আমাদের বাড়ীটা কিছুটা পুরাতন হিন্দুয়ানী রকমের ছিল, হিন্দুয়ানী কথাটা ভুল বললাম, আসলে হিন্দু বাড়ীই ছিল। মার কাছে শুনেছিলাম আমার দাদা নাকি কোনো এক হিন্দু লোকের কাছ থেকে নামমাত্র দামে কিনে নিয়েছিলেন। মোটা মোটা দেয়াল, জায়গায় জায়গায় খসে পড়ছিল পলেস্তার, স্যাঁতস্যাঁতে আর অন্ধকার, বাড়ীর ভিতর আবার অনেক পুরনো শিউলি কামিনী গাছ, মা অনেক যত্ন করে পানি দিতেন গাছগুলোয়। আমরা চার ভাই বোন ছিলাম। আমি বড়, ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে বসে আছি, বাবাকে একদিন হুট করেই বলে বসলাম– আমি আর পড়ালেখা করবো না। বাবা কিছুক্ষণ কোনো কথা বললেন না, সম্ভবত উনি আমার সাহস দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। এরপর মাকে ডেকে বলতেই শুরু হয়ে গেল চিৎকার আর বকাঝকা। কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্তে স্থির থাকলাম। আমার আসলে পড়ালেখা ভাল লাগতো না, আমার সবসময় চিন্তা করতে ভাল লাগতো, আকাশের দিকে তাকিয়ে শুধু চিন্তা করতাম, একটা আটপৌরে সংসারের স্বপ্ন দেখতাম, যেখানে কোনো অভাব থাকবে না, থাকবে না এরকম কোনো চিৎকার চেঁচামিচি। আমার পরেই মঞ্জু, ও আর আমি পিঠাপিঠি। সামনে পরীক্ষা দিবে। রেনু ক্লাস সেভেনে পড়তো, বেনু ছিল সবার ছোট, স্কুলে তখনো ভর্তি হয়নি, সারাদিন একা একা পুতুল খেলতো। আমি বেনুর কাছে যেয়ে প্রায়ই বসতাম, ওর পুতুল খেলা দেখতাম। বেনু আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে আবার পুতুল খেলতো, মাঝে মাঝে আমাকে বলতো– বুবু আমাকে আর একটা নতুন পুতুল বানিয়ে দাও না, আমি দিতাম। এরকমই চলে যাচ্ছিলো দিন।
বাবা ছিলেন প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। এজন্য আমাদের খুব সাদামাটা দিন কাটাতে হত। কিন্তু আমার এগুলো একদম পছন্দ ছিল না। আমি প্রায়ই এটা সেটা কিনতে চাইতাম, সিনেমা দেখতে যেতে চাইতাম আর মার বকুনি খেতাম। কান্নাকাটি শুরু করলে মা এসে বোঝাতে চাইতেন কিন্তু আমার এসব কিছুই ভাল লাগতো না। আমি কখনো মাকে ঘরের কোনো কাজে সাহায্যও করতাম না।
এই একঘেয়েমি দিনগুলোর মধ্যেই একদিন আমাদের বাড়িতে এলেন সুবলবাবু। দেখতে লম্বা, ফরসা, চুপচাপ ধরনের মানুষ, চল্লিশের মত বয়স। বাবার সাথে এসে উনি প্রায়ই দাবা খেলতেন। অনেক বই পড়তেন আর কি সুন্দর করে কথা বলতেন। আমি হা করে শুধু পর্দার আড়াল থেকে ওনাকে দেখতাম। আমার এখনো মনে পড়ে, প্রথমদিন এসে উনি আমাকে বলেছিলেন– নীলু কেমন আছো? আমাকে এককাপ লেবু চা খাওয়াবে? আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম ওনার এত সহজ স্বাভাবিক আচরণ দেখে মনে হয়েছিল– বাহ কত সুন্দর করেই না বললো। এরকম করে তো আমাকে কেউ বলে না, বললে কি আর আমি এরকম পাগলামো করতাম?
আমার ওনার সাথে গল্প করতে খুব ভাল লাগতো, পরে আবার সেগুলো মনে করে প্রায়ই একা একা হাসতাম। রেনু আমাকে জিজ্ঞেস করতো– এই বুবু হাসো কেন?
