‘রাস্তাটা সোজা আলীকদমের দিকে গেছে’। এই কথাই বারে বারে বলেছিল লোকটা। আরও বলেছিল বেশিক্ষণ হাঁটতে হবে না। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই রেস্ট হাউজে পৌঁছানো যাবে।
এই রেস্ট হাউজ ওদের কোম্পানির নিজস্ব। আগেও একবার এখানে এসেছিলেন জাহেদুল ইসলাম। সে অনেক বছর আগে। তখন ছোট্ট একটা কটেজ ছিল। এখন নাকি পুরনো কটেজটাকে ভেঙে বড় একটা প্রধান বাংলো বানানো হয়েছে। তার সঙ্গে আরও কয়েকটা ছোট ছোট কটেজ। পথে আসতে আসতে অনেক কথাই বলছিল লোকটা। লোকটা গাড়ি চালাচ্ছিল। কিন্তু সে ঠিক ড্রাইভার পদে চাকরি করে না। সে প্রোজেক্ট কোঅর্ডিনেটর। জাহেদুলের মত বড় কর্তাদের সে প্রোজেক্ট সম্পর্কে বাস্তব ধারণাগুলো দেয়। আর সেই ধারণাগুলোর সঙ্গে একটু উচ্চাঙ্গের ভাবসাব যোগ করে বিদেশি সেমিনারে বাহবা কুড়ায় জাহেদুল ও ফরেন এক্সপার্টরা। কক্সবাজার থেকে গাড়ি চালিয়ে আসার সময় অনেক গল্প করছিল। এত বেশি কথা বলছিল যে জাহেদুল বরং ভয় পাচ্ছিলেন অ্যাকসিডেন্ট না ঘটায়। গাড়ি চালাতে চালাতে এত বেশি কথা তার পছন্দ নয়। এই লোকটা নতুন। জাহেদুলের পছন্দ অপছন্দের কথা তার জানার কথা না। আগের মানুষটার নাম যেন কি ছিল? মনে পড়েছে নিখিল।
-‘নিখিল কেমন আছে বলতে পারো?’ মনের অজান্তেই প্রশ্নটা কখন মুখ দিয়ে বের হয়ে গেছে বুঝতে পারেননি জাহেদুল। প্রশ্নটা করেই একটু অপ্রস্তুত বোধ করলেন তিনি। নিখিলের কথা তো জানতে চাননি। বরং প্রাণপণে ভুলতেই চেয়েছেন।
-‘স্যার, নিখিল নামে তো আমাদের কোম্পানিতে কাউকে আমি চিনি না। কোন পোস্টে ছিলেন?’
-‘এই তো তোমার মতোই। তোমার গ্রামের বাড়ি কই?’ কথাটাকে চাপা দেয়ার জন্য ইচ্ছা করেই অন্য প্রসঙ্গ তুলতে চাইলেন জাহেদুল। কিন্তু লোকটি রিয়ার ভিউ মিররের ভিতর দিয়ে অদ্ভুতভাবে হাসলো। যেন বুঝতে পেরেছে কিছু।
-‘আপনি কি স্যার, আগেও এখানে আসছিলেন?’
