তমসার তীর। হত্যা। রক্তপাত।‘মা নিষাদ’।
আর্তনাদ চিরসঙ্গী আমাদের। রত্নাকর,
কবিতার চেতনার কাছে যেতে তপস্যায়
ছিলে ষাট হাজার বছর। কবি কেন হলে?
বিনয়ী জিজ্ঞাসা: ‘কবিতা কি অভিশাপ? নিজ
ক্ষরণের ধ্বনি? প্রেমের মৃত্যু, নাকি কোনো
অচেনা গহন, নিঃশব্দ ব্যথা। উইয়ের সাথে
নিবিড় আলাপে আদি কবি হলেন ডাকাত।’
তমসার স্রোতে রৌদ্রালোক, ঢেউয়ের তমসা
আমাদের তৃষ্ণা, পারাপার তদারকি করে।
পতনে-উত্থানে ডোবায়,ভাসায় মানুষের
বাঁচার পঞ্জিকা। শ্রমিকতা, শস্যের চেতন,
ভালোবাসা, ক্ষয়ের নির্মাণ, স্বপ্নের সংগ্রহ
জাদুঘর জানে। চলো, কথা বিনমিয় করি।
২.
‘কবির প্রকৃত বন্ধু অতৃপ্তি, ঘুমহীন সিঁড়ি।’
‘কবিও উত্তম ডাকাত। শব্দ তার নারী।’
‘চুম্বন অসমাপ্ত উদ্ধার। ফেলে যায় ক্ষত।’
‘সঙ্গম বাঁচায় প্রেম। সঙ্গ দাও। আঁকো ডানা।’
‘কথা বলা মানুষের সঙ্গ থেকে দূরে ছিলে।’
‘কথার অরূপ, নির্মাণের রূপান্তর আমি
বুঝেছি, শিখেছি একদল বল্মীকের কাছে।’
‘নাকি বিবেকের বিভাজনে খুঁজেছ সকাল।’
‘আমার যাপন বুঝেছিল ভাসমান তরি।’
‘শিকার-শিকারী, ক্ষুধা, সমুখে যাবার ধারা।’
‘কে চায় হত্যা বলো, নিষাদও আমার সখা।’,
‘তার ক্ষুধা আমাদেরও বাঁচার দীন অভ্যাস।’
‘যদি নাও মানুষের ভার পুরুষও জননী।’
‘যদি নাও মানুষের দায় নারীও জনক।’
৩.
পর্ববিভাজন। সিঁড়ি আমাকে জানাও কত
ধাপ শেষে শান্তিপারাবার। যুদ্ধে ক্ষত, নত
হতে হতে আকাশের ছায়া অথবা পাতাল
সঙ্গী হবে। অস্তগামীতার দৃশ্য আমার
কাম্য নয়। ভ্রমণপঞ্জির কথা, ব্যথা তুমি
এই তমসা নদীর তীরে, রত্নাকর কোন্
মানুষকে বলে যাবে ? হারাবার শ্লোক, কার
প্রেম, কোন্ বহতার জন্যে বলে যাবে একা।
সঙ্গী করো। ভাটির সত্যে দেব কাঁধ। ঢেউ
তমসার, আমাদের কোন্ পাড়ে নেবে, নিক।
চলমান হতে হতে হাঁটা-চিহ্নে কথা হবে
মানুষের গ্রহণের, বিদায়ের, উদয়ের।
আমাদের ভেতর-বাহির-বিভাজন-রেখা
নীরবতার শেকড় থেকে বলায় দহন।
৪.
একবার মনে হয়, হাতের মুঠোয় দিন,
শেকড়ের ঋতি, বিজয় এবার, সার্থকতা
হবে। ফলের উদ্ধার হবে। যদিও সুদূরে
নিকটে মরীচিকার গান। রত্নাকর, টানে
অতল, প্রকাশ। এই তমসার ভালোবাসা,
অবহেলা, তৃষ্ণাকথা আমাদের রক্তগত
ধ্বনি। সামাজিক, উপরিতলের, মানুষের
বিবিধ স্থবিরতার, চলমানতার। কিন্তু
অধিক হৃদয়ক্ষতে, ওই ক্রৌঞ্চি, ওই শোক
সকলের। মানুষের পলাতক মনে যত
গান আছে, যত অপরাধ, প্রেমহীনতার
অমীমাংসা রাখে ভাসমান এই নদীতীর।
তমসা অশেষ বলে যদি ঘুমের প্রহরে
থাকি, প্রেম দূরের রৌদ্রে তুলিবে গোলাপ।
৫.
পালাবে কোথায়? বলো কবি। তমসার ঢেউ
তোমাকে, আমাকে কবে নীল জোসনা দেখাবে ?