আমি ধরা পড়ে গেলে অপরাধীর মতো উত্তর দিতাম– এমনি। একদিন সুবলবাবুর কাছে যেয়ে বললাম– আমাকে রবীন্দ্রনাথের “নৌকাডুবি” বইটা এনে দিবেন আপনি? সেই পাশের বাড়ির মাধবীর মামার কাছ থেকে বইটা আনলাম। এতো সুন্দর বই অথচ ভালো করতে একটু পড়তেই পারলাম। মাধবীটা না কেমন যেন, বলে– মামা ওনার বই ফেরত চেয়েছে।
সুবলবাবু বললেন-নৌকাডুবির চেয়ে তো রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা উপন্যাসটা সুন্দর। ওটা পড়েছো? আমি তোমাকে ওটা এনে দিবো।
আমি বললাম– শুনুন মাস্টারমশাই আমি কি একবারও বলেছি আপনাকে “শেষের কবিতা” বইটা আনতে? যেসব বইয়ে সিনেমায় নায়ক নায়িকার মিল হয় না, আমি সেগুলো দেখিও না, পড়িও না। আমার কান্না পায়। নায়ক নায়িকার মিল হবে না, এটা কোনো কথা হলো নাকি আবার?
সুবলবাবু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, নীলু তোমার কি মনে হয় পাওয়ার ভিতরেই সব আনন্দ, সার্থকতা?
আমি আমার অভিমানী ঠোট ফুলিয়ে বললাম– অবশ্যই মিল হতেই হবে।
সুবলবাবু এবার জোরে হেসে ফেললেন, বললেন– আচ্ছা, তোমার কথাই ঠিক, তোমাকে নৌকাডুবি বইটাই এনে দেওয়া হবে।
উনি আমাদের বাসায় একসময় প্রতিদিন আসতে শুরু করলেন। রেনুর জন্য মালা, বেনুর জন্য প্লাস্টিকের পুতুল, হাওয়াই মিঠাই, আর আমার জন্য গল্পের বই, এরকম এটা সেটা আনতেন। একদিন উনি আমার জন্য কাঁঠালি চাঁপা রঙের অনেক সুন্দর একটা শাড়ী নিয়ে আসলেন, আমার আনন্দে চোখে পানি চলে আসলো। মনে মনে ভাবলাম–ইশ মানুষটা এতো ভালো কেন?
পরদিন উনি আসার ঠিক আগে আ মি শাড়ীটা পড়লাম, চোখে টানা কাজল দিলাম, টিপ পড়লাম। আয়নায় আমি নিজেই নিজেকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। একি সাথে কষ্টও হতে লাগলো, মনে হলো– কি কারণে এই রূপ নিয়ে এরকম একটা সাদামাটা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে আমি জন্মালাম? শাড়ী পরে আমি বাড়ির পুরনো পাতকুয়োটার আশেপাশে ঘোরাঘুরি করলাম যাতে সুবলবাবু এলেই উনি আমাকে দেখতে পান। বুকটা অদ্ভুত এক ভালোলাগায় ঢিপঢিপ করতে লাগলো। একসময় উনি এলেন, আমাকে দেখেই বললেন– বাহ নীলু, তোমাকে তো স্বর্গের অপ্সরীদের মতো লাগছে। এই কথা শুনে লজ্জায় আমার কানের লতি, নাকের ডগা লাল হয়ে গেলো। সেই রাতে আমি ঘুমাতে পারলাম না, বারবার বালিশ নিয়ে এপাশ-ওপাশ করতে থাকলাম। শেষরাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়লাম, স্বপ্নে দেখলাম সুবলবাবু আর আমি হাত ধরে হাঁটাহাঁটি করছি এক রেললাইনের উপর। আমি কাঁঠাল চাপা রঙের শাড়ী পড়া, হঠাৎ একটা ট্রেন এলো, আমরা দুজন দুদিকে চলে গেলাম হাত ছেড়ে। ট্রেনটা চলে যাবার আমি আর সুবলবাবুকে খুঁজে পেলাম না, চীৎকার দিয়ে ডাকলাম, কিন্তু উনি কোথাও নেই। আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো, সারা শরীর ঘামে ভেজা। এই প্রথম আমার মনে হলো, এই মানুষটাকে ছাড়া আমি কিছুতেই থাকতে পারবো না।
