাটা করাতও তাতে দাঁত বসাতে পারবে না। কিছু হাতকড়া খুব পাতলা; কিন্তু যাদের তা পরানো হয় কঠিন শাস্তির ভয়ে কেউ তা ভাঙার দুঃসাহস দেখাবে না। রয়েছে মুখে দেবার ঠুঁসিও। এক কোণায় স্তূপ করে রাখা বড় বড় শেকল আর গোলক। গোলকগুলো সাজিয়ে রাখা আছে পিরামিডের মতো করে। পাশেই ইংরেজি এস অক্ষরের মত বিছিয়ে রাখা অনেক শেকল। তার কিছু জং-ধরা আর কিছু ভাঙাচোরা। এমন কিছু শেকল পড়ে আছে যা দেখে মনে হয় যেন আজ সকালেই সেগুলো তৈরি করা। সংগ্রহশালার ওদিকে গিয়ে কোরা দেখল একটা চমৎকার লকেট চকচক করছে। সেটা সে তার গলায় পরার জন্য নিতে চাইল।
“এসবই ভীতিকর জিনিসপত্র। আমি নানা জায়গা থেকে কুড়িয়ে এনেছি, হুম” কেউ একজন বলল।
লোকটাকে তারা এ ঘরে ঢুকতে দেখে নি! লোকটা কে? কখন এখানে এসেছে? আগে থেকেই কি এখানে ছিল? তার পরণে ধূসর রঙের পাজামা আর গায়ে ছেঁড়াফাটা ময়লা একটা জামা। কঙ্কালসার একটা মানুষ। না-খেয়ে থাকা গোলামদেরও কোরা এত হাড্ডিসার দেখে নি কখনও। “যখন আমি সফরে যাই, তখন এসব স্মারক আমি কুড়িয়ে আনি,” কঙ্কালসার শ্বেতাঙ্গ লোকটি বলে। লোকটার কথা বলার ভঙ্গিতে বেশ পাগলাটে ভাব। খামারে কিছু পাগলকে এভাবে কথা বলতে শুনেছে কোরা।
ফ্লেচার তাকে পরিচয় করে দিলেন, “লাম্বলি।” লোকটা খুব দুর্বলভাবে হাত নাড়ল।
“কন্ডাক্টর?” সিজার জানতে চায়।
“তেমন কিছু না; স্টেশন এজেন্ট,” লাম্বলির জবাব।
রেলরোডের এসব কাজে যুক্ত হবার আগে তিনি নিজের ছোট্ট খামারে নিরিবিলি জীবনযাপন করতেন। এ জমিটা তারই। নিরাপত্তার কারণে কোরা ও সিজারকে কম্বল মুড়ি দিয়ে কিংবা চোখ বেঁধে আসতে হবে। সেটাই দস্তুর। কোথায় তারা আছে সে বিষয়ে তারা কিছু জানতে পারবে না।
“আজ তিনজন প্যাসেঞ্জার আসার কথা ছিল। এখন হাত-পা খুলে যেতে পারবেন।”
এসব কথার মানে বুঝে ওঠার আগেই ফ্লেচার জানালেন, তার ফেরার সময় হয়ে গেছে। “বন্ধুরা, আমার কাজ শেষ।” গভীর আন্তরিকতায় তিনি দু’ জনকেই আলিঙ্গন করলেন। কোরা নিজেকে কুঁকড়িয়ে ফেলল। গত দু’ দিনে দু’জন সাদা মানুষের হাত পড়েছে তার গায়ে। এই কি তার স্বাধীনতা?
