‘মনে আছে তো’? সারা মুখে হাসির ঝিলিক তুলে সে জিজ্ঞেস করে। মুখের সে কমনীয়তা কবে চলে গেছে। চোখের নীচে কালি, একটু ঘোলাটে চোখের সাগর-নীল মণি, গালের হাড় উঠে এসেছে বিশ্রীভাবে, একসময়ের উজ্জ্বল সোনালী চুলগুলো জটা পাকিয়ে গেছে। কিন্তু মুখের সেই ভুবনভোলানো হাসিটি এখনও অটুট আছে। সহাস্য মুখে প্রশ্নটি সে ছুঁড়ে দেয় যে মুহূর্তে আমি মেয়েটির হাসপাতাল-ঘরে প্রবেশ করি।
‘একদম মনে আছে। তুমি সেরে ওঠো, তারপর সব হবে।’ আমি একটু এগিয়ে গিয়ে ওর শীর্ণ প্রায় রক্তশূন্য হাতটি নিজের হাতে তুলে নেই। ‘কথা দিচ্ছ?’, মুখের ক্লান্ত হাসিটি ধরে রেখেই সে প্রশ্ন করে। ‘কথা দিলাম। কিন্তু তুমি সেরে ওঠো আগে।’ শিশুর মতো উচ্ছ্বসিত আনন্দে তার বিছানার পাশে বসা মা’য়ের দিকে তাকিয়ে সে বলে ওঠে, ‘দেখেছো মা, এতদিনে ভদ্রলোক কথা দিলেন।’ মা’র মুখের বিষণ্ণ হাসিটা আমার চোখকে ঝাপসা করে দেয়।
কত বয়স হবে মেয়েটির – হিসেব করি আমি। বড় জোর ১৭/১৮ বছর। আমাদের দ্বীপের রাস্তায়, লাল বাসে, নদী পারাপারের ঝুলন্ত বগিতে যখনই দেখা হয়েছে, তখনি দুষ্টু দুষ্টু হাসি হেসে মেয়েটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে, ‘মনে আছে তো?’ গত পনের বছর ধরে সে এটা করে এসেছে – স্হান, কাল, পাত্র ভেদে। সে তার মা-বাবা কিংবা বন্ধুদের সঙ্গেই থাকুক, অথবা আমি বেনু কিংবা আমার মেয়েদের সঙ্গেই থাকি না কেন, অভ্রান্তভাবে ঐ প্রশ্নের সন্মুখীন হয়েছি আমি। সবসময়েই ঐ কথাটি শুনে আমি হেসে উঠেছি। একটা না বলা ঠাট্টা ছিল ঐ বাক্যটি আমাদের দু’জনার মধ্যে।
শুরুটাও খুব মজার। বেনু আর আমি যাচ্ছিলাম এক বন্ধুর বাড়ীতে। ভারী সুন্দর ফলসা রঙের তাঁতের শাড়ী পরেছিল বেনু – অদ্ভুত মায়াবী দেখাচ্ছিল তাকে। আমার পরনে ছিল টকটকে লাল রংয়ের পাঞ্জাবী। নদী পারাপারের ঝুলন্ত বগিতে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা। নীচে পূর্বী নদী, সামনে ম্যানহ্যাটনের আকাশ, পুরো বগিতে গল্পরত মানুষের ভীড়।
আমাদের সামনেই শিশুসহ এক তরুণ দম্পতি দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাবার কোলে বাচ্চাটি। মাথাটি বাবার কাঁধে এলিয়ে। মুখের মধ্যে দু’টো আঙ্গুল পোরা। শিশুটি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। কত বয়স হবে বাচ্চাটার— বড় জোর পাঁচ। সোনালী কোঁকড়া চুল, নীল চোখ, ভারী মিষ্টি মুখের বাচ্চাটিকে আমার দেবশিশু মনে হচ্ছিল— ছবিতে যেমন দেখা যায়।
হঠাৎ বাবার কাঁধ থেকে মাথা তুলে, মুখের ভেতর থেকে আঙ্গুল দুটো সরিয়ে সে বেশ জোরের সাথে ঘোষণা করল, ‘আমি বড় হয়ে ঐ লাল জামা পরা লোকটাকে বিয়ে করব’। সারা বগির লোক হেসে উঠল হো হো করে। বেনু হেসে কুটি কুটি, বলল, ‘কিন্ত ওর তো বৌ আছে, আমি ওর বৌ।’
কিন্তু মেয়েটির এক কথা— আমি বড় হয়ে ওকে বিয়ে করব। মেয়েটির বাবা প্রথমে হতভম্ব, তারপরে বিব্রত, বারবার ক্ষমা চাইলেন মেয়ের বেমক্কা আবদারের জন্য। কি জানি, আমার লাল জামাটাই হয়তো তাকে আকর্ষণ করেছিল এবং তার আবদারের কারণ হয়ে উঠেছিল। শিশুমনের কথা ও কল্পনা কে বোঝে?
