ইস্তেহার: নতুন প্রেমের
১.
বলেছি এসো না; শোনো, এতো কম শীতে
ততোখানি জমবে না প্রেম;
যদি না কঠোর হিমে হৃদয়ের ত্রসরেণু
বরফে কঠিন হয়ে ওঠে।
তাহলে অপেক্ষা করি চলো
পথ ক্রমে ঢেকে যাক অবিরাম তুষারে-তুষারে। যাতে
অবাধে চালাতে পারি স্লেজ
২.
আজো যদি প্রেম কিছু বেঁচে থাকে, অবশিষ্ট থাকে
নিজেদের ঘাড় মটকে, হৃৎপিণ্ড খুবলে খেয়ে বেঁচে থাকতে হবে
৩.
যতোবার দেখা হবে ড্রাকুলার মতো ততোবার
একে অপরের শিরাফোলা ঘাড়ে
বক্র-সুচালো দাঁত গেঁথে নিয়ে ধীরে
রক্ত পান করে যাবো লাল সুরা ভেবে
৪.
আমরা বাদুড় হবো পৃথিবীর আকাশে-আকাশে
উড়ে যাবো সব দিকে। কার্পেথিয়ার থেকে দূর বহুদূর
আমরা করবো স্তব কুয়াশায় ঢাকা এক ঠাণ্ডা-হিম শাদা কফিনের;
কপিশ ডানার নিচে আবছায়া বেদীমূলে
রক্ত ঢেলে বলকে বলকে
আমরা করবো প্রেম
প্রণয়ের নব সংবিধানে
যদিবা এমন হয় কতো ভালো হবে:
আমরা জাগবো ফের
আপন বিনাশে আর
অপরের করাল বিনাশে
৫.
তোমার মসৃণ ত্বক কুঁচকে যাবে শীতে;
তোমার গানের গলা ভরে উঠবে
কফে আর ঘুংড়ি কাশিতে
৬.
আর আমি? বেঁকেচুরে যাব আর
পথ চলবো হামাগুড়ি দিয়ে;
প্রণয়ের শব কাঁধে বয়ে নিয়ে যাবো নদীতীরে
৭.
তর্জনী উঁচিয়ে আজ প্রশ্ন করি, ঝেড়ে-কেশে বলি:
তুমি কোন অধিকারে চিরকাল কোমল মসৃণ?
ডাইনি তুমি। দিলখোশ
আর আমি পিপাসার্ত প্রেত;
শকুনির মতো কোনো অনিবার্য ছকে
প্রেমের কঙ্কাল নিয়ে ছলনার পাশা খেলা হবে
হয়ো না বিব্রত, অহো, দোঁহে মিলে চলো
হেমবর্ণ ভোরগুলি ভরে দিই কয়লাকালো মেঘের বারুদে
তারপর শিরা কেটে রক্ত দেবো ঢেলে
৮.
প্রণয়ের ইস্তেহার লাল মেঘে
বিলি করবো আমরা দু’জনে।–যাতে
মাতৃক্রোড়ে ভয় পেয়ে শিশু কেঁদে ওঠে
৯.
ইক্ষুরস, দারু, তামরস—-এসবের চেয়ে
শ্রেয়তর আমাদের চুম্বনের গাঢ় লাল মদ
১০.
আমরা আনবো, অহো, ধাত্রী সেজে
ঘরে ঘরে গন্নাকাটা, মৃত শিশু
শীতের কুহর থেকে টেনে
১১.
তারপর আকাশের সবচেয়ে উঁচু ডালে বসে
উৎকর্ণ হয়ে শুনবো সমুদ্রের পাগল দামামা
১২.
আর কেউ নয়, শুধু আমরা দু’জনে
অক্ষরের দশাঙ্গুলে ছুঁয়ে দেখবো
বরফের মৃদু লাল কাশি
১৩.
চলো তবে প্রণয়ের নব সংবিধানে
প্রতিটি সমুদ্রতীরে প্রত্যহের দূর্গ জয় করি
কূর্মের বেদনা
১.
আমি এক শক্তখোল কূর্মের ভিতরে সুকোমল
‘হৃদয় লইয়া থাকি’ কর্দমাক্ত আবছা জলাশয়ে
শ্যাওলাঢাকা খর্ব দেহ। যেন এক কিম্ভুত সসার
বিকল এঞ্জিনসহ মুখ থুবড়ে পড়েছি ডাঙায়
আদিম জলার পাশে। সঙ্গীহীন। একা নিঃসহায়!
২.
আমাকে জড়িয়ে আছে লক্ষবাহু লতাগুল্মজাল;
অনেক কচ্ছপবর্ষ কাটিয়েছি বিস্মরণ-মেঘে
জন্তুদের মলে ও পুরীষে ভেসে-ডুবে
৩.
তারপর একদিন ঊর্ধ্বাকাশ থেকে আচানক
ভীষণ ভীষণানাং একচক্ষু দৈত্য তাকাল
তেতে উঠল আণবপ্রতাপে আর অগ্নি-হল্কায়
নির্বিরোধ কূর্মপৃষ্ঠে হানলো সে দৃষ্টিঅগ্নিবাণ।
আর আমি বন্ধ করে দিয়ে এই বুকের হাপর
অচেনা গুহায় গিয়ে ভয়ে লুকালাম।
যেন কেউ শুনতে না পায়
আমার ভীরু হৃদয়ের নিশ্বাসের স্বর
৪.
তবু হায়! তাদের চাহনি পারে
স্ক্যানারের মতো সব ভেদ করে যেতে
৫.
