কাটা ঘুড্ডি গিমাই শাকের দেশে
চিঠি জামপাতা
কিছু কিছু মানুষ পোস্টম্যান হয়ে জন্মায়,
দরজার চৌকাঠে শুভাশিস হয়ে শুয়ে থাকে।
চিঠি আসুক কী না আসুক-
ডাকপিয়ন আমাদের প্রতিদিন চিঠি বিলি করে যায়।
চিঠির খাম নদীর কুর্তায় মোড়া।
কাঁচা হলুদের গুঁড়া, একটি গমগমে হাসির লাইলাক।
চিঠির উপর অক্ষর নেই, নেই ঠিকানা গুট গুট,
লেবুরসের গোপন কালিতে লেখা সাকিন টিপসই।
চিঠির ভিতর লীলুয়া ডাহুক পাখিটি লেখা,
যাত্রাপালায় বিজয়ী বিবেকের মুরাশার ছবি আঁকা,
ধানকানা সুফিয়ার মুরালি গীতি অষ্টপ্রহরে বাঁধা।
কলহাস্য আর দিলখোলা প্রাণ যাত্রাপালার বিবেক,
এ-পালায় কেউ হাঁড়ি কালো মুখ করে তো রাখে
যদি সে রাজারও পুত্র, নাম তার প্রতিপক্ষ ভিলেন।
চিঠির ভিতর এক আঁচল জামের পাতা থাকে
একটি ছিটখই মেয়ে- নন্দিনী তারে ডাকে।
বিশু বলে, রঞ্জন আসবে, ঠিকঠিক দেখে নিও;
রঞ্জন আসে, এই এলো বুঝি- মন বলে আমারও।
কিচেনে মেঘের ঢাকনাটি খুলে দেখো-
হলুদ মিশানো মধুকর ডিঙা নুহের দেশে গ্যাছে।
ছিটখই মেয়েটি বলে রঞ্জন আসবে- আসেও,
কোমরে বাতের ব্যথা, ভাঙা মঠের পাশে, আবারও!
আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে
ঘরে ফেরা একাকী অরুণিমার রেখা
দ্বিধা পাড় খয়েরি জলডিঙায় আঁকা,
উন্মনা অনুসূয়া, ওগো তুমি অনুসূয়া
ভিজে জবজবে সখা দার্শনিক লাকাঁ।
এ-বাড়ি ও-বাড়ি হাওয়ার লটারি খেলা
হাতের আঙুলে এক ময়ূর ময়ূরী বেলা।
আসে গৃহকোণে এই সুতী পরাণের ডোরি
ছায়া ছায়া গানের আভোগ ও সঞ্চারী।
এ-কাল ও-কালে দুপাড়ে দু’খানি নাও
সুতাকাটা বোঁও না বলে ঘুড্ডি উড়ে যাও
পথের আগাম কদমফুলের মরমে ফোটে
একটি কথার তারা যে গোপন আখরোটে।
আমাকে ফেলে আমারেই তুলে নাও সাথে
বঁধু, বধুয়া আজি নিদ নাহি আঁখি পাতে।।
মা ফাতেমা বাবা
কিছুটা উঁচুতে ডালের জেব্রা ক্রসিঙের আড়ালে
পাখির আওলাদ ইতিউতি করে,
বুকের সিন্দুকে খাবার- জুড়ে আসে উড়ান পাখি,
পাখিছানার মুখে তুলে আহার
উড়ান পাখি আবার যেই কী সেই, আমি অনাহারী।
কেউ জানে না- বুঝে উঠতেও পারে না
দুনিয়ার কপালে নামে বুঝি গর্দিশ পড়ন্ত বিকেলে আজ-
ভেঙেচুরে উলটেপালটে মুছড়ে যাবে ভূমিকম্পে,
পিঁপড়ারা জানে আগে- ত্রাহি, ত্রস্ত অপার,
পিঠে ১০গুণ ভারী খাবার- ঘরে ফেরে পিপীলিকা।
শেষাবধি বাঁশের সাঁকো ঘুমায়- তাঁতী রাত্রি জাগে,
দীঘল বাইচের শেষে নদীর শিয়রে একা একা নাও
বাতাসে দোলে, দোলে নিরাগে; অন্ধকারে,
জ্বলে থাকে আলোহীন- কেরোসিন বাঁচাবে বলে
নিভে নিভে জ্বলে থাকে মাটির কুন্ঠিত কুপিবাতি।
নিরলে জানা থাকে একটি পিতলের চামচ,
চামচ মুখে তোলে ক’টি ভাতের দানা মোহর-
নিজের খাবার তুলে দেয় অন্যের মুখের ভিতর।
আমার বাবা- অবিন্যস্ত, পিতলের চামচ
অনির্দিষ্ট উজান ভাটি, বান্ধা হরিণ এক গাছের গোড়ায়,
জাগে পথের দিকে চাওয়া জানালার পাট, মায়াকল-
দৃশ্যপটগুলি আমার বাবা- মা ফাতেমা অবিকল!
নিরবা
কুয়া কী চিরল একটি পাতার গাছ স্থির দাঁড়িয়ে থাকে
প্রতিধ্বনির মজমা ঘোরে মায়া মহিষি ভার্যার চোখে।
ইলেকট্রনিকের খাম্বা এই নীল গগণে তারার পানে চেয়ে
দূরের সাগর যে নামে পিট সিগার প্রতিমা পাণ্ডের পায়ে!
মৌন পাহাড় কুমার ব্রত পাথর ধরি আদি পাড়ার জনক
পাতা কাঁপে শনশন রূপকথারা ঝরে নৈঃশব্দ্যের ডলক।
তাদের দেখে যেই না ভাবি আমিও নিরবা হয়ে থাকি
বোবা হবার সবক নিতে তোমারই নামটি ধরে ডাকি।।
বনগাঁ
ট্রেনে বিহার থেকে, কোলকাতা, বশিরহাট থেকে
পাগল আসে, হেঁটে হেঁটে আসে, ট্রাকে এসে নামে,
তারা বনগাঁ স্টেশনে এসে এমনি এমনি ঘোরে
পাগলেরা ট্রেন থেকে ঝরে পড়ে।
এমন নয় যে সবাই সিদ্ধান্ত নিয়ে বনগাঁ আসে
কেউ আসে বিড়বিড় করে- তাদের হাতে থাকে পুতুল-
পাটের পুতুল, লাল মাটির সরা।
ঝড়ের ঘোড়াধ্বনি কোথাকার গাছ
কোথায় উপড়ে নিয়ে ফেলে- সে খবর ডাকহরকরা
কাকেরাও কী জানে?
বনগাঁয় পাগলেরা খোলা আকাশের অবহেলার
নিচে জটলা পাকায়।
তারা পাতালে, সুরঙ্গ পথে মিঠাপানির মাছ হয়,
পদ্মা গাঙের ডিমওয়ালা ইলিশের হাটে মেশে।
তারা মনের অজানায় পুবদিকে শুঁকে দেখে-
এখনও কী সন্ধ্যা নামে লেবুঝাড়ের তলে!
আর কী-যে বান্নি, বান্নি জুড়ে গানের বৈঠকে নাচে
কৈশোর, কাটা ঘুড্ডি, গিমাই শাকের দেশে-
উজান মাটি ভাটির দেশে উজানিয়া গাঙে
কালিবাউশ পানির তলে ফজলি আমের রঙে
মরতে আসে ধরতে আসে কালো কৃষ্ণের নামে!
নাচে আর মাছ হয়- মিঠাপানির মাছ,
চরে আটকা পড়ে লাফাতে থাকে নানচিল কোরাল।
একসময় বড় বড় ট্রেনের হুইসেলের নিচে গলাকাটা ফোঁপানিগুলো
কোথায় হারায় বিদ্যুৎ কৌশলে,
বনগাঁ স্টেশনে পাগল এসে নামে হাম্বা রবের ঢলে!