-‘হ্যা বছর দশেক আগে।’ উত্তরটা একটু নিচুস্বরে বলে, কথাবার্তা বন্ধ করার জন্য ইচ্ছা করে মোবাইল ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন জাহেদুল। লোকটিও কি একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল? নইলে রাস্তার অত কিনারে চলে যাবে কেন? হার্ড ব্রেক কষার তীব্র শব্দে চমকে ওঠার আগেই সামনের সিটের সঙ্গে জোরে বাড়ি খেয়েছিলেন তিনি।সামলে নিয়ে সভয়ে দেখলেন গাড়ি রাস্তা ছেড়ে পাহাড়ি খাদের দিকে চলে এসেছে অনেকটা। ভাগ্যিস সময়মতো ব্রেক কষতে পেরেছে লোকটা। নইলে এতক্ষণে অতলে নেমে যেতে হতো।
-‘দেখে চালাতে পারো না?’ লোকটা মনে হয় শুনতে পায়নি। গাড়ি আবার চালানোর চেষ্টা করছে সে। কিন্তু গাড়িটাও বোধহয় ভয়ে থমকে গেছে। আবার চলতে কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। লোকটা গাড়ি থেকে নেমে এবার বনেট খুলে ইঞ্জিন পরীক্ষা করছে। এই সুযোগে জাহেদুলও নেমে এলেন গাড়ি থেকে। আজকের দিনটা মেঘলা হলেও এখনও বৃষ্টি শুরু হয়নি। বর্ষাকাল বৃস্টি যখন তখন হতেই পারে। আগের বারও বর্ষাকালেই এসেছিলেন তিনি। প্রতিবছর বর্ষাতেই এখানে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি শুরু হয়। এই কর্মসূচি হলো কর্পোরেট সোশাল রেসপনসিবিলিটি। তাদের প্রতিষ্ঠানের তামাকের ব্যবসা। বান্দারবানের কয়েকটি জায়গায় তামাকের চাষ করার জন্য জমি বরাদ্দ রয়েছে। প্রতিবছর বর্ষায় বৃক্ষরোপণও করে কোম্পানি। গতবারের পর জাহেদুল বদলি হয়ে যান ইন্দোনেশিয়ায়। বেশ চেষ্টা তদ্বির করেই বদলিটা নেন তিনি। কোম্পানিও চেয়েছিল তাকে যত দ্রুত সম্ভব বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে দিতে। এত বছর পর বান্দরবানে এসে অন্যরকম এক বিষণ্নতায় মনটা আচ্ছন্ন হয়ে আছে তার। গাড়ি থেকে নেমে বরং ভালো লাগলো। এসি গাড়িতে বসেছিলেন বলে অরণ্যের তাজা গন্ধটা এতক্ষণ পাননি। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বুক ভরে সতেজ গন্ধটা টেনে নিলেন। মনটাও ভালো হয়ে উঠল অকারণে। লোকটা তখনও গাড়ির ইঞ্জিনের উপর অবনত হয়ে আছে। জাহেদুল তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে সে সোজা হলো। তারপর এই অবস্থার সঙ্গে সম্পূর্ণ বেমানান একটা ঝকঝকে হাসি দিয়ে বললো,
-‘গাড়ি ঠিক হতে মনে হয় কিছুক্ষণ লাগবে স্যার। ব্যাটারিটা হঠাৎ ডাউন হয়ে গেল কেন বুঝতে পারছি না।’
-‘তাহলে উপায় কি? অন্য গাড়ি পাওয়া যাবে না? কক্সবাজার অফিসে ফোন করে বলে দাও আরেকটা গাড়ি পাঠাতে।’
-‘ফোনটা কাজ করছে না স্যার। মনে হয় এখানে নেটওয়ার্ক নাই।’
জাহেদুল নিজের মোবাইলটা পকেট থেকে বের করে দেখলেন, সত্যিই, তার সেটটাও নেটওয়ার্ক দেখাচ্ছে না। কি মুশকিল।
-‘আপনি স্যার চাইলে হেঁটে এগোতে পারেন। রেস্ট হাউজ বেশি দূরে না। খুব বেশি হলে একঘন্টা লাগবে হেঁটে যেতে’।
-‘আর তুমি কি করবে?’