আমাকে ভেবেছে তারা প্রদোষের আশ্চর্য মোহর
আমাকে খেলনা ভেবে মেতে উঠল নিঠুর খেলায়;
ভাঙতে চাইল তারা শক্ত খোলটিকে;
আমাকে ফেলল ছুড়ে গুহাটির নিরেট দেয়ালে
মারল আছাড় বারবার
তবে তারা অসফল। তাহাদের আয়ুধ বিফল
৬.
আমার সমস্ত দেহে ক্ষত আর মর্মে রক্তপাত
আমার নাভিতে জ্বলে হুতাশন লক্ষ নিনেভার
৭.
আঘাত উজিয়ে তবু হামা দিয়ে ফের আমি চলি;
নিজেকে বানিয়ে চাকা বাইরে আসি গড়াতে গড়াতে
ইশারা-রূপকে আমি নিজেকে ‘সাবাশ’ বলে উঠি
৯.
এসে দেখি, প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড এক বুদ্বুদের ভেতরে জগৎ;
এর সর্ব দিকে শুধু পেঁচানো নরক
হিংসার দীর্ঘ এক নদী তাতে চলে একেবেঁকে
১০.
হিরোনিমাসের আঁকা ছবি যেন; —তাতে
মাকড়জালের মতো পাতা-ফাঁদে প্রাণীরা কাতরায়।
কেউ কেউ বিঁধে আছে অগ্নিশলাকায়
কারো কারো নাসারন্ধ্র ভরে আছে হিলহিলে সাপে
১১.
এরপর স্বপ্নের আয়না ভেঙে আচানক হলো খান্ খান!
কিমাশ্চর্য! কী দারুণ
হিমশৈলশিরে, দেখি, লালিগোরাশের মাথা দোলে
গেরিলা
গোপনে ভাষার দুর্গে ঢুকে পড়ি গেরিলার মতো
মুহর্মুহু আক্রমণে কেঁপে ওঠে দুর্গ-সেনাপতি। তার
খসে পড়ে টুপি, শিরস্ত্রাণ
সৈন্যরা পালায় ভয়ে
অস্ত্র ফেলে ট্রেঞ্চে পরিখায়;
#
আর ওই অনেক উঁচুতে
স্তব্ধ-হিম শৈলকপাট থেকে ধীরে
নেমে আসা মাকড়ের জাল
এই দৃশ্য গ্রাসে নেয় পরম কৌতুকে!
জুয়েল মাজহার
জন্ম ১৯৬২ সালের ২০ জানুয়ারি। নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া থানার গড়াডোবা ইউনিয়নের সাখড়া গ্রামে। পিতা মুকদম আলী, মা বেগম নূরজাহান (সরু)। দুজনই প্রয়াত। বন্ধু শিরিন সুলতানা ও পুত্র অর্ক মাজহারের সঙ্গে থাকেন ঢাকায়। পেশা সাংবাদিকতা।
কৈশোরে নিরুদ্দেশযাত্রা। দীর্ঘ ভবঘুরে জীবন। যৌবনের একটা বড় অংশ কেটেছে বৃহত্তর সিলেটের পাহাড়ে। বিশেষত হবিগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল ও মৌলভীবাজারে। ঘৃণা করেন বৈষম্য, জাতিবৈর, সকল প্রকারের অন্ধতা। পৃথিবীকে খণ্ডক্ষুদ্র করে দেওয়া সীমান্ত নামের ‘খাটালের বেড়া’।
লেখেন মূলত কবিতা। কালেভদ্রে সাহিত্যশিল্প বিষয়ে গদ্যও লেখেন। বিচিত্র বিষয়ে প্রচুর অনুবাদও করেন—ইংরেজি থেকে বাংলায় আর বাংলা থেকে ইংরেজিতে।
প্রকাশিত কবিতাবই:
দর্জিঘরে একরাত
প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০০৩, ‘আগামী প্রকাশনী’, ঢাকা।
দ্বিতীয় সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, প্রকাশক ‘শুদ্ধস্বর’, ঢাকা।
মেগাস্থিনিসের হাসি
প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০০৯, বাংলা একাডেমি বইমেলা। ‘বাঙলায়ন’ প্রকাশনী, ঢাকা।
দ্বিতীয় সংস্করণ: ফেব্রুয়ারি ২০১৫। বাংলা একাডেমি বইমেলা। প্রকাশক ‘শুদ্ধস্বর’, ঢাকা।
দিওয়ানা জিকির
ফেব্রুয়ারি ২০১৩। বাংলা একাডেমি বইমেলা। প্রকাশক ‘শুদ্ধস্বর’, ঢাকা।
নির্বাচিত কবিতা
‘বেহুলাবাঙলা’ প্রকাশন; বাংলা একাডেমি বইমেলা, ফেব্রুয়ারি ২০১৯।
রাত্রি ও বাঘিনী
প্রকাশক: বাতিঘর, ঢাকা
বাংলা একাডেমি বইমেলা, ফেব্রুয়ারি ২০২০
প্রকাশিত অনুবাদগ্রন্থ:
১
কবিতার ট্রান্সট্রোমার
টোমাস ট্রান্সট্রোমারের বাছাই করা কবিতার অনুবাদ সংকলন। প্রকাশক শুদ্ধস্বর; বাংলা একাডেমীর ফেব্রুয়ারি বইমেলা,২০১২। এটি নতুন রূপে প্রকাশ করেছে বেহুলাবাঙলা বাংলা একাডেমি বইমেলা, ফেব্রুয়ারি ২০১৯।
২.
দূরের হাওয়া
২০০ বিশ্বকবিতার অনুবাদগ্রন্থ। প্রকাশক চৈতন্য প্রকাশন। বাংলা একাডেমি ফেব্রুয়ারি বইমেলা, ২০১৬।
সবকটি কবিতাই খুব ভালো লাগল। চিরকালীন সাহিত্যভাবনার জগতে জুয়েল মাজহারের কবিতা এক ধাক্কা।
great!