এস.এম.সুলতান: রৌদ্রলোকের বাসিন্দা

রৌদ্রলোকের বাসিন্দা তিনি। তার সাম্রাজ্যে অন্ধকার প্রবেশ করে না। সেখানে মানুষ-পশু-পাখি আর গাছপালা একাকারহয়ে আছে। তীব্র আলোর ঝলকানি পাতায় পাতায়, শাখায় শাখায়। এ আলো তার জীবন-দর্শনের, শিল্প-দর্শনের। যে দর্শনের স্রষ্টা তিনি নিজেই। শিল্পী এসএম সুলতানের মুখোমুখি হওয়া মানে রত্নভরপুর এক সমুদ্রের মুখোমুখি হওয়া। যতো কাছাকাছি যাওয়া যায় সমুদ্রের গভীরতা ততই বাড়ে। বর্তমানে (১৯৯১) তার বয়স ৬৮। ১৯২৩-এর আগস্টে জন্ম। ১৯৪৬-এ প্রথম চিত্র প্রদর্শনী হয় শিমলায়। ছবি আঁকছেন আরও আগে থেকে। স্কুলে ছাত্রাবস্থায়। আজ অবধি এঁকে চলেছেন। তার ভাষায় ‘রেস্ট লেসভাবে’। সৃষ্টির অদম্য নেশা প্রতিনিয়ত ক্যানভাসের সামনে টানে। গুরুতর অসুস্থ না হলেই আঁকেন। যেনো সৃষ্টিশীল সমুদ্রের নিরত স্রোতের অভিঘাত তার এক-একটি চিত্রকর্ম। কতো ছবি এঁকেছেন তার কোনো হিসেব নেই। তবে ১৫ থেকে ২৫ হাজার হবে, তিনি জানালেন। জানালেন, ‘প্রিজার্ভ করি না, প্রিজার্ভ করার জন্যে ছবি আঁকি না’।
একটু ঝুঁকে পড়েছেন যেনো। বয়স এগিয়ে যাচ্ছে। নানা ধরনের অসুখ বাসা বাঁধছে শরীরে। এ মুহূর্তে এ্যাজমা সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে। বিভিন্ন ওষুধ নিত্যসঙ্গী। কথা বলতে বলতে কিছুটা ওষুধ গ্রহণ করলেন। জীবনের এই প্রান্তসীমায় অনেক কথা বলার আছে তার। বয়স বাড়লেও কোনো সংস্কার তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। এখনো ক্লীন সেভ করেন প্রতিদিন। একজন চমৎকার আধুনিক মানুষ হিসেবে ভাবেন সমগ্র জাতিকে নিয়ে। এদেশের চাষী, জেলে, কামার-কুমার প্রতিটি মানুষের দুঃখে বিচলিত তিনি। উপকূলে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস আঘাত করলে আরও বেশি বিচলিত হয়ে পড়েন। ঘুম চলে যায়। অস্থির হয়ে ভাবেন, কি করছে ওরা! যারা মরে গেছে তারা তো গেছেই, যারা বেঁচে আছে তাদের খাদ্য নেই, চারদিকে লাশের গন্ধ, নিকটজনের থেকে ছিটকে ছুটকে পড়েছে এক-একজন এক এক দিকে। প্রতিটি দুর্গত মানুষকে নিয়ে ভাবেন সুলতান। এই ভাবনায় কোনো কৃত্রিমতা নেই। যেনো প্রতিটি দুর্গত মানুষই তার আপন সন্তান। উদ্ধার এবং ত্রাণ তৎপরতায় সন্তুষ্ট নন তিনি। কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। বললেন, ‘এরাও আদম সন্তান, জীবনের জন্যে সংগ্রাম করে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করে উপকূলে। একটি প্যাকেট খাবার ক্ষুধার্ত অসংখ্য মানুষের মধ্যে ছুঁড়ে দেয়া রুচিকর কাজ নয়’।

