আলাপ
একদিন গভীর রাত্রে তিনি আমাকে শুধালেন আমার জীবনে তাঁর কোনো দান মনে পড়ে কিনা
বললাম– ‘মনে পড়ে ‘
সেই যে সাপলুডো খেলার দিনগুলিতে দু-ফোঁটা জলের মতো দুটি পুট আমাদের দিয়েছিলেন আর আমরা দীর্ঘ ঝাউগুলির মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম পথে; আমাদের মাথার উপরে খুলে গিয়েছিল নক্ষত্রবীথি, সেইসব খুব মনে পড়ে
তিনি বললেন– ‘আর কিছু’?
বললাম– ‘আছে আরও ‘
আপনি যে নব্বইয়ের ঘরে রেখেছিলেন সোনালি সাপ, যে আমাকে একদিন তেইশের নির্জন চিলেকোঠায় নামিয়ে দিয়ে গেল; দেখতাম দূরে নদীর মতো সেই সাপ দুমড়ে মুচড়ে বাঁকে বাঁকে খুলে ফেলছে সোনালি খোলস
পাতা ঝরছে পৃথিবীতে।
আপনার মহত্তম দান, আমি সেই বিষ সর্পটিকে একদিন সানাই নামে ডাকতে শিখেছি
বুড়ো বাবার থান
অজস্র জঞ্জাল শরীরে বেঁধে উন্মাদ পথ হাঁটে।
কেশ, শ্মশ্রু ও গুম্ফের অরণ্যে কোণঠাসা হতে হতে তার নয়নদুটি অন্ধমুনির কুটিরের মতো জেগে থাকে। সে কি সভ্যতার তির থেকে জল আনতে গিয়েছিল?
কিন্তু ঢিল উড়ে আসে। উন্মাদ ছুটতে ছুটতে সন্ধ্যার বাঁকে অক্ষয় বটের সঙ্গে মিশে যায়।
কিছুতেই তাকে আলাদা করা যায় না…
সমস্ত ঢিলই সে গ্রহণ করেছে। রজ্জুবদ্ধ ঢিলগুলি দোল খায়। অগণন মনস্কামনার আত্মহত্যা দিয়ে তৈরি তার পোশাক।
প্রদীপগুলি মূর্ছিত হয়ে পড়ে
একটি বায়োগ্রাফির শেষকৃত্য
চুল্লিতে ঢোকাবার সময় একঝলক তিনি দেখলেন তার শরীরের উপর থাকা সবেধন মারকিন কাপড়টি মূহুর্তে গোলাপের মতো লাল হয়ে যেন প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ঝরে পড়ল।
একবার তার টবের গোলাপ ছিঁড়ে ফেলার কারণে এক ছোকরাকে তিনি তাড়া করে ফিরেছিলেন।
আজ কিন্তু তিনি এই রক্তচক্ষু চুল্লিকে তাড়া করতে পারলেন না।
চারপাশে কিছুক্ষণ পায়চারি করলেন, যেভাবে বসের চেম্বারের সামনে ঘুরঘুর করতেন একদিন। যেন ভিতরে প্রমোশনের কাগজ প্রিন্ট হচ্ছে।
যেন এক্ষুণি প্রচণ্ড ধমক ছিটকে আসবে ভিতর থেকে।
নীচে নেমে আউটলেটের সামনে অভ্যাসমতো অপেক্ষা করতে লাগলেন।
তোমার মাতৃভাষা
প্রথামতো, স্বীকৃত সাতাশটা ভাষায়
লিখে রাখো, ‘এই নলকূপ বিকল —
এতে জল পড়ে না।’
অবশ্য এত গ্রামীণ আর নিঃস্ব নলকূপে
তোমার মাতৃভাষা ছাড়া আর কেই বা জল
নিতে আসবে!
শুধু মনে রেখো, অঞ্জলি পেতে এত দীর্ঘ
প্রতীক্ষার পর, নীরবে ফিরে যাওয়ার ক্ষমতা
সব ভাষার থাকে না …
কাঠি লজেন্স
ভুলের ভিতর দিয়ে দীর্ঘতম দৌড়, তোমরা দেখেছো।
লুটিয়ে পড়ার মধ্যে যে বিজয় সংবাদ, তা পালন
করার মতো অন্ধকার নেমে আসবে
একটু পরেই।
আমার শিশুটি শুধু জানে, দূরে, গোধূলিতে
সূচালো গাছের মাথায়, কাঠি লজেন্সের মতো
একতাল সূর্য বিঁধে আছে…
শ্যামসুন্দর মুখোপাধ্যায়
জন্ম ১৯৮১। শূন্যদশকে লেখালেখির সূত্রপাত। প্রথম বই ‘হলুদ দাগের বাইরে পথচারী ‘(২০১১,প্রকাশক ‘মথ ‘)
দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘রঞ্জন ক্লিনিকে সন্ধ্যা ‘ (প্রকাশক ‘প্রতিভাস ‘,২০১৪)
এবং তৃতীয় ‘তবুও প্রয়াস ‘ থেকে প্রকাশিত ‘সার্কাসের আলো ‘ –একটি কাব্যপুস্তিকা। প্রকাশ কাল ২০১৮।
লেখালেখি প্রকাশিত মথ, কৃত্তিবাস, কবিসম্মেলন, আদম, মিরুজিন, দশমিক, লালন, ঘোড় সওয়ার, প্রতিবিম্ব, দাহপত্র ইত্যাদি পত্র পত্রিকায়।
‘হলুদ দাগের বাইরে পথচারী ‘ কাব্যগ্রন্থটি ২০১৪ সালে ‘সুবীর মণ্ডল স্মারক স্মৃতি পুরস্কার ‘ পায়।