এ শহরে এখন আর লাশের ঘ্রাণ নেই। জীবনের ঘ্রাণ নিয়ে রোজ শহরের ঘুম ভাঙে। এই ঘ্রাণকে সৌরভ অর্থে নেয়ার কোনো আবশ্যকতা নেই। ভাদ্রের কর্মক্লান্ত দিনশেষে ঘামে চিটচিটে অন্তর্বাস খুললে দুর্গন্ধের যেমন একটা ঝটকা এসে নাকে লাগে, চারদিকে তেমন দুর্গন্ধ। দুর্গন্ধমোড়া এ শহর রেজার। যদিও রোজ বদলাতে থাকা শহরকে ও ঠিকমতো চিনে উঠতে পারেনি এখনো। এই শহরও রেজাকে চেনে না।
রেজা আগন্তুকের মতো পা বাড়িয়ে চোখ ছোট ছোট করে সামনে তাকায়। দুপা হিমে জড়িয়ে আসছে। হাওয়ায় হাওয়ায় বাজছে শীতের জরো জরো ধ্বনি। ধোঁয়াওঠা বাতাসে নাক কুঁচকে আড়মোড়া ভাঙছে শহর। একজোড়া সঙ্গমরত কুকুর গড়িয়ে আসছে রেজার পায়ের কাছে। দুপা পেছনে সরে রেজা। বেলাজ প্রাণী দুটির দিকে আরেকবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। রেজাকে ছেড়ে যাবার আগের রাতে মনি ওকে এমন করে আটকে ফেলেছিল। অমনোযোগী-বিধ্বস্ত রেজা কিছুতেই নিজেকে ছাড়াতে পারছিল না। জাতিসাপের মতো ফোঁসফোঁস করতে করতে মনি ওর ঘাড়ের কাছে বিষাক্ত ছোবল দিচ্ছিল। মনির আঠালো শরীর থেকে রেজার নিভন্ত শরীর যতো পিছলে যাচ্ছিল, মনি ততো ক্ষেপে উঠছিল। প্রতিবারের ব্যর্থতায় মনির দিনের চড়চড়ে মেজাজ আরও চড়ে উঠছিল।
‘বুইড়ার বুইড়া, ফকিরের ফকির। ফকিরের খাসলত বিছনাতেও যায় না।’
শেষপর্যন্ত রেজার ন্যাতানো শিশ্ন মুচড়ে দিয়ে মনি বলেছিল, ‘যাহ, শালা তোরে দিয়া হইব না।’
মনির এখন কাকে দিয়ে হয় জানে রেজা তবু ওর মুখে পুনঃপুনঃ শালা সম্বোধন শুনেও রেজার শরীর কিংবা মগজ তেতে ওঠেনি। ছয় দিন আগে শোবার ঘরের ময়লা ফেলার ঝুড়িতে চিহ্ন রেখে গিয়েছিল মনির প্রেমিক। প্রেমিক না-ও হতে পারে। সম্ভোগে তৃপ্ত হতে প্রেমিক থাকা জরুরি না। রেজার জন্য এখন যেমন জরুরি না শরীরে তৃপ্ত হওয়া। শরীর নিছক শরীর রেজার কাছে। পর্নভিডিওতে নারী-পুরুষ কিংবা ইতরপ্রাণির সক্রিয় সম্ভোগ দেখেও ইদানীং রেজার শরীরে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় না।
রেজা এখন সবকিছুতে প্রতিক্রিয়াহীন থাকে-এ কথা বলাটাও ভুল হবে। আসলে ওর শরীর বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে জেগে না উঠে ডুবতে থাকে। ওকে জাগাতে কদিন আগে মনি বিছানার ওপরে ল্যাপটপ তুলে রগরগে সব মুভি ছেড়ে দিয়েছে। বলেছে, ‘বুলা পাঠাইছে মুভির লিংকটা। ওরা স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে দ্যাখে। এক রাইতে দুই সিটিং মারে।’
রেজাও দেখেছে। কামার্ত নগ্ন নারী-পুরুষের বদলে রেজা দেখতে পেয়েছে বিশাল গর্তে মুখ থুবড়ে পড়া অসংখ্য নারী-পুরুষ। না, নারী-পুরুষ না, মানুষের লাশ। শত শত, হাজার হাজার। যাদের হাতজোড়া পিছমোড়া করে বাঁধা, শরীর দুমড়ানো। উন্মুক্ত করোটির ছিদ্রপথে ঠোঁট দিয়ে খুঁচিয়ে চলছে কাক কিংবা শকুন, পেটের মাংস খুবলে খাচ্ছে শেয়াল। চারদিকে উড়ছে মাংসপচা ঘ্রাণ।
