দাপ্তরিক টেবিলের ওপরে ছোট্ট একটা চিরকুট। আমি আস্তে করে হাতে তুলে নিলাম। তা’তে গোটা গোটা অক্ষরে ইংরেজীতে সংক্ষিপ্ত একটি বার্তা – বাংলা করলে যার অর্থ দাঁড়ায়, ‘সম্প্রতি আমার বিদায় সম্বর্ধনা সভায় তোমার বলা আমার হৃদয় ছুঁড়ে গেছে। বলার শেষে তুমি তোমার হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে আমার গালে হাত বুলিয়ে দিয়েছিলে—একজন স্নেহময় পিতা তাঁর কন্যাকে যে ভাবে আদর করে। টের পেয়েছ নিশ্চয়ই যে আমি তোমার সে হাত আমার হাতের মুঠোয় তুলে নিয়েছিলাম। যে পিতৃস্নেহ আমি কোনদিন পাই নি, তুমি আমাকে তা দিয়েছ। হয়ত আর কখনও আমাদের দেখা হবে না, কিন্তু আমি কোনদিন তোমার কথা ভুলব না।’ চিরকুটের নীচের দিকে একটি চেনা নাম। আমি আস্তে আস্তে চিরকুটটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখি।
কতদিন হবে— বছর তিনেক? একজন একান্ত ও গবেষনা সহকারীর প্রয়োজন ছিল। ঐ পদের জন্য আবেদন পত্র পড়েছিল শ’তিনেকের মতো। নির্বাচনী পর্ষদ সব প্রক্রিয়া শেষ করে মাত্র দু’জন প্রার্থীকে চূড়ান্তভাবে সুপারিশ করেছিল। প্রতিযোগিতা সুকঠিন ছিল, সন্দেহ নেই। সিদ্ধান্তে হয়েছিল যে আমি দু’জন প্রার্থীর সঙ্গে কথা বলার পরে একজনকে নিয়োগ দেয়া হবে। প্রার্থীদের একজন ইংরেজ— রেঙ্গুনে কর্মরত, অন্যজন ফরাসী— কায়রোতে কর্মরত। দু’জনাই পড়াশোনায় তুখোড়, কর্মদক্ষ, কথাবার্তায় চৌকস। কিন্তু তারপরেও ফরাসী প্রার্থীটির মধ্যে এমন একটি অকৃত্রিমতা, বিশুদ্ধতা আর স্বাভাবিকতা ছিল যে আমার পছন্দের পাল্লা তার দিকেই ঝুঁকল।
কাজে যোগদানের পরে অল্পদিনের মধ্যেই বোঝা গেল যে আমাদের বাছাইয়ে কোন ভুল হয়নি। তার কাজের দক্ষতা, সাংগঠনিক ক্ষমতা আর সব সহকর্মীর সঙ্গে বন্ধুত্বের মাধ্যমে সোফি সবার মন জয় করে নিল। একান্ত ও গবেষনা সহকারী হিসেবে তার কাজের বেশীর ভাগটাই আমার সঙ্গে — তার কামরাটিও আমার কামরার পাশে। কিন্তু কাজের ফাঁকে মাঝে মাঝেই তাকে আনমনা হয়ে যেতে দেখি — দেখি জানালার শার্সি দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। কথা বলার সময়ে টের পাই, তার মন অন্য কোথাও চলে গেছে। কোন কোন দিন আমার কাজে দেরী হলে দেখি সে তখনও তার কামরায় কাজ করছে। কখনও কখনও সপ্তাহান্তে দপ্তরে গেলে দেখতাম, সোফি তার ঘরে বসে কাজ করছে।সব কিছুর মাঝেও টের পাই একটা বিষাদ যেন ওকে ঘিরে আছে— ওর সারা চোখে মুখে একটা নীরব বিষন্নতার উপস্হিতি বড় বেশী প্রকট।
একদিন এক পড়ন্ত বিকেলে আমি ওকে ডেকে পাঠালাম। ও ঘরে ঢুকতেই বললাম, ‘বোস’। ‘প্রায়ই দেখি তুমি দাপ্তরিক সময়ের বাইরেও কাজ করছ। তোমার ওপর কি কাজের চাপ বেশী পড়েছে?’, আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাই। সে একবার আমার মুখের দিকে তাকায়, তারপর দ্রুত চোখ সরিয়ে নিয়ে বাইরেটা দেখে, তারপর মাথা নীচু করে অস্ফুট স্বরে বলে, ‘না। আমি সময় হনন করতে চাই’। টের পাই সোফি আবেগ সামলানোর চেষ্টা করছে। আমি কিছু বলি না— চুপ করে থাকি। ওকে আমি সময় দেই। কিছুক্ষন পরে সে যখন চোখ তুলে চায় তখন দেখি, মেয়েটির দু’চোখ জলে টলটল করছে। ‘সময় আমার কাছে জগদ্দল পাথরের মতো বসে আছে— কিছুতেই কাটতে চায় না’, কি এক হতাশা নিয়ে সে বলে। ‘অথচ জানো, সে যখন ছিল, তখন কোথা দিয়ে যে সময় কেটে যেত, টেরই পেতাম না।’ কেমন এক সুখস্মৃতি তার কন্ঠে। আমি জানতে চাই না এই ‘সে’ টি কে?