চিত্রশিল্পী এসএমসুলতানের

৪ জুন ’৯১ বরেণ্য চিত্রশিল্পী এসএমসুলতানের মুখোমুখি হই। নড়াইল শহরে ঢোকার মুখেই রূপগঞ্জ বাজার। এখান থেকে কিছু পাকা, কিছু কাঁচা ২ কিলোমিটার মতো পথ পার হয়ে সুলতানের বাড়ি। চিত্রা নদীর পাশে ৪৪ শতক জমির উর সুলতানের বাড়ি। ১৯৮৫ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এরশাদ বাড়িটি সুলতানকে বানিয়ে দিয়েছিলেন। সংলগ্ন আরও ৪৭ শতক জমি সরকার সুলতানকে কাগজে-কলমে প্রদান করেছে। কিন্তু এই অর্পিত সম্পত্তির দখল আজ অবধি সুলতান পাননি। স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল এই জমি ভোগ-দখল করছে। চিরকুমার, চির বোহেমিয়ান সুলতানের পার্থিব সম্পদের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। তবে এই বাড়িটিকে ঘিরে তার একটি স্বপ্ন আছে। ‘শিশু স্বর্গ’। শিশুদের জন্য একটি আবাসিক শিল্পকলার স্কুল। প্রায় পুরো জীবন এই শিশুস্বর্গের স্বপ্ন লালন করেছেন তিনি। এজন্য বাড়ির আয়তন বাড়াতে চান। শিল্প ব্যাংকের কাছে ছবি বিক্রয়ের অর্থে আরও এক খণ্ড জমি কিনছেন শিশু স্বর্গের নামে। ওই জমিতে ফলের চাষ করা হয়েছে। শিশু স্বর্গের শিশু-কিশোররা কোথায় আবার ফল খেতে যাবে, এই আগাম ভাবনা থেকে এই জমিটি ক্রয় করা হয়েছে। শিশুদের জন্য একটি আবাসিক আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠাতা করা সরকারের পক্ষে খুব কঠিন কাজ নয়। এ ব্যাপারে একটি সংবিধান লিখে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চপর্যায়ে দৌড়াদৌড়ি করছেন সুলতান। সবাই আশ্বাস দিয়েছেন কাজ হয়নি।
বাঙালি জাতি দিন দিন রুচিহীন হয়ে পড়ছে, সে ব্যাপারে চিন্তিত তিনি। একই সাথে বিশ্ব মানবতা নিয়ে ভাবিতও। প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বিশ্বের যে বিভাজন রেখা টানা হয়েছে তা সুলতান মানেন না। তিনি স্বীকার করেন না তৃতীয় বিশ্ব মানে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বাসস্থান আর চিকিৎসা বঞ্চনার এক বিশাল ভূমি। তিনি মনে করেন, এই বিশ্ব বিভাজন একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। ধনী দেশগুলো আমাদের ওপর হীনমান্যতার বোঝা চালিয়ে দিতে চায়। এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া উচিত। কারণ, তৃতীয় বিশ্বে যখন সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছে তখন আজকের উন্নত বিশ্বের মানুষ ছিল বর্বর। যাবতীয় প্রাচীন ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী তৃতীয় বিশ্বের মানুষ। তৃতীয় বিশ্বের মেরুদণ্ডহীন রাজনীতিকরা এসব দেশের দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী।