ঘ্রাণে রেজার বমি পায়। পেট চেপে ধরে ও রাস্তাতে বসে পড়ে। বমির দমক কেটে গেলে শরীর হালকা লাগে। মাথার ভেতরে এখনো জমাট বেঁধে আছে গলিত মাংস। ঐ লাশটাও হয়তো নগ্ন ছিল। যে লাশটা খুঁজে পাওয়া যায়নি। মনি বলে, ‘খুঁইজা পাওন এতই সোজা! এত বছর পরে? যত্তসব ভড়ং। বউ পোষনের মুরোদ নাই, খালি ভণ্ডামি। শালা…।’
রেজা জানে কিচ্ছু হয় না ওকে দিয়ে। কোনোকিছুই হয় না। রাস্তার নেড়িকুত্তাকে দিয়েও যা হয়, রেজাকে দিয়েও তা হয় না। তাই রেজা হাঁটে। পথে পথে থাকে। খোঁজে সেই লাশ। ঠিকঠাক মতোই চলছিল ওর এই যাত্রা। কিন্তু কে যেন আজ বার বার রেজার পা টেনে ধরছে। চেনা পথও অচেনা লাগছে। সামনে তাকালেই দেখতে পাচ্ছে চকচকে মরুভূমি। বালুতে পা গেঁথে যাচ্ছে। রেজা তাই পা টেনে টেনে হাঁটছে। কেবল দিনের শুরু হয়েছে অথচ ওর হাঁটার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, বিশ্রামের সময় হয়ে এসেছে। কিন্তু বিশ্রাম নেওয়ার তো উপায় নেই। শহরের এ মাথা থেকে সে মাথা ছুটতে হবে। লাশের খোঁজে।
রেজার পা টলে ওঠে। মরুপথ বদলে এবার সমুদ্র হয়ে গেছে। ভয়ংকর এই রূপান্তর। সমুদ্রের ঢেউ মনির নগ্ন শরীরের মতোন ওর দিকে ধেয়ে আসছে। রেজা দুহাত দিয়ে নিজের মুখ আড়াল করে। ঢেউ আছড়ে পড়ে রেজার অশক্ত শরীরে। তেজস্বী সমুদ্র ফুলে ওঠে, তার দুগ্ধকোমল স্তন একরোখা ভঙ্গিতে রেজাকে পিষে ফেলতে চায়। লুণ্ঠিত রেজা ভেজা বালুতটে পড়ে থাকে। বাতাসের উড়ানে বাসি-পচা গন্ধে ওর শরীর ঢেকে যায়। পথের ধারে ডাস্টবিন উপচে পড়ে গোটা শহরের শৃঙ্গারের আখ্যান মেলে ধরছে। গতসপ্তাহে একটা নবজাতকের লাশ ছিল এখানে। একটা কুকুর মুখ দিচ্ছিল চোখ না ফোটা শিশুমুখে। রেজা ধাওয়া করতেই মুখে কচি একটা পা টেনে দৌড়ে পালিয়েছিল কুকুরটা।
রেজার জিভে টক পানি উঠছে। নিজের মুখের উৎকট গন্ধে দিশেহারা লাগছে। মানুষের পাপস্খলনের আবর্জনা ওর দিকে ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে আছে। একটা টোকাই ছেলে হাতড়ে হাতড়ে দুটো বেলুন খুঁজে এনেছে, প্যান্টে ঘষা দিয়ে নোংরা পরিষ্কার করে গাল ফুলিয়ে বেলুন ফুলাচ্ছে। ব্যবহৃত কনডমের ফুলে ওঠা দেখতে দেখতে রেজার বমিভাব ফিরে আসে। পেট খালি করে বমি করে রেজা কিছুটা ধাতস্থ হয়। মা বলতো, রাতে লেবু খেলে পেটে গ্যাস হয়।
হঠাৎ রেজার পেট ফুলে গ্যাসবেলুনের মতো ঢাউস হয়ে যায়। রেজার শরীর মাটি থেকে হালকা হয়ে আকাশে উড়তে শুরু করে। উড়তে উড়তে সে সমগ্র শহর দেখতে পায়। চোখের পলকে দুই চাকার মানুষে ছেয়ে যাচ্ছে সড়কগুলো। হাজারো মানুষের গতিময় চাকা ছুটছে এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্ত। ব্যস্ততার ঘূর্ণি সবার পায়ে। দুহাতের মুঠোয় চারকোণা রঙিনবাকশো। চোখে-মুখে মুখবইয়ের প্রচ্ছদে নিজেকে মেলে ধরার উগ্রতা, নতুন নতুন ইশুতে দেশপ্রেমের ব্যগ্রতা, ‘হাই ফ্রেন্স,…প্রতিবাদ গড়ে তোলো, হ্যাশট্যাগ প্লিজ…’, বিস্মৃতপ্রায় পুরনো ইশুও শোভা পাচ্ছে কারও কারও দেয়ালে, ‘শহীদের সংখ্যাতত্ত্ব, মুক্তিযোদ্ধা আর রাজাকারদের তালিকা…ধিক্কার জানাই দেশের কুলাঙ্গার সন্তানদের।’
রাজাকারদের তালিকায় নাম উঠেছে রেজার বাবারও। রেজা খোঁজ নিয়েছিল সরকারি দপ্তরে। তালিকা সংশোধন হবে, আবেদন করে সকল তথ্য জানাতে হবে। সময়ক্ষেপণ হবে না। কিন্তু সময় দেয়নি মা। খবরটা কানে যাওয়ার একদিন পরেই মা চলে গেছে। মাকে কবর রেখেই রেজা লাশের খোঁজে বেরিয়েছে। বাবার লাশটা খুঁজে পাওয়া চাই।
খুঁজতে খুঁজতে হাঁটতে হাঁটতে নিজের শহরকে চিনতে কষ্ট হয় রেজার। এ শহরে এখন শকুনের ওড়াওড়ি নেই। শেয়ালের পালও নিরুদ্দেশ। লাশে ভরা সব গর্ত আড়াল হয়েছে বাহারি সব আবাসন প্রকল্পের কংক্রিটের ভেতরে। ধাইধাই করে আকাশ ছুঁয়েছে লাল-নীল বাতি জ্বলা সারি সারি ভবন। অথচ গোটা শহর একসময় কবরখানা ছিল। এখন কোথায় কবর? কোথায় লাশ?
আহত মনে রেজা মাটিতে নামে। মাটি থেকে সূর্য দেখার চেষ্টা করে। আকাশের রং ফিকে, উষ্ণ বাতাস আনমনা। বহুপথ পাড়ি দেয়া রেজা টের পায় সূর্য বাড়ি নেই। মুখ গুঁজেছে পাতালপুরীতে। চোখ মেলবে না বলে পণ করেছে। সূর্যহীন শহরে বিকেলের পায়ে পায়ে নামছে বিষণ্ন রাত। বড় অদ্ভুত এই রাত। এ রাতের বুকে আঁধার নেই। আছে ভুল তালিকার গ্লানি, হিমঝরা বেদনা। আকাশের ভরাট মেঘে ফাটল ধরিয়ে বিদ্যুতের ঝলক রেজার শরীর ছুঁয়ে দেয়। অসময়ে মেঘে মেঘে ঘষা লাগে। সময় কত? পকেট থেকে কালো বেল্টের ক্যাসিও ঘড়িটা দেখে রেজা। ঘড়িতে সময়ের গতি নেই। এই হাতঘড়ি বুকপকেটে রেখেই রেজা বড় হয়েছে। পরীক্ষার হলে ঘনঘন সময় দেখেছে। সময়মতো অফিসেও গিয়েছে।
নিথর ঘড়ির ছাইরঙা ক্যানভাসে সময় দেখে রেজা। সময় নটা বেজে পনের মিনিটে স্থির। তের ডিসেম্বর রাত নটা বেজে পনের মিনিটে বাবাকে যখন ওরা ধরে নিয়ে যায় তখন বাবা হাতে এই ঘড়িটা পরেছিল। পরের দিন শান্তি কমিটির সদস্য বাবার ছাত্র কচি ঘড়িটা মায়ের হাতে দিয়ে গিয়েছিল। বাবার ঘড়িটা পাওয়া গেলেও লাশটা খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ঘড়িটা বুকপকেটে রেখে আবার পথে নামে রেজা, লাশের খোঁজে-যে লাশটা এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। ওকে পথে দেখে আকাশের উজ্জ্বলতম যোগতারাটি আরও জ্বলজ্বলে হয়ে ওঠে।
সাদিয়া সুলতানা
ছাত্রজীবন থেকে লেখক বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখি করছেন। বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান এবং শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জামানের সংকলন ও সম্পাদনায় অন্যপ্রকাশ হতে প্রকাশিত আইন অভিধান ‘আইন-শব্দকোষ’ এ তিনি গবেষণা সহকারীরূপে কাজ করেছেন। বর্তমানে তিনি বিচারক হিসাবে বাংলাদেশ বিচার বিভাগে কর্মরত আছেন। লেখকের গ্রন্থাবলি: চক্র (গল্পগ্রন্থ, ২০১৪), ন আকারে না (গল্পগ্রন্থ, ২০১৭), আমি আঁধারে থাকি (উপন্যাস, ২০১৮), ঘুমঘরের সুখ-অসুখ (গল্পগ্রন্থ, ২০১৯), মেনকি ফান্দার অপরাধ কিংবা পাপ (গল্পগ্রন্থ, ২০২০), আজু মাইয়ের পৈতানের সুখ (প্রকাশিতব্য উপন্যাসিকা, ২০২০)।