শ্রীচৈতন্য
সমুদ্রে ছড়ালো জাল। উঠে এ’ল ইয়া লম্বা দেহ। আজানুলম্বিত হাত। ধপধপে সমূহ শরীর। কষ বেয়ে রক্ত নামে।
গোঁ গোঁ ক’রে এমন চেঁচায়। তাতেই বিদীর্ণ যেন নীলজল আর নীলাকাশ। সমুদ্রে ফেলেছে জাল, আর জেলে পেয়ে
গেছে ভয়। এ’লোক সামান্য নয় ভূতপ্রেত হবেই নিশ্চয়। ‘ যাই গা ওঝার কাছে ‘ । ওঝা খুব ভালো ঝেড়ে দেয়।
ধুলোকে মুঠিতে নিয়ে কী’যে বলে আর যত ভূত, জব্দ হয়, ক্রমান্বয়ে, এক, দুই তিন, সাড়ে তিন। ইয়া লম্বা দেহ নাকি
কাঠের ভেতরে ঢুকে গেল। ইয়া লম্বা দেহ নাকি সাগরের নীলাভতাহেতু জলের ভেতরে গিয়ে লাবডুব লাবডুব ক’রে,
মিশেছে অতল জলে। আর তার প্রকীর্ণ ভাবনা দিচ্ছে সাঁতার আজ পাইনের একটি ছবিতে।
নীবিস্রংসন
মণিকর্ণিকা ঘাট মড়াপোড়ার ছাই-এ পিছল হয়ে আছে । কত সামলে চলতে হয়। তুমি তো এ’সব বোঝো না,
কাকেই-বা বোঝাব। আমি নিজেই বুঝি না, তাই মড়া সরিয়ে নিতে বললাম। তুমি বললে ‘ মড়াকেই সরতে ব’ল’।
‘মড়া কী সরে’ – আমার এই কথায় তুমি দৃশ্যবাস্তবতার ওপারে চলে গিয়ে আরেকটি দৃশ্যের মহিমা রচনা করলে,
যা মূলত শ্রাব্য। অবশ্য আমরা যারা পাঠক দৃশ্য, শ্রাব্য, গন্ধের ভেদ করি না। আদ্যন্ত ওপার থেকে নিজের শক্তি
বোঝালে। কিন্তু এবার ব’ল তো, প্রকৃতি, অবচেতনের পিছল পথে তোমাকে পিছলে যেতে দেখে যদি ‘ নীবিস্রংসন ‘,
‘ নীবিস্রংসন’ বলে চেঁচিয়ে লোক জড়ো ক’রে দিই, তাহলে ভালো হবে তো?
প্রলয়পয়োধিজলে
টিউশন থেকে বেরিয়ে আসছিল কালোমানিক। হাতে বই, পায়ে চপ্পল। রোদ কমে আসা বিকেলে। নিকাশনালার
ধারে, প্রেমিকাকে দেখেছিল অন্তরঙ্গ মুহূর্তে, অন্য আরও বুকে। তারপর ছুটে, নিতান্ত অভিমানে, ঝড়ঝাপটার ভেতর
দিয়ে, আমাদের শুকনো ভাবুকতার ভেতর দিয়ে, ডান হাতের গোকর্ণাকৃতি জলে ভেসে উঠলো। প্রলয়পয়োধিজলে
ডুবে গেল জগৎসংসার।
অহংগ্রহোপাসনা
বললে বিশ্বাস করবে না হয়তো অথবা আনমনা হয়ে তাকিয়ে থাকবে রাস্তার চলাচলের দিকে। অথবা বামদিক
দিয়ে যে পথ এসে মিশেছে তা তোমার পছন্দের নয় কখনও। পছন্দের নয় সেই পথের পাশের ঝাউবনগুলি।
পছন্দের নয় টুপটুপ বৃষ্টির পর হালকা হাওয়ায় পাতার দুলুনি। কারণ তোমার প্রাক্তনের স্মৃতি সংলিপ্ত,
আলোছায়াদের কেউ যেন অভিসন্ধিবশত মনোবিকলনের সাপেক্ষে সাজিয়ে রেখে ফিরে গেছে৷ বললে বিশ্বাস
করবে না হয়তো তোমায় ভাবতে ভাবতে যখন ঢেকুর উঠেছে আমার, তখন খণ্ড খণ্ড ক’রেই দেখেছি।
একটা সংমিশ্রিত পূর্ণাবয়ব। একটা আখাম্বা বোদা সন্দর্ভে তোমার মুখ আমি কতবার দেখেছি। এখন দেখতে
পাই না। অহংগ্রহোপাসনায় আলাদা হতে পারছি না। আমার ভয় করছে। তোমাকে আলাদা ক’রে আমার
ভেতরে নিতে চাইছি অথচ তুমি আলাদা হচ্ছ না, চলাচলের দিকে তাকিয়ে থাকা অপর আমার, মুখে
বিন্দু বিন্দু ঘাম, চুলে হাওয়া।
অনির্ণয়
সে’জন কেমন হবে ? মোটাসোটা, গোলগাল নাকি তন্বী, পীনপয়োধরা। অধরে গাম্ভীর্য ফুটবে নাকি স্থূল সাবেকি
মস্করা। এ’সব ভেবেছি আর আতান্তর বেড়েছে শুধুই। সে’জন যেমনই হোক পেতে রেখে শুই, আমার কবিতা৷
নির্ণয়ে সজাগ হয়ে অনির্ণয় বেশি জমা হ’ল। বিরাট চক্রাকারে ঘুরছে চাকতি অনির্ণয়ের। খোঁজ ও খননে রত
ক্লান্ত পাখি, আর ঠোঁট। ক্লান্তি মেখে ঘুমোবে এবার ৷ আবার আলাদা হ’ব, খোঁজ ও খনন শেষে ঘোল খেয়ে
বলব, আহা! কী তক্র খেলাম !
প্রতান
উঠোন ঝেঁটিয়ে পাতা জড়ো ক’রলো মিঠুকাকিমারা। প্রকীর্ণ কবিতা যেন গুপ্তপুঁথি ঘেঁটে অবশেষে, নাগালে এসেছে
আজ, বহুদিন আবিষ্কারহীন। এখন পুঁথির সঙ্গে খসখস শব্দ তুলে, এখন পাতার সঙ্গে খসখস শব্দ তুলে, কত দূরে,
কত কাছে, আসবে-যাবে মিঠুকাকিমারা।
শুভম চক্রবর্তী
শুভম চক্রবর্তীর লেখালেখির সূত্রপাত ২০১০ সাল নাগাদ অর্থাৎ প্রথম দশকের কবি বলা যায়৷ বাণিজ্যিক-অবাণিজ্যিক নানান পত্রিকায় নিয়মিত তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়। এখনো পর্যন্ত তিনটি কাব্যগ্রন্থ আছে
– শব্দের বিহ্বল ডানা (২০১৭), শরীরপরব (২০১৮), আয়াত (২০১৯)।
কবি ২০১৭ সালে ‘ শব্দের বিহ্বল ডানা’ এর জন্য পেয়েছেন ‘উতল হাওয়া সাহিত্য সম্মাননা’, ২০১৯-এ ।’শরীরপরব’ কাব্যগ্রন্থের জন্য মাসিক কবিতাপত্র পত্রিকার পক্ষ থেকে ‘কবি জয়দেব বসু পুরস্কার’।
সম্পাদিত পত্রিকা – ‘কর্ষণ’, ‘অনপেক্ষ’।
খুব গুরুত্বপূর্ণ এই কবিতাগুলি।