-‘আমি স্যার, এই রাস্তায় অন্য কোন গাড়ি আসলেই স্টার্ট দেয়ার ব্যবস্থা করবো। তারপরে গাড়ি নিয়ে রেস্ট হাউজে চলে আসবো। রাস্তায় যদি আপনাকে পেয়ে যাই তাহলে তো হয়েই গেল। মনে হয় পাবো স্যার। এই রাস্তাটা সোজা আলী কদমের দিকেই গেছে’।
জাহেদুলের মনে হলো পরামর্শটা খুব খারাপ না। এখানে রাস্তার মধ্যে গাড়ির আশায় বসে থাকার চেয়ে ঘন্টাখানেক হেঁটে রেস্ট হাউজে চলে যাওয়াই বরং ভালো। পাহাড়ি প্রকৃতির সৌন্দর্যও দেখা যাবে। সুন্দরের প্রতি তার আকর্ষণ সবসময়েই একটু বেশি।
-‘আমার লাগেজটা..’ কথাটা শেষ করার আগেই লোকটি আবার অদ্ভুত ভঙ্গীতে হাসলো।
-‘লাগেজ নিয়ে ভাববেন না স্যার। আমি গাড়ির সঙ্গেই নিয়ে আসবো। আপনি শুধু এই রাস্তা ধরে সোজা এগিয়ে যান। এটা সোজা আলী কদমের দিকে গেছে’।
আলীকদম। নামটা ঢাকায় বসে প্রথমবার যখন শুনেছিলেন তখন কোন রোমাঞ্চ জাগেনি। নেহাতই সাদামাটা একটা নাম। পাহাড়ি একটা জায়গার নাম আরও কাব্যময় হওয়া উচিত বলে তার মনে হয়েছিল। কিন্তু পরে শুনেছিলেন এই নামকরণের ইতিহাস। আলোহক্যডং থেকে এই অরণ্য-পাহাড় ঘেরা উপজেলার নাম হয়েছে। অন্য ইতিহাসও রয়েছে। সুপ্রাচীন কালে আলী নামে একজন দরবেশ এখানে বসতি করেছিলেন। তার পদস্পর্শে ধন্য হয়েছে পাহাড়। প্রকৃতি কি সত্যিই মানুষের স্পর্শে কখনও ধন্য হয়? কথাটা সেসময়ই মনে এসেছিল তার। প্রশ্নও করেছিলেন নিখিলকে। তার এ ধরনের চিন্তাতরঙ্গ বিনিময়ের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম ছিল নিখিল। বিনিময় মনে হলেও নিখিল কোন কিছু বিনিময় করতো না। শুধু নিরবে শুনে যেত। পাহাড়ের ছেলে। তার চেহারায় কঠিন শিলার দৃঢ়তা ছিল। সবটুকু আবেগ নিজের ভিতরে সংহত রাখতে জানতো সে। আর সেই কঠিন পাহাড়েরই ঝর্ণা হয়ে ছিল তার স্ত্রী। সুষমা। নামের সঙ্গে সত্তার এমন সার্থক মিল আর কখনও দেখেননি জাহেদুল। যে তিন মাস এখানে ছিলেন সে সময়টা, বান্দরবানের সবুজ বর্ষা, নিবিড় অরণ্য, পাহাড়ি জলধারা আর সুষমা এক হয়ে গগাঁর আঁকা তাহিতির ছবি হয়ে গেছে।
কতক্ষণ ধরে হাঁটছেন তিনি?এখনও কি একঘন্টা হয়নি? রাস্তাটা খুব পরিচিত লাগছে যদিও। অথবা রাস্তাটা পরিচিত নয়। পরিচিত এই আরণ্যক পূবালী বাতাস।
চারপাশে সবুজ বনানী। দূরে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের গা বেয়ে ঝর্ণার উচ্ছাস। সকালে বেরিয়েছিলেন কক্সবাজার থেকে। তারপর কতক্ষণ গাড়ি চলেছিল আর হাঁটছেন কত সময় ধরে তা কিছুতেই পরিষ্কার করে ভাবতে পারছেন না। মাত্র কয়েক ঘন্টায় মানুষের স্মৃতি এভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে? অন্যদিকে দশ বছরের পুরনো ঘটনাগুলো এমনভাবে চোখের সামনে ফিরে আসছে যেন সদ্য নাটকটি মঞ্চস্থ হলো, কুশীলবরা এখনও মঞ্চ ছেড়ে যায়নি।
মোবাইলটায় শুধু যে নেটওয়ার্ক নেই তাই নয়, চার্জও ফুরিয়েছে মনে হয়। অন্ধকার করে আছে মুখ। ইশ, পাওয়ার ব্যাংকটা রয়ে গেছে লাগেজে। মোবাইল থাকলে আর ঘড়ির দরকার নেই। কিন্তু জাহেদুল সবসময় হাতে ঘড়ি পরেন। তার ঘড়ির শখ আছে। দেশবিদেশ থেকে ব্র্যান্ডের ঘড়ি সংগ্রহ করেন। কিন্তু এখন হাতে কোন ঘড়ি নেই। আশ্চর্য তো। ফসিল ব্র্যান্ডের নীল ঘড়িটা তার খুব প্রিয়। কখন এটা হাত থেকে খুলে পড়ে গেল? রাস্তায়? না গাড়ির ভিতরে?