‘কায়রোতেই পরিচয় হয়েছিল ওর সঙ্গে— মিশরীয় ছেলে সে’, সোফি বলে চলে।’জানো, ওকে আমি ওমর শরীফ বলে ডাকতাম’, জলভরা চোখের মাঝেও এক চিলকে হাসি ফুটে ওঠে ওর মুখে। ‘কেন, ওমর শরীফের মতো দেখতে ছিল সে?’, আমি স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করি। ‘আমার চোখে তো তাই মনে হত’, কৌতুক চোখে পাল্টা জবাব তার। ‘কি যে ভালোবেসেছিলাম ওকে, কি যে আনন্দে ছিলাম দু’জনে’, যেন বহুদূর থেকে ওর মৃদু কণ্ঠ ভেসে আসে।
‘জানো, কায়রোর আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে কি উত্তেজনা আমাদের। সকাল-সন্ধ্যা দু’জনে হাত ধরাধরি করে তাহরীর স্কোয়ারে যাই, আন্দোলনকারীদের সঙ্গে গলা মেলাই, পুলিশের তাড়া খেয়ে দৌঁড় দেই দু’টো শিশুর মতো। একসময়ে শ্রান্ত-ক্লান্ত হয়ে নাইলের পাশে বসি ওর কাঁধে মাথা রেখে’, অনেকটা ফিসফিসিয়ে বলে সে। এরপর সোফি চুপ করে যায় – আনমনা আমার ঘরে মুকতাদিরের আঁকা চিত্রকর্মটির দিকে তাকিয়ে থাকে। বুঝতে পারি ওর মনের মধ্যে এক উথাল-পাথাল বয়ে যাচ্ছে, চোখের সামনে সোফি সেই সব দিনের ছবি চলচিত্রের মত দেখতে পাচ্ছে, এই শহর, এই দপ্তর, এই আবেষ্টনী ছাড়িয়ে ওর মন ঘুরপাক খাচ্ছে কায়রোর পথে পথে ওর ‘ওমর শরীফের’ সঙ্গে।
‘তারপর?’, মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করি আমি। ‘তারপর?’, আমার প্রশ্নটিই দ্বিরুক্তি করে সে। ‘তারপর একদিন আমাকে না বলে কয়ে সে চলে গেল। জানলাম সে নাকি এক মিশরীয় মেয়ের প্রেমে পড়েছে’, দু’চোখে তার জলধারা নামে। ‘আমার পৃথিবীটা কেমন যেন ওলোট-পাল্ট হয়ে গেল। অসহ্য হয়ে উঠল কায়রো— আমার কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল। অস্থির হয়ে উঠেছিলাম কায়রো থেকে বের হয়ে আসার জন্যে’, তার গলার ছটফটানি টের পাই। ‘এ সময়ে এ দপ্তরের সুযোগটা এলো। তুমি আমাকে নির্বাচন করলে। আমি নিউইয়র্কে এলাম এই কাজে। তুমি আমাকে বাঁচিয়ে দিলে’, তাঁর সারা চোখে-মুখে কৃতজ্ঞতা ফুটে ওঠে।
‘শোন সোফি, কাজ দিয়ে সময়কে হনন করার চেষ্টা কোর না’, ওর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমি বলি। ‘ওতে কোন লাভ হয় না – ওটা কোন সমাধান নয়’, ব্যাখ্যা করি ওকে। ‘তারচেয়ে অন্য কিছু কর— কত কিছু করার আছে নিউইয়র্কে— নাটক, সিম্ফনি, অপেরা, যাদুঘর। ও সবে মন দাও, উপভোগ করার চেষ্টা কর’, আমাদের কন্যাদের যেভাবে বলি, সে একই ভাবে ওকে বোঝানোর চেষ্টা করি। ‘এই তো আজ সন্ধ্যায় একটা নাটকের দু’টো টিকেট আছে আমার কাছে। যাবে আমার সঙ্গে?’, জিজ্ঞেস করি আমি। ভীষণ খুশী হয় সে, কিন্তু তারপরই যে কোন ফরাসী তরুনীর মতো বলে, ‘কিন্তু আমি তো সেজে আসি নি।’ আমি হেসে ফেলি, বলি,’ এটা একটা সাধারণ প্রেক্ষাগৃহের নাটক, এটার জন্য সাজতে হবে না। আর তা’ছাড়া, তুমি এমনিই সুন্দরী’। এতক্ষণে তার মুখে হাসি ফোটে।