নিজের পেছনে ঘুরে ঘুরে সামনে পেছনে
কতদূর যেতে পারি। আমাকে ফেরায় প্রেম
বিষণ্ন কৌতুকে। স্বপ্নের আগুনে পুড়ে গেছে
ঘুম। তল্পিবাহকের খাজনা দিতে পারি নাই।
ঋণি। অবমূল্যায়নে বটগাছও অপ্রীতির
দেশে খড়কুটো হয়ে যায়।‘এখনো সুন্দর
ভালোবাসা মূল্যবান’ আমরা বলেছি পথে
প্রান্তরে। প্রস্তরযুগে। যাদুঘরের ছায়ায়।
আজও বলি। ভাঙা আর ভাঙার মাঝখানে যদি
অবলম্বনের বীজ বোনা সার্থকতা পায়।
আমাকে গ্রহণ ভেবে, আশা করি, কোনো
এক পুথিকার গাবে কিছু অক্ষরের গান।
৬.
ব্যথা। এসো অবেদনবিদ। জাগরণ দূর
করো। তা হলে অনেক পর্যটন শেষ হতে
পারে। দেখাগুলি ক্লান্ত খুব। খোঁজে অন্য মাটি।
আমার হাতের তীরে মরে গেছে প্রিয় পাখি।
প্রেমকথা বলতাম যাকে, এখনো বলছি
তাকে। কালকেও যেতে হবে ওই দরজায়।
জানি না, যদি বন্ধ, যদি খোলা, ভেতরের
শূন্যতা, পূর্ণতা, কিছু পরিধির সত্যদিন
আলোকের ছায়া দিয়েছিল আশ্রমের
স্বর। রত্নাকর, বলো, যাপনের কোন্ সত্য,
কোন্ পরাজয় কখনো ছাড়ে না ঋণ। নেয়
ক্ষরণের ভার। যেন সার্থকতা নিয়তির।
পরাজিত স্বর আছে বলে রৌদ্রালোকে যাই।
আশা করি,বন্ধু বলবে না, ‘নতজানু হও।’
৭.
চলো, বৃক্ষনিচে বসি। নতুন পাতার সাথে
কথা আছে বাকি। ছায়ার কল্যাণগৃহ থেকে
সারিবদ্ধ ধ্যানে উইগুলি নিয়ে যাচ্ছে আশা।
সংগ্রহ কতটা বাঁচায় স্বপ্নের উল্লাস ?
‘আমার দস্যুতা নিয়ে তুমি কথা বলবে না
কে নয় দস্যু বলো, স্বার্থে সবাই প্রগতি,
মানুষের কাছে আমার সকল আকিঞ্চন
গেছে বৃথা। অপমানে ধুলোর অস্বচ্ছ হতে
হতে অন্য বোধ, অন্য প্রেম উধাও সুদূরে।’
‘কী বলে তপস্যা ? বন্ধ চোখ,খোলা চোখ,চির
অন্ধকার, প্রকাশের ভূগোলক, উইয়ের
চলাচল, ঋতুদের ব্যবহার ইত্যাদির
চেতনা ভিক্ষাপাত্র,ক্লান্ত,মর্ম খুঁজে খুঁজে ।
রত্নাকর, কোন্ প্রেম তোমাকে বাঁচায় ?’
জানুয়ারী-অগাস্ট, ২০১৮
জাহিদ হায়দার
জন্ম : ২১ এপ্রিল ১৯৫৬ পাবনার দোহারপাড়া গ্রামে। বড় দুই অগ্রজ জিয়া হায়দার ও রশীদ হায়দারের বিশেষ পরিকল্পনায় ঢাকায় প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া।
কিশোরকাল থেকে লেখালেখি শুরু। প্রধানত কবি। লেখালেখির অর্জনে আছে, গ্রন্থ: কবিতা–৮, গল্প–৩, উপন্যাস – ১ এবং ভ্রমণ – ১।
বিশেষ ভালোলাগা : চলমান ও স্থির মানুষের মুখ দেখা।
কবিতা:
স্বাগতকালের পর্যটক (১৯৮২);খোলা দরোজার দিন (১৯৮৫);অগ্নিগণ সখা আমার (১৯৯২); বলো দূত, অভিসার তিথি (১৯৯৬);বন্দনা করি অপেক্ষার (১৯৯৭);রূপকথা এঁকেছিল ক’জন (২০০৬); স্বপ্নপাড়ানি (২০১২); নির্বাচিত কবিতা (২০১৬);অববাহিকায় (২০১৭)
গল্পগ্রন্থ: জীবিকাজট (২০০১), আটমাত্রা (২০০৬),প্রেক্ষাপটের দাসদাসী (২০১৮, প্রকাশক: সমাবেশ)
উপন্যাস: প্রেম ও মৃত্যুর কথন (২০১৭)
ভ্রমণ: যখন ক্যামবোডিয়ায় (২০০৫)