ছ’তলার বারান্দায় দাঁড়ালে এই পাশটাই খোলা পাই। সাথে লাগোয়া গলিটার অন্য পাড়ে একটা চারতলা বাড়ি। সম্ভবত বছর পঁচিশেক আগে তৈরি করা। হয়ত তিরিশ বছরও হতে পারে। সামনের গেটের সাথেই একটা বাতাবিলেবু গাছ। ওতে এখনও গোটা ছয় বাতাবিলেবু ঝুলছে। বাড়িটার পশ্চিম পাশের অর্ধেকটা কেবল একতলা। তার ছাদ প্রায় দখল করে ছড়িয়ে আছে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা একখানা আমগাছ। দশ বছর আগে যখন এলাম এ বাসাটায় তারপর থেকে বেড়েছে ওটা আরও প্রায় দেড়তলা সমান। চারিদিকে আরও বেশকিছু ছোট আর মাঝারি গাছ। এসে অব্দি দেখছি তাদের নির্বিরোধ বেড়ে ওঠা।
খুব সকালে আর সন্ধ্যায় পাখিরা দল বেঁধে কিচিরমিচির শব্দ করে ওড়ে আর চোখে ও কানে মুগ্ধতা নিয়ে আমি দেখি, শুনি। মাঝে মাঝে মুঠোফোনে কয়েকটা ছবি তুলি। ঢাকা শহরের কংক্রিট জঙ্গলে এটা একটা বিশাল প্রাপ্তি। শহরের ভিতরের দিকে এমনটা খুব কম বাড়ির বাসিন্দারা দেখতে পান। কাক, কবুতর, নানান রকম শালিক, চড়ুই, দোয়েল, হরেক রকম পাখি। সকাল-সন্ধ্যায় বারান্দায় দাঁড়ালে দাঁড়িয়েই থাকতে ইচ্ছে করে।
গত কয়েক আমার বছরে বাসার চারপাশে ছ’তলা আর দশতলা বাড়ি তৈরি হচ্ছে একের পর এক। দিনে রাতে কনস্ট্রাকশনের লোকদের হল্লা আর বিবিধ যন্ত্রপাতির শব্দে মাঝে মাঝেই ফোনের অন্য প্রান্তের মানুষ জিজ্ঞেস করে, আমি কোথায়। কখনও কখনও দু’বার বলার পর তারা মেনে নেয়, আমি বাসায়ই। সেই ক্রমাগ্রসরমান ইট-কংক্রিটের আগ্রাসনের মাঝে এই এক চিলতে চোখের আর মনের স্বস্তি নিয়ে বেশ লাগতো। এবার সেটাও উবে যাচ্ছে।
কিছুদিন আগে অন্যপাশে আড়াআড়ি কোণাকুণি সামনের একটা বাসা ভাঙছিল যখন, ভাঙছিল আমার বুকের ভিতরটাও। ওই বাসায় একশো পদের গাছ লাগিয়েছিলেন তার মালিক। দোতলা এক ইউনিটের সেই বাসায় বাড়িওয়ালা নিজেই থাকতেন সপরিবারে। অবসরপ্রাপ্ত আমলা। তাঁর কেমন লেগেছিল জানি না। আমারই খুব কষ্ট হচ্ছিল। সেই বাসা ভাঙার পর ওইপাশের বারান্দাটায় আর যাওয়াই হয় না দু’বছর ধরে। শেষে এই এপাশের চারতলাটার সামনেও একদিন দেখলাম ডেভেলপারের বিশাল একখানা সাইনবোর্ড ঝুললো। দেখতে না দেখতে এত তাড়াতাড়ি এটাও ভাঙার সময় হয়ে যাবে বুঝিনি।
অক্টোবরের এক তারিখেই দেখলাম চার তলার চারটা বাসার সব মানুষ চলে গেছে বাড়ি ছেড়ে। আমার বাসার দিকে ওদের দখিনমুখী বারান্দার পাশের প্রতিটা দরোজা হাট-খোলা। বারান্দায় পড়ে আছে পরিত্যক্ত টুকিটাকি। খা-খা করছে যেন শূন্য বাড়িটা। সেদিন থমকে দাঁড়িয়ে ছিলাম ম্যালাক্ষণ, আমার উত্তরের বারান্দায়। কয়েক ঝাঁক পাখি তখনও আপন মনে ওড়াউড়ি করে ফিরে ফিরে দল বেঁধে জমায়েত হচ্ছিলো আমগাছটার ঘন ডাল-পাতার ভিতর। আমার দৃষ্টির আড়াল থেকে তাদের দুয়েকটার নড়াচড়া একটুখানি দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল থেকে থেকে। ফের একে একে সব বেরিয়ে এসে আবার ওড়াউড়ি। এমনটা করতে করতে এক সময় ওরা সব দূরে কোথাও চলে যাচ্ছে। আবার ফিরে আসছে।
হয়ত এই আমগাছে তাদের ঘরবাড়ি। হয়তো সেখানে ছোট্ট বাসায় তাদের দুয়েকটা ক্ষুদি ক্ষুদি ছানাও আছে। তাদের জন্যই ঘুরে ঘুরে খাবার নিয়ে ওরা ফিরে আসছে বারে বারে। হয়ত তাই। হয়ত তা নয়। আমার খুব ভাবতে ইচ্ছে করছে, এমনটাই। আর সেইসাথে বুকের ভিতর হু-হু করছে, পাখিগুলোর জন্য উতলা হচ্ছে মন। পরক্ষণেই ভাবছি, কী নির্বোধ আমি!
লুৎফুল হোসেন
কবি, প্রকাশক ও সাহিত্যকর্মী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর। বিভিন্ন রকমের পোর্টাল ও পত্রিকায় নিয়মিত গল্প, কবিতা, ফিচার, প্রবন্ধ এবং গান লিখছেন। বাংলাদেশের লিটলম্যাগ ও নানা প্রকাশনা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত আছেন সেই ছাত্র থাকাকালীন সময় থেকেই। শৈল্পিক মননশীলতাকে প্রশ্রয় দিয়ে একটু একটু করে গড়ে তুলছেন তার নিজস্ব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘রচয়িতা’।