একসময় অনিন্দিতার প্রাণের বন্ধু ছিল ক্যাপ্টেন সাইফ। বাংলাদেশ আর্মির একজন তরুণ ক্যাপ্টেন, সাইফুল আলম অলক। ওরা এখন আর বন্ধু নেই। এখন বড়জোর বলা যায় যে ওরা বন্ধু ছিল এককালে। খুব অল্প কয়েকটি মাসের বন্ধুত্ত্ব। সময়ের হিসেবে কালের বিস্তার কম কিন্তু আবেগের ঘনত্ব ছিল ভীষণ তীব্র। একসময়ের ঝকঝকে তরুণী অনিন্দিতা এখন মাঝবয়সী মহিলা। স্বামী আর সন্তান নিয়ে প্রবাসে বসবাস করছে একযুগেরও বেশি সময় ধরে। এই মধ্যবয়সে স্কুল পড়ুয়া ছেলে মেয়ে আর সংসারের কাজে পুরোনো বন্ধুদের কথা খুব একটা মনে পড়ে না অনিন্দিতার। সময় কোথায় কাউকে নিয়ে বিশেষ ভাববার!
প্রতিদিনই অনিন্দিতার মনে হয় আজকের এই দিনটি একেবারেই স্বতন্ত্র। এর আগে এমন আরেকটি দিন আর আসেনি তার জীবনে কোনদিন। খুব সকালে উঠে স্বামীর জন্য নাস্তা তৈরি করা, বাচ্চাদের আলাদা আলাদা টাইমে স্কুলে ড্রপ করা, লাঞ্চ বানানো—ঘর গুছানো আর পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বাতিক এক্কেবারেই সময় দেয়না বর্তমানের অনিন্দিতাকে। সেই কোনকালে বাংলাদেশে মন দুর্বল হওয়া বন্ধু ক্যাপ্টেন সাইফের কথাও মনে পড়ার মত অবসর কই তার! সেইদিনের সেই ছিপছিপে তরুণী এখন মাঝ চল্লিশের স্থুলাকৃতির মহিলা। শরীরে মেদ ভুঁড়ির বাহুল্য, গালে মেছতা। চোখের পাতায় রাজ্যের সন্দেহ আর বিরক্তি নিয়ে তাকায় আশেপাশে সবার দিকে। এখন বিশ্বাস করা কঠিন যে এই মিসেস মজুমদারই একসময়ে বন্ধু মহলের সবচেয়ে জনপ্রিয় তরুণী নন্দিত অনিন্দিতা, সুহাসিনী।
অনিন্দিতার বয়স যখন আঠারো ছিল, যখন ওর চোখের সামনে দেখা পৃথিবীর সবকিছুই ভীষণ রোমাঞ্চকর ছিল। প্রেম আর ভালোবাসার ছোঁয়া লেগে থাকতো প্রতিটি নিঃশ্বাসে। সেইসময়ে প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী অনিন্দিতা মনে মনে খুঁজেছে তার স্বপ্নের প্রেমিককে। নিয়ত পরিচয় হওয়া ছেলেদের ভেতরে খুঁজতে থাকতো কে সেই জন! মনের তরু-পল্লবে ঝিরঝিরে হাওয়া হয়ে দোল দিয়ে যেতে পারে এমন কণ্ঠস্বরের পুরুষের জন্য অপেক্ষা করেছিল সে অনেক নিদ্রাহীন রাত। দিনের আলোতে আশেপাশের পুরুষদের সব্বাইকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে, মনকে প্রশ্ন করেছে, এই কি সেই!
রঙিন প্রজাপতির মতন ফুলেফুলে উড়ে খিলখিল হাসিতে অনেক যুবকের হৃদয় ভেঙে খানখান করে দেবার পর ওর জীবনে এসেছিলো অলক। খুব আয়োজন করে সানাইয়ের করুন অথচ স্নায়ুকে কাতর করে তোলা সুর বাজিয়ে মনের মঞ্জিলে প্রবেশ করা নয়। একেবারেই আচমকা দৈব নির্দেশের মতো অলক দেখা দিলো প্রেমের বিচ্ছুরণের মিষ্টি আলোক রাশির উজ্জ্বলতা নিয়ে। বিডি চ্যাটে নকল নাম নিয়ে চ্যাট করছিলো ওরা দুইজন। একদিন, দুইদিন, আরো কয়েকটি দিন। ব্যাস কেমন করে দুইজনের আঙ্গুলগুলো কি-বোর্ডের প্লাস্টিক আবরণের ভেতর দিয়ে ছুঁয়ে দিতে লাগলো পরস্পরের হৃদয়ের স্পন্দন। লিখে লিখে কথা বলা ফুরায়নি তখনো। দেখা করার সাধ জাগে মনে। চক্ষুদৃষ্টিতে দেখা হবার আগেই মন ছুঁয়ে যাওয়া বালক বালিকারা মুখোমুখি বসে উসখুস করে। মুখে বলার মতো কথাই যেন খুঁজে পাচ্ছিলো না ওরা প্রথম দিন। শুধু চেয়ে থাকা। আর লজ্জায় চোখ সরিয়ে নেয়া।
– আচ্ছা, আমরা দুইজন আবার সিজোফ্রেনিয়ার পেসেন্ট নাতো!
– কেন?
– এই যে, মুখে কিছু না বলেও পড়ে ফেলছি দুইজন দুইজনের মনের কথা।
– ইশ, জ্যোতিষ ব্যানার্জি, আহা!