দিনটা কেমন যেন, মেঘলা, সূর্যহীন, মুখ গোমড়া। সূর্য নেই দেখে ঠিক বোঝাও যাচ্ছে না বেলা কত হলো। দুপুরের পর বন পাহাড় থেকে এক ধরনের সুগন্ধ ভেসে আসে। একথা সুষমা বলেছিল। কোনদিন বিকেলে বেড়াতে বের হলেই এ কথা বলতো সুষমা। কথাটা তার বিশ্বাসও হতো। তিনিও তখন গন্ধটা অনুভব করতেন। তার তখনও সন্দেহ হতো এই গন্ধটা বন পাহাড় থেকে নয় সুষমার শরীর থেকেই আসে। আজকে তিনি নিঃসন্দেহ হলেন ওটা ছিল সুষমারই বিশেষ সৌরভ।
রাস্তাটা চলছে তো চলছেই। যেন অনন্তকাল চলবে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে না যদিও। কোন গাড়িও চলছে না। আগে মাঝে মাঝে বুনো হাতির পাল এই রাস্তা পার হয়ে এক পাশের জঙ্গল থেকে অন্য পাশে যেত। যেদিন বুনো হাতির পাল বের হতো সেদিন এখানে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যেত। আজকেও কি বুনো হাতির পাল বেরিয়েছিল? গাড়ির চালকরা এই খবরটা পায় কিভাবে? মোবাইলে?
কিন্তু এখানে তো মোবাইল কাজ করে না। জাহেদুল আবার পকেট থেকে অযথাই মোবাইলটা বের করলেন। চার্জ ফুরালে নেটওয়ার্ক থাকলেও সে চলবে না এটা জানা সত্ত্বেও।
পাহাড়ী পথ। সড়কটা পাকা। কিন্তু পাহাড়ের ভিতর দিয়ে যে সরু পথগুলো গেছে সেগুলো পায়ে চলা। কোনটা চড়াই, কোনটা উৎরাই। হয়তো নেমে গেছে কোন পাহাড়ি গ্রামের দিকে। সুষমা কিন্তু নিছক গ্রাম্য পাহাড়ি মেয়ে ছিল না। নিখিলের মতো সেও বেশ ভালো লেখাপড়া জানতো, কবিতাও লিখতো। বাংলায় নয়। নিজস্ব ভাষায়। বেশ কয়েকবার তাকে পড়ে শুনিয়েছে। নিখিল স্বল্পবাক। সুষমা প্রগলভা।
ওরা পরষ্পরকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিল। কিন্তু ওদের সম্পর্কের ভিতর নিশ্চয়ই ফাটল গড়ে উঠেছিল। নইলে কেন জাহেদুল পা বাড়াতে যাবেন? সত্যিই কি ফাটল ছিল? প্রশ্নটা দশ বছর আগে যখন নিজেকে করেছিলেন তখন উত্তর ছিল অ্যাফারমেটিভ। কারণ জাহেদুল যদি ওদের সম্পর্কের ভিতর সমস্যার কথা স্বীকার না করেন তাহলে তার নিজের আচরণগুলো অযৌক্তিক হয়ে যায়। সহানুভূতিশীল প্রেমিক থেকে নিজের কাছেই তিনি পরিণত হয়ে যেতেন সামান্য লম্পটে। হয়তো একারণেই তিনি ভাবতেন সুষমার প্রকৃত মূল্যায়ন নিখিল কখনও করতে পারে না। নিখিল যখন সুষমাকে ভালোবেসেছে তখনও ওরা দুজনেই নিছক কিশোর কিশোরী।