বাংলাদেশ সম্পর্কে সুলতান বলেন, ‘নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ একটি অসাধারণ ধনী দেশ। এদেশের মাটির ক্ষমতা অসীম’। তিনি তার বাড়ির অঙ্গনে তারই লাগানো ৩টি গাছের দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলেন, ‘ওই ৩টি গাছের একটি জাপানি, একটি ইউরোপের এবং একটি চায়নিজ গাছ, এই মাটির উর্বরা ক্ষমতা এই গাছ ৩টিকে বড় করে তুলেছে। আমি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জীবনের দীর্ঘ সময় কাটিয়েছি। এতো উর্বর মাটি কোথাও দেখিনি। এ দেশের কর্মজীবী মানুষের শ্রম শক্তির ওপর আমার আস্থা ব্যাপক। এদেশের দারিদ্র্য নিয়ে যারা প্রতিনিয়ত হীনমন্যতায় ভোগেন তারা এ মাটিকে জানেন না। তারা এ দেশের ইতিহাস পড়েননি। তারা এদেশের খনিজ সম্পদ সম্পর্কে কোনো খোঁজখবর রাখেন না। সম্রাজ্যবাদী শক্তির শিখিয়ে দেয়াবুলি তারা আওড়ান। এই দৃষ্টিভঙ্গি এদেশের অগ্রগতি ব্যাহত করেছে। আজ থেকে ২০ বছর আগে যখন দেশ স্বাধীন হলো, তখন ভেবে ছিলাম বাঙালি সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ ঘটবে। কিন্তু হলো কই, কতিপয় অযোগ্য ব্যক্তি, প্রশাসন যন্ত্রের উপরে বসে দিন দিন দেশটাকে অধঃপতনের দিকে নিয়ে গেলো। ওয়ার্কিং ক্লাসকে অবহেলা করাই হচ্ছে এ জাতির সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য। এই তো ক’য়েক দিন আগের কথা। আমাদের চিত্রা নদীতে সরকার কিছু পোনা মাছ ছেড়ে দিলো। এরপর জেলেদের নদীতে নামতে বারণ করে দেয়া হলো। জেলেরা বংশ পরাস্পরায় এই নদীর মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেছে। আজ ওদের ঘরে চাল নেই, লবণ নেই। ওদের শিশুরা ক্ষুধায় কাঁদছে। একইভাবে চাষিদের ধানের দাম বেঁধে দেয়া হচ্ছে। আবার কৃষি উপকরণের দাম বাড়ানো হচ্ছে। গরিব মারার এসব পলিসি এ জাতিকে পতনের চূড়ান্ত দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।
নিস্তরঙ্গ বৃক্ষবহুল গ্রামের মধ্যে সুলতানের বাড়িটি বর্তমানে শিল্পপ্রেমিকদের তীর্থ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। সামরিক-বেসারিক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা, বিভিন্ন দূতবাসের দেশি-বিদেশি কর্মকর্তারা, আর্ট কলেজের ছাত্রছাত্রীরা এবং বুদ্ধিজীবী রাজনীতিকসহ বহু মানুষের আসা-যাওয়া সুলতানের বাড়িতে। বাড়িটি নির্মাণের আগে সেকেলে পরিত্যক্ত বিভিন্ন পোড়ো বাড়ি ছিল সুলতানের বাড়ি। বর্তমানে বাড়িটিতে সুলতান ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের সময় নিহত তার এক বন্ধুর পরিবারবর্গ তার সঙ্গে থাকে। এই সহৃদয় পরিবারটি চিরকুমার সুলতানকে জীবনের শেষ পর্যায়ে পারিবারিক পরিবেশ দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে। এছাড়াও সুলতানের পরিবারে আছে অসংখ্য বিভিন্ন ধরনের পশু-পাখি। একটি মিনি চিড়িয়াখানা বলা যায় সুলতানের বাড়িটিকে। কখনো তার আঁকার ঘরে, কখনো ড্রয়িং রুমে, কখনো বা বাড়ির লনে প্রায় ৩ ঘণ্টা যাবত একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার সুলতান কবি দারা মাহমুদকে দেন সেই ১৯৯১ সালে। সাক্ষাৎকারটি একটি গৌন পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল সেই সময়। কিন্তু এর প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনা করে পুনঃ মুদ্রণ করা হলো :

দারা মাহমুদ : আপনি কিভাবে ছবি আঁকতে শুরু করেন, মনে আছে কি?