– বিশ্বাস হলো নাতো! দাও দেখি তোমার ডান হাত খানা। পড়ে বলে দিচ্ছি ভবিষ্যতের কথা।
মুখ ভেংচায় অনিন্দিতা। হাসি চেপে বলে, বুঝি না আমি তোমার ওসব কথা! সবই আমার হাত ছোঁবার বাহানা।
অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয় অনিন্দিতা। সেই প্রথম অলকের স্পর্শ অনিন্দিতার হাতে। লজ্জা কাটাতে জলদি বললো, কই বলো! কি বলে আমার হাতের রেখা? এইজন্মে কবে আমি ভাঙিব কারো ঘাড়ের মাথা!
হাতটি ধরে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে অলক অনিন্দিতার মুখের দিকে। আধুনিক, স্পষ্টবাদী এই মেয়েটিকে তার খুব পছন্দ। ভালোলাগে। ভালোলাগার চেয়েও বেশি কিছু। কিন্তু সম্পর্ক পাকাপাকি করার কথা মুখে উচ্চারণ করতে গিয়ে মনে ভয় কাজ করে অলকের। কথা দিয়ে কথা রাখতে না পারে যদি শেষপর্যন্ত!
হাতের তালুতে হালকা আঁকিবুকি কেটে বলে, মেয়ে তোর কপালে দুঃখ আছে?
– কিসের দুঃখ? বিরহের?
– না, একাধিক বিবাহের।
– সত্যি? দুইটা বিয়ে?
– না। আরো বেশি। আপাতত তিনটা নিশ্চিত।
হাত টেনে নিজের কোলের উপর সরিয়ে নেয় অনিন্দিতা। অলকের কপালে একটি আঙ্গুল ঠেকিয়ে বলে, তিনবারই তোকে বিয়ে করবো। ভয় পাস না।
সর্বসাকুল্যে চারটি দিন দেখা হয়েছিল ওদের। এই চারটি দিন ছিল অনিন্দিতার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় সময়। ভালোবাসায় টইটুম্বুর জোয়ারের জলের মতো একূল সেকূলে উথলে পড়া প্রেমের সময় তখন প্রতিটি মুহূর্ত। অলক রোজ একটি করে উপহার আনতো অনিন্দিতার জন্য। প্রথমদিন হাতে হলুদ গোলাপ আর দুইটি সিনেমার ডিভিডি। অলক চেয়েছিলো অনিন্দিতাকে তার নিজের সকল পছন্দের সাথে যত জলদি সম্ভব পরিচয় করিয়ে দেয়।
ডিভিডি দুইটির একটি ছিল “Scent of a Woman,” আল-পাচিনোর সাথে অনিন্দিতার প্রথম পরিচয় হয় এই মুভিটি দেখে। আরেকটি মুভি ছিল “A Walk in the Clouds,” কিয়ানু রিভস আগে থেকেই তার প্রিয় অভিনেতা। দুইটি ডিভিডি অনিন্দিতা কত হাজারবার যে দেখেছে তার হিসেব নেই। অথচ বর্তমানের এই অনিন্দিতা, বাড়িতে টিভির চ্যানেল বদলাতে গেলে ফ্লিম ফোরে হঠাৎ করে যদি সিনেমা দুটির একটিও চলতে দেখে, কোন ভাবান্তর হয় না ওর মনে। বিরক্তি নিয়ে টিভির রিমোট টিপে অন্য প্রোগ্রাম খুঁজতে থাকে। আঙ্গুলগুলো ব্যস্ত হয়ে যায় আরো ভালো কোন প্রোগ্রাম দেখাচ্ছে কিনা সেই খোঁজে। হয়তো টিভিতে আজকাল রান্নার অনুষ্ঠানগুলোই সবচেয়ে ভালো বানাচ্ছে।
দ্বিতীয় দিন দেখা করে অলক জেদ ধরলো অনিন্দিতাকে সে ড্রাইভিং শেখাবে। তার ভীষণ ইচ্ছে হয়েছে মনে, অনিন্দিতা গাড়ি চালাবে আর সে নিজে পাশে বসে গাড়ির কাঁচ নামিয়ে হাওয়া খাবে ঠিক যেইভাবে অনিন্দিতা এখন হাওয়া খাচ্ছে। অলক সোজা চলে যায় সেনাকুঞ্জের পেছনের কারপার্কে। অলকের গাড়ির সামনে সেনাবাহিনীর পার্কিং স্টিকার লাগানো ছিল তাই পরিচর্যাকারী লোকেরাও একবার তাকিয়ে আবার ফিরে গেলো নিজের কাজে। জীবনে সেই প্রথম অনিন্দিতার ড্রাইভিং সিটে বসা। গাড়ি চালানোর চেয়েও বেশি ভয় করছিলো ঐযে গিয়ারে ওর হাতের উপর চেপে বসা অলকের হাতের চাপ। নিঃশাস বন্ধ হবার উপক্রম আর কি! তবু ভালো, সেদিন সেনাকুঞ্জের কোন দেয়ালে ধাক্কা মারেনি গাড়িটি। বরং হৃৎপিণ্ডের ধুকধুকানি শুধুমাত্র বুকের পাঁজরে খাঁচার দেয়ালেই মাথা কুটে মরেছে বার কয়েক।