ঐ রাতের পর দুদিন উনি আসলেন না। যেদিন আসলেন, সেদিন আমি ওনার সাথে মজা করে এককাপ চায়ে পুরো একটা লেবু দিয়ে দিলাম। এক চামচ মুখে দিয়ে আমি নিজেই মুখ কুঁচকে উঠলাম। পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকলাম উনি কি করেন। দেখি উনি চায়ে চুমুক দিচ্ছেন আর নি:শব্দে হাসছেন। তখন মানুষটার জন্য আমার মায়া হতে লাগলো। মনে হলো– কি দরকার ছিলো এরকম দুষ্টুমি করার? এককাপ লেবু চা-ই চায়, বেশী কিছুতো না। নিজেকে অপরাধী মনে হতে লাগলো। আমি আবার নতুন করে চা বানিয়ে নিয়ে গেলাম।
মা কিন্তু এসব খুব একটা ভালো চোখে দেখতেন না। বাবাকে বললেই বলতেন– আরে ছাড়োতো নীলুর মা, এতো মন ছোট কেন তোমার? তুমি এমনি এমনি সন্দেহ করো। তারপরেও মা আমাকে একদিন গালে চড় লাগালেন সুবলবাবুর সাথে জোরে হাসার জন্য। বললেন, তুই আর ওনার সামনে যাবি না। এর পরদিন উনি আমাদের বাসায় আসলেন, আমি ওনার সামনে যেয়ে স্থির দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকালাম, উনি বুঝতে পারলেন। তারপর…তারপর মাঘ মাসের ঘন কুয়াশামাখা এক ভোরে আমি ওনার হাত ধরে বাড়ি ছাড়লাম। আমার এখনো মনে আছে সকালের আলো ফুটতে তখনো অনেক বাকি, বড় রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো তখনো জ্বলছিল, গলির নুলো ফকিরটা তখনো চট মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছিলো, লাবুদের বাড়ীর ভাতের মাড়ে গা পোড়া কুকুরটা একবার আমাদের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করলো।
আমরা যখন রেলস্টেশন পৌঁছলাম তখন একটু আলো ফুটছিলো। আমার মনে হলো–আচ্ছা বাড়ীর সবাই এখন কি করছে? রোজকার মতো মা নিশ্চয়ই নামাজ পড়ে কোরআন শরীফ পড়বেন, বাবা মসজিদ থেকে হাঁটতে বের হবেন, রেনুটা আমার খাটেই মড়ার মতো পরে ঘুমোচ্ছে? ধীরে ধীরে রোদ উঠতে থাকলো, আমার এই প্রথমবারের মতো বাড়ীর জন্য কেমন খারাপ লাগতে থাকলো। আমার খুব পানির তেষ্টা পেতে লাগলো, এমনসময় ট্রেন এসে গেল, আমি আমার সব অতীত ফেলে রেখে গেলাম।
আমরা যশোরের ঘোষপাড়া নামক একটা জায়গায় এলাম। ওখানে সুবলবাবুর এক মামা থাকতেন,উনিই আমাদের সব ব্যবস্থা করে দিলেন। আমরা বিয়ে করলাম। নতুন জায়গায় আমার স্বামী কয়েকটা টিউশানি করা শুরু করলেন, আমাকে ওনার মামী হাতের কাজ সেলাই শেখাতে শুরু করলেন যাতে আমি অর্ডারির কাজ পাই। আমাদের দিন চলে যাচ্ছিলো একরকম। এরমধ্যেই আমার প্রথম ছেলেটা হলো। আমার স্বামী টুকটাক শাড়ীর ব্যবসা করছিলেন, ইন্ডিয়া থেকে চোরা পথে শাড়ীর ব্যবসা। আমিও সেলাইয়ের কাজ করতাম, কারণ তখন আমি বুঝে গিয়েছিলাম বাস্তবতাটাকে। মাঝে মাঝে বাবা মার কথা মনে পড়তো, মঞ্জু নিশ্চয়ই বড় হয়ে চাকরী করছে, রেনুটার মনে হয় ভালো একটা বিয়ে হয়ে গিয়েছে, বেনু স্কুলে পড়ছে, ওদের মনে হয় এখন আর কোনো অভাব নেই। আমার ওদের সাথে দেখা করতে মন চাইতো, মাকে বলতে ইচ্ছে করতো– মা তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, আর দিবো না।