এস. এম. সুলতান : সে আমলে স্কুলে একজন ড্রয়িং টিচার নিয়োগ করা হতো। আমি নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র ছিলাম। আমাদের ড্রয়িং টিচার ছিলেন, শ্রী কৃষ্ণনাথ ভট্টাচার্য। তিনি ক্লাসে যেসব আঁকার কাজ দিতেন, তাই করতাম প্রথম প্রথম। তিনি প্রশংসা করতেন এবং উৎসাহ দিতেন। এইভাবে সেই শৈশবে অঙ্কন শিল্পের দিকে ঝুঁকে পড়ি।

দারা মাহমুদ : আপনার শিল্পী জীবনের প্রারম্ভ পর্বে আপনাকে উৎসাহ দিয়েছেন, প্রেরণা দিয়েছেন এরকম দু’এক জনের কথা বলুন।

এস. এম. সুলতান : শিক্ষক কৃষ্ণনাথ ভট্টাচার্য, নড়াইল জমিদার বাড়ির ছেলে ধীরেন্দ্র নাথ রায়, পরবর্তীতে কলকাতায় শাহেদ সোহরাওয়ার্দী এরকম অনেক ব্যক্তি জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে সহযোগিতা করেছেন, উৎসাহ দিয়েছেন। স্মৃতিতে অনেক কিছু থাকে না। তবে আমার চিত্রকর্মের যারা উপজীব্য সেই শ্রমজীবী মানুষ সব সময় আঁকার প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।

দারা মাহমুদ : আপনার ছবি দেখে দর্শকদের মনে একটি সাধারণ কৌতূহল কাজ করে। কেন শ্রমজীবী মানুষ এরকম পেশীবহুল। এর শিল্পগত যুক্তি আমরা খুঁজে বের করেছি। এ সম্পর্কে পন্ডিত ব্যক্তিরা প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন বিস্তর। তবু আপনার মুখ থেকে জানার আগ্রহ সকলের।

এস. এম. সুলতান : মানুষ গুহা থেকে বেরিয়ে এসে পৃথিবীতে কৃষি সভ্যতার পত্তন ঘটায়। সভ্যতার সেই উষাকাল থেকে শ্রমজীবী মানুষ সমগ্র মানব জাতির মুখের কাছে অন্ন তুলে ধরেছে। সভ্যতার ক্রমবিকাশে এই মানুষের অবদান সবচেয়ে বেশি। আজ পর্যন্ত এই ওয়ার্কিং ক্লাস শ্রম ও মেধা দিয়ে মানুষের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে। এরাই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ সন্তান। কিন্তু কালে কালে এরাই বঞ্চিত হয়েছে। শোষণের শিকার হয়েছে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে আজকের কৃষক রুগ্ন। কিন্তু এটি তার সত্যিকার চেহারা নয়। আমি কৃষকের দীনতা দেখাতে চাই না, যে শক্তি দিয়ে ওরা পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে যায়। সেই শক্তি এবং তার অন্তর্গত গতি আমি আঁকতে চেষ্টা করি।

দারা মাহমুদ : শিল্প জীবনের জন্য, শিল্প শিল্পের জন্য এরকম দুটি শিল্প মতবাদ সারাবিশ্বে চালু আছে, এ সম্পর্কে কিছু বলুন।

এস. এম. সুলতান : রাজা রাজ্ড়াদের পতনের মধ্যদিয়ে শুধুমাত্র আনন্দদানের জন্য শিল্প সৃষ্টির যুগ শেষ হয়ে গেছে। সামন্ত প্রভুরা বলতেন শিল্পীকে একটি ন্যুড পরীর ছবি এঁকে দেয়ার জন্য। এক শ্রেণীর শিল্পী এ ফরমায়েশী কাজটি করতো। এভাবে শুধুমাত্র আনন্দদানের জন্য শিল্প সৃষ্টি হতো। কিন্তু আজ এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে শিল্প সমাজ বিবর্তনের একটি অনুষঙ্গ। শিল্পীর এবং শিল্পের সামাজিক দায়িত্ব প্রশ্নাতীত। তবে আধুনিককালের কিছু শিল্পী ‘এ্যাবাস্ট্রাক্ট’ আর্টের নামে জনবিচ্ছিন্ন শিল্প সৃষ্টি করছেন। ইউরোপকে সর্বক্ষেত্রে অনুকরণ করার প্রবণতা ভালো নয়। এক এক জায়গায় সামাজিক প্রেক্ষাপট এক এক রকম। এক এক জাতির সংস্কৃতি এক এক ভাবে এগোয়। একজন শিল্পীকে আত্মসচেতন হতে হবে। আমি কিন্তু শিল্পের বিশ্বজনীনতা অস্বীকার করছি না। শিল্পীকে প্রথমে তার নিজস্ব পরিমণ্ডলে উত্তীর্ণ হতে হবে। এরপর বিশ্ব তাকে গ্রহণ করে নেবে।