অনিন্দিতার সামনে আসলে অলকটা কেমন ছেলেমানুষ হয়ে যেত। একদম গুলিয়ে যেত ওর চেনা পৃথিবীর সবকিছু। লজ্জায় কিংবা প্রেমে অলকের মুখটি খুব লাল হয়ে থাকতো। কথা বলতে গিয়ে কেমন তোতলাতো। যদিও মুখের উচ্চারণ নিয়ে কোনোদিন কারো সামনে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়নি ওকে এর আগে কখনো। অনিন্দিতা ঠিক বুঝতে পারতো অলকের মনের তরঙ্গে কী ঝড় উঠেছে। অলকও বুঝতো অনিন্দিতা মনের ভেতরে তারই প্রেয়সী, স্বপ্নের রানী। ঢেউয়ের তালেতালে এইভাবে দুলছিল দুইটি হৃদয়। সারাক্ষণ কী হয়, কী হয় ভয়। সাহসী মেয়ে অনিন্দিতা আগ বাড়িয়ে অলকের আবেগকে উজানে নিয়ে নিদারুণ পরিণতির দিকে টেনে নিতে তাড়া দেয়নি একদমই। ওর মনে হয়েছিল, চলুক না সময় এভাবেই। এতো জলদি করার কি আছে! আমি তো আছিই। আর সেও আছে। চিরদিন থাকবে বলেই বিশ্বাস ছিল অনিন্দিতার মনে।
দ্বিতীয়দিন ওরা নিউমার্কেটে গিয়েছিলো। উদ্দেশ্য ফুচকা খাবে। নিউমার্কেটের দুই নাম্বার গেটের পাশের দোকানের ফুচকা অলকের খুব প্রিয়। অনিন্দিতাকে সেটা খাওয়াতে চায়। ফুচকার দোকানে বসে সাদা টিস্যু পেপারে কিছু কাটাকুটি করছিলো অনিন্দিতা। তারপর তার ব্যাগ থেকে পোষ্ট অফিসের একটি হলুদ খাম বের করে টিস্যুটি সেই খামে ভরে উপরে অলকের আর্মি অফিসার্স কোয়ার্টারের ঠিকানাটি লিখলো। যতই অলক জানতে চায় কী লেখা আছে সেখানে, অনিন্দিতা ততই দৃঢ়তার সাথে জানায়, “না, একদম সম্ভব না।“ কিছুতেই জানানো যাবে না কী লেখা আছে ঐ টিস্যু পেপারে। বাংলাদেশের ডাক বিভাগের দয়ায় যদি এই হলুদ খাম অলকের হাতে সত্যি পৌছায় কোনদিন, তবেই সে জানতে পারবে কী লেখা আছে ওর ভেতর। হাতে পায়ে ধরে অনেক অনুনয় বিনয় করেও কোন লাভ হলো না বেচারা অলকের।
এতক্ষণে পাঠক হয়তো ভাবছেন, আচ্ছা অনিন্দিতা কেমন করে এসব কথা ভুলে যেতে পারলো! ভুলে যাওয়া কী সম্ভব! কোনোদিন! কিছুই কি মনে পড়ে না? অলকের সাথে সাক্ষাতে কাটানো অবিমিশ্র পুলকিত চারটি দিন আর ইন্টারনেট ও ফোনের কয়েকটি মাসের কথা সত্যি কি মুছে ফেলতে পেরেছে সে তার জীবন থেকে? অলকের কথা অনিন্দিতার মনে পড়ে না, নাকি মনে করতে চায় না?
অবশ্য মনে করেই বা কী লাভ? স্মৃতির পাতায় হারিয়ে যাওয়া সেই দিনগুলোকে কিংবা প্রিয় মানুষটিকে তো ফিরে পাওয়া যাবে না কোথাও। অনিন্দিতার মনে খুব অভিমান জমে আছে। কিচ্ছু মনে করতে চায় না সে। যে মানুষটা ওকে পাগলের মতো ভালোবেসে, অন্ধ প্রেমিকের মতো আশ্বাসে বিশ্বাসে নিবিড় বন্ধন গড়েছিলো, মনে হয়েছিল অনিন্দিতার চেয়ে তারই ভালোবাসা কয়েকশ গুন্ বেশি, কেন সে হঠাৎ করে ওভাবে মুখ ফিরিয়ে নিলো? প্রাণের প্রাঙ্গনে শিকড়ে মাটিতে জলে ছায়ায় আচ্ছাদিত হয়ে থাকা সতেজ গাছটিকে অমন করে উপড়ে ফেলে দিতে পারলো! তাহলে আর তাকে মনে রাখবে কেন অনিন্দিতা! প্রতারকের জন্য কোন মমতা পোষণ করে না সে তার বুকে। তারচেয়ে ঢের ভালো এই মধ্যবিত্ত জীবন। ভাত রাঁধো, বাচ্চা পালো, অন্ধকারে স্বামীর নাক ডাকার তীব্র শব্দে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা খুঁজে নাও। মন্দ না। অন্তত এটা নিশ্চিত যে আনরোমান্টিক স্বামীটি তার স্ত্রীকে রাস্তার মাঝখানে ফেলে রেখে হঠাৎ কোথাও হারিয়ে যাবে না অন্তত।
তাই অনিন্দিতাও সম্পূর্ণরূপে মুছে ফেলেছে অলকের নাম নিজের মন থেকে। স্মৃতির পাতা থেকে। কোনদিন কেউ যদি জানতে চেয়েছে,কখনো ওর জীবনে প্রেম এসেছিল কিনা! অনিন্দিতা নির্দ্বিধায় উত্তর দিয়েছে – না।
– কেন?
– কাউকে ভালো লাগেনি আমার।
– কাউকেই না?
– না। বসন্তের বাতাস খুব দামি গো বৈরাগী। সংসারী মানুষের মনে লাগে না এই বাতাস।
বাকিটুকু রহস্যময় হাসি দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্বাসঘাতকের পরিচয় কোনদিন সে দেবে না তার নিজের মুখে। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক সেই নাম আর মানুষটি ওর তারুণ্যের অতি মূল্যবান স্মৃতির পাশ থেকে এক জীবনের মতো।
কিন্তু মানব জীবন দীর্ঘ ও রহস্যময়। সরল হাঁটা পথের মাঝেও প্রহেলিকা লুকিয়ে থাকে। কারণ জানা থাক আর নাই থাক, আচমকা হানা দেয় তা রুটিন মাপা জীবনের অন্ধকার বাঁকে। অলকের সাথে দেখা হলো অনিন্দিতার। কত বছর পর? তা ঠিকঠাক মত হিসেবে করলে চব্বিশ বছর তো হবেই। তারমানে দুই যুগ। মাঝখানে চব্বিশটি বছর পার হয়ে গেলেও ওরা কিন্তু ঠিকই চিনতে পারে একে অপরকে। মাত্র কয়েক মুহূর্তের দৃষ্টি বিনিময়। ঠিক সিনেমায় দেখা স্লো-মোশন সিনের মত: চারপাশে সবকিছু ছুঁটে চলছে দ্রুত, শুধু দুটি প্রাণী হঠাৎ থমকে গেছে প্রাণে। তাদের মাথা ঝিমঝিম। গায়ের সব রক্ত হুড়মুড় করে উঠে এসেছে মুখের চামড়ার নিচে। ছলকে পড়ে অনিন্দিতার হাতের চা। গ্লাসের স্কচ ভিজিয়ে দেয় অলকের সাদা শার্টের একপাশ।
কয়েক সেকেন্ড মাত্র। অনিন্দিতা সামলে উঠলো প্রথম। সেদিন তাদের পরিচিত বাঙালি জসিম সরকারের বাসায় গেট-টুগেদার পার্টি ছিল। দশটি পরিবার নিমন্ত্রিত হয়েছিল। নয়টি পরিবার পরস্পরের পরিচিত। শুধু একটি পরিবার নতুন, বাংলাদেশ থেকে কিছুদিন আগে আসা ঢাকা সেনানিবাসের আর্মি অফিসার সাইফুল আলম। বাংলাদেশ সরকার প্রতিবছর একজন করে আর্মি অফিসারকে ইংল্যান্ডে পাঠায়। তারা সরকারের খরচে সেখানে লেখাপড়া করে, আশেপাশের দেশ ভ্রমণ করে, স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে পুরো একটি বছর থাকে ইংল্যান্ডে। অনিন্দিতার মনের খুব গভীর তলায় ক্ষীণ প্রত্যাশা ছিল, একদিন হয়তো অলক আসবে অন্যান্য সেনাবাহিনীর অফিসারদের মতো। অলক কিন্তু কখনই ভাবেনি এতো বছর পর এতো দূরের দেশে এসে দেখা হয়ে যাবে ওর প্রিয় কদম রেনুর সাথে। ওর প্রথম প্রেম। বিণৎ খরখরে মিলিটারি বুটের আওয়াজ তোলা জীবনে বেহেলার সুর হয়ে দোলা দিয়ে গিয়েছিলো যে নারী প্রথম, সে ছিল অনিন্দিতা। আবেগের উচ্ছাসে বেসামাল মস্তিস্ক কখনো ঠিকভাবে বলতেই দেয়নি ওকে হৃদয়ের কথা। প্রণয়ের কথা। কিন্তু অলক জানতো, প্রকাশ না করলেও অনিন্দিতা ঠিক বুঝতে পারতো ওর ভালোবাসার কথা। আজ এতো বছর পর এমন আচমকা দেখা হয়ে যাওয়ায় বিব্রতবোধ করে কি অলক!
জসিম ভাইয়ের কনজার্ভেটরিতে সোফার এক কোনে বসেছিল অনিন্দিতা। কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না আজ ওর। অন্যান্য মহিলারা সবাই ড্রয়িংরুমে খুব আড্ডায় মেতেছে।
অলক অনিন্দিতার কাছে গিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলে, কেমন আছো অনু?
এতোদিন পরেও বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো অনিন্দিতার! গলা দিয়ে স্বর বেরুতে চায় না। ফিসফিসিয়ে বলে, ভালো আছি। তুমি?
– আমিও ভালো আছি। অনেক বছর পর তোমাকে দেখে খুব ভালো লাগছে।
– তাই নাকি?
অনিন্দিতার বিদ্রুপ গায়ে মাখে না অলক।
– দেশে সবসময় তোমাকে খুঁজেছি। সবখানে। আসার দিন এয়ারপোর্টেও মনে হচ্ছিলো হয়তো ঠোকাঠুকি হয়ে যাবে তোমার সাথে আজকেই। কিন্তু এখানে এসে দেখা হবে, ভাবিনি।
– আমি জানতাম, তোমার সাথে আমার একদিন এভাবেই দেখা হবে।
– তুমি অনেক বদলে গেছো অনু। আগে এমন খুঁচিয়ে কথা বলতে পারতে না তুমি।
– বদলে যাওয়ার নামই তো বেঁচে থাকা। বদলাতে না পারলে সেই কবেই মরে যেতাম।
– আমার তোমাকে কিছু বলার আছে অনু।
– কি লাভ এখন সেসব শুনে। জীবন আমাদের পার হয়ে এসেছে লক্ষ লক্ষ ব্যবধানের পথ। আমরা এখন আর সেই আগের আমরা নেই অলক।
– তবুও আমি বলতে চাই। আমাদের এই জীবনের অদলবদল সম্ভব হবে না আর কোনদিন জানি। কিন্তু তোমাকে আমি যে আঘাত দিয়েছি তার জন্য একটু অনুতাপ করার সুযোগ চাই।
অনিন্দিতার চোখ দুটি জলে ভরে যায়। উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে বাগানের চেরি ব্লসমের দিকে।
তৃতীয় দিন অলক এনেছিল অনেকগুলো চকলেট। বিভিন্ন রকমের চকলেটের ভেতর ছিল কয়েকটি সারপ্রাইজ চকলেট এগ।
অনিন্দিতা বলেছিলো, তুমি আমাকে এতো চকলেট খাওয়াচ্ছ কেন? আমাকে মুটি বানিয়ে তোমার লাভ?
– এই কয়টা চকলেট খেলে মুটি হয়ে যাবেন না মিস স্লিম।
– যতদিন আমি মিস আছি ততদিন আমি স্লিমই থাকতে চাই। তোমার বৌকে খাইয়ো এসব চকলেট।
– তাকেই তো খাওয়াচ্ছি।
– মানে?
– মানে কিছু না। এমনি বললাম। কিন্তু বিয়ের পর মুটি হওয়া যাবে না বলে দিচ্ছি। আমি মোটা মেয়ে একদম পছন্দ করি না।
বাচ্চাদের কেউ দৌড়ে এসে অনিন্দিতার কাছে কোক চাইলো। সম্বিৎ ফিরে পায় অনিন্দিতা। বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে এখন। সোফা থেকে উঠে বাচ্চাটিকে কোক ঢেলে দিতে গিয়ে দেখলো টেবলের উপর একটি কাগজে একটি মোবাইল নাম্বার লেখা। হাতের লেখাটি অপরিচিত হলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না এটা অলকের ফোন নাম্বার। মনের ভেতর হারিয়ে গিয়ে খেয়ালই করেনি কখন অলক চলে গিয়েছে অন্য ঘরে।
পরের কয়েকটি দিন অনিন্দিতার খুব অস্থির কাটে। সকাল নয়টার ভেতর বাড়িতে সে একা হয়ে যায়। সাধারণত এই সময়ে সে নিজের মতো কিছুটা আলসেমি করে। গরম চায়ের মগ হাতে নিয়ে অনিন্দিতা ভাবে, অলককে কি ফোন করা উচিত? নাকি তাতে বিপত্তি ডেকে আনবে শুধু নিজের নিরবিচ্ছিন্ন সংসারে! ওরা তো এখন আর কেউ কারো বন্ধু না। বিবাহিত মানুষদের আসলে আগের জীবনের আবেগগুলোকে নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করা ঠিক না। কিন্তু অনিন্দিতার মন বলছে, অলক ওর ফোন কলের অপেক্ষায় আছে। প্রতিমুহূর্তে হাতের মুঠোফোনটি লুকিয়ে রাখছে নিজের হাতের ভেতর। যদি ফোন আসে! বাইরে আবহাওয়া মাইনাস চার আর ঘরের ভেতর রুম হিটিংয়ের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে অনিন্দিতার মনে পড়ে অলকের সাথে ওর শেষ দেখা হওয়া দিনটির কথা।
অলক সেদিন একটি সাদা গেঞ্জি আর জিনসের প্যান্ট পরে এসেছিলো। অলকের ছোট্ট গাড়িটিতে করে ওরা শহর থেকে অনেকটা দূরে বেড়াতে গিয়েছিলো। একটি সবুজ মাঠের কাছে গিয়ে গাড়ি থামায় অলক। খুব সাধারণ কথাবার্তা, ঠাট্টা, হাসি-কৌতুক, হাহা-হিহি করে কেটে গেলো সেদিন পাঁচটি ঘন্টা। অলক খুব শোভন ছেলে ছিল। কখনো অশালীন কথা বলা কিংবা গায়ের উপর ঝুঁকে পড়ার খারাপ অভ্যাস ছিল না ওর। সেদিন বাড়ি ফেরার সময় গাড়িতে ইংরেজি গান বাজছিলো। গানের সুর ছাপিয়ে অলক বলেছিল, আমার ভাবীকে তোমার ছবি দেখিয়েছি অনু।
– কেন?
– এমনি। তাছাড়া তোমার কথা তো জানাতে হবেই একদিন, তাই না?
অনিন্দিতা চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ।
– ভাবী কী বললো আমার ছবি দেখে!
– বলেছে, মিষ্টি। আম্মুকে দেখাতে চেয়েছে। আমি বলেছি, আমি নিজেই জানাবো আম্মুকে।
– এখনই জানাতে হবে? যাক না আরো কিছু দিন।
– আমি আব্বুকে খুব ভয় পাই। আব্বুকে নিয়ে চিন্তায় আছি।
অলকের সিরিয়াস চিন্তিত মুখ দেখে হেসে ফেলে অনিন্দিতা।
– হয়েছে বাবা। তোমাকে আর এতো ভয় পেতে হবে না। যা হয় দেখা যাবে। এখন সাবধানে গাড়ি চালাও তো।
সেদিন বাড়ি ফিরে গোসল করে মাথার ভেজা চুল গামছায় ঝাড়তে ঝাড়তে অনিন্দিতার মনে হয়েছিল এই জীবনে আনন্দ বলতে ওর অলকই আছে একমাত্র। প্রাণের কাছাকাছি, হৃদয়ে শিহরণ জাগানো পুরুষ দেখেছে সে কেবল এই একজনেরই ভেতরে। প্লেট্রনিক ভালোবাসায় আচ্ছন্ন অনিন্দিতার বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা আসে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত আসে। রাত একসময় গভীর হয়। গভীর রাতের নিস্তব্ধতায় প্রেমিকের বাঁশি বাজে। অলক ফোন করেছে।
– আজ এতো দেরি করলে যে ফোন করতে! টায়ার্ড হয়ে গেছো গাড়ি চালিয়ে! অভিযোগ করে অনিন্দিতা।
– না। টায়ার্ড হইনি। একটু গম্ভীর শোনায় সেই মুহূর্তে অলকের কণ্ঠস্বর।
– তাহলে কী? বেশি আহ্লাদিত!
অলক কেমন ইতস্তত করে। অনেকক্ষণ চুপ হয়ে থাকে। অনিন্দিতা বুঝে পায় না কী হতে পারে কারণ। আজ সারাটাদিন ওরা একসাথে অনেকটা সময় কাটিয়েছে। অলকের কথা না জানলেও অনিন্দিতা চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারে এটা ওর জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। ভালোবাসার সরল বাক্যটি উচ্চারণ না করেও, কানায় কানায় পরিপূর্ণ ভালোবাসাময় এমন আরেকটি দিন অনিন্দিতার জীবনে আসবে না আর কোনোদিন। ল্যান্ডফোনের তার আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে অলকের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে থাকে অনিন্দিতা। কথা না বললেও টেলিফোনের ওপাশে অলকের উপস্থিতি উপভোগ করছে তখন।
– অনু, একটি কথা।
– বলো। আমি শুনছি তো।
– তোমাকে বলেছিলাম না যে আমার ভাবীকে তোমার ছবি দেখিয়েছিলাম! ভাবী আমাকে না জানিয়ে আম্মুকে বলে দিয়েছে তোমার কথা। আম্মুর কাছ থেকে আব্বুও শুনেছে গত সপ্তাহে। অথচ আমাকে কেউ কিচ্ছু বলেনি।
অনিন্দিতার শরীর শক্ত হয়ে যায়। কান খাড়া করে আছে তারপর কী হলো শুনবে।
অলক মনে হলো গলায় পানি ঢাললো। তারপর একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলার শব্দ ভেসে আসে টেলিফোনের তার বেয়ে। অলক খুব ফিসফিসিয়ে কথা বলছিলো। যেন খুব লুকিয়ে কথা বলতে হচ্ছে ওকে।
– অনু, আজ বিকেলে বাড়ি ফিরতেই আমার ভাবী দৌড়ে আসে আমার কাছে। বললো, সন্ধ্যায় বাড়িতে মেহমান আসছে। জানতে চাইলাম, কে? বললো আব্বুর এক বন্ধু ও তার পরিবার। আংকেলকে আমি আগে দেখিনি কখনো। নাম শুনেছি বলেও মনে পড়লো না। আমরা সবাই একসাথে ডিনার করলাম। ডিনার শেষে আমি আমার নিজের ঘরে গিয়ে ভাবছিলাম তোমার সাথে একটু কথা বলি। তখন ভাবী আমার ঘরে এসে জানালো, আমাকে ভাইয়ার ঘরে যেতে হবে। কারণ আংকেল সাথে সে মেয়েটি এসেছে তার সাথে আমার বিয়ে কথা হচ্ছে। মুরুব্বিরা সবাই চাচ্ছে আমরা দুজন যেন নিজেদের ভেতর একটু আলাপ পরিচয় করে নেই।
কথা থামিয়ে চুপ করে অলক। ফোনের ওপাশেও কোন কথা নেই। কথা না বললেও কানের দুলে টেলিফোনের ঘষাঘষিতে অলক বুঝতে পারে অনিন্দিতা আছে ফোনের ওপাশে। অলক জলদি বলে ফেলতে চাইলো ওর কথাগুলো।
– দেখো অনু, মেয়েটির তো কোন দোষ নেই। ভীষণ শান্ত আর সরল মনে হলো মেয়েটাকে। আব্বু চান আমি উনার বন্ধুর মেয়েকে বিয়ে করি। এখন আমি যদি না করি আমাদের পুরো পরিবারটিতে ভয়ঙ্কর ঝড় উঠবে। আর তুমি জানো, আমি তেমন সাহসী ছেলে না। আমি কী করবো অনু?
– আমি বললে তুমি শুনবে?
– আমি জানি না। আমার খুব ভয় করছে।
– তুমি মেয়েটিকে বিয়ে করে তোমার পরিবারকে শান্ত রাখো। আর আমাকে বিয়ে করে আমাদের প্রেমটিকে বাঁচিয়ে রাখো। পারবে?
– কী বলছো তুমি এসব? সে অসম্ভব।
– তাহলে আর আমাকে জিজ্ঞেস করছো কেন! সিদ্ধান্ত তো তোমার নেয়াই হয়ে গিয়েছে। এখন আমাকেও জানানো হয়ে গেলো। ব্যাস। অভিনন্দন গ্রহণ করুন প্রাক্তন প্রেমিক আমার। নাকি প্রেমিক শব্দটা বেশি বলে ফেললাম?
– পারলে আমাকে ক্ষমা করো অনু। আমি তোমার যোগ্য না।
ফোনের লাইন কেটে দিয়েছিলো সেদিন অনিন্দিতা নিজেই। তারপর দিনগুলো কিভাবে যে পার করেছিল সেকথা শুধু অনিন্দিতা নিজেই জানে। খুব কষ্টের ভেতর বারবার মনে হতো অলক যদি একটিবার ফোন করতো ওকে! ভালোবাসার কথা নাই বলুক, সাধারণ বন্ধুর মতো থাকুক পাশে। অনিন্দিতা কান পেতে শুনতে চাইতো অলকের কথা। ওর নতুন বিয়ে করা শান্ত- লক্ষী বৌটির কথা। কিন্তু অলক কিভাবে যেন পেরেছিলো! না একটি ফোন কল। না একটি ইমেইল। না একদিন বাড়ির সামনে রাস্তায় এসে অন্ধকারে চুপিচুপি দাঁড়িয়ে থাকা! কোথাও দেখা যায়নি অলকের বিন্দুমাত্র চিহ্ন। অনিন্দিতা অলকের নাম্বারে অনেকবার ফোন করেছে। ফোন নাম্বার বন্ধ। অনেকগুলো ইমেইল করেছিল। একটিরও জবাব আসেনি। এতো ভালো একজন সঙ্গী এমন করে জীবন থেকে হারিয়ে গেলো আচমকা! অথচ ওরা দুইজনই ঢাকা শহরে বাস করে তখন। শত লোকের ভিড়ে ভুল করেও দেখা হয়ে যায়নি ওদের আর কোনদিনই। আর দেখা হলো দুই যুগ পর! এই শীতের দেশে প্রবাসী এক ঘরণীর সাথে!