এরপর কোথাও আমন্ত্রণ এলেই সোফিকে জিজ্ঞেস করি, সে যাবে কি না। লক্ষ্য করি যে অন্য সহকর্মীরাও ওকে নানানভাবে আমন্ত্রণ জানান। হয়তো সোফির বিষণ্ণতা, একাকীত্ব তাঁরাও অনুভব করতে পেরেছেন। ইতিমধ্যে দেখি যে সোফিও অন্যদের দিকে হাত বাড়িয়েছে। আমাকে একদিন জিজ্ঞেস করে যে একটি প্রজাপতি প্রদর্শনী দেখতে যাবো কিনা তার সঙ্গে। যাই তার সঙ্গে। আর একদিন আমাদের সবাইকে আমন্ত্রণ জানায় তার বাড়ীতে এক ছুটির দিনে। সবাই মিলে প্রচুর হৈ চৈ হয়। টের পাই যে বিষাদ আর বিষণ্ণতার খোলস থেকে ধীরে ধীরে সোফি বেরিয়ে আসছে।
বিকেলের দিকে কাজের শেষে দু’ কাপ কফি নিয়ে আমরা বসি। সোফি ওর পরিবারের গল্প করে। একদম গ্রামের মেয়ে সে – প্যারিস থেকে ১০০ মাইল দূরে ওদের গ্রাম। অসুস্হ মা বাড়ীতে।বড় বোন বিবাহিতা, প্যারিস থাকে। এক ভাই আছে — আজ ২০ বছর মা-বোনদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখেনি। মরক্কোর এক মেয়েকে বিয়ে করে রাবাতে সংসার পেতেছে। ভাইয়ের কথা বলতে গিয়ে ওর চোখে বেদনার ছায়া নামে। বাবাকে সোফির মনে নেই। ওর দু’বছর বয়সে সে বাবাকে হারিয়েছে। খুঁটে খুঁটে সে আমাদের কন্যাদের কথা জিজ্ঞেস করে— কেমন দেখতে তারা, কি করে তারা আমার সঙ্গে। আমি আমাদের কন্যাদ্বয়ের গল্প বলি, কি তৃষিত চোখে যে সোফি সেই সব গল্প শোনে । আমি বুঝতে পারি, আমার মাঝে সে তার না-পাওয়া বাবাকে খোঁজে।
এমনি করে দিন গড়িয়ে চলে— দিন থেকে মাস, মাস থেকে বছর। সোফিকে দেখে আর ‘বিষন্ন প্রতিমার’ মতো মনে হয় না । এখন সে উচ্ছল, প্রানবন্ত, টগবগ করছে প্রানপ্রাচু্র্য্যে। বহু কিছু করে সে, অনেক বন্ধুবান্ধব তার, কাজ করছে খুব ভালো— আমি চেয়ে চেয়ে দেখি আর মনে মনে খুশী হই। মাস খানেক আগে খুব মন দিয়ে মাথা নীচু করে কিছু একটা লিখছিলাম। চোখ না তুলেই বুঝতে পারি যে কেউ একজন এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়। মাথা তুলে দেখি, সোফি — আহবান জানাই আসতে, বসতে বলি। হাতের কাজ রেখে ওর দিকে তাকাই।কেমন যেন একটু উদভ্রান্ত লাগছে ওকে।এদিক ওদিক তাকায়, নখ খুঁটে, কপালের ঘাম মোছে।
‘কি হয়েছে?’, জিজ্ঞেস করি ওকে। ,আমি ….আমি’, আমতা আমতা করে সে, আমার চোখে চোখ রাখে না। জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেল যে, সে আরো উচ্চপদের একটা কাজ পেয়েছে জিনিভাতে, কাজটাও অন্যরকমের, আর ওখান থেকে প্যারিস খুব কাছে— অসুস্হ মা’কে প্রায়শই দেখতে পাবে সে। ‘বাহ, খুব ভালো খবর। আন্তরিক অভিনন্দন!’, সব শুনে আমি বলি। ‘কিন্তু আমার ভালো লাগছে না’, তার চোখ ছল ছল করে। ‘কেন?’, জিজ্ঞেস করি আমি। ‘এখানকার সহকর্মী, বন্ধু-বান্ধবদের জন্য খারাপ লাগছে। এ শহর ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। আর তা’ছাড়া’, একটু থামে সে, ‘তোমাকে ছেড়ে যেতে খারাপ লাগছে’, এবার চোখ দিয়ে জল গড়ায় তার। মনে পড়ল, আমাদের কন্যারা আমাকে যখন ছেড়ে যায়, তখন ঠিক এই কথাটাই বলে,’ তোমাকে ছেড়ে যেতে খারাপ লাগছে, বাবা’।