দারা মাহমুদ : উপমহাদেশের শিল্প চর্চা সম্পর্কে কিছু বলুন।

এস. এম. সুলতান : উপমহাদেশে বেশকিছু প্রতিভাবান শিল্পীর জন্ম হয়েছে। কিন্তু শ্রমজীবী মানুষকে উপজীব্য করছেন কই তেমন তো পাই না। দুর্ভিক্ষের সময় জয়নুল কিছু কাজ করছেন কই তেমন তো আর পাই না। আর যামিনী রায় বলুন, রামকিঙ্কর বুলন- সাধারণ মানুষ উঠে এসেছে তুলিতে, এরকম ঘটনা বিরল। আমি…বলতে পারেন, ক্যানভাসের ওপর দিয়ে যুদ্ধ করে যাচ্ছি। একটি ছবি বেশি দামে বিক্রি হবে সেই লক্ষ্য সামনে থাকলে ‘ওদের’ নিয়ে ছবি আঁকা যায় না। যখন শিল্পীর চেতনায় ‘কমিটমেন্ট’ কাজ করে তখনি সে সাহসী হতে পারে।

দারা মাহমুদ : ইউরোপের চিত্রকর্ম সম্পর্কে কিছু বলুন।

এস. এম. সুলতান : ভ্যানগগের কথা মনে পড়ে। গরিব মানুষ আলু সেদ্ধ খাচ্ছেন। সাধারণ ঘরদোর। সমাজের নীচুতলার মানুষকে উপজীব্য করে ভ্যানগগ যেভাবে অসাধারণ চিত্রকর্ম তৈরি করেছেন- ইউরোপের আর কোনো শিল্পীর মধ্যে এতো মানবধর্মী কাজ খুঁজে পাই না। অথবা রৌদ্রালোকিত শস্য ক্ষেত আঁকার মধ্যদিয়ে সাধারণ মানুষ সৃষ্টি সামাজিক গতিকে ভ্যানগগ যেভাবে ধারণ করেছেন তা তুলনাহীন।

দারা মাহমুদ : তরুণ আঁকিয়েদের সম্পর্কে আপনার ধারণা কি?

এস. এম. সুলতান : অনেক প্রতিভাবান তরুণ শিল্পী আসছে। তবে একটি সার্বজনীন সমস্যার মোকাবিলা সকলকে করতে হচ্ছে। আর্ট কলেজ থেকে বেরুনোর পর জীবিকার জন্য এদের ভাবিত হতে হচ্ছে। অনিবার্য জৈবিক প্রয়োজনে এসব প্রতিভাবান শিল্পী কমার্শিয়াল আর্টের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। ফলে এসব শিল্পী তাদের প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হচ্ছে না। যারা এদেশের পলিসি মেকার তাদের বিষয়টি ভাবা উচিত। যারা আর্ট কলেজ থেকে বেরুচ্ছে তাদের কর্মসংস্থানের দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। এক্ষেত্রে আমার সুনির্দিষ্ট মতামত হচ্ছে, হাইস্কুল পর্যায় পর্যন্ত একজন করে ড্রয়িং টিচার নিয়োগ করতে হবে। এতে সুবিধে দুটো। আর্ট কলেজ থেকে বেরিয়ে আসা ছাত্রদের কর্মসংস্থান হবে। বছরে প্রায় ৬ মাস স্কুলগুলো বন্ধ থাকে। এই দীর্ঘ সময় আর্টিস্টরা ক্রিয়েটিভ কাজ করার অবকাশ পাবে। একদিকে এদের যেমন তীব্র অন্ন চিন্তা থাকছে না, অন্যদিকে থাকছে অবসর। তখনই এরা প্রকৃত অর্থে সৃষ্টিশীল কাজ করতে পারবে। অন্যদিকে শিশুরা আঁকার প্রতি উৎসাহী হবে। আমাকে আমেরিকার চিকিৎসকরা বলেছেন, শিশুরা ড্রয়িং-এ গেলে তাদের মস্তিষ্ক গঠন ভালো হয়। যে কোনো সাবজেক্টে সে ভালো করবে। ওই শিশুর প্রতিভার বিকাশ হবে। শিশু তার পরবর্তী জীবনে চূড়ান্ত পেশাগত দক্ষতা দেখাতে সক্ষম হবে। আগামী দিনের প্রকৃত অর্থে করিৎকর্মা জাতি গঠনের জন্য আমাদের হাইস্কুল পর্যায় পর্যন্ত ড্রয়িং মাস্ট করা অত্যন্ত জরুরি।

দারা মাহমুদ : দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন সম্পর্কে কিছু বলুন।

এস. এম. সুলতান : সামাজিক অবকাঠামোর মৌলিক পরিবর্তন বাদ দিয়ে কোনো পরিবর্তন অর্থবহ হতে পারে না। কর্মজীবী মানুষের লাইফ স্টাইলের পরিবর্তনই সর্বাগ্রে কাম্য। কৃষককে ‘ইগনোর’ করে সমাজের কোনো মঙ্গল হতে পারে না। ওদের লিভিং স্টান্ডার্ড বাড়াতে হবে। আন হাইজিনিক পরিবেশ থেকে উদ্ধার করে ওদের স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ উপহার দিতে হবে। ওরা রুচিহীন নয়। যথেষ্ট সৌখিন। ঘর লেপে পুছে রাখে। কিন্তু দিন দিন ওদের সমাজের নীচু এলাকার দিকে ঠেলে দেয়ার কারণে উপরের ময়লা পানি ঘরে প্রবেশ করে পরিচ্ছন্নতা নষ্ট করছে। এটা খুব দুঃখজনক যারা এক সময় এদেশে ডাকাতি করতে এসেছিল। আজ তারা স্যানিটেশন শেখাতে আসছে।
যারা ফসল উৎপন্ন করে, দুঃখজনক হলেও সত্য তাদের শিশুরা ক্ষুধায় কাঁদে। ওদের দেয়া করের টাকায় ঢাকায় প্রাসাদ ওঠে আর বন্যার প্রথম আঘাতে ওদেরই সাজানো জীবন ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। বিলাস দ্রব্যের স্তূপ গড়ে উঠছে শহরে। আর গ্রামে ওদের বধূরা আব্রু রক্ষা করতে পারছে না। জাতি রুচিহীন হয়ে পড়েছে। সুবিধাভোগী শ্রেণীর রুচিতে কিছুই আর বাধছে না। আমরা অতি সামান্য মানুষ। ক্যানভাসের সাথে যুদ্ধ ছাড়া আর কি বা করতে পারি?

দারা মাহমুদ : শিশু স্বর্গ সম্পর্কে কিছু বলুন।

এস. এম. সুলতান : এ সম্পর্কে একটি সংবিধান আমি তৈরি করেছি। এর এক কপি ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন সাহেব নিয়ে গেছেন। আমার সমস্ত সম্পদের উত্তরাধিকারী যাতে শিশু স্বর্গ হতে পারে সে ব্যাপারে একটি উইল করে যেতে চাই। শিশু স্বর্গ হচ্ছে শিশুদের একটি আবাসিক শিল্প কলার স্কুল। আচ্ছা। শিশুরা এবং পাখিরা ভোরে কেনো কাঁদে বলতে পারেন! ওদের ক্ষুধা লাগে তাই। শিশু স্বর্গের ছেলেদের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ থাকবে। প্রয়োজনীয় রঙ, তুলি, পুস্তকাদি দেয়া হবে ওদের। এখানে ভর্তির ব্যাপারে কোনো বৈষম্য থাকবে না। গ্রামের দরিদ্র কৃষকের ছেলেমেয়েরা এই স্কুলে লেখাপড়া করতে পারবে। আমাদের সমাজে যারা লেখাপড়া শিখে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হয়, তারা মোট জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ থেকে আসে। যাদের সামর্থ্য আছে তারাই উচ্চশিক্ষার সুযোগ পায়। কিন্তু জনসংখ্যার বেশি অংশ দরিদ্র শ্রেণী। এদের ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যেতে পারে না। দু’এক জন যা যায়, তারা প্রাইমারি অথবা হাইস্কুলের গন্ডির মধ্য থেকে ড্রপ আউট হয়ে পড়ে।