সে বয়সের প্রেম আর মিউজিকাল চেয়ার অনেকটা একই রকম। যে যার পাশে বসে পড়তে পারে। তরুণ যুগলদের বিয়ের ব্যাপারটাও জাহেদুলের মনে হতো নিছক সামাজিক রীতিকে সম্মান, অভ্যাস, গড়পরতা দৈহিক আকর্ষণ আর গতানুগতিকতার মিশেল। সুষমা আর নিখিলের সম্পর্কটা তার কাছে খুব সাদা মাটা বলেই মনে হয়েছিল। নিখিলের এমন কি যোগ্যতা রয়েছে যে, সে সুষমার মতো নারীকে সারাজীবন ধরে রাখতে পারে? সুষমার পাশে তার একমাত্র নিজেকেই যোগ্য বলে মনে হতো বলেই নিখিলকে আরও বেশি অযোগ্য মনে হয়েছিল হয়তো। কিন্তু দশ বছর পরে এখন তার কেন যেন মনে হয়, সুষমা আর নিখিল পরষ্পরের জন্যই জন্মেছিল। তিনিই ছিলেন অযোগ্য অনুপ্রবেশকারী। এই অস্বস্তিকর সত্যটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার জন্য আবার সুষমার সৌন্দর্যের চিন্তায় অবগাহণ।
একথা ঠিক যে, সুষমার মনোযোগ তিনি পেয়েছিলেন। সেটা নিছক নিখিলের উর্ধতন বলে নয়। সেরকম তো আরও ছিল কত। তার দিকে সুষমার তাকানোর ভঙ্গি, তার কথার দিকে সবিশেষ মনোযোগ, তার সুবিধা অসুবিধার দিকে যত্নময় সেবা, তার সাহচর্যে আনন্দ পাওয়া এসবেই কি পুরোটা সীমাবদ্ধ ছিল? সবটাই সামাজিকতা? নেহাতই সাধারণ বন্ধুত্ব বা সৌহার্দ্য?জাহেদুলের দিক থেকে ঠিক কী ছিল? জাহেদুল দশ বছর পরে আবার প্রশ্নটা নিজেকে করলেন। সুষমা সুন্দরী ছিল নিঃসন্দেহে। তার প্রতি শারিরীক আকর্ষণ জন্মানো খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু সে ছিল অন্যের স্ত্রী। অন্যের স্ত্রীর প্রতি শারিরীক আকর্ষণকে নৈতিক সমর্থন দিতে পারে একমাত্র প্রেম। নিজের অযৌক্তিক কামনাকে যুক্তিযুক্ত ভাবার জন্যই কি তিনি সুষমাকে ভালোবাসেন বলে ভেবেছিলেন? ‘অসম্ভব। সুষমাকে আমি ভালোবাসতাম। অবশ্যই ভালোবাসতাম। আমি ওকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম, শুধু যদি ও রাজি হতো।’ কিন্তু জাহেদুল নিজের এই দৃঢ়বচনেও আস্থা রাখতে পারলেন না।
রাস্তাটা ক্রমশ সরু হয়ে আসছে। চারপাশের নিবিড় অরণ্য ওকে আলিঙ্গন করতে ইচ্ছুক। এই অরণ্যেই কোথাও হারিয়ে গিয়েছিল সুষমা। এমনি এক বর্ষায় সুষমাকে আর কখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। সে তার গ্রামে ফিরে যায়নি। সে পালিয়ে যায়নি শহরেও। সে শুধু জাহেদুলের কাছ থেকে চলে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল প্রকৃতির মধ্যে। গ্রিক দেবতা অ্যাপোলোর কামনা থেকে বাঁচতে দাফনি হয়ে গিয়েছিল লরেল বৃক্ষ। সুষমাও কি এই আলী কদমের নিবিড় অরণ্যের কোন আলোক সঞ্চারী বৃক্ষ হয়ে গেছে?