পার্স থেকে ফোন নাম্বার লেখা কাগজটি বের করে মোবাইলে নাম্বারগুলো চাপে অনিন্দিতা।
– হ্যালো।
– কথা বলতে পারবে এখন?
– অনু?
এতো বছর পরেও সেই ডাকটি শুনে আবার দম বন্ধ হয়ে আসে অনিন্দিতার।
– আমি মিসেস মজুমদার। আশা করি আমাকে তুমি এই নাম ধরেই ডাকবে।
– আমাকে ক্ষমা করতে পারোনি এখনো জানি। তবুও আমি তোমার ক্ষমাপ্রার্থী।
– কী যেন বলতে চেয়েছিলে, বলো।
– দেখা করবে একবার? প্লিজ।
– দেখা করে কী লাভ? ফোনেই বল।
– না। ফোনে না। শুধু একদিন দেখা করো। খুব বেশি সময় নেবো না তোমার মিসেস মজুমদার।
ঠিক হয় স্টারবাকস কফি শপে দেখা করবে ওরা সকাল এগারোটায়। অনিন্দিতার জন্য সময়টা সুবিধার। অলকও ম্যানেজ করে চলে আসে দেখা যথাসময়ে। অলক অর্ডার করলো আগের মতো অতিরিক্ত চিনিযুক্ত কাপাচিনো আর অনিন্দিতা নিলো একটি আইস কফি, চিনি ছাড়া। টেবিলের উপর দুজনের দুই কাপ কফির দিকে তাকিয়ে থাকে অনিন্দিতা। বলে, ভালোই হয়েছিল আমাদের দুজনের সংসার বাঁধতে হয়নি। আমরা দুইজন আসলে দুই মেরুর মানুষ ছিলাম অলক। তুমি ভীষণ উষ্ণ, সুগারযুক্ত, মিষ্টি রগরগে কফি আর আমি দেখো কেমন শীতল, ম্যাটমেটে আর পানসে। আমাদের জন্য একমাত্র বিচ্ছেদই সঠিক ছিল।
দুঃসাহসীর মত অলক নিজের হাতটি রাখে টেবিলের উপর অনিন্দিতার হাতে।
– অনু, আমাকে ক্ষমা করে দাও, প্লিজ। যদি পারো তুমি আমার উপর কোনো রাগ জমা করে রেখো না আর।
হালকা ভাবে নিজের হাতটি সরিয়ে নেয় অনিন্দিতা। বলে, দেখ অলক, জীবন আমাদের এখন অনেকটা পথ পার হয়ে গিয়েছে। এখন তুমি চাইলেও আর আমার হাত ধরতে পারো না। আমি এখন আর তোমার কেউ হই না।
– সেদিন তোমাকে ওভাবে দুঃখ দেয়া ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না অনু।
– আমি শুনতে চাই না ওসব কথা। ভুলে গেছি আমি সেসব দিন।
– আমি বলতে চাই। তোমার সাথে কথা না বলে, তোমাকে না দেখে থাকতে আমার খুব কষ্ট হয়েছে অনু। কিন্তু আমার কোন উপায় ছিল না।
– কেন, তোমার আব্বু কী তোমাকে গুলি করে মেরে ফেলতো হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করলে?
– গুলি করতো। আমাকে না। নিজেকে।
– ভয় দেখিয়েছে তোমাকে। কোনদিনই করতো না তেমন কিছু উনি।
– দেখো অনু তোমাকে আমি শেষের দিন ফোনে বলেছি আজ আবার বলছি, তুমি যেমন সুন্দর একটি পরিবারে বড় হয়েছ, আমার পরিবারের মানুষদের চিন্তা তোমার মতো উদার না। তোমাদের মন মানসিকতার সাথে আমাদের পরিবারের তুলনা হয় না অনু। আমার জন্ম খুব রক্ষণশীল পরিবারে। আমি আমার কৈশোর- তারুণ্য- আর যৌবনে খুব সতর্ক ছিলাম, আমি যেন কারো প্রেমে না পড়ি। আমাদের পরিবারে প্রেম একটি ভয়ঙ্কর শব্দ। সব সময় আমাদেরকে সেই কথা মনে করিয়ে দেয়া হতো। তারপরেও আমি কেমন করে তোমাকে জড়িয়ে ফেলেছিলাম। আমাকে তুমি পারলে ক্ষমা করে দিও। এর বেশি কিছু আসলে আমার বলার নেই। এই যে এতো বছর পর তোমাকে দেখলাম, তোমার সামনে বসে নিজের অক্ষমতার জন্য ক্ষমা চাইতে পারলাম, নিজেকে আমার আজ হালকা লাগছে। জগদ্দল একটি পাথর চেপে ছিল এতদিন আমার বুকের উপর।
– আমি তোমাকে কত লক্ষবার ফোন করেছি অলক! তুমি একটিবার ফোন ধরোনি!