ইরাবতী
যে একটু সরে বসে- কিছুটা বিহ্বল, কুন্ঠিত-
তার জামায় শাড়ির আঁচলের গন্ধ থাকে।
হয়তো সালোয়ার কামিজ পরা, কিন্তু গন্ধটা
শাড়ির বতুয়া শাকের মাড়ের, পানিতে ডুবে থাকা
পাটের গীতশ্রী আঁশের!
সরলাঙ্ক পাটিগণিতের মেয়ে জানালায় গির্জার ঘন্টা দেখে, নীরবতা দেখে,
বাইরে মোটরসাইকেলের আওয়াজ শোনে-
ডানাওয়ালা ঘোড়ায় চড়ে বনবাসে যায় রাজার কুমার।
বিষয়গুলোর সঙ্গে তার মায়ের কোন সম্পর্কই নেই,
তা-ও ঘুরে ঘুরে মা-কেই ডাকে-
আনন্দে, বিহ্বলতায় ইরাবতী অকারণ মা-কে ডাকে।
বলে, দেখো দেখো মা- একটু বাতাসেই জামরুল গাছটি
কেমন সরে সরে বসে!
ইরাবতী নার্ভাস, খানিক অপ্রস্তুত- সামান্য হাওয়ায়
জামরুল গাছ- কেমন সরে সরে বসে।
তাই তার চাঁদের সঙ্গে মিল পড়ে।
সে এক কবিকে বলে- ওগো মনখারাপের হাওয়াই বাতি,
সেফটি পিনের সাঁকো-
তোমার পদ্যখানি আর লিখো না ল্যাপটপে,
হাতে লেখো, পুরনো অভ্যাসে শেওলা মিশিয়ে লেখো।
আমাকে যে আড়াল করে লেবুর গন্ধ আঁকো-
তার চিহ্নটুকু দিও;
হাতের লেখায় ইশকুল ছুটির দুরুদুরু বক্ষ মিশে থাক।
তোমার হাতের লেখা পদ্যে এমন শিহরণ ছিল,
ইশকুল ছুটির সর্বনামগুলি ছিল।
পদ্যগুলি হাতে লিখো, আবার হাতে আঁকো
শোন আমার বিলের কবি- সেফটি পিনের সাঁকো!
বদরুজ্জামান আলমগীর
কবি, নাট্যকার, অনুবাদক। জন্মেছিলেন ভাটি অঞ্চল কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে। পড়াশোনা বাজিতপুরে, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বহুদিন দেশের বাইরে- যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় থাকেন।
বাঙলাদেশে নাটকের দল- গল্প থিয়েটার- এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য; নাট্যপত্রের সম্পাদক। নানা পর্যায়ে আরও সম্পাদনা করেছেন- সমাজ ও রাজনীতি, দ্বিতীয়বার, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, পূর্ণপথিক, মর্মের বাণী শুনি, অখণ্ডিত।
প্যানসিলভেনিয়ায় কবিতার প্রতিষ্ঠান- সংবেদের বাগান-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
প্রকাশিত বই:
আখ্যান নাট্য: নননপুরের মেলায় একজন কমলাসুন্দরী ও একটি বাঘ আসে (বাঙলা একাডেমি, ১৯৯৭)
কবিতা: পিছুটানে টলটলায়মান হাওয়াগুলির ভিতর (অপরাজিতা, ২০০৫)
আখ্যান নাট্য: আবের পাঙখা লৈয়া (জন্মসূত্র, ২০১৬)
প্যারাবল: হৃদপেয়ারার সুবাস (ঘোড়াউত্রা প্রকাশন, ২০১৮)
কবিতা: নদীও পাশ ফেরে যদিবা হংসী বলো (ঘোড়াউত্রা প্রকাশন, ২০১৯)
কবিতা : দূরত্বের সুফিয়ানা (ভাঁটফুল, ২০২০)
ভাষান্তরিত কবিতা: ঢেউগুলো যমজ বোন (ঘোড়াউত্রা প্রকাশন, ২০২০)
কবিতাগুলো অসাধারন।