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠি। ওর পাশে গিয়ে ওর মাথায় হাত রাখি। সে মুঠো করে আমার হাতটা ধরে। আমি মৃদু হেসে খুব নরম গলায় ওকে বলি, ‘সোফি, এটা একটা বিরাট সুযোগ। তোমার সামনে প্রচুর সম্ভাবনা। এ সুযোগ তার দরজা খুলে দেবে। তা’ছাড়া মা’য়ের কত কাছে থাকতে পারবে— যেটা খুব দরকার।’, আশ্বস্ত করার চেষ্টা করি আমি।’আর আমরা তো প্রায়শই জিনিভাতে যাই। দেখা হবে অনেকের সঙ্গেই’, ভরসা দেই তাকে। টের পাই ফোঁপাচ্ছে সে। আমি তার মাথায় চুমু দেই আলতো করে।
একসময়ে উঠে দাঁড়ায় সে— চোখ মোছে। আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগোয়। তারপর হঠাৎ করে পেছন ফিরে বলে, ‘তোমাকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করবে’। কিছুটাক্ষণ তাকিয়ে থাকে আমার দিকে, তারপর ধীর গতিতে বেরিয়ে যায়। সোফির যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করে কেন জানি আমার রবীন্দ্রনাথের ‘শেষ চিঠি’ কবিতার শেষ দু’চরন মনে পড়ে যায়, ‘তোমাকে দেখতে বড্ডো ইচ্ছে করছে।’ ..আর কিছুই নেই।
সেলিম জাহান
ড: সেলিম জাহান একজন অর্থনীতিবিদ ও লেখক। কর্মজীবনে বছর দু’য়েক আগে জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের পরিচালক ও মূখ্য লেখক হিসেবে অবসর গ্রহন করেছেন।তার আগে তিনি জাতিসংঘের দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগের পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৯২ সালে জাতিসংঘে যেগদানের আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন দীর্ঘ ২৫ বছর। উপদেষ্টা ও পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্হাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে।
ড: জাহান লেখালেখি করছেন গত চার দশক ধরে। আশির দশকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এ সাময়িকীতে নিয়মিত লিখেছেন। রেডিও ও টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জননন্দিত উপস্হাপক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৯১-৯২ সালে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির মহাসচিব ছিলেন।ইংরেজী ও বাংলায় তাঁর প্রকাশিত গ্রণ্হের সংখ্যা এত ডজন এবং প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা দেড় শতাধিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্হ: বেলা-অবেলার কথা, স্বল্প কথার গল্প, পরানের অতল গহিণে, শার্সিতে স্বদেশের মুখ, অর্থনীতি-কড়চা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনীতি, Overcoming Human Poverty, Freedom for Choice, Development and Deprivation.