চুপ করে থাকে অলক।
– অনেকগুলো ইমেইল করেছিলাম তোমার ইমেইলে। একটিরও উত্তর দাওনি। প্রেম চলে গেলে কি মানুষ রাতারাতি সম্পূর্ণ অচেনা – অপরিচিত হয়ে যায় অলক! আমাকে কি ওটুকুই চিনেছিলে তুমি, যে বিয়ে না করলেই তোমাকে আমি মিথ্যাবাদীর অপবাদ দিতাম! কি যে ভীষণ মিস করেছি আমি তোমাকে তখন অলক, তুমি চিন্তাও করতে পারবে না। আমার মতো মেয়ে!
– সেদিন ফোনে তোমাকে আমি সবকথা বলিনি অনু। বলতে পারিনি। সেই রাতেই সানজিদার সাথে আমার বিয়ের কাবিন হয়। আব্বু আম্মুরা আগে থেকেই সব ঠিক করে রেখেছিলো। আমাকে ভরসা করতে পারেনি তারা। কাবিনের পর দেখি আমার খাটেই ফুল দিয়ে বাসর সাজিয়ে ফেলেছে আমার ভাবী। পরদিন সকালে আমার মোবাইল ফোনটি থেকে পুরোনো সিম খুলে ভাইয়া নতুন একটি সিম ভরে দেয়। পারিবারিক ব্যস্ততায় কয়েকটি সপ্তাহ কেটে যাবার পর নিজের ভেতর খুব অপরাধবোধ কাজ করতে থাকে অনু। তোমার ফোন নাম্বারটি মুখস্ত থাকলেও তোমার সাথে কথা বলার সাহস হয়নি আমার। তাছাড়া সানজিদার সাথেও সম্পর্কটা কেমন যেন সুন্দর হয়ে উঠলো দিনে দিনে। মনে হলো তোমার সাথে যোগাযোগ রাখা মানে সানজিদার সাথে প্রতারণা করা। নিজেকে অতটা নিচে নামাতে পারিনি অনু।
– আর আমার সাথে যে প্রতারণা করলে খুব! তার কি বিচার!
– আমি জানি না। তুমি শাস্তি দাও আজ। আমি মাথা পেতে নেবো।
কথা হারিয়ে স্থবির হয়ে থাকে দুইটি মানুষ। কফির মগদুটো টেবিলের উপর তেমনই পড়ে থাকে। আইস কফির মগে এখন পড়ে আছে অপেয় ঠান্ডা কফি। আর কাপাচিনোর মগে বাড়তি তিন চামচ চিনি গলে কফির সাথে ভাসছে মিলেমিশে। নরম আর গরম দুটো পাশাপাশি চলতে চলতে মাঝামাঝি সঠিক তাপমাত্রা নিজেরাই খুঁজে নেয় একসময়। জীবনকেও চলতে দেয়া উচিত তার নিজস্ব গতিতে। ব্রহ্মান্ডের কোথাও হয়তো জমা হয়ে থাকবে অলকের ব্যর্থতার গ্লানি। অনিন্দিতার অভিমানের দীর্ঘশ্বাস। বাতাসে বাতাস ভেসে জল, কণা, আলো গায়ে মেখে তারাই একদিন ফোটাবে প্রেমের অসম্ভব সুন্দর কোন নাদেখা ফুল। কেবল মিলন হলো না বলেই ভালোবাসা মিছে হয়ে যায় না। প্রেমিকের মনে নিজের অগোচরে ঠিক বেঁচে থাকে প্রেম। স্নেহ। ভালোবাসা। স্পর্শের আকাঙ্খা।
দুই যুগ আগের লাজুক অলক যা করতে সাহস পায়নি আজ তাই করলো। চুমু খেলো অনিন্দিতার গালে। তবে এই চুমুতে শিহরণের চাইতে মমতার মাখামাখি অনেক বেশি।- ভালো থেকো অনু।
– তুমিও।
– একটি কথা জিজ্ঞেস করলে বলবে প্লিজ। সেদিন হলুদ খামের ভেতর কী লিখেছিলে তুমি? বাংলাদেশের ডাক বিভাগের দায়িত্বশীলতার কথা তো জানোই। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে।
সেই সেদিনের মতোই বুকের ভেতর অপরিসীম ভালোবাসা নিয়ে অনিন্দিতা স্টারবাকসের একটি টিস্যু পেপারের উপর খুব যত্ন করে লিখে দিলো কয়েকটি লাইন:
“আমার লতার একটি মুকুল,
ভুলিয়া তুলিয়া রেখো – তোমার অলক বন্ধনে৷
আমার স্মরণ-শুভ-সিন্দুরে,
একটি বিন্দু এঁকো – তোমার ললাট চন্দনে৷”
–
লুনা রাহনুমা
কলেজে পড়ার সময় থেকে লেখা শুরু। বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক ও সাপ্তাহিকীতে লেখা প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশে একটি পাক্ষিক পত্রিকায় রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেছেন বছর খানেক। তারপর একটি দৈনিকে ছয় মাস কাজ করার পর স্থায়ীভাবে যুক্তরাজ্যে বসবাস আরম্ভ করেন ২০০৬সাল থেকে। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ দুইটি। “ভালোবেসে এঁকে দিলাম অবহেলার মানচিত্র”(১৯৯৮), “ফুঁ”(২০২০)। লেখার শুরু কবিতা দিয়ে হলেও বর্তমানে বেশ কিছু অণুগল্প, গল্প, ও ধারাবাহিক গল্প প্রকাশিত হয়েছে কয়েকটি অনলাইন সাহিত্য ম্যাগাজিনে। কর্মজীবনে তিনি একজন পে-রোল একাউন্টেন্ট হিসেবে কাজ করছেন।