সেই শুরু। পাঁচের মেয়ে সাত হল, দশ পেরুল। কিন্তু প্রশ্ন তার একটাই, ‘মনে আছে তো?’ মাস থেকে বছর গড়ায়, সে বড় হয়ে ওঠে। কিন্তু যেখানেই দেখা হয়, ভদ্রলোকের এক কথার মতো কথা তার একটাই। আর কোন কথা হয় না, মেয়েটির নামও জানি না, কিন্তু কথা তার সামান্যই। আমি বিব্রত হই না, রাগ করি না, কিশোরীর ঐ কথায় মজাই পাই। বেনু ঠাট্টা করে আমাকে, ক্ষ্যাপায়, আমি হাসি।
একদিন দেখি ছেলে বন্ধু হয়েছে তার। আমাদের দ্বীপেরই ছেলে। কিন্ত তার ঐ প্রশ্নে ছেদ পড়ে না। ঐ ইঙ্গিতের প্রশ্ন শুধু সে আর আমি বুঝি— আর বোঝে বেনু ও তার মা-বাবা। আমরা সবাই নির্মল কৌতুক অনুভব করি মেয়েটির শিশুকালের এক কথার প্রলম্বিত বিস্তারে। আমার জানা নেই, তার ছেলে বন্ধুটিকে সে এ ঠাট্টাটির কথা বলেছিল।
তারপরের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত। ঐ ছেলেটি তাকে মাদকদ্রব্য ধরাল। অনেক সময়ে দেখেছি মাদকাসক্ত হয়ে দু’জনে পড়ে আছে কোন দালানের কোনে, রাস্তার পাশে, পূর্বী নদীর পাড়ে। ক্রমান্বয়ে তার অবস্হা খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছিল। তবু তার মধ্যেও যখনি তাকে দেখেছি তার সেই সনাতন প্রশ্নে ছেদ পড়ে নি। আমি জানি না তার মা-বাবার মনের অবস্হা, কেমন ভাবে দিন কাটছিল তাদের, ভেবে কূল-কিনারা করতে পারছিলেন কি না, কেন এমনটা হল।
ক’সপ্তাহ আগে তার বাবার সঙ্গে দেখা হলে জেনেছিলাম চরম অসুস্হ সে। সেটা শুনেই হাসপাতালে তাকে দেখতে এসেছিলাম। তার দিকে তাকিয়ে দেখি ক্লান্ত হয়ে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু মুখের হাসিটি তার মুখে কখনো লেগে আছে। রাতজাগা ক্লান্তি থেকে তার মা’র মাথাটাও হেলিয়ে পড়েছে দেয়ালে। আমি আস্তে করে মেয়েটির কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালাম পরম স্নেহে আর মমতায়— আমাদের কন্যাদের যেমনটা করি। তারপর দরজাটা ভেজালাম আস্তে করে আমার পেছনে।
যখন শেষবারের মতো মেয়েটির দিকে তাকালাম, তখন মনে হল যেন শুনতে পেলাম, ‘মনে আছে তো?’ গতকাল শুনি, মেয়েটি চলে গেছে। ‘মনে আছে তো’? —প্রশ্নটি হয়তো আর শুনব না, কিন্ত ঐ মেয়েটি আমার মনে ভেতরে থাকবে চিরকাল । কারণ আমি তার শৈশব-কৈশোরের মিছেমিছি ঠাট্টা প্রেমের কারণ।
সেলিম জাহান
ড: সেলিম জাহান একজন অর্থনীতিবিদ ও লেখক। কর্মজীবনে বছর দু’য়েক আগে জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের পরিচালক ও মূখ্য লেখক হিসেবে অবসর গ্রহন করেছেন।তার আগে তিনি জাতিসংঘের দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগের পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৯২ সালে জাতিসংঘে যেগদানের আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন দীর্ঘ ২৫ বছর। উপদেষ্টা ও পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্হাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে।
ড: জাহান লেখালেখি করছেন গত চার দশক ধরে। আশির দশকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এ সাময়িকীতে নিয়মিত লিখেছেন। রেডিও ও টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জননন্দিত উপস্হাপক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৯১-৯২ সালে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির মহাসচিব ছিলেন।ইংরেজী ও বাংলায় তাঁর প্রকাশিত গ্রণ্হের সংখ্যা এত ডজন এবং প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা দেড় শতাধিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্হ: বেলা-অবেলার কথা, স্বল্প কথার গল্প, পরানের অতল গহিণে, শার্সিতে স্বদেশের মুখ, অর্থনীতি-কড়চা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনীতি, Overcoming Human Poverty, Freedom for Choice, Development and Deprivation.