সুষমা হারিয়ে গিয়েছিল কারণ। না, এখানে তাকে থামতেই হবে। ওই কারণটা নিয়ে ভাবার সময় হয়তো এখনও আসেনি। ওই কারণটা জাহেদুলের নিজের প্রতি সকল সম্মানবোধকেই বিপন্ন করে দেয়। সুষমার হারিয়ে যাওয়া অথবা তাকে কাছে পাওয়া দুটো চিন্তাই জোড়া সাপের মতো কুণ্ডলী পাকানো।
এই চিন্তাগুলোকে এড়িয়ে সামনে তাকাতেই জাহেদুল দেখতে পেলেন রেস্ট হাউজটাকে। কখন যেন একদম রেস্ট হাউজের মূল ফটকের সামনে পৌঁছে গিয়েছেন তিনি।
কই, আগের সেই রেস্ট হাউজটাই তো রয়েছে। এই যে শুনেছিলেন অনেক পরিবর্তন হয়েছে। নতুন নতুন কটেজ হয়েছে। দশ বছর আগেও তো এই রেস্ট হাউজেই উঠেছিলেন এক বর্ষায়। তখন ছিল সন্ধ্যা। বাতাসে ছিল পাহাড়ি বেলিফুলের ঘ্রাণ। আজকেও আকাশটাকে সন্ধ্যার মেঘমালায় ঢাকা বলে মনে হচ্ছে। সন্ধ্যা নেমে এলো কখন? রিসেপশনটাও আগের মতোই আলাদা একটা ছোট্ট ঘরে। রিসেপশনে গিয়ে দাঁড়াতেই ভাবলেশহীন চেহারার এক লোক তার হাতে চাবি এগিয়ে দিল।এ লোকটাকে আগে কখনও দেখেননি তিনি।
রিসেপশন থেকে চাবি নিয়ে সেই আগের কটেজটার দিকেই এগোলেন জাহেদুল। রিসেপশনের লোকটা কোন প্রশ্ন করলো না দেখে একটু বিস্ময় বোধ করলেন তিনি। তাহলে কি অফিস থেকে আগেই জানিয়ে রাখা হয়েছিল যে তিনি আসবেন? লোকটা তাকে চিনলো কি করে? অবশ্য আজকাল ইন্টারনেটের কল্যাণে নাম চেহারা সব কিছুই মুহূর্তের মধ্যে পাঠিয়ে দেয়া সম্ভব। ও নিয়ে মাথা ঘামানোর কোন মানে হয় না। তিনি এখন ক্লান্ত। ভীষণ ক্লান্ত মনে হচ্ছে নিজেকে। একটু আগেও তো দিব্যি হাঁটছিলেন পাহাড়ি পথ দিয়ে। হঠাৎ করে যেন ঝুম বৃষ্টি হয়ে নেমে এসেছে ক্লান্তি। এখন তিনি ঘুমোতে পারলে বাঁচেন। পাহাড়ি বেলি ফুলের চেনা সৌরভটা উপভোগ করতে করতেই কটেজের বারান্দায় উঠে এলেন তিনি।সেই পুরনো কটেজটাই। পাশাপাশি দুটো বেডরুম। তারটা বায়ে নিখিল-সুষমারটা ছিল ডানদিকে।
চাবি দিয়ে নিজের ঘরের দরজাটা খুললেন। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলেন চাবির রিংটা পর্যন্ত একইরকম আছে। জোড়া ঝিনুক লাগানো একটা রিং। দশ বছর আগে। অথচ এই চাবির রিংটার কথাও মনের ভিতর ঠিকই রয়ে গিয়েছিল।
কিছুই হারায় না। মানুষের সব স্মৃতি, সব আনন্দ, যন্ত্রণার অনুভূতি, পাপ, প্রেম, সবটুকু আকাশ জমা থাকে কোন এক গোপন ফোল্ডারে। কিছুই ডিলিট করতে পারে না মানুষ।