আমি তিন বাচ্চার মা হলাম, আমার স্বামীও আগের থেকে অনেক বুড়ো হয়ে গিয়েছেন। আমার স্বপ্নগুলো কোথায় যেন হারিয়ে যেতে থাকলো। তারপরেও চলছিলো দিন। হঠাৎ আমার স্বামী একদিন বাড়ী ফিরলেন না, তার পরদিনও না… তার পরদিনও না… আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম, এরকমতো হয় না। অনেক খোঁজ করলাম। কেউ কেউ বললো ওনার কাছে নাকি ইদানীং কোন সুন্দর মতো একটা মেয়ে আসতো, আবার কেউ বললো এক্সিডেন্টে মারাই গিয়েছে বোধ হয় কিন্তু আমি কিছুই বিশ্বাস করলাম না। আর সবচেয়ে বড় বাস্তবতা ছিল তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে আমার টিকে থাকা। আমি সেলাইয়ের কাজ বাড়িয়ে দিলাম। আমার ছেলেমেয়েরা ওদের বাবার জন্য কান্নাকাটি করতো, একসময় ওরা বাবা ছাড়াই থাকতে শিখে গেল, আর আমি? আমারও মনে হতো যখন ইলেক্ট্রিসিটি চলে যেত, হ্যারিকেনের আলো জ্বালাতাম, সেই আলোয়… যখন দমকা হাওয়া এসে জানলার কপাটে বারি খেত… যখন হুট করে নামা ঝুম বৃষ্টিতে দৌড়ে যেয়ে উঠোনের কাপড় তুলতে যেতাম… তখন। মাঝেমাঝে মনে হতো রাতের অন্ধকারে এই বোধহয় কেউ আমার গায়ে তার হাতটা রাখবে, আমাকে আদর করবে। কোথায় হুট করে হারিয়ে গেলো মানুষটা আমাকে একা রেখে? এভাবে কয়েক বছর কেটে গেল। আমার ছেলেমেয়েরা বড় হলো, আমার কানের কাছের কয়েকগাছি চুল পেকে গেলো।
একদিন বাসায় আমি একা, ছেলেমেয়েরা কেউ নেই। হঠাৎ শুনলাম বাইরের বাঁশের গেটটা দিয়ে কেউ ভিতরে ঢুকছে আর আমার নাম ধরে ডাকছে। আমার মেরুদণ্ড দিয়ে হিমশীতল একটা স্রোত বয়ে গেলো। মনে হলো আমি কিছু শুনতে পাচ্ছি, আমার কান ঝাঁ ঝাঁ শব্দ করতে লাগলো, আমি নড়তে পারলাম না। এই হাঁটার শব্দ, এই কণ্ঠ আমার বহু বছরের চেনা। শুধু দেখলাম, আমার স্বামী আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। হাসি দিয়ে বললেন, কেমন আছো নীলু? আমাকে এককাপ লেবু চা খাওয়াবে?…
বিশেষ দ্রষ্টব্য: বেনাপোল বর্ডারের কাছে চোরাই শাড়ী আনতে যেয়ে পুলিশের কাছে ধরা পড়েন সুবলবাবু। পরে কোর্টে চালান হন, সাত বছরের জেল হয় ওনার।
সানজিদা শহীদ
জন্ম ১৫ ই জুন, ঢাকায়। পৈত্রিক বাড়ী বরিশাল। কথাসাহিত্যিক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। পেশায় একজন চিকিৎসক। বর্তমানে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
আমার জেলা শহরও লেখিকার পৈত্রিক শহর৷
এক কাপ লেবু চায়ের নিমন্ত্রণের আশায় রইলাম৷