এই বিশাল জনশক্তির ভেতরে অসংখ্য প্রতিভাবান থাকে। হয়তো যিনি একজন দক্ষ রাষ্ট্রনায়ক হতে পারতেন, তিনি মাঠে চাষ করেই জীবন কাটিয়ে দিলেন। অথবা একজন কবি শিল্পী হওয়ার যাবতীয় যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শিক্ষা এবং সুযোগের অভাবে একজন কাঠমিস্ত্রির কাজ করে গেলেন জীবনভর। শিশুস্বর্গ ব্যাপকভাবে না হলেও একটি ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা হবে…এসব প্রতিভার বিকাশ ঘটানোর।

দারা মাহমুদ : শিশুস্বর্গের ব্যাপারে আপনি উচ্চ পর্যায়ে কার সাথে কথা বলেছেন।

এস. এম. সুলতান : শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছাড়াও সাবেক সরকারের প্রধান প্রধান রাজনীতিকদের সঙ্গে কথা বলেছি। কেউ নিরুৎসাহিত করেননি। কিন্তু এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।

দারা মাহমুদ : আপনার কিছু ইচ্ছার কথা বলুন।

এস. এম. সুলতান : আমি চাই বাঙালি জাতির বোধোদ্বয় হোক। উন্নয়ন মানে শুধু নগর নির্মাণ নয়… উন্নয়ন মানে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের উন্নয়ন। সবকিছু অপরিকল্পিতভাবে এগুচ্ছে। এই দেশটা একটা পরিকল্পনার মধ্যে আসুক। কোস্টাল এরিয়ায় পাকা পিলার দিয়ে উঁচু উঁচু ঘর নির্মাণ করা হোক। কৃষকরা কৃষি পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাক। সমাজের নীচুতলার মানুষেরলাইফ স্টাইল উন্নত হোক। শিশুরা বিকশিত হওয়ার মতো সুস্থ পরিবেশ পাক। চিকিৎসাহীনতা এবং স্বাস্থ্যহীনতার হাত থেকে জাতি মুক্তি পাক। সমাজে যারা সৃষ্টিশীল মানুষ তারা কাজের পরিবেশ পাক তারা যাতে মর্যাদার সাথে বাঁচতে পারে সেই ব্যবস্থা হোক।

দারা মাহমুদ : একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি। আপনি আপনার জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে থেকেছেন। কিন্তু রাজধানী থেকে অনেক দূরে এই নড়াইলে আপনি বার বার ফিরে আসেন কেনো?

এস. এম. সুলতান : এখানকার মানুষ পরিচিত। এখানকার বৃক্ষ-মাটি পরিচিত। একজন পরিচিত মানুষ যখন মারা যায় তখন দুঃখ পাই। একইভাবে একটা পরিচিত গাছ যখন মারা যায় অথবা কেটে ফেলা হয় তখন একই রকম দুঃখ পাই। এই অনুভূতি পৃথিবীর আর কোনো জায়গায় আমি ঘনিষ্ঠভাবে পাই না। এছাড়া এখানে থাকলে যারা আমার সৃষ্টির উপজীব্য সেই শ্রমজীবী মানুষ তাদের কাছাকাছি থাকতে পারি। কাজের তাগিদ অনুভব করি। কাজের পরিবেশ পাই।

দারা মাহমুদ : স্থানীয় প্রশাসন কি আপনার খোঁজখবর রাখে?