ঘরটা খুলে ভিতরে ঢুকতেই কেমন একটা গন্ধ পেলেন জাহেদুল। আগরবাতির সঙ্গে মেশানো মাথার তেলের একটা গন্ধ। খুব পুরনো, ঝিম ধরা গন্ধটা নাকে যেতেই কি যেন মনে পড়বে পড়বে মনে হলো। গন্ধেরও স্মৃতি থাকে। যে কোন ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে গন্ধের স্মৃতি। মায়ের সুতির শাড়িতে হলুদের গন্ধ, বাবার শার্টে কাগজ আর কালির গন্ধ একাকার হয়ে মিশে থাকে শৈশবের সঙ্গে। স্কুলের কথা ভাবলেই ক্লাসরুমে চকের গুঁড়ো মাখা ব্ল্যাকবোর্ড, টিফিনবক্সে আটকে থাকা খাবার, শিশুদের ঘামের গন্ধের ছেঁড়াখোঁড়া এলোমেলো পেইন্টিং হয়ে যায়। এই গন্ধটার সঙ্গেও যেন মিশে আছে বহু পুরনো কোনো জীবনের গল্প। সুষমার স্মৃতির সঙ্গে এই গন্ধটা কেন মিশে গেল কে জানে।
ঘরটা ঠিক আগের মতোই রয়েছে। একদিকে একটা লম্বা সোফা। অন্যদিকে টেবিল চেয়ার। একটা আলমারি আর জানালার পাশে বড়সর সেই খাট। তিন মাসের কক্সবাজার জীবনে মাত্র এক সপ্তাহ ছিলেন এই রেস্ট হাউজে। সেই একটি সপ্তাহের কথা সচেতনভাবে তিনি ভুলতে চেয়েছেন দশ বছরে। কিন্তু অসংখ্যবার তারা ফিরে এসেছে নিয়ন্ত্রণহীন স্বপ্নে।
ক্লান্ত পায়ে খাটের দিকে এগিয়ে গেলেন জাহেদুল। টান টান করে বেডকভার পাতা। খাটের উপর বসতেই চোখে পড়লো একটা মোটা নোটবই। লেদারে বাঁধানো এ ধরনের নোটবই বা ডায়রি তাদের কোম্পানির। প্রতিবছর জানুয়ারি মাসে তারা এই ডায়রি আর ক্যালেন্ডার উপহার দেন ক্লায়েন্টসহ বিশিষ্টজনদের। কোম্পানির রেস্ট হাউজে যারা আসবে সেই অতিথিদেরও একটি ডায়রি সৌজন্য উপহার দেয়া হয়। কিন্তু ডায়রিটা থাকার কথা টেবিলের উপর। এটা খাটে কেন? প্রশ্নটা তার নিউরনে ঘুরপাক খাবার আগে তিনি সেটা হাতে তুলে নিলেন। ডায়রিটা তার হাতের উপর খুলে গেল। পাতাগুলো সাদা হওয়ার কথা। কিন্তু এটার প্রতি পাতায় লেখা রয়েছে। হাতের লেখাটা জাহেদুলেরই। এখন তার হাতের লেখা একদম ভালো নয়। এখন তিনি ল্যাপটপের কি বোর্ডে আঙুল না ছুঁইয়ে কিছু লিখতে পারেন না। এখন হাতের লেখা বিচ্ছিরি হয়ে গেছে। হাতে বেশিক্ষণ লিখতে গেলে আঙুল ব্যথা করে। কিন্তু একসময় তিনি লিখতেন। পাতার পর পাতা, ছাপার অক্ষরের মতো ছিল তার জমকালো হাতের লেখা। তবে ডায়রি তিনি কোনদিন লেখেননি। এটা কে লিখেছে? এই ডায়রি তো তিনি কোনদিন দেখেননি।
প্রথম পাতায় প্রথম এন্ট্রিতে জাহেদুলেরই নাম ও জন্মতারিখ লেখা। পাতা উল্টাতে গিয়ে ক্ষণে ক্ষণে আনন্দ বেদনা বিস্ময়ে চমকিত হতে লাগলেন তিনি। কে যেন এই ডাইরির পাতায় পাতায় তার জীবনের সমস্ত ঘটনা লিখে রেখেছে। তার শৈশবের, কিশোর বয়সের অজস্র ঘটনা, তারুণ্যের অসংখ্য উচ্ছা্স ডায়রির পাতায় পাতায় সাল তারিখ দিয়ে লেখা আছে। পড়তে পড়তে ক্লান্তি, সময়ের প্রবাহ সব কিছু ভুলে গেলেন তিনি। নিজের জীবনটাকে যেন ডায়রির পাতায় আরেকবার দেখে নিচ্ছেন। এই ডায়রি কি তার আমলনামা?