সিজার নীরবে ফ্লেচারের গাড়ি নিয়ে ফিরে যাওয়ার দিকে চেয়ে রইল। ঘোড়ার সাথে আগের মতই কথা বলতে বলতে তিনি চলে গেলেন। তাদের নিয়ে ফ্লেচার ভীষণ বড় ঝুঁকি নিয়েছেন। যদি এরা নিরাপদে পৌঁছে যেতে পারে তবেই তার পরিশ্রম সার্থক হবে। এদের বেঁচে থাকাটাই বড় কথা। অনেক দিন আগে যেদিন তিনি সিজারকে তার দোকানে নিয়ে আসেন সেদিন থেকেই সিজার ফ্লেচারের কাছে ঋণী। ঠিক এই কর্তব্যবোধ কোরা লক্ষ্য করছে সিজারের চোখেমুখে। তার না কোন বিপদ হয়! লাম্বলি গোলাঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন। দরজা বন্ধ করার ঘরঘর আওয়াজে কাঁপন জাগল শেকলে শেকলে।
লাম্বলি নিরাবেগ মানুষ। একটা লণ্ঠন জে¦লে সেটা সিজারের হাতে দিলেন। এবার পা দিয়ে একটা ফাঁদ-দরজা (ট্রাপ-ডোর) টেনে আনলেন। ঘরঘর শব্দ আর কাঁপুনি থামতেই তিনি বললেন, “আমিই পয়লা ঢুকছি।” সেখান থেকে একটা সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে। পাথরের সিঁড়ি। বেশ খাড়া। নিচের দিক থেকে একটা বোঁটকা গন্ধ আসছে। মাটির নিচে কোন ঘরে নয়, সিঁড়িটা নেমে গেছে আরও নিচে। অনেক কষ্ট করে এমন সিঁড়ি তৈরি করা হয়েছে। মনে মনে তারিফ করল কোরা। ধাপগুলো খাড়া হলেও পাথরগুলো এমন দৃঢ়ভাবে বসানো যে তাতে নিরাপদে নেমে যাওয়া যায়। সিঁড়ি বেয়ে তারা এসে নামল একটা টানেলে। সামগ্রিক নির্মাণ কৌশল এতই চমৎকার যে, তার প্রশংসা করার ভাষা জানা নেই কোরার।
সিঁড়িটা গিয়ে পৌঁছেছে একটি ছোট রেল প্লাটফর্মে। টানেলের কালো বিশাল মুখ দুটো উভয় পাশে হা করে খোলা। বিশ ফুটের মত লম্বা হবে প্লাটফর্মটা। দেয়ালগুলো নির্মাণ করা হয়েছে গাঢ় কালো ও হালকা কালো পাথর মিলিয়ে। একটা গাঢ় কালোর পর একটা হালকা কালো, আবার একটা গাঢ় কালোর পর একটা হালকা কালো পাথর বসিয়ে বসিয়ে তৈরি করা। অনেক মেধা আর শ্রম দিয়ে প্লাটফর্মটা তৈরি করা হয়েছে। কোরা ও সিজার পাতা রেলগুলো দেখছিল। টানেলের মধ্যে যতদূর দেখা যাচ্ছে দুই পাটি রেল পাতা হয়েছে কাঠের স্লিপারের উপর দিয়ে। উত্তর দিকের অজানা কোথাও থেকে দক্ষিণে কতদূর লাইন গেছে তা জানা তাদের পক্ষে অসম্ভব। কেউ একজন একটা ছোট বেঞ্চ পেতে রেখেছে। কোরার ঝিমুনি আসছিল। সে গিয়ে বেঞ্চের উপর বসে পড়ল।
সিজার কিছু বলার সুযোগ পাচ্ছে না। “কতদূর গেচে রেল পথটা?”
লাম্বলি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, “যেখানেই যাক তা আপনাদের জন্য যথেষ্ট।”
“অনেক বচর লেগেছে?”
“আপনি যা ভাবতে পারেন তার চেয়ে বেশি। ভেন্টিলেশন সমস্যার সমাধান করতেই অনেক সময় লাগে।”
“কারা বানালো?”
“এদেশে কারা বানায়?”
কোরা লক্ষ্য করল তাদের জানার আগ্রহ মেটাতে চেষ্টা করছেন লাম্বলি। কিন্তু এসব জানা খুব জরুরি নয়।
“সিজার আবার জানতে চায়, “বানালো ক্যামনে?”
“হাত দিয়ে, আবার কী করে? আপনাদের যাওয়া নিয়ে কথা বলাই বোধহয় ভাল।” পকেট থেকে হলুদ একটা কাগজ বের করে লাম্বলি তার দিকে ট্যাঁরো চোখে তাকালেন। “দুটো পথ আছে। যে কোনটা বেছে নিতে পারেন। একটা ট্রেন একঘন্টা পর, আরেকটা ছ’ ঘন্টা পর ছাড়বে। খুব সুবিধের কিছু নয়। আমাদের প্যাসেঞ্জাররা যদি ঠিক সময়েও এসে পৌঁছয়, তবু কিছু সীমাবদ্ধতার মধ্যে আমাদের ট্রেন চালাতে হয়। ”
“পরেরটা,” উঠে দাঁড়িয়ে কোরা বলল। আর কোন কথা না।
“কিন্তু ট্রেন দুটো একই জায়গায় যাবে না। একটা এক দিকে, অন্যটা…”
“কনে যাবে?” কোরার জিজ্ঞাসা।
“বেশ দূরেই যাবে, আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি। পথে অনেক ঝাঁমেলা আছে। লোকাল, এক্সপ্রেস, তাদের ক্রসিং কত কি! এ জন্য কখন কোন স্টেশন বন্ধ থাকবে কেউ তো জানে না। সমস্যা হল, আপনাদের পছন্দের গন্তব্য হিসেবে একটার চেয়ে অন্যটা হয়ত ভাল। স্টেশন জানা থাকলেও হয়ত লাইন নেই। পৌঁছানোর আগে আপনারা তার কিছুই জানতে পারবেন না।”
তার এ কথার মাথামুণ্ড কিছুই বুঝতে পারল না তারা। স্টেশন এজেন্টের কথা হল, সরাসরি যাওয়ার লাইনটা অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এ কথার অর্থ কি? তিনি কি বোঝাতে চাচ্ছেন, অন্যটা অনেক দূরের? লাম্বলি তা বিশদ করলেন না। শুধু বললেন, “যেটুকু জানি, তাই বললাম। বাকিটা পলাতকরাই ঠিক করে। যে কোন জায়গায় হতে পারে, শুধু যেখান থেকে পালায় সেখানে যেন না হয়।” নিজেদের মধ্যে কিছু কথা বলে সিজার বলল, “ঠিক আছে, পরেরটায় যাব।”
“আপনাদের যেমন মর্জি,” বলে তিনি বেঞ্চের দিকে পা বাড়ালেন।
তারা অপেক্ষা করতে থাকল। সিজারের অনুরোধে লাম্বলি বলতে লাগলেন কীভাবে তিনি এই আন্ডারগ্রাউন্ড রেলের সাথে যুক্ত হন। কিন্তু কোরার আগ্রহ নেই তা শোনার। তার চিন্তা কী করে এত বড় টানেল তৈরি করেছে? কত লোক খেটেছে এটা তৈরি করতে? তাছাড়া এই টানেলের পরেও তো অনেক দূর পর্যন্ত রেল লাইন তৈরি করতে হয়েছে। কোথায় গিয়ে শেষ এর? খামারে তাদের রোজকার বাঁধিগৎ জীবনের কথা মনে পড়ল। সারবাঁধা গাছ থেকে তুলো তোলা। কীভাবে জমি চাষ থেকে এই তুলো তোলার কাজগুলো করতে হয়। আফ্রিকান কালো গোলামরা সেখানে একযোগে খেটে মরে, যতক্ষণ তাদের গতরে কুলায়। সাদা সাদা তুলোর গুঁটিগুলো দেখে মনে হয় আসমানে যেন লক্ষ কোটি তারা জ¦লছে। আর তাতে পূর্ণিমার আকাশ আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তুলো তোলা শেষে খামারটা গোলামদের গায়ের কালো রঙে ডোরাকাটা জমিন মনে হয়। বীজ বোনা থেকে তুলো গাঁট বাঁধা পর্যন্ত বিশাল কর্মযজ্ঞ। কিন্তু এত যে গতর খাটা এর কোনই স্বীকৃতি নেই। তাদের গতরের সব ঘাম আর রক্ত চুষে নেয় মালিক একা।
কিন্তু গোলামী থেকে মুক্তির জন্য এই যে স্টেশন, এই রেলরোড, টাইম টেবিল মেনে চলা এসবই যারা তৈরি করেছে এর সবই তাদের অনন্য কীর্তি। এসবই তাদের গৌরব। এর চেয়ে গৌরবের আর কিছু নেই। কিন্তু যারা এটি তৈরি করেছে তারা কি সেভাবে পুরস্কৃত হয়েছেন? (চলবে)
আমিরুল আলম খান
জন্ম যশোর জেলার ভারতীয় সীমান্তলগ্ন শিববাস গ্রামে ১৩৫৮ বঙ্গাব্দের ১৫ই অগ্রহায়ণ।
পড়েছেন এবং পড়িয়েছেন ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য। এরপর মাধ্যমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে যুক্ত থেকেছেন। যশোর শিক্ষা বোর্ডে প্রথমে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পরে চেয়ারম্যান ছিলেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি অপেশাদার সাংবাদিকতায় যুক্ত গত পাঁচ দশক ধরে। ইংরেজি দৈনিকে নিউ নেশান-এ প্রায় এক দশক সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেন। দৈনিক ইত্তেফাক, প্রথম আলো, সমকাল, বণিক বার্তায় কলাম লেখেন।
গ্রামীণ পাঠাগার আন্দোলনে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশে গ্রামোন্নয়নের নতুন মডেল ডিহি ইউনিয়ন পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন। দেশের প্রাচীনতম এবং বৃহত্তম গণপাঠাগার যশোর পাবলিক লাইব্রেরির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
শিক্ষা, ভাষা, প্রকৃতি, কৃষি, বাস্তুসংস্থানবিদ্যায় আগ্রহী। এসব নিয়েই তার বই: বাঙলার ফল, অরণ্যের পদাবলী, পারুলের সন্ধানে, কপোতাক্ষ-মধুমতীর তীর থেকে, বিপর্যস্ত ভৈরব অববাহিকা, পারুল বিতর্ক, বাংলাদেশের শিক্ষার স্বরূপ সন্ধান এবং বিদ্যাবাণিজ্যের রাজনৈতিক-অর্থনীতি।
তাঁর অনুবাদগ্রন্থ: আফ্রিকান-আমেরিকান উপন্যাস দি স্লেভ গার্ল। হ্যারিয়েট অ্যান জেকব রচিত এই আত্মজৈবনিক উপন্যাসটি বোস্টন থেকে প্রকাশিত হয় ইনসিডেন্টস ইন দ্য লাইফ অব এ স্লেভ গার্ল শিরোনামে, ১৮৬১ সালে।