এস. এম. সুলতান : স্থানীয় প্রশাসন কোনো খোঁজ নেয় না। কর্মকর্তারা এসে প্রথম প্রথম খোঁজ নেয় এবং ছবি চায়। ছবি প্রাপ্তিতে ব্যর্থ হয়ে খোঁজ নেয়া ছেড়ে দেয়। আমি তো ড্রয়িং রুমে ঝুলিয়ে রাখার জন্য ছবি আঁকি না।

আবাসিক শিল্পী হিসেবে আপনি ৯ হাজার ৫শ টাকা মাসিক সরকারি ভাতা পান। এতে কি সংসার ঠিকমতো চলে?

এস. এম. সুলতান : উপরওয়ালা চালিয়ে নেয়। প্রতিমাসে ২০ হাজার টাকার উপরে খরচ হয়। আবাসিক শিল্পী হিসেবে বছরে ৬টি ছবি শিল্পকলা একাডেমিকে দিতে হয়। এছাড়া দু’একটি ছবি বিক্রি হয়। সেখান থেকে কিছু আসে। চলে যায়।

দারা মাহমুদ : মানুষ ছাড়া আপনার পরিবারে এখন পশু-পাখি কেমন?
এস. এম. সুলতান : বিড়াল ৩৬টি, কুকুর ৪টি, হনুমান ২টি, বানর ৫টি, খরগোস কয়েক ডজন, গরু ৪টি, হাঁস মুরগি কয়েক ডজন ও একটি মদনটেকসহ বেশকিছু পাখি রয়েছে।

দারা মাহমুদ : আপনার জীবদ্দশায় যদি শিশু স্বর্গের বাস্তবায়ন দেখে যেতে পারতেন তাহলে কেমন লাগবে।

এস. এম. সুলতান : খুবই ভালো লাগবে। একটা প্রশান্তি নিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু আমরা বড় নগণ্য। পয়সাওয়ালা এবং ক্ষমতাবানরা এগিয়ে না এলে ভালো কাজ করা কষ্টকর। যশোরে শিশুদের আর্টের স্কুল চারূপীঠ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। খুবই আনন্দ পেয়েছি। শিশুদের সুকুমার বৃত্তির বিকাশ ঘটানোর মতো পরিবেশ তৈরি না করতে পারলে জাতির আগামী দিন অন্ধকার হয়ে যাবে।

দারা মাহমুদ : আপনি গুরুতর অসুস্থÑ এরকম খবর শুনে আমরা এসেছি।

এস. এম. সুলতান : বয়স হয়েছে। অসুস্থতা নিত্যসঙ্গী। কি আর করা যাবে।

দারা মাহমুদ : আমরা জেনেছি আপনি চিকিৎসার ব্যাপারে নিরুৎসাহী।

এস. এম. সুলতান : কি হবে চিকিৎসা করে, ওসব বড় লোকের জন্য।

দারা মাহমুদ : অসুস্থতার মধ্যেও দীর্ঘ সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

সুলতান: তোমাকেও ধন্যবাদ। বৃষ্টি না হলে শিশুস্বর্গের জন্য যে জমি কিনে ফলের চাষ করেছি কয়েক ফার্লং দূরে ওখানে নিয়ে যেতাম। উইস ইউ সাকসেস।

 

দারা মাহমুদ

দারা মাহমুদ কবিতার এক সহজ অথচ দুর্বোধ্য রহস্যঘেরা পথের অভিযাত্রী। সরল সড়ক ধরে ক্রমশ কঠিন সূক্ষ্মতার দিকে তার চলা। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে হেঁটেই চলেছেন কবিতার ক্রমশ প্রাতিস্বিকতার পথে। জন্ম ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৫৮। ৫/৭ বার পেশা বদল করে এখন সাংবাদিকতায় স্থিত। দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকীয় লেখা ও বার্তা বিভাগের সম্পাদনার কাজে যুক্ত। মোট গ্রন্থ ১১টা। তবে মৌলিক একক কাব্যগ্রন্থ মাত্র ৫টা। এত কম লেখার কারণও ওই প্রাতিস্বিকতার কঠিন পথ অনুসরণ।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top