কথাটা মনে হতেই মাথার ভিতর এবং বুকের গহনে যুগপৎ ইলেকট্রিক শক অনুভব করলেন তিনি। একই সঙ্গে আতংক ও বিস্ময় তাকে আচ্ছন্ন করে তুললো। আছে, সেই ঘটনাটাও আছে। যে ঘটনিাটি সুষমা আর তিনি ছাড়া পৃথিবীর কারও জানার কথা নয় সেটি এখানে বিস্তারিত বর্ননায় তার অনুভবের প্রতিটি খুঁটিনাটি নিয়ে লেখা আছে। জাহেদুল এই ডায়রি আর পড়তে চান না। এটা বীভৎস এক পাপের খতিয়ান হয়ে উঠেছে।
শুধু অদম্য কৌতুহলবসে শেষের পাতাটা উল্টে দেখলেন আজকের তারিখে লেখা আছে কক্সবাজার আলীকদম সড়কে বেলা সাড়ে ১১টায় মোটর দুর্ঘটনায় মৃত্যু।
বারান্দা থেকে তখন ভেসে আসছিল সুষমার কণ্ঠে একটি পাহাড়ি গান, নিখিলও গলা মিলিয়েছিল তার সঙ্গে, তাদের দ্বৈতকণ্ঠ মিশে যাচ্ছিল পাহাড়ি বেলিফুলের সৌরভের সঙ্গে।
শান্তা মারিয়া
২৪ এপ্রিল, ১৯৭০ ঢাকায় জন্ম।
ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে পড়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স। বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্পে ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহমা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতায় নারী নেতৃত্ব বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন।
১৯৯৭ সালে দৈনিক মুক্তকণ্ঠে সাংবাদিকতা শুরু। এরপর জনকণ্ঠ, আমাদের সময়, রেডিওআমার ও চীনআন্তর্জাতিক বেতার এবং বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরডটকম-এ সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন। সর্বশেষ আমাদের সময় পত্রিকায় ফিচার এডিটর পদে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে চীনের ইউননান মিনজু বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার শিক্ষক। পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটসহ মানবাধিকার বিষয়ক বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনারে পেপার উপস্থাপন করেছেন। কবিতা, গল্প ও ভ্রমণকাহিনি প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়। এ পর্যন্ত ৫টি কাব্যগ্রন্থসহ ১২টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ডস, চীন, ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল এবং বাংলাদেশের প্রায় সবক’টি জেলায় ভ্রমণ করেছেন। জ্ঞানতাপস ভাষাবিদ ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহর পৌত্রী ও ভাষাসৈনিক এবং বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী মুহম্মদ তকিয়ূল্লাহর কন্যা। ভ্রমণ করতে ভালোবাসেন। মিথোলজি ও ইতিহাসপাঠ শান্তা মারিয়ার প্রিয় নেশা।